গুলিতে মৃত্যু: অবলম্বন হারিয়ে অসহায় ইফতির বাবা
ইফতির বাবা ইউনুস সরদার মানবজমিনকে বলেন, ইফতি একটি গ্যারেজে মেকানিকের কাজ করতো। আমার এক মেয়ে এক ছেলে। দুই সন্তানের মধ্যে ইফতি ছোট। খুব অল্প বয়সে আমার বাবা মারা যায়। তারপর থেকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের। ভেবেছিলাম ছেলেকে নিয়ে সামনের দিনগুলোতে ভালো থাকবো। সে বৃদ্ধ বয়সে আমাদের দেখেশুনে রাখবে। ইফতিকে হারিয়ে তার মা একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমার সন্তানকে কি আর ফিরে পাবো। ইফতি সবসময় আমাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতো। সে বলতো, ‘বাবা আমি এখন অনেক বড় হয়েছি, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি তোমাদের সব কষ্ট দূর করে দিবো, আমি ছাড়া তোমাদের তো আর কোন ছেলে সন্তান নেই।’ আমাদের মন খারাপ হলে সবসময় সাহস দিতো, বুঝাতো। ইফতি কাজ করে যা আয় করতো সেটি থেকে কিছু খরচ সংসারের জন্য দিতো। সে সাত হাজার টাকা মাসে বেতন পেতো। তাকে কাজে আসা যাওয়ার সুবিধার জন্য একটা বাইসাইকেলও কিনে দিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, এখনো রাতে সন্তানের কথা মনে পড়লে ঘুমাতে পারি না। সবসময় আমার সন্তানকে মনে পড়ে। মোবাইলে থাকা ওর ছবিগুলো দিনরাত দেখি। ইফতি প্রায়ই আমাদের না বলে তার বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে চলে যেতো। কাজের জন্য আমাকে তো সবসময় বাইরে থাকতে হতো। ও অনেক সাহসী ছিল। বাবা হয়ে সন্তানের লাশ দেখাটা কতটা কষ্টের তা বুঝাতে পারবো না। ওর মৃত্যুর পরে কিশোরগঞ্জ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। ঢাকাতেও একটি সেমিনার থেকে অল্প কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে যোগাগের জন্য বলা হয়েছিল।
ইউনুস সরদার বলেন, ঘটনার দিন জুমার নামাজ শেষে সে আন্দোলনে যায়। আমি তখন কাজে ছিলাম। বিকালের দিকে আমার মেয়ে মোবাইলে কল করে বলে, বাবা রামপুরায় অনেকে মারা গেছে আমার ভাইতো এখনো বাসায় আসেনি। আমি ওর কথাটি তেমন গুরুত্ব দেইনি। পরবর্তীতে মেয়ে আবার কল করে বলে, বাবা ইফতি তো মারা গেছে। এই কথা শুনে আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি বাসার সামনে রাখা আমার সন্তানের লাশ। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। রামপুরা ব্রিজের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়। রাতে মেডিকেলে নেয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন রাত তিনটার সময় রামপুরা থানায় ক্লিয়ারেন্সের জন্য যাই সেখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই। একদিন পার হয়ে গেলেও লাশের ময়নাতদন্ত করতে পারিনি। কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তিনদিন পরে ময়নাতদন্ত শেষে ছেলের মরদেহ হাতে পাই। কিশোরগঞ্জে আমার স্ত্রীর বাবার বাড়িতে ইফতির মরদেহ দাফন করা হয়। তিনি বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ। গাড়ি চালিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই। পরিবার নিয়ে ঢাকার শাহজাহানপুরে থাকি। আমরা ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বসবাস করি। বাবা-মা অভাবের কারণে অনেক ছোট বয়সে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় চলে আসার পর নদীতে ভেসে যায় আমাদের জায়গা-জমি। অল্প কিছু ভিটার জমি ছিল সেটিও লোকজন নিয়ে যায়। ভেবেছিলাম একমাত্র সন্তানের জন্য কিছু করে রেখে যাবো। সেও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আজ আর কোনো আশা নেই, আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।
No comments