চাঁদাবাজি দখলের হাত বদল, ক্ষোভ by শুভ্র দেব

আগে তো মুখ খুলে কথা বলতে পারতাম না। কিছু বললেই আওয়ামী লীগের নেতারা সরকারবিরোধী বলে পুলিশে ধরিয়ে দিতেন।  একজন নিরীহ ব্যবসায়ী সরকারের বিরুদ্ধে বলায় তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কতো মারধর, অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। জমিজমা দখল  করে নেয়া হয়েছে। নিজের ভোটটা দিতে পারি নাই গত ১৬ বছর। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হতো। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন আমরা অনেক স্বস্তিতে আছি। মন খুলে কথা বলতে পারি। নিজের ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরতে পারি। কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মুসাপুর ইউনিয়নের লাঙ্গলবন্দের চিড়াইপাড়া এলাকায় চা দোকানি নবীর হোসেন। একই এলাকার গাড়িচালক আব্দুস সালাম বলেন, সরকার পতন হওয়ার পর খুব শান্তিতে আছি। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি। কথা বলার আগে কোনো চিন্তা করতে হয় না। ইনকাম হয়তো বাড়ছে না, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তবুও ভালো আছি। আর দ্রব্যমূল্য বাড়ার পেছনে কারণও আছে। যেমন দুই বারের বন্যায় সবজি উৎপাদন করতে পারেননি কৃষক। তাই আলুর ওপর চাপ পড়েছে। তবে আরও কিছুদিন গেলে দাম কমবে। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম কমলে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারবে। মাংস বিক্রেতা আলিম উদ্দিন বলেন, ইউনূসের আমলে ভালো আছি। যদিও জিনিসপত্রের দাম বেশি। বাজারে গেলে হিমশিম খেতে হয়। তবে আগে মানসিকভাবে যে অশান্তিতে ছিলাম সেটা আর হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা জোর করে মানুষের জমি দখল করে নিতেন। চাঁদাবাজি করতেন। মানুষকে নির্যাতন করতেন। তাদের প্রভাবে কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। কোনো চায়ের দোকানে বসে আওয়ামী লীগ বা সরকার নিয়ে কিছু বলা যেতো না। এখন আর এসব নাই।

৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ কেমন আছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনব্যবস্থা কেমন লাগছে, সাধারণ মানুষের জীবনমানে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা এসব জানতে বুধবার জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে বিভিন্ন তথ্য মিলেছে। বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে কথা বলে মোটাদাগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মিশ্র প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে।

বন্দর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চাঁনপুরের বাসিন্দা আব্দুল কাদের। ৬০ বছর বয়সী কাদের গত ১৪ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার যেই হউক আমি কখনো কোনো সুবিধা নেইনি। আমরা সাধারণ মানুষ। ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্য করে খাই। আওয়ামী লীগের আমলে ব্যবসা নিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এখন আর সেই সমস্যা নাই। সব জিনিসের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। কিনতে হয় বেশি দিয়ে অথচ বিক্রি করতে হয় আগের দামে। এতে করে লাভ কমে গেছে। যে হারে দাম বাড়ছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়ছে না। তাই সরকারের জিনিসপত্রের দাম কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া দরকার। হাসিনা সরকারের আমলে ভোট দিতে পারি নাই ১৬ বছর। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়েনি। মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এম এ সালাম ভোট জালিয়াতি করে ১৬ বছর ধরে চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিই এই এলাকার সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের সঙ্গে সখ্যতা রেখে দাপট দেখাতেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ ছিল না। কতো মানুষের যে জমিজমা দখল করেছে তার হিসাব নাই।  কেওঢালা বাজারের জুতার ব্যবসায়ী ইয়াকুব দেওয়ান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সব সমাধান করা সম্ভব না। কারণ এতগুলো মন্ত্রণালয় অথচ সব মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা নাই। অনেকগুলো মন্ত্রণালয় একজন উপদেষ্টা সামলাচ্ছেন। তাই এখন মানুষ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এসব সমাধানের জন্য সরকারপ্রধান ও উপদেষ্টাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। আর জনগণের নির্বাচিত সরকার যত দ্রুত আসবে ততই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে অনেক পরিবর্তন এসেছে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে। এই এলাকায় আওয়ামী নেতাদের প্রভাব কমেছে। সবাই পালিয়েছেন। এখন মানুষ চাচ্ছে দ্র্রব্যমূল্যর দাম নিয়ন্ত্রণে আসুক।

সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের ললাটি গ্রামের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী শাহেদ শাহ বলেন, দ্রব্যমূল্য এত বেশি হয়েছে আমাদের মতো মানুষের একেবারে নাগালের বাইরে। মানুষ আশাবাদী ছিল এই সরকার সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু এখনও সবকিছু বেড়েই চলছে। একই ইউনিয়নের সুখেরটেক গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বলেন, কত বছর পরে রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারছি গত কয়েকমাস ধরে। ভয় ছাড়া হাটাচলা করতে পারছি। পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করার ভয় নেই। অকারণে বিনা অপরাধে অনেক মামলার আসামি হতে হয়েছে। এখন শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান যেভাবে দেশে চালাচ্ছেন তাতে আমরা অনেক খুশি। এ ছাড়া জিনিসপত্রের দাম তিনি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন না। কারণ এখানে বড় একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেট ভাঙা কষ্ট হবে। একই এলাকার অলি উল্লাহ বলেন, আমাদের এলাকায় শান্তি ফিরেছে। আমরা মিলেমিশে আছি। ধর্মীয় কোনো সংঘাত নাই। আলাউদ্দিন নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, সবমিলিয়ে দেশের যা অবস্থা তাতে আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। অস্থির এক পরিবেশ বিরাজ করছে। বাজারে গেলে জিনিসপত্রের দাম শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। সোনারগাঁও উপজেলার পানামনগর সিটির পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচিত সরকার না আসলে দেশ এরকমই অস্থির থাকবে। কারণ নির্বাচিত সরকারের জবাবদিহিতা করতে হয়। তারা খারাপ করলে মানুষ আর ভোট দিবে না। এই ভয় তাদের মনে কাজ করে। তাই এই সরকার কোনো কিছু না করলেও বলার মতো কিছু থাকবে না। তবে সরকারের উচিত মানুষ কী চায় সেটা  বোঝার। রিকশাচালক আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, আমার রিকশায় করে প্রতিদিন কতো যাত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাই। যাত্রীদের গল্প শুনে বোঝা যায়। সবাই এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।  

রূপগঞ্জের চনপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ আহমেদ বলেন, ভেবেছিলাম হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বস্তিতে থাকবো। কিন্তু কিছু পরিবর্তন আসলেও বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান হয়নি। আগে চাঁদাবাজি, দখল, মাদক ব্যবসা আওয়ামী লীগের নেতারা করতো। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর এখন হাতবদল হয়েছে। চিত্র আগের মতোই আছে। এ ছাড়া আমরা সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়াও নাই। আমরা চাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকুক। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে দাম বাড়লেও আমাদের আয় একই জায়গায় বন্দি। তাই এসবের পরিবর্তন হওয়া দরকার। কায়েতপাড়ার বাসিন্দা সোলায়মান ভূঁইয়া বলেন, স্বৈরাচারের পতনে আমরা খুশি। দেশে এক দুঃশাসন ছিল। এখন আমরা স্বস্তিতে আছি।  

সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনানী নতুন মহল্লার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, লুটপাটের জমানা এখন আর নাই। সব মানুষ এখন ভালো আছে। আয় কম হলেও মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারছে। কোনো ভয় নাই মনে। আগে তো একটা ভয় নিয়ে চলতে হতো। কখন কার ওপর কোন বিপদ আসে। একই এলাকার বাহরাইন প্রবাসী মকবুল বলেন, আমি দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছি দেশে। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আমরা দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছি। অথচ ভারত থেকে পণ্য আনার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। অনেক টাকা লোকসানের পরে আমি মধ্যেপ্রাচ্য চলে যাই। এখন ভালো আছি। তবে আওয়ামী লীগের সময় আমার পরিবারের সদস্যরা অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়েও হয়রানি করা হয়েছে আমার পরিবারকে। হাসিনা সরকারের পতনের খবর পেয়ে দেশে এসেছি। এখন আর কোনো সমস্যা নাই।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.