ইমাম হোসাইন (আ)-এর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান বিশ্বে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা by মাহদী মাহমুদ
ইমাম
হুসাইনের কারবালা মহাবিপ্লব বিশ্বকে হুসাইনি ধারা ও ইয়াজিদি ধারা এ
দু'ভাগে ভাগ করেছে। এ বিষয় সংশ্লিষ্ট 'ইমাম হোসাইন (আ)-এর বিপ্লবের
প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান বিশ্বে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা' শীর্ষক প্রামাণ্য
তথ্য-সমৃদ্ধ ও চিন্তা-উদ্দীপক একটি প্রবন্ধ সবার জন্য তুলে ধরা হল:
বর্তমান মুসলিম সমাজে বিরাজমান দুরবস্থা তথা রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এবং ইহুদিবাদী আগ্রাসন, ভ্রাতৃঘাতী মাজহাবী সংঘাত ও সেক্যুলারিজমের ছোবলের শেকড় খুঁজতে গেলে কেবল অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক কিংবা তার পূর্বে ক্রুসেডের যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করাটা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। কেননা, মুসলমানদের পতন ইংরেজ, খ্রিস্টান, ইহুদি, সাম্রাজ্যবাদী কারো হাতেই নয়; বরং খোদ মুসলমান নামধারী মুনাফিক জালেম শাসক,আলেম এবং বুদ্ধিজীবীদের হাতেই।
ড. কলিম সিদ্দিকী এ বিষয়ে তাঁর ‘উপনিবেশবাদ কবলিত মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আচরণ’ শীর্ষক বক্তৃতায় বলেন, ‘এটা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, উপনিবেশী শক্তিগুলো আসলে ইসলামের রাজনৈতিক শক্তিকে পরাজিত করতে পারেনি। ইসলামের রাজনৈতিক শক্তির পতন ঘটেছিল ঔপনিবেশিকদের রঙ্গমঞ্চে আসার অনেক অনেক আগে,রাজতন্ত্রী ও বংশীয় মুসলিম শাসকদের হাতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উল্লেখ্য যে, মুসলিম ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা মুলুকিয়াহ বা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রেরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।”
আর এই রাজতন্ত্রের সূচনা-বিন্দুতে ছিল বনি উমাইয়া। রাসূল(সা)-এর ওফাতের পর থেকে ইমাম হোসাইনের নির্মম শাহাদাতের মধ্যকার ৫০টি বছরে এমন কিছু ঘটেছে যার ফলে ইসলামে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের উত্থান ঘটে এবং একইসাথে মুসলমানদের মাঝে শিয়া-সুন্নি সহ হাজারো মাজহাবী দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। সমস্যার মূল তথা ঐ ৫০টা বছরই ছিল কারবালার মহা-ঘটনার প্রেক্ষাপট।
ড.কলিম সিদ্দিকী তাঁর ভাষণের অন্যত্র বলেছেন, ‘ধর্মকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের অধিকতর শক্তিশালী হওয়া ইসলামে অসম্ভব। তাই ধর্মের মুখোশ পরে রাষ্ট্রনীতির কূটকৌশল শুরু করে সর্বপ্রথম উমাইয়ারা। তখন থেকেই অন্য শাসকরা নিজেদের বংশগত স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহারের প্রয়াস পায়। কালক্রমে এই ধরনের বংশীয় শাসকেরা অধিক হারে সেক্যুলার ধারার রাজনৈতিক আচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়ে।’
ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ছিল পুরোভাগে রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক।তিনি তাঁর কারবালা-পূর্ব ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘জেনে রাখ, এ শাসকদল (বনি উমাইয়া) শয়তানের আদেশ মেনে চলছে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করছে এবং দুর্নীতিকে প্রতিদিনকার নিয়ম বানিয়েছে।তারা অধিকারগুলোকে এক জায়গায় জমা করেছে। মুসলমানদের সম্পদের ভাণ্ডারকে(বাইতুল মা’লকে) তাদের নিজেদের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে এবং আল্লাহর হারামকে বৈধতা দিয়েছে এবং তাঁর হালালকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তাদের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে সব মানুষের মধ্যে আমিই সবচেয়ে যোগ্য।’ (তাবারী)
আর ইমাম হোসাইনই সে সময় ছিলেন জান্নাতের যুবকদের সর্দার এবং আহলে বায়েতের জীবিত সদস্য। আর তাই ইমাম হোসাইন রাসূলের সুন্নাহ এবং পাক কুরআনের নির্দেশাবলী পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
ইমাম হোসাইন বলেছিলেন,‘আমি কোনো ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি কিংবা ক্ষমতার লোভে বিদ্রোহ করছিনা। আমি শুধু আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই। আমি চাই সৎকাজের নির্দেশ দিতে এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে। আর আমার নানা এবং বাবা আলীর পথ ধরে চলতে।’
