দিল্লি ক্রাইম: একটি অকথিত কাহিনী by সামা ফারুকি
দিল্লি
ক্রাইম আলোড়ন সৃষ্টি করে লোকমুখে নির্ভয়া নামে পরিচিত জ্যোতি সিং নামের ২৩
বছরের এক নারীর নৃশংস গণধর্ষণবিষয়ক পুলিশ প্রতিবেদনের জের ধরে। সাত পর্বের
দীর্ঘ নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার প্রথম মওসুমের সর্বশেষ ক্রাইম সিরিজটি
তাৎক্ষণিক কষ্টসাধ্য, তবে চূড়ন্তভাবে দেখার মতো ছিল। ধর্ষণের চিত্রটি
একবারের জন্য না দেখানো হলেও (এর বদলে ক্যামেরায় দিল্লি আকাশ থেকে তোলা ছবি
দেখানো হয়, যাতে দিল্লির লোকজন দৈনন্দিন কাজ করছে বলে মনে হয়, সবকিছুই
ঠিকমতো চলছে বলেও মনে হতে থাকে) ভয়ঙ্কর ঘটনাটি এত যন্ত্রণাদায়কভাবে
উপস্থাপন করা হয় যে দর্শকরা যা দেখানো হচ্ছে এবং যা দেখানো হচ্ছে না, তার
মধ্যকার অস্বস্তিকর সংযোগে মনোনিবেশন করতে বাধ্য হয়।
ঘটনা সবার জানা। ২০১২ সালে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় চলন্ত বাসে ছয় লোক মিলে জ্যোতিকে ধর্ষণ করে। এর জের ধরে প্রতিবাদ ওঠে, আরো কঠোর ধর্ষণ আইন প্রণীত হয়। অনেকে জানতে চাইতে পারেন, সমাপ্তির পর এখন আবার কেন ওই ঘটনা সামনে আনা হচ্ছে? ঘটনার শিকার নারীটি আর আমাদের মধ্যে নেই, কাজেই কেন ওই মর্মান্তিক ঘটনা সামনে আনা হচ্ছে?
কিন্তু দিল্লি ক্রাইম আসলে জ্যোতিকেন্দ্রিক নয় (যদিও তিনিই এর মূলে রয়েছেন), বরং তাকে যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের পাকড়াও করা নিয়েই। এতে পুলিশের ডিসি বর্তিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত দলের দিকেই বেশি নজর দেয়া হয়েছে। মামলাটি তার নজরে আসার পর তিনি অপরাধী যারাই হোক না কেন, তাদের পাকড়াও করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। কয়েক দিনের মধ্যে পুরো বিশ্বের বোঝা তার কাঁধে ন্যস্ত হয়।
কাহিনীটির শুরু ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক শীতের রাতের ঘটনা দিয়ে শুরু। পুলিশ কর্মকর্তারা দিপিকা ও আকাশ (তারা জ্যোতি ও তার বন্ধু অবিন্দ্র প্রতাপ পান্ডে চরিত্র রূপ দিয়েছেন) প্রধান রাস্তার খাদে পড়ে আছে দেখতে পান। হেড কনস্টেবল রাম প্রতাপ (খান) তাদেরকে সাদা বেড শিটে ঢেকে কাছের হোটেলে নিয়ে যান, তাদের ঠিকানা যোগার করার চেষ্টা করেন। তাদেরকে পুলিশ ভ্যানের পেছনে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মুর্ছা যাওয়া দিপিকার ফিসফিস কণ্ঠ শোনা যায়: ‘তারা আমার সাথে ভয়ঙ্কর আচরণ করেছে। প্লিজ আমার বাবাকে বলো না।’
পরের দৃশ্য চলে যায় ১২ ঘণ্টা আগের ঘটনায়: রাম প্রতাপ প্রতিদিন সকালের মতোই জেগে ওঠেছিলেন, প্রতিদিনকার মতোই দাঁত ব্রাশ করেন, নাস্তার টেবিলে তার স্ত্রীর সাথে হালকা কথাবার্তা বলেন। তিনি ৩৪ বছর চাকরি করেছেন। সিরিজের যে কারো চেয়ে বেশি দিনই তা করেছেন, তবে সম্ভবত সংগ্রাম এখনো চলছে। বড় চিত্রে ছোট চরিত্রে তিনি নিম্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার ভেতরের অবস্থা তুলে ধরেছেন। তারা অনেক বেশি পরিশ্রম করেন, কিন্তু বেতন পান কম, মূল্যায়নও হয় না। তাদের কর্মস্থল থানায় বিদ্যুৎ থাকে না, বাজেটে থাকে টানাপোড়েন। তাদেরকে কর্মস্থলে যেতে হয় বাসে করে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তিরস্কার খেতে হয়।
