এশিয়ায় পপুলিজমের উত্থান by লি জং-হা
সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বে পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদের উত্থান অসংখ্য আলোচনার
বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর তা হয়েছে যৌক্তিক কারণেই। লোকরঞ্জনবাদীদের
ভ্রষ্ট পলিসি বিশ্বজুড়ে বহু প্রতিকূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি বয়ে
এনেছে। এবার এই ঝুঁকি এশিয়াতেও আসছে।
লোকরঞ্জনবাদের সোজাসাপ্টা কোনো সংজ্ঞা নেই। এটি হতে পারে আদর্শিক কিংবা অর্থনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক। ডানপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি যেমন লোকরঞ্জনবাদী বলে অভিহিত হতে পারে, তেমনি পারে বামপন্থি মতামতও। এক্ষেত্রে বিষয়টির ব্যাখ্যা করা হয় নির্দিষ্ট কোনো দেশের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে।
তবে লোকরঞ্জনবাদের কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন, লোকরঞ্জনবাদী দলগুলোর নেতৃত্বে সাধারণত থাকেন কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা।
এই নেতা ‘দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট বা অভিজাত সম্প্রদায়’ ও ‘বহিরাগতদের’কে ‘জনতা’র মুখোমুখি দাঁড় করান। বিষয়টা যেন এমন যে, ‘জনতা’র প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন কেবল ওই ব্যক্তি বা তার দল। এই কৌশল সবচেয়ে কার্যকর হয় যখন কিনা জনগণ প্রতিষ্ঠিত নেতা বা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বা সামাজিক অসমতা, অনিরাপত্তাবোধ বা প্রকাশ্য দুর্নীতি এই হতাশা সৃষ্টির কারণ।
তবে দেখা যায়, ক্ষমতায় আসলে এই জনতোষণবাদীরা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যায়। তারা প্রথমেই প্রতিনিধিত্বকারী গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাটো বা অগ্রাহ্য করে। বিশেষ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার বা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ঠেকাতে ভারসাম্যের ব্যবস্থাও (চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স) তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। তারা দাবি করে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই তারা ‘জনতা’র সেবা করতে পারছে না।
লাতিন আমেরিকায় বলিভিয়ার ইভো মোরালেস, কলম্বিয়ার আলভারো উরিব ও ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ গণভোট আয়োজন করে বড় ধরণের সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেছেন, যার দরুণ বস্তুত তাদের নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ বেড়েছে কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসবের ফলে আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক মানের অধঃপতন হয়েছে।
লোকরঞ্জনবাদীদের অর্থনৈতিক রেকর্ডও বেশ নাজুক। অর্থনীতিবিদ রুডি ডর্নবাসচ ও সেবাস্তিয়ান এডওয়ার্ডসের মতে, একটি জনতোষণবাদী পলিসি বা নীতিতে প্রবৃদ্ধি ও আয় বিন্যাসের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি, বহিঃসীমাবদ্ধতা, আক্রমণাত্মক বাজারবিরোধী নীতিমালার প্রতিক্রিয়ার কথা এতে ভাবা হয় না। ফলে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক কার্যকারিতা (এফিসিয়েন্সি) ও উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে করে দীর্ঘমেয়াদে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সত্তর ও আশির দশকে যে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল বহু লাতিন আমেরিকান দেশ, তা এই প্রবণতার কারণেই হয়েছিল।
এখনকার লোকরঞ্জনবাদীরা অবশ্য হঠকারী সম্প্রসারণমূলক ব্যাষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালার কথা বলছে না। কিন্তু তারা এরপরও আর্থিক উদ্দীপনা ও বাজারের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভর করতে চান। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যদিও আর্থিক শৃঙ্খলার কথা বলে বেড়াচ্ছেন, তবুও উচ্চমাত্রার ব্যয় ও কম রাজস্ব (২০১৭ সালে আর্থিক কর্পোরেশনগুলোকে বিরাট অংকের করমুক্তি দেওয়াই এ জন্য দায়ী) কেন্দ্রীয় বাজেট ঘাটতি ব্যাপকহারে বাড়াচ্ছে। একইভাবে ট্রাম্প সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতিমালারও পক্ষে।
কিন্তু পশ্চিমে লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষতি করে ফেললেও, এবার এশিয়ান ভোটাররা তাদের স্থানীয় লোকরঞ্জনবাদীদের কথায় পটে যেতে শুরু করেছেন। ভারতের নরেন্দ্র মোদি, ইন্দোনেশিয়ার জোকো উইডোডো ও ফিলিপাইনের রড্রিগো দুতের্তের উত্থান তারই প্রতিফলন।
এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, লোকরঞ্জনবাদ এশিয়ায় কোনো নতুন কিছু নয়। ফিলিপাইনে ১৯৯৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জোসেফ এসত্রাডা জিতেছিলেন নিজেকে গরিবের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। নিজের এই ভাবমূর্তি তিনি গড়েছিলেন অভিনেতা থাকাকালে নিন্মবিত্তের মানুষের পক্ষের নায়ক হিসেবে অভিনয় করে। জোসেফ এসট্রাডা যদিও ব্যাপকহারে দারিদ্র্য-হ্রাসকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন, এগুলোর বাস্তব প্রভাব পড়েছে সামান্যই।
ঠিক একইভাবে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ মুঘল থাকসিন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি দরিদ্র অবস্থা থেকে নিজ চেষ্টায় ধনী হয়েছিলেন। খুব সতর্কভাবেই তিনি ‘জনতা,’ বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র্য মানুষের একজন হিসেবে নিজের ইমেজ দাঁড় করান। ক্ষমতায় এসে তিনিও দরিদ্র মানুষের জন্য বহু নীতি প্রণয়ন করেন। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা এর অন্যতম। কিন্তু এর নকশা ত্রুটির কারণে ঘাটতি বাড়তে থাকে, সেবার মান কমতে থাকে। পরে অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৬ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী। কিন্তু তারপরও তিনি থাইল্যান্ডের দরিদ্রদের কাছে এখনও বেশ জনপ্রিয়।
বর্তমানে এশিয়ার লোকরঞ্জনবাদীদের সমর্থন বৃদ্ধির কারণ মূলত সাংস্কৃতিক ক্ষোভ। যেমনটা ড্যানি রড্রিক পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঞ্চলে নগরায়ন ও উত্তর-বস্তুবাদের (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য) মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রবণতার কারণে তুলনামুলকভাবে বয়সী ও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল লোকজনের মনে হচ্ছে তারা নিজের দেশেই পরবাসী।
এই অনুভূতিই লোকরঞ্জনবাদীদের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করে। তাদের কাছে, জনতা মানে হলো স্থানীয় সম্প্রদায়, যাদেরকে কিনা অভিবাসী, অপরাধী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও উদারপন্থী অভিজাতদের কাছ থেকে রক্ষা করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। ধর্মীয় ঐতিহ্যবাদ, আইন-শৃঙ্খলা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের মতো ধারণা ট্রাম্পের অভিবাসন দমনপীড়নের মতো বৈষম্যবাদী নীতির পক্ষে অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই সাংস্কৃতিক লোকরঞ্জনবাদই মূলত এশিয়ায় শিকড় গাঁড়ছে। দুতের্তে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছেন অপরাধীদেরকে জনগণের শত্রু হিসেবে উপস্থাপিত করে। আর শত্রুদেরকে তো নির্মূল করতেই হবে। সুতরাং, সন্দেহভাজন মাদক ব্যবহারকারী বা ডিলারকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করলেই (প্রায় ৫ হাজার জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন) কেবল আইন-শৃঙ্খলা শক্তিশালী হবে। ওদিকে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদ এই বসন্তে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে, অথচ তার সরকার আগের মেয়াদে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এশিয়ায়ও এসেছে পপুলিস্ট স্রোত। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইনকে ২০১৭ সালে ভোটাররা নির্বাচিত করেছে, যারা কিনা ব্যবসায়ী অভিজাত/এলিটদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগসাজশ ও মানুষের চাহিদা পূরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। মুন জায়ে-ইনের প্রশাসনও জনতোষণবাদী অর্থনৈতিক নীতিমালা হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে, ব্যাপকহারে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও সামাজিক কল্যাণ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করেছে।
এশিয়ান ব্যারোমিটার সার্ভে নামক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো হংকং ও তাইওয়ানের নাগরিকরাও ব্যাপক রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এছাড়া অর্থনৈতিক অসমতা নিয়েও হতাশা কাজ করে তাদের মধ্যে। ফলে এসব অঞ্চলে জনতোষণবাদের উত্থান হওয়ার ব্যাপক অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
জনতোষণবাদের এই ঝুঁকি হ্রাস করতে হলে, দায়িত্ববান এশিয়ান নেতাদেরকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে জনতোষণবাদীদের শোচনীয় অতীত রেকর্ড সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকরঞ্জনবাদীদের পালে হাওয়া দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আর তা করা সম্ভব কেবল অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে। কেবলমাত্র জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষোভের দিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নজর দেওয়ার মাধ্যমেই এশিয়ার নেতারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও সাংস্কৃতিক অনিরাপত্তাবোধের অপব্যবহার হওয়ার কবল থেকে জনগণকে বাঁচাতে পারবেন।