এই সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজে বাধা দেয়া বা নিষেধ করাই হচ্ছে ইসলামি সমাজব্যবস্থা, ইসলামি ন্যায়বিচার এবং ইসলামি রাজনীতির মূলমন্ত্র। সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার যে সংকীর্ণ এবং ক্ষুদ্র ধারণা মুসলমানদের, তা থেকে আমরা মনে করি যে,এটি বোধ হয় মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা কিংবা নামাজ-রোযা বা ইসলামি আহকাম পালনে দায়েশীয়(ISIS-terrorist group) পন্থায় মানুষকে বাধ্য করা।
কিন্তু ইমাম হোসাইন এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ হল অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (এর জন্যে আন্দোলন-সংগ্রাম করা),জালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মা’ল ও গনিমত বণ্টন, যাকাতের নিসাব থেকে যাকাত গ্রহণ এবং তা যথার্থ খাতে ব্যয় করা।’
ইমাম হোসাইনের উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্রের বিপরীতে রক্তের বিজয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঘুমন্ত মুসলিম উম্মাহকে ধাক্কা দেয়া ও বলা, ‘জাগো!আবারো সাক্ষ্য দাও।’ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। তিনি চেয়েছেন যেন অনাগতকালের রাজতন্ত্র-পীড়িত জনগণ ও আলেম-বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষেরা এই ইতিহাস চর্চা করে এবং ইমাম হোসাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজতন্ত্র, উপনিবেশ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিজের জান-মাল-পরিবার নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। ইসলামি সমাজে ব্যাধির উপর বিরাট একটা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ইমাম হোসাইনের আন্দোলন।
আমরা যদি কারবালার পূর্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে কয়েকটা জিনিস দেখব। যার কেন্দ্র হচ্ছে ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিনাশ এবং স্বৈরাচার,স্বেচ্ছাচার ও রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকরণ। ইসলামি রাষ্ট্রের জনগণের বাইতুল মা’লকে আম ও খাস বাইতুল মালে ভাগ করে,এর এক অংশ(আ’ম) আমীরের জন্যে রেখে দেয়া এবং সেই অর্থ খরচ করে ইয়াজিদের মতো শাসকের পক্ষে বায়াত(ভোট) কেনা এবং বিদ্রোহ দমনের প্রচেষ্টা। রাসূল(সা)-এর নিকটতম সাহাবীদেরকে হত্যা করা, হাত কেটে দেয়া,লাঞ্ছিত এবং নির্বাসিত করা এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা। ইসলামি রাষ্ট্রের গভর্নরের দায়িত্ব এবং অন্যান্য শীর্ষ পদে রাসূল কর্তৃক অভিশপ্ত, জারজ কিংবা যিনাকার (ব্যভিচারী ) এ ধরনের ব্যক্তিদের বসানো। প্রত্যেক মসজিদের মিম্বর থেকে খুতবায় হযরত আলী(কা)-কে গালমন্দ এবং অভিসম্পাত করা। কোরআনের নির্দেশ এবং রাসূলের সুন্নাতসমূহকে সুস্পষ্টভাবে পরিবর্তন সাধন করা।
সংক্ষিপ্ত এই নিবন্ধে আমরা তেমনি কিছু ঘটনার উদাহরণ টানব যাতে আমরা বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থার সাথে ইমাম হোসাইনের সময়ের প্রেক্ষাপটের মিল খুঁজে পাই।
রাজতন্ত্রীকরণ
মাওলানা মুঈনউদ্দিন নদভী তাঁর কিতাবে লিখেছেন, ‘আমীর মুয়াবিয়া কর্তৃক খলিফা হযরত আলী(আ)-এর মুকাবেলায় যুদ্ধে জয়লাভের অভিপ্রায়ে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করা, পরবর্তী খলিফা হযরত হাসানের (আ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা,ইসলামি খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিবর্তন করা, তার শাসনামলের প্রতিটি ঘটনা এমন প্রকাশ্য ভ্রান্তিময় যাকে সত্যাশ্রয়ী লোক কখনো সমর্থনযোগ্য ও পছন্দনীয় বলে গণ্য করতে পারেনা। বিশেষত ইয়াজিদের মনোনয়নে খেলাফতের ফেতনা চিরতরে শেষ হয়ে যায় এবং ইসলামে বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক প্রথা চালু হয়।’ (সিয়ারুস সাহাবা)
এছাড়াও ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, আমীরে মুয়াবিয়া পরবর্তী শাসকরূপে ইয়াজিদকে মনোনয়নে সম্মতিলাভের উদ্দেশ্যে ইবনে ওমর এবং আব্দুর রহমান বিন আবি বকরের কাছে এক লক্ষ দিরহাম করে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সেগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।(ইবনে আসিরের আল কামিল,ইবনে কাসিরের আল বিদায়া আন নিহায়া,তাবাকাতে ইবনে সা’দ)
গভর্নরদের অত্যাচার
আমীর মুয়াবিয়া ৪০ হিজরির প্রথমদিকে বুশর বিন আরতাতকে ইয়ামেন ও হেযাজে পাঠায়। হযরত আলীর কোনো অনুসারীর দেখা পেলেই তাকে ধবংস করার জন্যে তাকে নির্দেশ দেয়া হয়।বস্তুত বুশর তাই করেছিলো।(আল ইসাবায় ইবনে হাযারের মন্তব্য)
অপর এক গভর্নর যিয়াদ বিন আবিহ সম্পর্কে ইতিহাসে এসেছেঃ ‘যে লোকই যিয়াদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করত তাকে সে হত্যা করত। হাজ্জাজের চেয়েও সে ছিল অধিক রক্তপিপাসু।’ (এলামুল নুবালা।)