প্রথম পর্বে এই রাম প্রতাপের মাধ্যমেই পরিচালক অন্যান্য বড় চরিত্রকে সামনে এনেছেন। যেমন আমরা স্টেশন হাউস অফিসার বিনোদ তিওয়ারিকে চন্ডিগড় থেকে আসা বড় চোখের নবাগতের সাথে কথা বলতে দেখি। ওই লোক বড় নগরীতে উদ্দীপনা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে আগ্রহী। আরেক দৃশ্যে রাম প্রতাপকে তার রাতের খাবার ফেলে এক সন্ত্রাসীর পেছনে ধাওয়া করতে দেখি।
সিরিজটি সব পূর্ণ ক্রাইম থ্রিলারের মতো এগুতে থাকে। একটার পর একটা নতুন তথ্য আসতে থাকে, দর্শক রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তম্ভের ভেতরে কী ঘটছে তা দেখতে থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাজনীতিবিদ, বিচার বিভাগ, মিডিয়া এবং সর্বোপরি জনগণও ট্রাজেডিতে এসে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে কেন সিস্টেম কখনো কাজ করে, কখনো কাজ করে না, তা সামনে চলে আসে। অনেক কিছুই থাকে যা বইপত্রে দেখা যায় না।
গল্পে সহানুভূতিশীল পুলিশের কথা দেখা যায়। তাদের অধৈর্য, অবহেলা অনিচ্ছাকৃত হিসেবেই তুলে ধরা হতে থাকে। তারা তাদের স্বাভাবিক গতিতে কাজ করে গেলেও মিডিয়া তাদেরকে পুরোপুরি নেতিবাচক আলোতেই সামনে নিয়ে আসে।
এতে সমাজের ভূমিকার ওপরও যথাযথ আলো ফেলা হয়েছে। লোকজন ক্ষেপে গেলে তারাও গণধর্ষণকারীদের মতোই রক্তলোলুপ, ক্রুদ্ধ আর মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
এক পর্যায়ে হতবিহ্বল ভুপেন্দ্র সিং জানতে চান: তারা ক্রুদ্ধ, কিন্তু তারা আসলে কী চায়? এই শোয়ের তারকাই হলেন শাহ। তার আবেগময় চোখ, নিয়ন্ত্রিত শারীরিক ভাষা তাকে সামনে নিয়ে আসে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অধীনস্তদের একেকজনের সাথে একেক রকম সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন তিনি। আবার তাকেই তার মেয়েকে আগলে রাখার জন্য প্রান্তকর প্রয়াস চালাতে দেখা যায়।
অনেক দর্শক হয়তো দিল্লি ক্রাইমকে আরেকটি স্যাকরেড গেমস (মুম্বাইয়ের দেবতা ও অপদেবতদের নিয়ে করা সিরিজ) হবে বলে আশা করেছিলেন। না তা হয়নি। এটি ভারতের রাজধানীর ক্ষমতার করিডোরের ছবিই সামনে এনেছে। এখানে অতিলৌকিক কিছু নেই, বরং বাস্তব জগতের কথাই সামনে চলে এসেছে।
দিল্লির বাস্তব জগতকে সামনে আনার কারণেই দিল্লি ক্রাইম দশর্কপ্রিয়তা পেয়েছে। এখানকার কুয়াশায় ঢাকা শীতের বিকেল, ট্রাফিক জ্যাম, বেওয়ারিশ কুকুর, শ্রেণি বৈষম্য দশর্কদের সামনে ফুটে ওঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ লোকের কাছে এগুলো একেবারেই চেনা জগত।
ঘটনা সবার জানা। ২০১২ সালে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় চলন্ত বাসে ছয় লোক মিলে জ্যোতিকে ধর্ষণ করে। এর জের ধরে প্রতিবাদ ওঠে, আরো কঠোর ধর্ষণ আইন প্রণীত হয়। অনেকে জানতে চাইতে পারেন, সমাপ্তির পর এখন আবার কেন ওই ঘটনা সামনে আনা হচ্ছে? ঘটনার শিকার নারীটি আর আমাদের মধ্যে নেই, কাজেই কেন ওই মর্মান্তিক ঘটনা সামনে আনা হচ্ছে?