[লি জং-হা কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়াটিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট লি মুং-বাক-এর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন। এই নিবন্ধটি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত।]
লোকরঞ্জনবাদের সোজাসাপ্টা কোনো সংজ্ঞা নেই। এটি হতে পারে আদর্শিক কিংবা অর্থনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক। ডানপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি যেমন লোকরঞ্জনবাদী বলে অভিহিত হতে পারে, তেমনি পারে বামপন্থি মতামতও। এক্ষেত্রে বিষয়টির ব্যাখ্যা করা হয় নির্দিষ্ট কোনো দেশের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে।
তবে লোকরঞ্জনবাদের কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন, লোকরঞ্জনবাদী দলগুলোর নেতৃত্বে সাধারণত থাকেন কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা।
এই নেতা ‘দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট বা অভিজাত সম্প্রদায়’ ও ‘বহিরাগতদের’কে ‘জনতা’র মুখোমুখি দাঁড় করান। বিষয়টা যেন এমন যে, ‘জনতা’র প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন কেবল ওই ব্যক্তি বা তার দল। এই কৌশল সবচেয়ে কার্যকর হয় যখন কিনা জনগণ প্রতিষ্ঠিত নেতা বা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বা সামাজিক অসমতা, অনিরাপত্তাবোধ বা প্রকাশ্য দুর্নীতি এই হতাশা সৃষ্টির কারণ।
তবে দেখা যায়, ক্ষমতায় আসলে এই জনতোষণবাদীরা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যায়। তারা প্রথমেই প্রতিনিধিত্বকারী গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাটো বা অগ্রাহ্য করে। বিশেষ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার বা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ঠেকাতে ভারসাম্যের ব্যবস্থাও (চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স) তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। তারা দাবি করে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই তারা ‘জনতা’র সেবা করতে পারছে না।
লাতিন আমেরিকায় বলিভিয়ার ইভো মোরালেস, কলম্বিয়ার আলভারো উরিব ও ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ গণভোট আয়োজন করে বড় ধরণের সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেছেন, যার দরুণ বস্তুত তাদের নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ বেড়েছে কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসবের ফলে আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক মানের অধঃপতন হয়েছে।
লোকরঞ্জনবাদীদের অর্থনৈতিক রেকর্ডও বেশ নাজুক। অর্থনীতিবিদ রুডি ডর্নবাসচ ও সেবাস্তিয়ান এডওয়ার্ডসের মতে, একটি জনতোষণবাদী পলিসি বা নীতিতে প্রবৃদ্ধি ও আয় বিন্যাসের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি, বহিঃসীমাবদ্ধতা, আক্রমণাত্মক বাজারবিরোধী নীতিমালার প্রতিক্রিয়ার কথা এতে ভাবা হয় না। ফলে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক কার্যকারিতা (এফিসিয়েন্সি) ও উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে করে দীর্ঘমেয়াদে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সত্তর ও আশির দশকে যে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল বহু লাতিন আমেরিকান দেশ, তা এই প্রবণতার কারণেই হয়েছিল।
এখনকার লোকরঞ্জনবাদীরা অবশ্য হঠকারী সম্প্রসারণমূলক ব্যাষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালার কথা বলছে না। কিন্তু তারা এরপরও আর্থিক উদ্দীপনা ও বাজারের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভর করতে চান। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যদিও আর্থিক শৃঙ্খলার কথা বলে বেড়াচ্ছেন, তবুও উচ্চমাত্রার ব্যয় ও কম রাজস্ব (২০১৭ সালে আর্থিক কর্পোরেশনগুলোকে বিরাট অংকের করমুক্তি দেওয়াই এ জন্য দায়ী) কেন্দ্রীয় বাজেট ঘাটতি ব্যাপকহারে বাড়াচ্ছে। একইভাবে ট্রাম্প সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতিমালারও পক্ষে।
কিন্তু পশ্চিমে লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষতি করে ফেললেও, এবার এশিয়ান ভোটাররা তাদের স্থানীয় লোকরঞ্জনবাদীদের কথায় পটে যেতে শুরু করেছেন। ভারতের নরেন্দ্র মোদি, ইন্দোনেশিয়ার জোকো উইডোডো ও ফিলিপাইনের রড্রিগো দুতের্তের উত্থান তারই প্রতিফলন।
এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, লোকরঞ্জনবাদ এশিয়ায় কোনো নতুন কিছু নয়। ফিলিপাইনে ১৯৯৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জোসেফ এসত্রাডা জিতেছিলেন নিজেকে গরিবের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। নিজের এই ভাবমূর্তি তিনি গড়েছিলেন অভিনেতা থাকাকালে নিন্মবিত্তের মানুষের পক্ষের নায়ক হিসেবে অভিনয় করে। জোসেফ এসট্রাডা যদিও ব্যাপকহারে দারিদ্র্য-হ্রাসকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন, এগুলোর বাস্তব প্রভাব পড়েছে সামান্যই।