সাহাবীদের উপর নির্যাতন
যিয়াদের পক্ষ থেকে সাহাবী হাকামের (রা) কাছে আমীর মুয়াবিয়ার একটি পত্র আসে। সেই চিঠিতে গনীমতের মাল থেকে সোনা-রুপা মুয়াবিয়ার বাইতুল মালের জন্যে রাখার নির্দেশ ছিল। হাকাম(রা) আল্লাহর নির্দেশকে আমীরের নির্দেশের উপরে প্রাধান্য দিয়ে বলেন,‘সে কি রাসূলের এ কথা শোনে নি যে, কোনো কাজে আল্লাহর অবাধ্যতার প্রশ্ন দেখা দিলে তখন কারো কথা মানা যাবেনা?’ অতঃপর তিনি সমস্ত মালে গনীমত সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। বলা হয়,তাতে হযরত হাকাম(রা) কারা প্রকোষ্ঠেই মৃত্যুবরণ করেন।(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
খলিফা উসমানের শাসনামলে সিরিয়ায় আমীর মুয়াবিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, সম্পদের অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, বণ্টন-বৈষম্য এবং কোরআন ও সুন্নাতবিরোধী কার্যক্রমের কারণে রাসূলের প্রবীণতম সাহাবী আবুযর গিফারীর সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধ এবং দূরত্বের সুচনা হয়। যার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে সাহাবী আবুযর গিফারী স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যান। স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকাকালীন জনমানুষশূন্য মরুভূমিতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর নামাজে জানাজায় অংশ নেন আরেক প্রবীণতম সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ। ইতিহাস সূত্রে দেখা যায় যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ কুফায় নিযুক্ত খলিফা উসমানের গভর্নর ওয়ালিদ বিন উকবা এবং সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রীয় খেলাফতে অর্থনৈতিক-সামাজিক অনিয়ম,নৈতিক অবক্ষয় এবং স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ক্ষণে ক্ষণে অসন্তোষ জানাতে থাকলে এবং আবুযার গিফারির জানাজায় অংশ নেয়ার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁর ওপর নাখোশ হয়ে পড়ে।
মিম্বরে দাঁড়িয়ে হযরত আলী(কা)-এর নামে অভিসম্পাত ও গালাগালের প্রতিবাদ জানানোতে রাসূল(সা)-এর সাহাবী হুজর বিন আদীকে ছয় সঙ্গীসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
দেওবন্দের অন্যতম বুজুর্গ মাওলানা মানাজির আহসান গিলানী তাঁর ‘তাদবীনে হাদীস’ গ্রন্থের ৪২৩ পৃষ্ঠায় হযরত হুজর(রা)-কে একজন সাহাবী হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর শাহাদাতের ঘটনা বিবৃত করেছেন। বিবরণের শেষে তিনি লিখেন, ‘হযরত হুজর(রা)-কে কুফায় গ্রেফতার করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেয়ার খবর মদীনায় পৌঁছামাত্র মহানবীর (সা) স্ত্রী আয়েশা বিনতে আবুবকর অনতিবিলম্বে দূত পাঠিয়ে কোনো অবস্থায় তাঁকে হত্যা না করার সুপারিশ করেন। কিন্তু দূত পৌঁছার আগেই তাঁর শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যায়।এ ঘটনা দ্বারা হুজর বিন আদী(রা)-এর উচ্চ মর্যাদা আন্দাজ করতে কষ্ট হবার কথা নয়।’
এছাড়াও এই মুয়াবিয়ার শাসনামলে আমর বিন হামাক,মালিক আল আশতার,মোহাম্মদ ইবনে আবি বকর,মাইসাম বিন তাম্মার প্রমুখ খোদাভক্ত সাহাবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ইমাম আলী(কা)-কে মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে গালাগাল
মুয়াবিয়া যখন তার বিরোধীদেরকে হত্যা করতে এবং স্বপক্ষীয়দেরকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বুশর বিন আরতাতকে বসরা নগরীতে পাঠাল, তখন বুশর সেখানে উপস্থিত হয়ে মিম্বরে চড়ে গালমন্দ, ভর্ৎসনা এবং অবজ্ঞার সাথে হযরত আলীর নাম উল্লেখ করে বলল,‘সমবেত জনতা! আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কি সত্য কথা বলিনি?’ আবু বাকরাহ নামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি (ইনি প্রথম খলিফা আবুবকর নন) তখন জবাবে বললেন,‘তুমি মস্তবড় সত্তার কসম করেছ। আল্লাহর কসম!তুমি সত্য কথা বলনি। কোনো ভালো কাজও করনি।’ তাতে বুশর আবু বকরাহকে প্রহার করার নির্দেশ দিলে তিনি এমনভাবে প্রহৃত হন যে তাঁর সংজ্ঞা লোপ পায়।’ (আনসাবুল আশরাফ,পৃ. ৪৯২,দারুল মাআরিফ,মিশর)
হযরত আলীকে গালমন্দ করার কথা ইতিহাস ছাড়াও হাদীস গ্রন্থেও পাওয়া যায়।যেমন মুসনাদে হাম্বালে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা)-এর কয়েকটি রেওয়ায়াতে আছে, তিনি কতিপয় সাহাবীর কাছে অভিযোগ করেন, ‘তোমাদের সামনে রাসূল(সা)-কে উদ্দেশ্য করে মিম্বরে দাঁড়িয়ে গালমন্দ করা হয় কি?’