কিন্তু দিল্লি ক্রাইম আসলে জ্যোতিকেন্দ্রিক নয় (যদিও তিনিই এর মূলে রয়েছেন), বরং তাকে যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের পাকড়াও করা নিয়েই। এতে পুলিশের ডিসি বর্তিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত দলের দিকেই বেশি নজর দেয়া হয়েছে। মামলাটি তার নজরে আসার পর তিনি অপরাধী যারাই হোক না কেন, তাদের পাকড়াও করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। কয়েক দিনের মধ্যে পুরো বিশ্বের বোঝা তার কাঁধে ন্যস্ত হয়।
কাহিনীটির শুরু ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক শীতের রাতের ঘটনা দিয়ে শুরু। পুলিশ কর্মকর্তারা দিপিকা ও আকাশ (তারা জ্যোতি ও তার বন্ধু অবিন্দ্র প্রতাপ পান্ডে চরিত্র রূপ দিয়েছেন) প্রধান রাস্তার খাদে পড়ে আছে দেখতে পান। হেড কনস্টেবল রাম প্রতাপ (খান) তাদেরকে সাদা বেড শিটে ঢেকে কাছের হোটেলে নিয়ে যান, তাদের ঠিকানা যোগার করার চেষ্টা করেন। তাদেরকে পুলিশ ভ্যানের পেছনে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মুর্ছা যাওয়া দিপিকার ফিসফিস কণ্ঠ শোনা যায়: ‘তারা আমার সাথে ভয়ঙ্কর আচরণ করেছে। প্লিজ আমার বাবাকে বলো না।’
পরের দৃশ্য চলে যায় ১২ ঘণ্টা আগের ঘটনায়: রাম প্রতাপ প্রতিদিন সকালের মতোই জেগে ওঠেছিলেন, প্রতিদিনকার মতোই দাঁত ব্রাশ করেন, নাস্তার টেবিলে তার স্ত্রীর সাথে হালকা কথাবার্তা বলেন। তিনি ৩৪ বছর চাকরি করেছেন। সিরিজের যে কারো চেয়ে বেশি দিনই তা করেছেন, তবে সম্ভবত সংগ্রাম এখনো চলছে। বড় চিত্রে ছোট চরিত্রে তিনি নিম্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার ভেতরের অবস্থা তুলে ধরেছেন। তারা অনেক বেশি পরিশ্রম করেন, কিন্তু বেতন পান কম, মূল্যায়নও হয় না। তাদের কর্মস্থল থানায় বিদ্যুৎ থাকে না, বাজেটে থাকে টানাপোড়েন। তাদেরকে কর্মস্থলে যেতে হয় বাসে করে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তিরস্কার খেতে হয়।
প্রথম পর্বে এই রাম প্রতাপের মাধ্যমেই পরিচালক অন্যান্য বড় চরিত্রকে সামনে এনেছেন। যেমন আমরা স্টেশন হাউস অফিসার বিনোদ তিওয়ারিকে চন্ডিগড় থেকে আসা বড় চোখের নবাগতের সাথে কথা বলতে দেখি। ওই লোক বড় নগরীতে উদ্দীপনা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে আগ্রহী। আরেক দৃশ্যে রাম প্রতাপকে তার রাতের খাবার ফেলে এক সন্ত্রাসীর পেছনে ধাওয়া করতে দেখি।
সিরিজটি সব পূর্ণ ক্রাইম থ্রিলারের মতো এগুতে থাকে। একটার পর একটা নতুন তথ্য আসতে থাকে, দর্শক রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তম্ভের ভেতরে কী ঘটছে তা দেখতে থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাজনীতিবিদ, বিচার বিভাগ, মিডিয়া এবং সর্বোপরি জনগণও ট্রাজেডিতে এসে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে কেন সিস্টেম কখনো কাজ করে, কখনো কাজ করে না, তা সামনে চলে আসে। অনেক কিছুই থাকে যা বইপত্রে দেখা যায় না।
গল্পে সহানুভূতিশীল পুলিশের কথা দেখা যায়। তাদের অধৈর্য, অবহেলা অনিচ্ছাকৃত হিসেবেই তুলে ধরা হতে থাকে। তারা তাদের স্বাভাবিক গতিতে কাজ করে গেলেও মিডিয়া তাদেরকে পুরোপুরি নেতিবাচক আলোতেই সামনে নিয়ে আসে।
এতে সমাজের ভূমিকার ওপরও যথাযথ আলো ফেলা হয়েছে। লোকজন ক্ষেপে গেলে তারাও গণধর্ষণকারীদের মতোই রক্তলোলুপ, ক্রুদ্ধ আর মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
এক পর্যায়ে হতবিহ্বল ভুপেন্দ্র সিং জানতে চান: তারা ক্রুদ্ধ, কিন্তু তারা আসলে কী চায়? এই শোয়ের তারকাই হলেন শাহ। তার আবেগময় চোখ, নিয়ন্ত্রিত শারীরিক ভাষা তাকে সামনে নিয়ে আসে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অধীনস্তদের একেকজনের সাথে একেক রকম সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন তিনি। আবার তাকেই তার মেয়েকে আগলে রাখার জন্য প্রান্তকর প্রয়াস চালাতে দেখা যায়।
অনেক দর্শক হয়তো দিল্লি ক্রাইমকে আরেকটি স্যাকরেড গেমস (মুম্বাইয়ের দেবতা ও অপদেবতদের নিয়ে করা সিরিজ) হবে বলে আশা করেছিলেন। না তা হয়নি। এটি ভারতের রাজধানীর ক্ষমতার করিডোরের ছবিই সামনে এনেছে। এখানে অতিলৌকিক কিছু নেই, বরং বাস্তব জগতের কথাই সামনে চলে এসেছে।
দিল্লির বাস্তব জগতকে সামনে আনার কারণেই দিল্লি ক্রাইম দশর্কপ্রিয়তা পেয়েছে। এখানকার কুয়াশায় ঢাকা শীতের বিকেল, ট্রাফিক জ্যাম, বেওয়ারিশ কুকুর, শ্রেণি বৈষম্য দশর্কদের সামনে ফুটে ওঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ লোকের কাছে এগুলো একেবারেই চেনা জগত।
No comments