শীতে ওদের রাত কাটে যেভাবে by মেহনাজ শাহরিন অর্থি
রাত ৯.২০ মিনিট। হোটেল সোনারগাঁওয়ের উল্টা পাশে ফ্লাইওভারের নিচে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক বৃদ্ধা। নাম হোসনেয়ারা। বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি। বলেন, আগে আমি মানুষের বাসায় কাজ করতাম। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে এভাবেই বড় করেছি। ওরা এখন রিকশা চালায়। বিয়ে করেছে। কিন্তু আমাকে খেতে দেয় না। আর মেয়ে থাকে ময়মনসিংহে। এখন আমি একা মানুষ। ভিক্ষা করে খাই। রাতে কোনোদিন এখানে ঘুমাই। কখনো শাহবাগের দিকে ঘুমাই। গরমে সমস্যা না হলেও শীতে কাহিল হয়ে পড়ি। সম্বল মাত্র একটি কাঁথা। নিচে একটা মাদুর বিছিয়ে নেই। কিন্তু সমস্যা হয় এই বড় বড় বাস ট্রাকগুলোর আওয়াজে।
ফ্লাইওভারের নিচে এক কোণে শুয়ে আছেন সোয়েদ আলী নামে এক বৃদ্ধ। বয়স প্রায় ৭০। সারা দিন রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যার পর এখানে আসেন একটুখানি ঘুমানোর তাগিদে। তিনি বলেন, আমার বাড়ি নওগাঁ জেলায়। আমার তিন ছেলে। দুইজনের নওগাঁতে ছোট চায়ের দোকান। বাকি জন বড় ছেলের সঙ্গে দোকানেই থাকে। স্ত্রী মারা গেছে দুই বছর হলো। জীবিত থাকাকালীন বড় ছেলের সঙ্গে থাকতো সে। আমি কারও দয়ায় বাঁচতে চাই না বলে খেটে খাই, রিকশা চালাই, দিন আনি-দিন খাই। রাতে এইখানে ঘুমাই। ঢাকা শহরে এসেছি প্রায় ১৩ বছর হলো। এই ধুলাতেই অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। এখন আর ধুলায় কোনো সমস্যা হয় না। ভাত-ডালের সঙ্গে ধুলাও আমি তিনবার খাই।
এরপর চোখ পড়লো ফ্লাইওভারের পিলার ঘেঁসে বসে থাকা আসমা বেগমের দিকে। তিনি বললেন, আমার বয়স ৪২ বছর। ফুলের মালা বিক্রি করি। ঢাকা শহরে এসেছি এক বছরও হয়নি। তবে রাস্তাঘাট কম চিনিনি। জীবন আমাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে। এক মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে যখন চরম অভাবে পড়েছিলাম, তখন আমার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে। ছেলে-মেয়ে দু’টোকে কষ্ট করে বড় করেছি, বিয়ে দিয়েছি। এখন আর তারা আমাকে দেখে না। এখন ফুল বিক্রি করেই খাই। আর রাতে এখানে ঘুমাই। কোনোদিন আবার একটু সামনে গিয়ে ঘুমাই। যখন যেখানে জায়গা পাই আর কি। এত ধুলার মধ্যে কীভাবে ঘুমান- জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন গ্রামে থাকতাম তখন এই রকম পরিবেশে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল না। এখন বাধ্য হয়ে এই ধুলার মধ্যেই থাকতে হয়। এই পরিবেশে ঘুমানো যায় না। একটু পর পর বাতাসে যে ধুলাটা আসে এটা নাকেই ঢুকে, কখনো আবার ঢুকে কানে।
শুধু কাওরান বাজারই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে এইসব বাস্তুহারা মানুষের জীবনে প্রচণ্ড শীতে নেমেছে চরম দুর্গতি। জীবনের তাগিদে দিনের বেলা তারা পথের নানা প্রান্তে ছুটলেও দিনশেষে তাদের আশ্রয় মিলে পথের ধারে কোনো এক ফুটওভার ব্রিজের ওপরে বা ফ্লাইওভারের নিচে। আর এখানে শীতের মধ্যে দূষিত বায়ু আর শব্দদূষণে এক নাজেহাল পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা।
No comments