বর্তমান মুসলিম সমাজে বিরাজমান দুরবস্থা তথা রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এবং ইহুদিবাদী আগ্রাসন, ভ্রাতৃঘাতী মাজহাবী সংঘাত ও সেক্যুলারিজমের ছোবলের শেকড় খুঁজতে গেলে কেবল অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক কিংবা তার পূর্বে ক্রুসেডের যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করাটা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। কেননা, মুসলমানদের পতন ইংরেজ, খ্রিস্টান, ইহুদি, সাম্রাজ্যবাদী কারো হাতেই নয়; বরং খোদ মুসলমান নামধারী মুনাফিক জালেম শাসক,আলেম এবং বুদ্ধিজীবীদের হাতেই।
ড. কলিম সিদ্দিকী এ বিষয়ে তাঁর ‘উপনিবেশবাদ কবলিত মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আচরণ’ শীর্ষক বক্তৃতায় বলেন, ‘এটা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, উপনিবেশী শক্তিগুলো আসলে ইসলামের রাজনৈতিক শক্তিকে পরাজিত করতে পারেনি। ইসলামের রাজনৈতিক শক্তির পতন ঘটেছিল ঔপনিবেশিকদের রঙ্গমঞ্চে আসার অনেক অনেক আগে,রাজতন্ত্রী ও বংশীয় মুসলিম শাসকদের হাতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উল্লেখ্য যে, মুসলিম ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা মুলুকিয়াহ বা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রেরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।”
আর এই রাজতন্ত্রের সূচনা-বিন্দুতে ছিল বনি উমাইয়া। রাসূল(সা)-এর ওফাতের পর থেকে ইমাম হোসাইনের নির্মম শাহাদাতের মধ্যকার ৫০টি বছরে এমন কিছু ঘটেছে যার ফলে ইসলামে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের উত্থান ঘটে এবং একইসাথে মুসলমানদের মাঝে শিয়া-সুন্নি সহ হাজারো মাজহাবী দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। সমস্যার মূল তথা ঐ ৫০টা বছরই ছিল কারবালার মহা-ঘটনার প্রেক্ষাপট।
ড.কলিম সিদ্দিকী তাঁর ভাষণের অন্যত্র বলেছেন, ‘ধর্মকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের অধিকতর শক্তিশালী হওয়া ইসলামে অসম্ভব। তাই ধর্মের মুখোশ পরে রাষ্ট্রনীতির কূটকৌশল শুরু করে সর্বপ্রথম উমাইয়ারা। তখন থেকেই অন্য শাসকরা নিজেদের বংশগত স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহারের প্রয়াস পায়। কালক্রমে এই ধরনের বংশীয় শাসকেরা অধিক হারে সেক্যুলার ধারার রাজনৈতিক আচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়ে।’
ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ছিল পুরোভাগে রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক।তিনি তাঁর কারবালা-পূর্ব ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘জেনে রাখ, এ শাসকদল (বনি উমাইয়া) শয়তানের আদেশ মেনে চলছে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করছে এবং দুর্নীতিকে প্রতিদিনকার নিয়ম বানিয়েছে।তারা অধিকারগুলোকে এক জায়গায় জমা করেছে। মুসলমানদের সম্পদের ভাণ্ডারকে(বাইতুল মা’লকে) তাদের নিজেদের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে এবং আল্লাহর হারামকে বৈধতা দিয়েছে এবং তাঁর হালালকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তাদের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে সব মানুষের মধ্যে আমিই সবচেয়ে যোগ্য।’ (তাবারী)
আর ইমাম হোসাইনই সে সময় ছিলেন জান্নাতের যুবকদের সর্দার এবং আহলে বায়েতের জীবিত সদস্য। আর তাই ইমাম হোসাইন রাসূলের সুন্নাহ এবং পাক কুরআনের নির্দেশাবলী পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
ইমাম হোসাইন বলেছিলেন,‘আমি কোনো ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি কিংবা ক্ষমতার লোভে বিদ্রোহ করছিনা। আমি শুধু আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই। আমি চাই সৎকাজের নির্দেশ দিতে এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে। আর আমার নানা এবং বাবা আলীর পথ ধরে চলতে।’