ঠিক একইভাবে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ মুঘল থাকসিন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি দরিদ্র অবস্থা থেকে নিজ চেষ্টায় ধনী হয়েছিলেন। খুব সতর্কভাবেই তিনি ‘জনতা,’ বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র্য মানুষের একজন হিসেবে নিজের ইমেজ দাঁড় করান। ক্ষমতায় এসে তিনিও দরিদ্র মানুষের জন্য বহু নীতি প্রণয়ন করেন। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা এর অন্যতম। কিন্তু এর নকশা ত্রুটির কারণে ঘাটতি বাড়তে থাকে, সেবার মান কমতে থাকে। পরে অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৬ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী। কিন্তু তারপরও তিনি থাইল্যান্ডের দরিদ্রদের কাছে এখনও বেশ জনপ্রিয়।
বর্তমানে এশিয়ার লোকরঞ্জনবাদীদের সমর্থন বৃদ্ধির কারণ মূলত সাংস্কৃতিক ক্ষোভ। যেমনটা ড্যানি রড্রিক পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঞ্চলে নগরায়ন ও উত্তর-বস্তুবাদের (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য) মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রবণতার কারণে তুলনামুলকভাবে বয়সী ও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল লোকজনের মনে হচ্ছে তারা নিজের দেশেই পরবাসী।
এই অনুভূতিই লোকরঞ্জনবাদীদের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করে। তাদের কাছে, জনতা মানে হলো স্থানীয় সম্প্রদায়, যাদেরকে কিনা অভিবাসী, অপরাধী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও উদারপন্থী অভিজাতদের কাছ থেকে রক্ষা করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। ধর্মীয় ঐতিহ্যবাদ, আইন-শৃঙ্খলা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের মতো ধারণা ট্রাম্পের অভিবাসন দমনপীড়নের মতো বৈষম্যবাদী নীতির পক্ষে অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই সাংস্কৃতিক লোকরঞ্জনবাদই মূলত এশিয়ায় শিকড় গাঁড়ছে। দুতের্তে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছেন অপরাধীদেরকে জনগণের শত্রু হিসেবে উপস্থাপিত করে। আর শত্রুদেরকে তো নির্মূল করতেই হবে। সুতরাং, সন্দেহভাজন মাদক ব্যবহারকারী বা ডিলারকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করলেই (প্রায় ৫ হাজার জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন) কেবল আইন-শৃঙ্খলা শক্তিশালী হবে। ওদিকে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদ এই বসন্তে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে, অথচ তার সরকার আগের মেয়াদে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এশিয়ায়ও এসেছে পপুলিস্ট স্রোত। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইনকে ২০১৭ সালে ভোটাররা নির্বাচিত করেছে, যারা কিনা ব্যবসায়ী অভিজাত/এলিটদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগসাজশ ও মানুষের চাহিদা পূরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। মুন জায়ে-ইনের প্রশাসনও জনতোষণবাদী অর্থনৈতিক নীতিমালা হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে, ব্যাপকহারে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও সামাজিক কল্যাণ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করেছে।
এশিয়ান ব্যারোমিটার সার্ভে নামক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো হংকং ও তাইওয়ানের নাগরিকরাও ব্যাপক রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এছাড়া অর্থনৈতিক অসমতা নিয়েও হতাশা কাজ করে তাদের মধ্যে। ফলে এসব অঞ্চলে জনতোষণবাদের উত্থান হওয়ার ব্যাপক অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
জনতোষণবাদের এই ঝুঁকি হ্রাস করতে হলে, দায়িত্ববান এশিয়ান নেতাদেরকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে জনতোষণবাদীদের শোচনীয় অতীত রেকর্ড সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকরঞ্জনবাদীদের পালে হাওয়া দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আর তা করা সম্ভব কেবল অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে। কেবলমাত্র জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষোভের দিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নজর দেওয়ার মাধ্যমেই এশিয়ার নেতারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও সাংস্কৃতিক অনিরাপত্তাবোধের অপব্যবহার হওয়ার কবল থেকে জনগণকে বাঁচাতে পারবেন।
[লি জং-হা কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়াটিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট লি মুং-বাক-এর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন। এই নিবন্ধটি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত।]
No comments