আহতদের অনেকেই পাননি সরকারি অর্থ, নিঃস্ব পরিবার by সুদীপ অধিকারী
গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরস্থ পঙ্গু হাসপাতাল গিয়ে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের জন্য ডেডিকেটেড তিনতলার বি-ওয়ার্ডের ৪৮টি বেডের প্রায় প্রতিটিতেই রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে বি-৩৯ নম্বর বেডে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন মো. তানভীর। গত ১৯শে জুলাই রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ। তানভীরের মা পারভিন বেগম বলেন, আমাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। আমার তিন ছেলে আর এক মেয়ে। তানভীর সবার বড়। ৭/৮ বছর আগে ওর বাবা আমাদের ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। সেই থেকে ওদের নিয়ে আমার লড়াই চলছে। আমার নিজেরও কিডনির সমস্যা। একটা কিডনি কেটে ফেলতে হয়েছে। অন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি গ্রামে থাকলেও সংসারের হাল ধরতে তানভীরকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। আমি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের যেই ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলাম, তিনিই তানভীরকে একটি কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সবকিছু ভালোই চলছিল। ও ঢাকার রামপুরা এলাকায় মেস বাসায় থাকতো। গত ১৯শে জুলাই ওর বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, আমার ছেলের নাকি আন্দোলনে গিয়ে পায়ে গুলি লেগেছে। আমি জমি বিক্রি করে টাকা এনে ওই প্রাইভেট হাসপাতালের বিল দিয়ে তানভীরকে পঙ্গুতে নিয়ে আসি। তিনি বলেন, গত ২৫শে আগস্ট আমার বড় ছেলেকে এই হাসপাতালে ভর্তি করি। হাসপাতাল থেকে বিনা খরচে রোগীর চিকিৎসা করালেও আমাদের খরচ কেউ দেয় না। প্রতিদিন এই হাসপাতালে আমার এক হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
তানভীরের পাশেই এই ওয়ার্ডের বি-৩৮ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন মো. গোলাম মোস্তফা। দুই মেয়ে ও এক সন্তানের এই জনক গত ১৯শে জুলাই রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় ডান হাতে ও ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গোলাম মোস্তফা বলেন, আন্দোলনে গিয়ে গুলি লাগার পর আমাকে প্রথমে এই পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এখান থেকে আবার জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২৩শে জুলাই আবার এখানে এসে ভর্তি হই। তিনি বলেন, আমি পেশায় একজন রিকশাচালক ছিলাম। আমার ১৬ বছরের একটি মেয়ে, ৭ বছরের একটি ছেলে ও দুগ্ধপোষ্য একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। আমি গুলি খেয়ে হাসপাতালের বিছানায়। এখন পর্যন্ত সরকারি- বেসরকারি কোনো সহায়তা পাইনি। এ পর্যন্ত আমি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছি। এখন আর কেউ টাকাও ধার দেয় না। একদিন ঘরে চাল থাকে তো দুইদিন থাকে না।
একই ওয়ার্ডের বি-৩৭ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন মো. মনির খান। তিনিও ১৯শে জুলাই রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ১৭ বছরের এই তরুণ বলেন, আমি বাড্ডার একটি ডিমের দোকানে কাজ করতাম। দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হলে বন্ধুদের সঙ্গে আমিও আন্দোলনে যোগ দিই। আমার সামনে আমার বন্ধু সাগর আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর আমার গুলি এসে লাগে বাম পায়ে। এক্সে-রে দেখিয়ে মনির বলেন, আমার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে। ডাক্তার পায়ে স্টিলের খাঁচা লাগিয়ে দিয়েছে। কবে খুলবে ঠিক নেই। চিকিৎসা শেষ হলেও কী আগের মতো পা ফেলে হাঁটতে পারবো তাও জানি না। কিন্তু এতসবের পরেও এখনো আমি কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি।
একই ওয়ার্ডের বি-৪১ নম্বর বেডে গত তিন মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আহমেদ। ডান পায়ে গুলি লাগে তার। একাধিক অস্ত্রোপচারের পর পা জুড়ে লাগানো আছে স্টিলের রিং। এই রিং পরেই এক বছর থাকতে হবে তার। আব্দুল্লাহর মা বিলকিস বেগম বলেন, চিকিৎসক বলেছেন, হাঁটতে পারলেও হাঁটু থেকে পা আগের মতো ভাঁজ করতে পারবে না। তিনি বলেন, সরকারি সহায়তা হিসাবে এক লাখ টাকা পেয়েছি ঠিকই কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি টাকা আমাদের খরচ হয়ে গেছে।
পাশেই বি-৪২ নম্বর বেডে চিকিৎসা নেয়া ১৯ বছরের সাদ আব্দুল্লাহর ভাষ্য একই। এই মাদ্রাসা ছাত্র বলেন, তারও অস্ত্রোপচারে ডান পায়ের গুলি বের হয়েছে। এখন পুরো পায়ে স্টিলের খাঁচা পরানো। সাদ বলেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন, আমার পায়ের এই রিং খুলতে সময় লাগবে এক বছর।
এসব বিষয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (নিটর) অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম-উজ-জামান বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে আন্দোলনে আহতের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজ রাখছি। তাদের ওষুধ-পত্র, চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হাসপাতালের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে।
No comments