এই সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজে বাধা দেয়া বা নিষেধ করাই হচ্ছে ইসলামি সমাজব্যবস্থা, ইসলামি ন্যায়বিচার এবং ইসলামি রাজনীতির মূলমন্ত্র। সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার যে সংকীর্ণ এবং ক্ষুদ্র ধারণা মুসলমানদের, তা থেকে আমরা মনে করি যে,এটি বোধ হয় মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা কিংবা নামাজ-রোযা বা ইসলামি আহকাম পালনে দায়েশীয়(ISIS-terrorist group) পন্থায় মানুষকে বাধ্য করা।
কিন্তু ইমাম হোসাইন এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ হল অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (এর জন্যে আন্দোলন-সংগ্রাম করা),জালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মা’ল ও গনিমত বণ্টন, যাকাতের নিসাব থেকে যাকাত গ্রহণ এবং তা যথার্থ খাতে ব্যয় করা।’
ইমাম হোসাইনের উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্রের বিপরীতে রক্তের বিজয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঘুমন্ত মুসলিম উম্মাহকে ধাক্কা দেয়া ও বলা, ‘জাগো!আবারো সাক্ষ্য দাও।’ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। তিনি চেয়েছেন যেন অনাগতকালের রাজতন্ত্র-পীড়িত জনগণ ও আলেম-বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষেরা এই ইতিহাস চর্চা করে এবং ইমাম হোসাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজতন্ত্র, উপনিবেশ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিজের জান-মাল-পরিবার নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। ইসলামি সমাজে ব্যাধির উপর বিরাট একটা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ইমাম হোসাইনের আন্দোলন।
আমরা যদি কারবালার পূর্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে কয়েকটা জিনিস দেখব। যার কেন্দ্র হচ্ছে ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিনাশ এবং স্বৈরাচার,স্বেচ্ছাচার ও রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকরণ। ইসলামি রাষ্ট্রের জনগণের বাইতুল মা’লকে আম ও খাস বাইতুল মালে ভাগ করে,এর এক অংশ(আ’ম) আমীরের জন্যে রেখে দেয়া এবং সেই অর্থ খরচ করে ইয়াজিদের মতো শাসকের পক্ষে বায়াত(ভোট) কেনা এবং বিদ্রোহ দমনের প্রচেষ্টা। রাসূল(সা)-এর নিকটতম সাহাবীদেরকে হত্যা করা, হাত কেটে দেয়া,লাঞ্ছিত এবং নির্বাসিত করা এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা। ইসলামি রাষ্ট্রের গভর্নরের দায়িত্ব এবং অন্যান্য শীর্ষ পদে রাসূল কর্তৃক অভিশপ্ত, জারজ কিংবা যিনাকার (ব্যভিচারী ) এ ধরনের ব্যক্তিদের বসানো। প্রত্যেক মসজিদের মিম্বর থেকে খুতবায় হযরত আলী(কা)-কে গালমন্দ এবং অভিসম্পাত করা। কোরআনের নির্দেশ এবং রাসূলের সুন্নাতসমূহকে সুস্পষ্টভাবে পরিবর্তন সাধন করা।
সংক্ষিপ্ত এই নিবন্ধে আমরা তেমনি কিছু ঘটনার উদাহরণ টানব যাতে আমরা বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থার সাথে ইমাম হোসাইনের সময়ের প্রেক্ষাপটের মিল খুঁজে পাই।
রাজতন্ত্রীকরণ
মাওলানা মুঈনউদ্দিন নদভী তাঁর কিতাবে লিখেছেন, ‘আমীর মুয়াবিয়া কর্তৃক খলিফা হযরত আলী(আ)-এর মুকাবেলায় যুদ্ধে জয়লাভের অভিপ্রায়ে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করা, পরবর্তী খলিফা হযরত হাসানের (আ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা,ইসলামি খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিবর্তন করা, তার শাসনামলের প্রতিটি ঘটনা এমন প্রকাশ্য ভ্রান্তিময় যাকে সত্যাশ্রয়ী লোক কখনো সমর্থনযোগ্য ও পছন্দনীয় বলে গণ্য করতে পারেনা। বিশেষত ইয়াজিদের মনোনয়নে খেলাফতের ফেতনা চিরতরে শেষ হয়ে যায় এবং ইসলামে বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক প্রথা চালু হয়।’ (সিয়ারুস সাহাবা)
