প্রত্যাবাসনে ভীত রোহিঙ্গারা
প্রত্যাবাসনে
ভীত রোহিঙ্গারা। তারা বলছেন, এখনও রাখাইনে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এ
অবস্থায় ফিরে গেলে ফের নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার হওয়ার শঙ্কাও তাড়া করছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এবং দ্য স্টার অনলাইনে ভীত
রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক রিপোর্টে এমন করুণ আর্তনাদই ফুটে উঠেছে। বলা
হয়েছে, প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম ওঠা রোহিঙ্গারা এতটাই ভীতির মধ্যে রয়েছেন
যে তাদের অনেকেই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ৫৮ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ ওই
তালিকায় নাম ওঠার খবরে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন বলেও জানানো হয়েছে।
কিন্তু স্থানীয় সূত্রগুলো রোহিঙ্গাদের নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেয়া এবং মৃত্যুর
খবরটি নিশ্চিত করেনি। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সরকারের
দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও এমন তথ্য পাওয়ার কথা স্বীকার করেনি।
তবে তারা খোঁজ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন। “রোহিঙ্গাস ফিয়ারস গ্রো এজ রিফিউজিস ফেস ফোরসিবলি রিটার্ন টু মিয়ানমার” শিরোনামে রিপোর্ট করেছে গার্ডিয়ান। যার উপ-শিরোনাম ছিল “এইড এজেন্সিস গিভ ওয়ার্নিং এজ মিয়ানমার অ্যান্ড বাংলাদেশ বিগিন রিটার্ন অব ‘টেরিফাইড’ রিফিউজিস টু রাখাইন স্টেট”। রিপোর্টের সূচনাতে বলা হয়েছেÑ জাতিসংঘের আপত্তি এবং রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার হাজারও রোহিঙ্গাকে এই সপ্তাহে রাখাইনে ফেরাতে পরিকল্পনা নিয়েছে। ওই প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতির জন্ম দিয়েছে। বাস্তুচ্যুতদের মতামত ব্যতিরেকে গত সপ্তাহে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনাটি নেয়া হয়। এ খবর কক্সবাজারস্থ ক্যাম্পগুলোতে পৌঁছালে আতঙ্ক তৈরি হয়। প্রথম ব্যাচ বৃহস্পতিবারই যাচ্ছে বলেও জানানো হয়। কিন্তু তখনও তালিকায় থাকা অনেক রোহিঙ্গারাই তাদের ‘নাম থাকার’ বিষয়টি জানে না। তাদের কাছে এটি খুবই অস্পষ্ট যে তালিকাটি কীভাবে তৈরি করা হয়েছে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে মুহাম্মদ আয়াজ নামে একজনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, আয়াজ বলেছেন, ‘জোরপূর্বক’ প্রত্যাবাসন নিয়ে কয়েক দিনের দুশ্চিন্তা এবং নিন্দ্রাহীনতায় কাটানোর পর গত সপ্তাহে তার বাবা মুহাম্মদ শাকের (৫৮) হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও বাবা আমাকে বলছিলেন তোমার ভাই-বোনদের লুকিয়ে ফেল। তাদের ফেরত পাঠানো থেকে বাঁচাও। তোমরা মিয়ানমারে ফিরো না। যদি যাও সেখানে তোমাদের আবারও সহিংসতার মুখে পড়তে হবে।’ গার্ডিয়ানের রিপোর্টে যে পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়Ñ গত বছরের আগস্টের পর মিয়ানমারের আর্মি এবং মুসলিম বিদ্বেষী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু লোক মিলে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচারের প্রেক্ষিতেই প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্মীদের ওই বর্বরতাকে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গণহত্যা বলে আখ্যা দিয়েছে। সেখানে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার তথ্য পেয়েছে তারা। ইনভেস্টিগেশন টিম বহু নারীকে গণ ধর্ষণ এবং নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতনের প্রমাণও পেয়েছে। স্থানীয় সূত্রের বরাতে গার্ডিয়ান তাদের রিপোর্টে জানিয়েছেÑ কক্সবাজারে থাকা বাস্তুচ্যুতরা তাদের ওপর বয়ে যাওয়া অত্যাচারের মতই এখন ফের আতঙ্কে ভুগছেন। উনচিপাড়াং ক্যাম্পের দু’জন বাস্তুচ্যুত এ খবরে অত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন জানিয়ে প্রতিবেশীদের বরাতে রিপোর্টে বলা হয়Ñ ষাট বছর বয়সী দিল মোহাম্মদ এবং এবং পঞ্চান্ন বছর বয়সী হামিদ হোসাইন তালিকায় নিজের নাম থাকার খবরে এবং তাদের রাখাইনে যেতে হবে এমনটা জানার পর এতটা শংকিত হয়ে পড়েন যে তারা নিজেদের জীবন নিজেরাই শেষ করে দিতে উদ্ধত হয়েছিলেন। জামতলী রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা মুহাম্মদ ইসমাঈল, তার স্ত্রী ও ৬ সন্তানের নাম প্রত্যাবাসন তালিকায় রয়েছে। তিনি বলছিলেন তার কাছাকাছি থাকা আরো ১৩টি পরিবারের নাম রয়েছে প্রত্যাবাসন তালিকায়। কিন্তু তার মতো কেউই জানেন না কীভাবে তালিকায় স্থান পেলেন। তারা কেউই ফিরতে চান না জানিয়ে ইসমাঈল বলেন, আমি খুবই বিভ্রান্তি এবং ভয়ের মধ্যে আছি। আমরা এটাও জানি না আমাদের জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে? প্রত্যাবাসনের লিজিস্টিক বা প্রস্তুতির বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট উল্লেখ করে রিপোর্টে রাখাইন রাজ্যের মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রভাবশালী সদস্য অং শেরিংকে উদ্ধৃত করে বলা হয়Ñ তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের অনুমোদন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম গ্রুপে ২০০০ রোহিঙ্গা ফিরবেন। প্রতিদিন ১৫০ জনকে স্থল পথে বা নৌকায় ফেরানো হবে। সীমান্তের হ্লা ফোন কাউং ট্রানজিট ক্যাম্প হয়ে তারা ফিরবেন। প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ওই ক্যাম্পে তাদের থাকতে হবে, নিজ গ্রামের পুনর্বাসনের আগ পর্যন্ত। এসব কারণেও বাস্তচ্যুত পরিবারগুলো দ্বিধা ও ভয়ের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়Ñ রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যাদের জমিজমা ছিল তা স্থানীয় বোদ্ধারা নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় তারা কিভাবে নিজেদের গ্রামে ফিরবে এবং সেখানে কিভাবে বসবাস করবে তা নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়- নতুন করে কিছু মডেল গ্রাম বানানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার সীমিত। ফলে রোহিঙ্গারা কোথায় কি অবস্থায় ফিরবে তা এখনও অস্পষ্ট। তা ছাড়া সেখানে রাখাইনে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের গভীর বৈরী আচরণের বিষয়টিও রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়Ñ যদিও বাংলাদেশের তরফে বলা হয়েছে প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়। কিন্তু প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা অনেক রোহিঙ্গাকে জোর করার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাদেরকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে, এই মাসের যেকোনো সময় আপনারা কল পাবেন এবং আপনাদের সীমান্তের ওপারে যেতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ার অভিযোগও করছে রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় ইউএন্এইচসি আর বলছে তারা প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো যানবাহন বা কোনো ধরনের সুবিধা দেবে না। তারা মনে করে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইন এখনও উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যেটা তাদের অধিকার সেটি এখনও নিশ্চিত হয়নি। ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র ক্যারোলিন গ্লাককে উদ্ধৃত করে বলা হয়Ñ তিনি বলেছেন, এটা অস্পষ্ট যে, যারা ফেরত যাবেন তাদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে। তবে ইউএনএইচসিআর এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, তাদেরকে যদি ক্যাম্পে রাখা হয়, তাহলে তারা কোনো সহায়তা পাবে না। রিপোর্ট বলছে, চটজলদি ওই প্রত্যাবাসনের অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক চাপ। বাংলাদেশে ডিসেম্বরে নির্বাচন। প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার কক্সবাজারে থাকাটা একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যু। চীন বলছে, তারা মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে যাবে প্রত্যাবাসনটি শুরু করার জন্য। তারা এরই মধ্যে প্রত্যাবাসীদের জন্য রাখাইনে প্রায় ১ হাজার বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ৪২টি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার যৌথ বিবৃতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছেÑ তারা সবাই বলছে, এখনই প্রত্যাবাসন হবে অপরিপক্ব এবং বিপজ্জনক। তাদের সঙ্গে অভিন্ন সুরেই জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লি সার্বিক বিবেচনায় প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আতঙ্কে ঘুম ও নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা
এদিকে রয়টার্সের বরাতে মালয়েশিয়ান সংবাদ মাধ্যম স্টার অনলাইন একটি রিপোর্ট করেছে। ‘কান্ট ইট, কান্ট সিøপ: রোহিঙ্গা অন মিয়ানমার রিপার্টরিয়েশন লিস্ট’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যা¤েপ বসবাসরত নুরুল আমিন প্রত্যাবাসনের কথা শোনার পর থেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। একই অবস্থা তার চার সন্তান, স্ত্রী এবং বোনের। তিনি বলেন, যখন থেকে শুনেছি মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে, তখন থেকে রাতে ঘুমাতে পারি না। আর ফিরে যাবার তালিকায় আমার নাম রয়েছে, একথা শোনার পর থেকে আমি খেতেও পারছি না। মিয়ানমারে প্রথম ব্যাচের প্রত্যাবাসন তালিকায় দুই হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তাদের কেউই মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয় জানিয়ে সংবাদ সংস্থাটি বলছে, যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার বিষয়ে তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করেন না। অনেকে আবার নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দিয়ে নিজ গ্রামে পাঠানো উচিত বলে মত দিয়েছেন। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, জোরপূর্বক কাউকে ফেরত পাঠানো হবে না। কিন্তু তাদের মতামত ছাড়াই প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম তোলা হয়েছে জানিয়ে একজন বলেন, এটিই তাদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ওই তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং তালিকাটি পুনর্নিরীক্ষণ করেছে মিয়ানমার। আব্দুর রহিম নামের আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন, আমাকে যাবার জন্য জোর করা হলে আমি বিষ খাবো। আমার চোখের সামনে আমার ভাইকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। দেশে ফিরে আবারো একই অবস্থা হবে না এর নিশ্চয়তা কী? নূর কাইদা নামের ২৫ বছর বয়সী এক নারীর মন্তব্য ছিল এমন দেশে ফিরে ধর্ষণের শিকার হবার চেয়ে ক্যা¤েপ মারা যাওয়াও অনেক ভালো। প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্যা¤প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যেসব রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে তাদের তালিকা ও নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। কেননা এতে পুরো ক্যা¤েপ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ যেসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য তালিকা তৈরি করেছে তাদের কাউকেই জোরপূর্বক পাঠানো হচ্ছে না। প্রত্যাবাসনের জন্য অনুপ্রাণিত করার চেষ্টায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।
তবে তারা খোঁজ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন। “রোহিঙ্গাস ফিয়ারস গ্রো এজ রিফিউজিস ফেস ফোরসিবলি রিটার্ন টু মিয়ানমার” শিরোনামে রিপোর্ট করেছে গার্ডিয়ান। যার উপ-শিরোনাম ছিল “এইড এজেন্সিস গিভ ওয়ার্নিং এজ মিয়ানমার অ্যান্ড বাংলাদেশ বিগিন রিটার্ন অব ‘টেরিফাইড’ রিফিউজিস টু রাখাইন স্টেট”। রিপোর্টের সূচনাতে বলা হয়েছেÑ জাতিসংঘের আপত্তি এবং রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার হাজারও রোহিঙ্গাকে এই সপ্তাহে রাখাইনে ফেরাতে পরিকল্পনা নিয়েছে। ওই প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতির জন্ম দিয়েছে। বাস্তুচ্যুতদের মতামত ব্যতিরেকে গত সপ্তাহে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনাটি নেয়া হয়। এ খবর কক্সবাজারস্থ ক্যাম্পগুলোতে পৌঁছালে আতঙ্ক তৈরি হয়। প্রথম ব্যাচ বৃহস্পতিবারই যাচ্ছে বলেও জানানো হয়। কিন্তু তখনও তালিকায় থাকা অনেক রোহিঙ্গারাই তাদের ‘নাম থাকার’ বিষয়টি জানে না। তাদের কাছে এটি খুবই অস্পষ্ট যে তালিকাটি কীভাবে তৈরি করা হয়েছে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে মুহাম্মদ আয়াজ নামে একজনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, আয়াজ বলেছেন, ‘জোরপূর্বক’ প্রত্যাবাসন নিয়ে কয়েক দিনের দুশ্চিন্তা এবং নিন্দ্রাহীনতায় কাটানোর পর গত সপ্তাহে তার বাবা মুহাম্মদ শাকের (৫৮) হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও বাবা আমাকে বলছিলেন তোমার ভাই-বোনদের লুকিয়ে ফেল। তাদের ফেরত পাঠানো থেকে বাঁচাও। তোমরা মিয়ানমারে ফিরো না। যদি যাও সেখানে তোমাদের আবারও সহিংসতার মুখে পড়তে হবে।’ গার্ডিয়ানের রিপোর্টে যে পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়Ñ গত বছরের আগস্টের পর মিয়ানমারের আর্মি এবং মুসলিম বিদ্বেষী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু লোক মিলে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচারের প্রেক্ষিতেই প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্মীদের ওই বর্বরতাকে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গণহত্যা বলে আখ্যা দিয়েছে। সেখানে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার তথ্য পেয়েছে তারা। ইনভেস্টিগেশন টিম বহু নারীকে গণ ধর্ষণ এবং নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতনের প্রমাণও পেয়েছে। স্থানীয় সূত্রের বরাতে গার্ডিয়ান তাদের রিপোর্টে জানিয়েছেÑ কক্সবাজারে থাকা বাস্তুচ্যুতরা তাদের ওপর বয়ে যাওয়া অত্যাচারের মতই এখন ফের আতঙ্কে ভুগছেন। উনচিপাড়াং ক্যাম্পের দু’জন বাস্তুচ্যুত এ খবরে অত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন জানিয়ে প্রতিবেশীদের বরাতে রিপোর্টে বলা হয়Ñ ষাট বছর বয়সী দিল মোহাম্মদ এবং এবং পঞ্চান্ন বছর বয়সী হামিদ হোসাইন তালিকায় নিজের নাম থাকার খবরে এবং তাদের রাখাইনে যেতে হবে এমনটা জানার পর এতটা শংকিত হয়ে পড়েন যে তারা নিজেদের জীবন নিজেরাই শেষ করে দিতে উদ্ধত হয়েছিলেন। জামতলী রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা মুহাম্মদ ইসমাঈল, তার স্ত্রী ও ৬ সন্তানের নাম প্রত্যাবাসন তালিকায় রয়েছে। তিনি বলছিলেন তার কাছাকাছি থাকা আরো ১৩টি পরিবারের নাম রয়েছে প্রত্যাবাসন তালিকায়। কিন্তু তার মতো কেউই জানেন না কীভাবে তালিকায় স্থান পেলেন। তারা কেউই ফিরতে চান না জানিয়ে ইসমাঈল বলেন, আমি খুবই বিভ্রান্তি এবং ভয়ের মধ্যে আছি। আমরা এটাও জানি না আমাদের জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে? প্রত্যাবাসনের লিজিস্টিক বা প্রস্তুতির বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট উল্লেখ করে রিপোর্টে রাখাইন রাজ্যের মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রভাবশালী সদস্য অং শেরিংকে উদ্ধৃত করে বলা হয়Ñ তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের অনুমোদন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম গ্রুপে ২০০০ রোহিঙ্গা ফিরবেন। প্রতিদিন ১৫০ জনকে স্থল পথে বা নৌকায় ফেরানো হবে। সীমান্তের হ্লা ফোন কাউং ট্রানজিট ক্যাম্প হয়ে তারা ফিরবেন। প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ওই ক্যাম্পে তাদের থাকতে হবে, নিজ গ্রামের পুনর্বাসনের আগ পর্যন্ত। এসব কারণেও বাস্তচ্যুত পরিবারগুলো দ্বিধা ও ভয়ের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়Ñ রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যাদের জমিজমা ছিল তা স্থানীয় বোদ্ধারা নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় তারা কিভাবে নিজেদের গ্রামে ফিরবে এবং সেখানে কিভাবে বসবাস করবে তা নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়- নতুন করে কিছু মডেল গ্রাম বানানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার সীমিত। ফলে রোহিঙ্গারা কোথায় কি অবস্থায় ফিরবে তা এখনও অস্পষ্ট। তা ছাড়া সেখানে রাখাইনে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের গভীর বৈরী আচরণের বিষয়টিও রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়Ñ যদিও বাংলাদেশের তরফে বলা হয়েছে প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়। কিন্তু প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা অনেক রোহিঙ্গাকে জোর করার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাদেরকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে, এই মাসের যেকোনো সময় আপনারা কল পাবেন এবং আপনাদের সীমান্তের ওপারে যেতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ার অভিযোগও করছে রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় ইউএন্এইচসি আর বলছে তারা প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো যানবাহন বা কোনো ধরনের সুবিধা দেবে না। তারা মনে করে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইন এখনও উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যেটা তাদের অধিকার সেটি এখনও নিশ্চিত হয়নি। ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র ক্যারোলিন গ্লাককে উদ্ধৃত করে বলা হয়Ñ তিনি বলেছেন, এটা অস্পষ্ট যে, যারা ফেরত যাবেন তাদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে। তবে ইউএনএইচসিআর এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, তাদেরকে যদি ক্যাম্পে রাখা হয়, তাহলে তারা কোনো সহায়তা পাবে না। রিপোর্ট বলছে, চটজলদি ওই প্রত্যাবাসনের অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক চাপ। বাংলাদেশে ডিসেম্বরে নির্বাচন। প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার কক্সবাজারে থাকাটা একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যু। চীন বলছে, তারা মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে যাবে প্রত্যাবাসনটি শুরু করার জন্য। তারা এরই মধ্যে প্রত্যাবাসীদের জন্য রাখাইনে প্রায় ১ হাজার বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ৪২টি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার যৌথ বিবৃতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছেÑ তারা সবাই বলছে, এখনই প্রত্যাবাসন হবে অপরিপক্ব এবং বিপজ্জনক। তাদের সঙ্গে অভিন্ন সুরেই জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লি সার্বিক বিবেচনায় প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আতঙ্কে ঘুম ও নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা
এদিকে রয়টার্সের বরাতে মালয়েশিয়ান সংবাদ মাধ্যম স্টার অনলাইন একটি রিপোর্ট করেছে। ‘কান্ট ইট, কান্ট সিøপ: রোহিঙ্গা অন মিয়ানমার রিপার্টরিয়েশন লিস্ট’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যা¤েপ বসবাসরত নুরুল আমিন প্রত্যাবাসনের কথা শোনার পর থেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। একই অবস্থা তার চার সন্তান, স্ত্রী এবং বোনের। তিনি বলেন, যখন থেকে শুনেছি মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে, তখন থেকে রাতে ঘুমাতে পারি না। আর ফিরে যাবার তালিকায় আমার নাম রয়েছে, একথা শোনার পর থেকে আমি খেতেও পারছি না। মিয়ানমারে প্রথম ব্যাচের প্রত্যাবাসন তালিকায় দুই হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তাদের কেউই মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয় জানিয়ে সংবাদ সংস্থাটি বলছে, যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার বিষয়ে তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করেন না। অনেকে আবার নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দিয়ে নিজ গ্রামে পাঠানো উচিত বলে মত দিয়েছেন। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, জোরপূর্বক কাউকে ফেরত পাঠানো হবে না। কিন্তু তাদের মতামত ছাড়াই প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম তোলা হয়েছে জানিয়ে একজন বলেন, এটিই তাদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ওই তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং তালিকাটি পুনর্নিরীক্ষণ করেছে মিয়ানমার। আব্দুর রহিম নামের আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন, আমাকে যাবার জন্য জোর করা হলে আমি বিষ খাবো। আমার চোখের সামনে আমার ভাইকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। দেশে ফিরে আবারো একই অবস্থা হবে না এর নিশ্চয়তা কী? নূর কাইদা নামের ২৫ বছর বয়সী এক নারীর মন্তব্য ছিল এমন দেশে ফিরে ধর্ষণের শিকার হবার চেয়ে ক্যা¤েপ মারা যাওয়াও অনেক ভালো। প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্যা¤প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যেসব রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে তাদের তালিকা ও নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। কেননা এতে পুরো ক্যা¤েপ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ যেসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য তালিকা তৈরি করেছে তাদের কাউকেই জোরপূর্বক পাঠানো হচ্ছে না। প্রত্যাবাসনের জন্য অনুপ্রাণিত করার চেষ্টায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে।
No comments