বিদায় কবি হেলাল হাফিজ (১৯৪৮-২০২৪)
কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ই অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই। ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে ওঠে মিছিলের স্লোগান।
‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এই লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর বইটির ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে। দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা ৭১’। তৃতীয় এবং সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
কবিতায় অসামান্য অবদানের স্মারক হিসেবে হেলাল হাফিজকে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয়। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা।
মৃত্যু যেভাবে: কবি হেলাল হাফিজ রাজধানীর শাহবাগের একটি হোস্টেলে মারা যান। ওই হোস্টেলের ওয়াশরুমে পড়েছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। তখন তার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। পরে বিএসএমএমইউ-তে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাউর রহমান বলেছেন, উনাকে কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ে আসেন মৃত অবস্থায়। উনারা পরিবারের সদস্য নন, উনার হোস্টেলের প্রতিবেশী হতে পারে। বিষয়টি আমি শাহবাগ থানার ওসিকে জানিয়েছি। এদিকে এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খলিল মনসুর বলেছেন, শাহবাগের একটি হোস্টেলে থাকতেন কবি হেলাল হাফিজ। দুপুরে তিনি হোস্টেলের একটি কমন ওয়াশরুমে যান। অনেকক্ষণ হলেও তিনি ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছিলেন না। পরে হোস্টেলের অন্য রুমের সদস্যরা ওয়াশরুমের সামনে এসে ডাকাডাকি করলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে তারা বাধ্য হয়ে ওয়াশরুমের দরজা ভাঙেন। দরজা ভেঙে দেখতে পান কবি হেলাল হাফিজ ওয়াশরুমের ফ্লোরে পড়ে রয়েছেন এবং তার মাথা ফেটে অনেক রক্ত বের হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রাথমিক ধারণা স্ট্রোক বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে তিনি বাথরুমে পড়ে যান। বাথরুমের বেসিনটিও ভাঙা ছিল। আমাদের ধারণা, তিনি বেসিনের ওপর পড়ে যান। তখন বেসিন ভেঙে যায় এবং উনার মাথা ফেটে যায়।
প্রধান উপদেষ্টার শোক: কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক শোক বার্তায় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধান উপদেষ্টা কবির পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন তারুণ্যের শক্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ। তার কালজয়ী কবিতার মতোই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের ছায়া: প্রিয় কবির মৃত্যু যেন মেনে নিতে পারছেন না তার অজস্র পাঠক-ভক্ত। শোক ও ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করছেন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে শুরু করে সব অঙ্গনের মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পুরোটা যেন হেলাল হাফিজের কবিতা-স্মৃতির চাদরে ঢেকে গেছে। সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ও নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, কবি হেলাল হাফিজ আর যৌবনের গান প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি আরও নানা রকম কবিতাও লিখেছিলেন। যেমন: ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা’! কিন্তু আমাদের অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা এই জুলাইতেও লিখতে হয়েছে। কবির প্রয়াণে শোক এবং শ্রদ্ধা। আগামীকাল সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমি এবং বাদ জোহর প্রেস ক্লাবে হেলাল হাফিজের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানিয়েছেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা।
No comments