এছাড়াও ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, আমীরে মুয়াবিয়া পরবর্তী শাসকরূপে ইয়াজিদকে মনোনয়নে সম্মতিলাভের উদ্দেশ্যে ইবনে ওমর এবং আব্দুর রহমান বিন আবি বকরের কাছে এক লক্ষ দিরহাম করে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সেগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।(ইবনে আসিরের আল কামিল,ইবনে কাসিরের আল বিদায়া আন নিহায়া,তাবাকাতে ইবনে সা’দ)
গভর্নরদের অত্যাচার
আমীর মুয়াবিয়া ৪০ হিজরির প্রথমদিকে বুশর বিন আরতাতকে ইয়ামেন ও হেযাজে পাঠায়। হযরত আলীর কোনো অনুসারীর দেখা পেলেই তাকে ধবংস করার জন্যে তাকে নির্দেশ দেয়া হয়।বস্তুত বুশর তাই করেছিলো।(আল ইসাবায় ইবনে হাযারের মন্তব্য)
অপর এক গভর্নর যিয়াদ বিন আবিহ সম্পর্কে ইতিহাসে এসেছেঃ ‘যে লোকই যিয়াদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করত তাকে সে হত্যা করত। হাজ্জাজের চেয়েও সে ছিল অধিক রক্তপিপাসু।’ (এলামুল নুবালা।)
সাহাবীদের উপর নির্যাতন
যিয়াদের পক্ষ থেকে সাহাবী হাকামের (রা) কাছে আমীর মুয়াবিয়ার একটি পত্র আসে। সেই চিঠিতে গনীমতের মাল থেকে সোনা-রুপা মুয়াবিয়ার বাইতুল মালের জন্যে রাখার নির্দেশ ছিল। হাকাম(রা) আল্লাহর নির্দেশকে আমীরের নির্দেশের উপরে প্রাধান্য দিয়ে বলেন,‘সে কি রাসূলের এ কথা শোনে নি যে, কোনো কাজে আল্লাহর অবাধ্যতার প্রশ্ন দেখা দিলে তখন কারো কথা মানা যাবেনা?’ অতঃপর তিনি সমস্ত মালে গনীমত সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। বলা হয়,তাতে হযরত হাকাম(রা) কারা প্রকোষ্ঠেই মৃত্যুবরণ করেন।(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
খলিফা উসমানের শাসনামলে সিরিয়ায় আমীর মুয়াবিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, সম্পদের অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, বণ্টন-বৈষম্য এবং কোরআন ও সুন্নাতবিরোধী কার্যক্রমের কারণে রাসূলের প্রবীণতম সাহাবী আবুযর গিফারীর সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধ এবং দূরত্বের সুচনা হয়। যার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে সাহাবী আবুযর গিফারী স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যান। স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকাকালীন জনমানুষশূন্য মরুভূমিতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর নামাজে জানাজায় অংশ নেন আরেক প্রবীণতম সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ। ইতিহাস সূত্রে দেখা যায় যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ কুফায় নিযুক্ত খলিফা উসমানের গভর্নর ওয়ালিদ বিন উকবা এবং সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রীয় খেলাফতে অর্থনৈতিক-সামাজিক অনিয়ম,নৈতিক অবক্ষয় এবং স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ক্ষণে ক্ষণে অসন্তোষ জানাতে থাকলে এবং আবুযার গিফারির জানাজায় অংশ নেয়ার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁর ওপর নাখোশ হয়ে পড়ে।
মিম্বরে দাঁড়িয়ে হযরত আলী(কা)-এর নামে অভিসম্পাত ও গালাগালের প্রতিবাদ জানানোতে রাসূল(সা)-এর সাহাবী হুজর বিন আদীকে ছয় সঙ্গীসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
দেওবন্দের অন্যতম বুজুর্গ মাওলানা মানাজির আহসান গিলানী তাঁর ‘তাদবীনে হাদীস’ গ্রন্থের ৪২৩ পৃষ্ঠায় হযরত হুজর(রা)-কে একজন সাহাবী হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর শাহাদাতের ঘটনা বিবৃত করেছেন। বিবরণের শেষে তিনি লিখেন, ‘হযরত হুজর(রা)-কে কুফায় গ্রেফতার করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেয়ার খবর মদীনায় পৌঁছামাত্র মহানবীর (সা) স্ত্রী আয়েশা বিনতে আবুবকর অনতিবিলম্বে দূত পাঠিয়ে কোনো অবস্থায় তাঁকে হত্যা না করার সুপারিশ করেন। কিন্তু দূত পৌঁছার আগেই তাঁর শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যায়।এ ঘটনা দ্বারা হুজর বিন আদী(রা)-এর উচ্চ মর্যাদা আন্দাজ করতে কষ্ট হবার কথা নয়।’
