দেশে ৭১ লাখ লোক ডায়াবেটিস আক্রান্ত বছরে চিকিৎসায় খরচ ১৭ হাজার কোটি by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
ডায়াবেটিসের
চিকিৎসার জন্য একজন রোগীকে মাসিক প্রায় ২,০০০ টাকা খরচ করতে হয় বলে
বাংলাদেশে ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে
ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ
ইনসুলিন নেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটোই প্রয়োজন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক
এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং চিকিৎসক অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব
বলেছেন, ডায়াবেটিস রোগীকে সচেতন হতে হবে। হাঁটা-চলা, খাদ্যাভাসের মাধ্যমে
নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সকল ডায়াবেটিস রোগীকে ট্যাবলেট খেতেই হয়। কিছু রোগী
ইনসুলিন ব্যবহার করেন। ইনসুলিনের দাম বেশি হওয়ায় ওষুধ ব্যবসায়ীরা এটি
বিক্রি করার জন্য বেশি ঘুরেন।
এতে খরচ বেড়ে যায়। রোগীর খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, আর্থিক বিশ্লেষণে এটা এসেছে ।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন-আইডিএফ-এর মতে, বাংলাদেশে মোট ৭১ লাখ শনাক্তকৃত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর গড় খরচ ২,০০০ টাকা। সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে খরচ হচ্ছে ১৪ শত ২০ কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সচেতনতার মাধ্যমে যদি ডায়াবেটিসের বিস্তার কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ রোগের জন্য আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে।
সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিত ব্যায়াম করেন চাকরিজীবী মো. কামরুল ইসলাম। গত দুই বছর আগে তার ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনেছেন। শুধু কামরুল ইসলাম নন, বাংলাদেশে দিন দিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস এখন মহামারি হয়ে উঠছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন-আইডিএফ-এর মতে, বাংলাদেশে মোট ৭১ লাখ শনাক্তকৃত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। এ ছাড়া আরো প্রায় ৭১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে বসবাস করেন। সংস্থাটি ২০১৫ সালে এই প্রতিবেদন দিয়েছিল। বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের অর্ধেকই জানেন না তারা এতে আক্রান্ত। ফলে তারা থাকছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে। বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪১ কোটির উপরে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ৬৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব বয়সের মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছরই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে নতুন নতুন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা।
সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দশমে। নানা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরও ডায়াবেটিস রোগীর মাত্র ২৫ ভাগকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, স্বাস্থ্যশিক্ষাই যার প্রধান চিকিৎসা। যথাযথ স্বাস্থ্যশিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে ডায়াবেটিস রোগীর বৃদ্ধির হার বেশি। ডায়াবেটিস সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য মানুষ।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) সূত্র জানায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাডাস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সমপ্রতি বাডাস কর্পোরেটভিত্তিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বল্পমূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়া হবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে-ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা স্লোগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার।
এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ন কর্মসূচির অনুমতি দেয়ার সময় হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে (যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতা করার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বিশ্বেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে শহরে ১০ ভাগ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। অন্যদিকে গ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ ভাগ। আরো ১০ শতাংশ লোক ডায়াবেটিস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বিএসএমএমইউ’র এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে আশির দশকে যেখানে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ শতাংশ, সেখানে এখন গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের সামগ্রিক প্রবণতা ৮ শতাংশের মতো। এভাবে ক্রমশ ডায়াবেটিস বাড়তে থাকলে শুধু ডায়াবেটিসের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য হবে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাছাড়া, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধ হয়ে যাওয়া, পায়ে পচন, এমনকি পা কেটে ফেলা পর্যন্ত লাগতে পারে।
এত বড় বৈশ্বিক এই স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে দরকার জনসচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততা। সময়মতো ইন্টারভেনশন (খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন), নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান তিনি। বাডাস-এর তথ্যমতে, ১০ জনের মধ্যে একজন নারী ডায়াবেটিস আক্রান্ত। বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের পরবর্তী গর্ভধারণের সময়ে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায়। যে সব মহিলার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায় তাদের পরবর্তীকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। যে সব মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল তাদের শিশুদেরও পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এদিকে এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১৪ই নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে জীবনযাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করছে। ডায়াবেটিস যে হারে বাড়ছে তাতে আমাদের এখনই এ রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ, স্বাভাবিক ও কর্মঠ জীবন নিশ্চিত করতে পারে। ডিসিপ্লিন জীবনযাপন করতে হবে। হাঁটতে হবে। ঘন ঘন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। একটি পর্যায়ে পৌঁছলে অনেক জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ডায়াবেটিস। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আরো জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য খাতের মোট বরাদ্দের ১১ শতাংশ খরচ হয় ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার কারণে। ডায়াবেটিস রোগীদের যারা কম নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের খরচ বেশি। আর যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তদের খরচ কম।
