শহিদুল আলমকে ভয় পায় কে? -নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধ by গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক
বাংলাদেশের
প্রথিতযশা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে ৫ই আগস্ট তার বাসা থেকে টেনে হিঁচড়ে
নিয়ে যায় ৩০ জনেরও বেশি সাদাপোশাকের পুলিশ। তারা জোর করে রাত সাড়ে দশটার
দিকে তার বাসায় প্রবেশ করে। ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়।
নজরদারি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। তবুও ঘটনার মুহূর্ত সেলফোনে ধারণ করতে সক্ষম
হয় কেউ একজন। সেখানে শহীদুল আলমকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, আমি নির্দোষ।
আমি আইনজীবী চাই।
যাকে আমি ভীষণ অমায়িক ও মেধাবী মানুষ হিসেবে চিনি, সেই শহিদুলকে এভাবে চিৎকার করতে দেখে ভয়াবহ লাগছিল। এখন ঠিক এভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করে ত্রাস।
কয়েক দশক ধরে শহিদুল আলমের কর্মে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ও আশেপাশের অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট। আমার এক বন্ধু সেদিন জানালেন, নিউ ইয়র্ক শহিদুল আলমের আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখার পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মর্মান্তিক কাহিনী সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠার কথা।
আমি প্রথম তার কাজের সঙ্গে পরিচিত হই ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সাইক্লোন আঘাত হানার পর। আমি ত্রাণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ঝড়ের পর আক্রান্ত অঞ্চলে সফরও করি। শহিদুলের ছবিতে যেন আমার অভিজ্ঞতার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছিল। যোগ্যতার কারণেই ২০১৪ সালে শহিদুল আলম বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পেয়েছিলেন শিল্পকলা পদক। দেশের শিল্পীদের জন্য এটি সর্বোচ্চ একটি সম্মাননা।
শহিদুলকে গ্রেপ্তারের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে আল জাজিরায় দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকার। ঢাকায় শিক্ষার্থী বিক্ষোভের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যেই নির্মম নির্যাতন চালায় তা সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলেন তিনি। তিনি সরকারী দুর্নীতি, অপশাসন, ভিন্নমত দমন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমের প্রসঙ্গেও কথা বলেন। অদ্ভুত হলেও, শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার তার বক্তব্যেরই যথার্থতা প্রমাণ করে।
জুলাইয়ের শেষ নাগাদ গতিশীল এক বাসের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় দুই শিক্ষার্থী। এরপর থেকেই স্কুলশিশুসহ হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রতিবাদে নামে রাজপথে। বিক্ষোভ যখন সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে ত্বরান্বিত হয়, তখন সরকার শাসকদলের অনুগতদের লেলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীদের ওপর। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষকরা বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বর্ণনা করেছেন কীভাবে বিক্ষোভকারীরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যদের হাতে আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
পুলিশের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগের অনুগতদের হামলা প্রত্যক্ষ করেছেন যেসব সাংবাদিক তাদের একজন ছিলেন শহিদুল আলম। তিনি বিক্ষোভ ও নির্যাতন দুইই ক্যামেরাবন্দী করেছেন। এই প্রখ্যাত সাংবাদিক নিজেই শুধু আটক হননি। আরও বহু প্রতিবাদকারী গ্রেপ্তার ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতিত হয়েছেন।
অক্টোবর ও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নিজ দেশের গঠনমূলক সমালোচনা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের। হাসিনা সরকার নিশ্চিতভাবেই শহিদুল আলমের মতো গ্রহণযোগ্য ও সম্মানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে ভীষণ ভীত। কারণ, তার সমালোচনা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। তার গ্রেপ্তার ও বন্দিত্ব সমালোচনাপ্রবণ কন্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টার সমতুল্য।
হাসিনা সরকার শুধু একটি গ্রেপ্তারেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করছে তার মানহানি ও সুনাম ক্ষুণœ করার পথ খুঁজে বের করতে। শহিদুলের পার্টনার নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ তাকে কারাগারে দেখে এসেছেন। তখন তিনি বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করেন যে, তাদের কথাবার্তা গোপনে ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করছে কারাগার কর্তৃপক্ষ।
রেহনুমা আহমেদ এক ইমেইল বার্তায় বলেছেন, ‘ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত বন্ধুরা আমাকে বলেছেন যে, তাদেরকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে শহিদুল সম্পর্কে ‘নোংরা কাহিনী’ প্রকাশ করার। তাকে এমনকি শিশু যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে উপস্থাপনেরও কথাবার্তা চলছে। বিষয়টি জঘন্য কারণ শিশুদের প্রতি শহিদুলের ভালোবাসার কথা সকলের জানা।’
এটি বিস্মিত হওয়ার মতো ঘটনা নয়। কারণ, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ক্রমেই কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যেমনটা রিপোর্ট করেছে, গত কয়েক সপ্তাহ বা মাসে শ’ শ’ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা গুম হয়ে গেছে। এদের অনেকের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। মাদকবিরোধী যুদ্ধের নাম শ’ শ’ মানুষকে বিচারবহির্ভূত কায়দায় হত্যা করা হয়েছে।
শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর তাকে ঢাকার একটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কুখ্যাত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ, তিনি অনলাইনে এমন বক্তব্য রেখেছেন যা ‘জাতির ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে’। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, শহিদুল আলম যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা গেছে। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আমার রক্তাক্ত শার্ট ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে। আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে তাদের নির্দেশনা মোতাবেক যদি আমি স্বাক্ষ্য না দিই, তাহলে আমাকে আরও...।’ এরপরের বক্তব্য আর বোঝা যায়নি।
আদালত এক সপ্তাহের জন্য শহিদুলকে পুলিশি হেফাজতে রাখার অনুমতি দেন। এ সময় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাকে হাসপাতালে যাওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়। ১২ই আগস্ট শহিদুল আলমকে ফের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তবে অভিযোগের তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ফের কারাগারে পাঠানো হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি ১৪ বছরের কারাদন্ড পেতে পারেন।
বাংলাদেশীদের মধ্যে এক ধরণের অনুভূতি রয়েছে যে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আর কাজ করে না। পুলিশও সুরক্ষা প্রদান করে না। অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতাও নেই। ফলে সাংবিধানিক শাসনের বিকাশ ও পুনরুদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। যৌন সহিংসতাও চলছে অহরহ। নির্বাচনী প্রক্রিয়া জোরপূর্বক সহিংসতায় নিমজ্জিত। এক ধরণের ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে দেশজুড়ে।
শহিদুল আলম ন্যায়বিচার পাবেন বাংলাদেশে, তেমনটা অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে তার বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘তার মিথ্যা পোস্ট ও অভিযোগের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে পুলিশ ও আমাদের দলীয় কার্যালয়ে আক্রমণ করে। অনেক পুলিশ সদস্য ও আমাদের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন। এদের একজন আরাফাতুল ইসলাম বাপ্পি নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তিনি এখন স্থায়ীভাবে পঙ্গু।’ শহিদুল আলমের সঙ্গে পুলিশ ও আদালত যে ধরণের আচরণ করবে, তার ওপর এই ধরণের বক্তব্যের নিশ্চিত নেতিবাচক প্রভাব থাকতে বাধ্য।
শহিদুল আলমের অধিকার লঙ্ঘণের পাশাপাশি, বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার ভেঙে পড়ার আলামত দৃশ্যমান। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে হাসিনা সরকার বিচারকে কেবল প্রতিশোধ হিসেবে দেখে।
শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও কারাবন্দিত্ব একজন মানুষের ওপর নিষ্ঠুরতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতির ওপর আক্রমণ। বাংলাদেশকে অবশ্যই তাকে ও আটককৃত প্রতিবাদকারীদের মুক্তি দিতে হবে ও অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে।
(গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি সেখানে ইন্সটিটিউট ফর কম্পেয়ারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তার এই নিবন্ধ নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত।)
যাকে আমি ভীষণ অমায়িক ও মেধাবী মানুষ হিসেবে চিনি, সেই শহিদুলকে এভাবে চিৎকার করতে দেখে ভয়াবহ লাগছিল। এখন ঠিক এভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করে ত্রাস।
কয়েক দশক ধরে শহিদুল আলমের কর্মে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ও আশেপাশের অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট। আমার এক বন্ধু সেদিন জানালেন, নিউ ইয়র্ক শহিদুল আলমের আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখার পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মর্মান্তিক কাহিনী সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠার কথা।
আমি প্রথম তার কাজের সঙ্গে পরিচিত হই ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সাইক্লোন আঘাত হানার পর। আমি ত্রাণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ঝড়ের পর আক্রান্ত অঞ্চলে সফরও করি। শহিদুলের ছবিতে যেন আমার অভিজ্ঞতার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছিল। যোগ্যতার কারণেই ২০১৪ সালে শহিদুল আলম বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পেয়েছিলেন শিল্পকলা পদক। দেশের শিল্পীদের জন্য এটি সর্বোচ্চ একটি সম্মাননা।
শহিদুলকে গ্রেপ্তারের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে আল জাজিরায় দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকার। ঢাকায় শিক্ষার্থী বিক্ষোভের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যেই নির্মম নির্যাতন চালায় তা সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলেন তিনি। তিনি সরকারী দুর্নীতি, অপশাসন, ভিন্নমত দমন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমের প্রসঙ্গেও কথা বলেন। অদ্ভুত হলেও, শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার তার বক্তব্যেরই যথার্থতা প্রমাণ করে।
জুলাইয়ের শেষ নাগাদ গতিশীল এক বাসের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় দুই শিক্ষার্থী। এরপর থেকেই স্কুলশিশুসহ হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রতিবাদে নামে রাজপথে। বিক্ষোভ যখন সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে ত্বরান্বিত হয়, তখন সরকার শাসকদলের অনুগতদের লেলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীদের ওপর। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষকরা বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বর্ণনা করেছেন কীভাবে বিক্ষোভকারীরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যদের হাতে আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