এছাড়াও এই মুয়াবিয়ার শাসনামলে আমর বিন হামাক,মালিক আল আশতার,মোহাম্মদ ইবনে আবি বকর,মাইসাম বিন তাম্মার প্রমুখ খোদাভক্ত সাহাবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ইমাম আলী(কা)-কে মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে গালাগাল
মুয়াবিয়া যখন তার বিরোধীদেরকে হত্যা করতে এবং স্বপক্ষীয়দেরকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বুশর বিন আরতাতকে বসরা নগরীতে পাঠাল, তখন বুশর সেখানে উপস্থিত হয়ে মিম্বরে চড়ে গালমন্দ, ভর্ৎসনা এবং অবজ্ঞার সাথে হযরত আলীর নাম উল্লেখ করে বলল,‘সমবেত জনতা! আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কি সত্য কথা বলিনি?’ আবু বাকরাহ নামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি (ইনি প্রথম খলিফা আবুবকর নন) তখন জবাবে বললেন,‘তুমি মস্তবড় সত্তার কসম করেছ। আল্লাহর কসম!তুমি সত্য কথা বলনি। কোনো ভালো কাজও করনি।’ তাতে বুশর আবু বকরাহকে প্রহার করার নির্দেশ দিলে তিনি এমনভাবে প্রহৃত হন যে তাঁর সংজ্ঞা লোপ পায়।’ (আনসাবুল আশরাফ,পৃ. ৪৯২,দারুল মাআরিফ,মিশর)
হযরত আলীকে গালমন্দ করার কথা ইতিহাস ছাড়াও হাদীস গ্রন্থেও পাওয়া যায়।যেমন মুসনাদে হাম্বালে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা)-এর কয়েকটি রেওয়ায়াতে আছে, তিনি কতিপয় সাহাবীর কাছে অভিযোগ করেন, ‘তোমাদের সামনে রাসূল(সা)-কে উদ্দেশ্য করে মিম্বরে দাঁড়িয়ে গালমন্দ করা হয় কি?’
লোকেরা বলল, ‘কেমন করে?’
উম্মে সালামাহ(রা) বললেন, ‘আলীকে কি গালি দেয়া হয়না?’ (যদি দেয়া হয়)এভাবে কি তাঁকেও(রাসূল-সা.) গালমন্দ করা হচ্ছেনা, যিনি তাঁকে(আলী) মহব্বত করতেন।আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,রাসূল(সা) তাঁকে ভালোবাসতেন।’
সুন্নাতের পরিবর্তন
বুখারী শরিফের দুই ঈদের অধ্যায়ে এসেছে, মারওয়ান যখন ঈদের খুৎবা দিতে ঈদের নামাজের জামায়াতের আগেই মিম্বরটিতে ওঠা শুরু করে তখন আবু সাঈদ খুদরী তার জামা টেনে ধরে ধরে রাখেন।কিন্তু মারওয়ান তার জামা ছাড়িয়ে নিয়ে মিম্বরে আসীন হয়। তারপর আবু সাঈদ বলেছিলেন, “আমি মারওয়ানকে বললাম, ‘আল্লাহর কসম!(তুমি শরীয়া বিধানে) পরিবর্তন এনেছ ‘ তখন মারওয়ান বলল, ‘আবু সাঈদ! তুমি যা জান তার যুগ পার হয়ে গিয়েছে।’ আমি জবাবে বললাম, ‘আল্লাহর কসম! আমার জানা বিষয় না-জানা বিষয় অপেক্ষা উত্তম’।”
এই যুগে অমুসলমানের রক্তমূল্য কমিয়ে অর্ধেক করে বাকি অর্ধেক খলিফার নিজের বা ব্যক্তিগত বাইতুল মালে জমা করা, কিংবা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে সোনা-রুপা আলাদা করে খলিফার নিজের হাতে রাখা কিংবা আহলে বায়েতের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিজের জায়গীর বানানো, ঈদের নামাজের পূর্বে আলী(কা)-কে গালি দেয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ খুৎবা চালু করার মতো বেদআতের সূচনা করা হয়।
নারীদের দাসী বানানো
এ লোকটি ইয়ামেনের হামাদান শহরটি লুটতরাজ করে সেখানকার মহিলাদের ক্রীতদাসীতে পরিণত করে। এ দুর্ভাগা নারীরাই সর্বপ্রথম মুসলমান পরিচিতি বহন করে দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ হন।(তাদেরকে প্রকাশ্যে কেনাবেচা করা হতো-এলামুল নুবালা)। লোকটি মদীনা শহরটি ধবংস করে দেয়। ঘটনা ইতিহাস খ্যাত হওয়ায় এর বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। (আল কামিল, যাহাবীর এলামুল নুবালাতেও অনুরূপ বর্ণিত)