এতে খরচ বেড়ে যায়। রোগীর খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, আর্থিক বিশ্লেষণে এটা এসেছে ।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন-আইডিএফ-এর মতে, বাংলাদেশে মোট ৭১ লাখ শনাক্তকৃত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর গড় খরচ ২,০০০ টাকা। সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে খরচ হচ্ছে ১৪ শত ২০ কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সচেতনতার মাধ্যমে যদি ডায়াবেটিসের বিস্তার কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ রোগের জন্য আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে।
সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিত ব্যায়াম করেন চাকরিজীবী মো. কামরুল ইসলাম। গত দুই বছর আগে তার ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনেছেন। শুধু কামরুল ইসলাম নন, বাংলাদেশে দিন দিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস এখন মহামারি হয়ে উঠছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন-আইডিএফ-এর মতে, বাংলাদেশে মোট ৭১ লাখ শনাক্তকৃত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। এ ছাড়া আরো প্রায় ৭১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে বসবাস করেন। সংস্থাটি ২০১৫ সালে এই প্রতিবেদন দিয়েছিল। বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের অর্ধেকই জানেন না তারা এতে আক্রান্ত। ফলে তারা থাকছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে। বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪১ কোটির উপরে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ৬৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব বয়সের মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছরই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে নতুন নতুন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা।
সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দশমে। নানা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরও ডায়াবেটিস রোগীর মাত্র ২৫ ভাগকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, স্বাস্থ্যশিক্ষাই যার প্রধান চিকিৎসা। যথাযথ স্বাস্থ্যশিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে ডায়াবেটিস রোগীর বৃদ্ধির হার বেশি। ডায়াবেটিস সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য মানুষ।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) সূত্র জানায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাডাস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সমপ্রতি বাডাস কর্পোরেটভিত্তিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বল্পমূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়া হবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে-ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা স্লোগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার।
এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ন কর্মসূচির অনুমতি দেয়ার সময় হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে (যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতা করার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বিশ্বেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে শহরে ১০ ভাগ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। অন্যদিকে গ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ ভাগ। আরো ১০ শতাংশ লোক ডায়াবেটিস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বিএসএমএমইউ’র এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে আশির দশকে যেখানে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ শতাংশ, সেখানে এখন গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের সামগ্রিক প্রবণতা ৮ শতাংশের মতো। এভাবে ক্রমশ ডায়াবেটিস বাড়তে থাকলে শুধু ডায়াবেটিসের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য হবে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাছাড়া, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধ হয়ে যাওয়া, পায়ে পচন, এমনকি পা কেটে ফেলা পর্যন্ত লাগতে পারে।
এত বড় বৈশ্বিক এই স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে দরকার জনসচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততা। সময়মতো ইন্টারভেনশন (খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন), নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান তিনি। বাডাস-এর তথ্যমতে, ১০ জনের মধ্যে একজন নারী ডায়াবেটিস আক্রান্ত। বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের পরবর্তী গর্ভধারণের সময়ে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায়। যে সব মহিলার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায় তাদের পরবর্তীকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। যে সব মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল তাদের শিশুদেরও পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এদিকে এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১৪ই নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে জীবনযাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করছে। ডায়াবেটিস যে হারে বাড়ছে তাতে আমাদের এখনই এ রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ, স্বাভাবিক ও কর্মঠ জীবন নিশ্চিত করতে পারে। ডিসিপ্লিন জীবনযাপন করতে হবে। হাঁটতে হবে। ঘন ঘন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। একটি পর্যায়ে পৌঁছলে অনেক জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ডায়াবেটিস। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আরো জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য খাতের মোট বরাদ্দের ১১ শতাংশ খরচ হয় ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার কারণে। ডায়াবেটিস রোগীদের যারা কম নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের খরচ বেশি। আর যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তদের খরচ কম।
No comments