পুলিশের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগের অনুগতদের হামলা প্রত্যক্ষ করেছেন যেসব সাংবাদিক তাদের একজন ছিলেন শহিদুল আলম। তিনি বিক্ষোভ ও নির্যাতন দুইই ক্যামেরাবন্দী করেছেন। এই প্রখ্যাত সাংবাদিক নিজেই শুধু আটক হননি। আরও বহু প্রতিবাদকারী গ্রেপ্তার ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতিত হয়েছেন।
অক্টোবর ও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নিজ দেশের গঠনমূলক সমালোচনা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের। হাসিনা সরকার নিশ্চিতভাবেই শহিদুল আলমের মতো গ্রহণযোগ্য ও সম্মানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে ভীষণ ভীত। কারণ, তার সমালোচনা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। তার গ্রেপ্তার ও বন্দিত্ব সমালোচনাপ্রবণ কন্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টার সমতুল্য।
হাসিনা সরকার শুধু একটি গ্রেপ্তারেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করছে তার মানহানি ও সুনাম ক্ষুণœ করার পথ খুঁজে বের করতে। শহিদুলের পার্টনার নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ তাকে কারাগারে দেখে এসেছেন। তখন তিনি বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করেন যে, তাদের কথাবার্তা গোপনে ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করছে কারাগার কর্তৃপক্ষ।
রেহনুমা আহমেদ এক ইমেইল বার্তায় বলেছেন, ‘ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত বন্ধুরা আমাকে বলেছেন যে, তাদেরকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে শহিদুল সম্পর্কে ‘নোংরা কাহিনী’ প্রকাশ করার। তাকে এমনকি শিশু যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে উপস্থাপনেরও কথাবার্তা চলছে। বিষয়টি জঘন্য কারণ শিশুদের প্রতি শহিদুলের ভালোবাসার কথা সকলের জানা।’
এটি বিস্মিত হওয়ার মতো ঘটনা নয়। কারণ, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ক্রমেই কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যেমনটা রিপোর্ট করেছে, গত কয়েক সপ্তাহ বা মাসে শ’ শ’ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা গুম হয়ে গেছে। এদের অনেকের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। মাদকবিরোধী যুদ্ধের নাম শ’ শ’ মানুষকে বিচারবহির্ভূত কায়দায় হত্যা করা হয়েছে।
শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর তাকে ঢাকার একটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কুখ্যাত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ, তিনি অনলাইনে এমন বক্তব্য রেখেছেন যা ‘জাতির ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে’। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, শহিদুল আলম যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা গেছে। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আমার রক্তাক্ত শার্ট ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে। আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে তাদের নির্দেশনা মোতাবেক যদি আমি স্বাক্ষ্য না দিই, তাহলে আমাকে আরও...।’ এরপরের বক্তব্য আর বোঝা যায়নি।
আদালত এক সপ্তাহের জন্য শহিদুলকে পুলিশি হেফাজতে রাখার অনুমতি দেন। এ সময় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাকে হাসপাতালে যাওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়। ১২ই আগস্ট শহিদুল আলমকে ফের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তবে অভিযোগের তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ফের কারাগারে পাঠানো হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি ১৪ বছরের কারাদন্ড পেতে পারেন।
বাংলাদেশীদের মধ্যে এক ধরণের অনুভূতি রয়েছে যে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আর কাজ করে না। পুলিশও সুরক্ষা প্রদান করে না। অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতাও নেই। ফলে সাংবিধানিক শাসনের বিকাশ ও পুনরুদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। যৌন সহিংসতাও চলছে অহরহ। নির্বাচনী প্রক্রিয়া জোরপূর্বক সহিংসতায় নিমজ্জিত। এক ধরণের ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে দেশজুড়ে।
শহিদুল আলম ন্যায়বিচার পাবেন বাংলাদেশে, তেমনটা অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে তার বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘তার মিথ্যা পোস্ট ও অভিযোগের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে পুলিশ ও আমাদের দলীয় কার্যালয়ে আক্রমণ করে। অনেক পুলিশ সদস্য ও আমাদের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন। এদের একজন আরাফাতুল ইসলাম বাপ্পি নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তিনি এখন স্থায়ীভাবে পঙ্গু।’ শহিদুল আলমের সঙ্গে পুলিশ ও আদালত যে ধরণের আচরণ করবে, তার ওপর এই ধরণের বক্তব্যের নিশ্চিত নেতিবাচক প্রভাব থাকতে বাধ্য।
শহিদুল আলমের অধিকার লঙ্ঘণের পাশাপাশি, বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার ভেঙে পড়ার আলামত দৃশ্যমান। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে হাসিনা সরকার বিচারকে কেবল প্রতিশোধ হিসেবে দেখে।
শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও কারাবন্দিত্ব একজন মানুষের ওপর নিষ্ঠুরতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতির ওপর আক্রমণ। বাংলাদেশকে অবশ্যই তাকে ও আটককৃত প্রতিবাদকারীদের মুক্তি দিতে হবে ও অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে।
(গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি সেখানে ইন্সটিটিউট ফর কম্পেয়ারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তার এই নিবন্ধ নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত।)
No comments