সর্বোপরি উমাইয়া পরিবার এবং তাদের অনুদাসদের হাতে সরকারি প্রত্যেকটি পদ তুলে দেয়া হয়। যার মধ্যে বুশর বিন আরতাত-যার হত্যাযজ্ঞের কথা আমরা আগেই বলেছি। যিয়াদ বিন আবিহ-যাকে আমীরে মুয়াবিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘ভাই’ এর মর্যাদা দেয়। যিয়াদের পুত্র ওবায়দুল্লাহ কুফার গভর্নর হয়। সে মুসলিম বিন আকিলের হত্যার নির্দেশদাতা এবং কুফার শত শত জনগণকে হত্যা করে ইমাম হোসাইনের পক্ষে বিপ্লবে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক দলটির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়। এ ছাড়াও সে কারবালায় ইমাম হোসাইনের হত্যার প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা এবং তদারককারী। মারওয়ান বিন হাকাম-যাকে রাসূল(সা) অভিসম্পাত করেছিলেন- সে ইমাম হোসাইনের মৃত্যুর পরের বছর মদিনায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং ধর্ষণ চালানোতে মদদ দেয়। মুগীরা বিন শো’বা, ইবনে গাইলান, কিংবা আমর বিন আস- এরা ছিল মিশরে আলীপন্থী গভর্নর খলিফা আবু বকরের সন্তান তথা বিশিষ্ট সাহাবী মোহাম্মাদ বিন আবি বকর এবং সাহাবী মালিক বিন আশতারকে হত্যায় প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা।
এভাবে ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে রাজতন্ত্রে পরিণত করা এবং সুন্নাত পরিবর্তনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে বনি উমাইয়ার শাসনকালে। উমাইয়া ইসলামে দীক্ষিত এলিট-বুদ্ধিজীবী এবং আলেমদের অনুসরণ করেই আজকে মুসলিম মিল্লাতের বিভিন্ন প্রান্তে রাজতন্ত্রের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে সগর্বে এই কুফরি রাজতন্ত্রকে ইসলামের শাসনব্যবস্থা হিসেবে জায়েয বা বৈধ হওয়ার ইসলামিক এবং বৈজ্ঞানিক ফতোয়াও দিয়ে দেয়া হয়েছে। জনগণের মনে এই বিশ্বাস জন্মানো হয়েছে যে, আদতে রাসূল(সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদার শাসনব্যবস্থার সাথে উমাইয়া রাজতন্ত্রের কোনো গুণগত পার্থক্য নেই।
রাজতন্ত্রের পথ ধরে এসেছিল ঔপনিবেশিক লুটেরারা। আর উমাইয়াদের নিজেদের ব্যক্তি-জীবনে নৈতিকতাহীনতা-ধর্মহীনতা এবং সমাজ জীবনে কপট ধার্মিকতা-মুনাফিকীর রীতি অবলম্বনে মুসলিম দেশগুলোর শাসক, বুদ্ধিজীবী ও এক শ্রেণির আলেমদের মধ্যে লেবাসী ধার্মিকতা, রাষ্ট্রীয় সেক্যুলারিজম এবং ফ্যাসিবাদী-স্বেচ্ছাচারী রূপ গড়ে উঠেছে। যুগের উমাইয়াদের মতো তারা নিজ নিহ দেশে ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর আগ্রাসনের রাজনীতি গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ব্যবহার করছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ব্যয় না করে সেসব অর্থে ব্যক্তিগত ব্যবসা গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যবহার করে তারা রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভোট কিংবা জনসমর্থন কিনছে। বুদ্ধিজীবী এবং আলেমদের কিনে নিয়ে তাদের মুখ থেকে নিজেদের কুকর্মের পক্ষে সাফাই আদায় করে জনগণের কাছে সেগুলোকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করছে। উমাইয়াপন্থী আলেমদের ব্যবহার করে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের পক্ষে শিয়া-সুন্নি বিভেদ, ফেরকাবাজী এবং পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দেয়ার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়েছে-যার ফল ভোগ করছে ফিলিস্তিন,আরাকান কিংবা কাশ্মীরের মজলুম জনগণ।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর আলেম সমাজ এবং ইসলামি বুদ্ধিজীবীদেরকে উমাইয়া নিগড় থেকে বেরিয়ে আসা। আর সে লক্ষ্যে রাসূল(সা)-এর ওফাতের পর থেকে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের মধ্যকার সময়ে মুসলিম উম্মাহের মধ্যে যেসব মতবিরোধের সূচনা হয়েছিল সেগুলোর ওপর আলোকপাত করে, ভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে ডায়ালগের সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে। আর একইসঙ্গে ‘ইসলামি’ বলে মনে-প্রাণে গৃহীত ইয়াজিদী সংস্কৃতি ফেলে সব মাজহাবকেই সামাজিক ন্যায়বিচার তথা আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ, ইসরায়েল ও জালেম শাসক এবং তাদের অনুসারী আলেমেছু‘দেরও (মন্দ আলেমদের) বয়কট করতে হবে। আর এভাবেই ইমাম হোসাইন (আ) যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সেই আন্দোলনকে সফল বিপ্লবে রূপ দান করা সম্ভব হবে। (লেখক: মাহদী মাহমুদ, গবেষক ও বিশ্লেষক)
No comments