সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়েছে যে হাসপাতাল by কাফি কামাল
কক্সবাজার-টেকনাফ
মহাসড়কের দুইপাশ তখন আহত-অসুস্থ ও আশ্রয়হীন লাখো রোহিঙ্গা নর-নারীর
আর্তনাদে মুখরিত। অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি সেদিন মানবতার হাত বাড়িয়ে
দিয়েছিল ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ড্যাব। বালুখালী পানবাজারে
তিনদিনের জন্য স্থাপন করেছিল একটি মেডিকেল ক্যাম্প। দিনটি ছিল ১১ই
সেপ্টেম্বর ২০১৭। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ ১০ মাস। তাঁবুর ক্যাম্পটি এখন
দোতলা একটি বাড়িতে পরিণত হয়েছে পরিপূর্ণ হাসপাতালে। দশ মাসে হাসপাতালটিতে
চিকিৎসা নিয়েছে সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় গরিব রোগী। আবাসিক
ডাক্তার, প্যারামেডিক ও ফার্মাসিস্টদের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহেই বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবা দেন সেখানে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি
বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের
প্রোটিন মিক্স। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোকজন
এখানে চিকিৎসা নেন। একজন মিডওয়াইফ ফলোআপ চেকআপসহ স্বাস্থ্য পরামর্শ দেন
গর্ভবতী নারীদের। জন্মনিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য যুবতী নারীদের
কাউন্সেলিং করেন চিকিৎসক ও মিডওয়াইফ মিলে। ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে বিতরণ
করা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি
হাসপাতাল ও হেলথ সেন্টারগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। অন্য
হাসপাতালে যেখানে দৈনিক ৮০-১৫০ জন রোগী চিকিৎসা নেন, সেখানে এ হাসপাতালে
দৈনিক রোগীর সংখ্যা ৫০০’র বেশি। সপ্তাহের বাকি ৬ দিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল
৪টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা সেবা দেন। মিডওয়াইফ ও প্যারামেডিকসদের সেবা মেলে ২৪
ঘণ্টা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ড্যাবের সদস্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা টিম করে
হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেন। কাগজপত্রে হাসপাতালটির নাম- ‘ফ্রি
মেডিক্যাল ক্যাম্প, মেটারনাল, চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড প্রাইমারি হেলথ কেয়ার
সেন্টার’। কিন্তু রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় মানুষ এটিকে চেনে- খালেদা জিয়া
হাসপাতাল নামে।
হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পেছনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রয়েছেন মূল ভূমিকায়। লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় টেলিভিশনে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব দেখে সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে একটি রোহিঙ্গা ত্রাণ কমিটি গঠন করেন তিনি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক করে গঠিত রোহিঙ্গা ত্রাণ কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ আলী চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও রুহুল কবির রিজভী। যে কমিটির তত্ত্বাবধানে পরবর্তীতে ড্যাবের অস্থায়ী হেলথ ক্যাম্পটিকেই পরিণত করা হয় হাসপাতালে। পরে ৩০শে অক্টোবর খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। হাসপাতালে নিয়মিত অনুদান দিয়ে আসছেন- মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু, প্রবাসী সংগঠনের চাইল্ড অব অ্যাডাম, নেইবারহুড লাভ অ্যান্ড পিস অর্গানাইজেশন। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অনুদান, চিকিৎসক, নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সমিতি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে চলছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হাসপাতালটির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিএনপির ত্রাণ কমিটি।
হাসপাতালটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন ড্যাব মহাসচিব ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি জানান, বিএনপি অস্থায়ী হাসপাতালটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদন পেতে নানামুখী বেগ পেতে হয়। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অনুরোধে সৌদি আরব প্রবাসী মোশতাক আহমেদ বালুখালী বাজারে তার বাউন্ডারি ঘেরা দোতলা বাড়িটি হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দেন। অনুমতি পাওয়ার পর ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয় হাসপাতালে। গর্ভবতীদের জন্য ডেলিভারি রুম, রোগীদের বিশ্রাম কক্ষ, ফার্মেসি, জরুরি বিভাগ, পুরুষ বহির্বিভাগ, নারী বহির্বিভাগ, ড্রেসিং কর্নার, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও আবাসিক চিকিৎসক এবং নার্সের জন্য থাকার ঘর নির্মাণ করা হয়। ড্রেসিংয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, প্রোটিন মিক্স ও বিস্কুট, পানি এবং অ্যান্টিসেপটিক সাবান সংগ্রহ করা হয়। গর্ভবতী মায়েদের বিতরণের জন্য ২৫ টন প্রোটিন মিক্স কিনে দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ডা. জাহিদ বলেন, প্রথম আড়াই মাস বুলেটবিদ্ধ, কাটা ছেঁড়ায় আহত ও জ্বর-সর্দি আক্রান্ত মিলিয়ে দৈনিক কয়েক হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তাদের ১৮-৩৫ জনের চিকিৎসক টিম। পুরোপুরি স্বেচ্ছাব্রতে তারা এ চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এখন রোগীর সংখ্যা যেমন কমেছে তেমনি শনাক্ত হচ্ছে নানা ভাইরাল রোগ। ৩রা জুলাই পর্যন্ত এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে চার লাখ রোগী। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় লোকজন চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছিল তাই স্থানীয়দেরও চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি। হাসপাতালের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে ও স্থানীয়দের চাহিদা মেনে হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছি। রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ ও ড্যাবের মতো প্রফেশনাল অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হওয়ায় আমরা প্রচলিত নিয়মে অনুদান চাইতে বা নিতে পারি না। এখন হাসপাতালটি বন্ধ করে দিলে রোগীরা বঞ্চিত হবে। তারপরও যতদিন সম্ভব আমরা হাসপাতালটির কার্যক্রম চালিয়ে নিতে চাই।
হাসপাতালে ল্যাব প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন সঞ্জয় বালা ও নাজিমউদ্দিন। সঞ্জয় বালা জানান, বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে রোগীদের ব্লাড, ইউরিন ও বায়োকেমিস্ট্রি টেস্ট করা হয়। সামপ্রতিক সময়ে প্রতিদিনই ২৫-৩০ জন করে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এছাড়া শনাক্ত হচ্ছে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও ডিপথেরিয়া রোগী। রোগীদের পলিপ্যাকযুক্ত রিপোর্ট কার্ড দেয়ার পাশাপাশি রোগ শনাক্তকৃতদের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে। হাসপাতালের আবাসিক দুই চিকিৎসক সিফাত ও আসিফ জানান, এখনো প্রতিদিন ৪-৫শ’ রোগী চিকিৎসা নেন। রোগীদের বেশিরভাগই ডায়রিয়া, চর্মরোগ, জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, দাঁতের ব্যথা, ম্যালেরিয়াসহ নানা ভাইরাল রোগে আক্রান্ত। হাসপাতাল থেকেই রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের নেবুলাইজার সুবিধা দেয়া হয়। হাসপাতালে একমাত্র আবাসিক নারী চিকিৎসক ফাতেমা রয়েছেন ৮ মাস ধরে। তিনি জানান, প্রথমদিকে ভাষাগত দূরত্বের কারণে কিছুটা সমস্যা হতো। আমাদের কিশোর অনুবাদ টিমের সদস্যদের সাহায্যে আমরা বুঝে নিতাম। এখন আমরা তাদের ভাষা কিছুটা বুঝি, তারাও আমাদের বুঝাতে পারেন। রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে গর্ভবতীর সংখ্যাই বেশি। তবে রোহিঙ্গা নারীরা আগের তুলনায় অনেক স্বাস্থ্য সচেতন।
হাসপাতালে মিডওয়াইফ লিপি জানান, আমরা গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কার্ডের মাধ্যমে ফলোআপ, টিকাদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরামর্শ দেই। নরমাল ডেলিভারিতে সহায়তা করি। গর্ভবতী ও গর্ভপরবর্তী সময়ে ফুড সাপ্লিমেন্ট দিই। রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে রোগীদের নাম, ব্লক ও ক্যাম্পের ঠিকানা এবং রোগের ইতিহাস সবই সংরক্ষণ করি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাউন্সেলিং এবং ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাম্পেইন করি। এখন অনেকেই ইনজেক্টেবল মেথড ব্যবহার করছেন। আশার বিষয় হচ্ছে, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। হাসপাতালে দুইজন ফার্মাসিস্টের মধ্যে নাজিমউদ্দিন বলেন, আমরা চিকিৎসকদের উল্লিখিত ওষুধগুলো নির্ভুলভাবে রোগীদের বিতরণ করি। প্রতিটি ওষুধের প্যাকেট বা পাতায় মার্কার পেন দিয়ে সেবনের নিয়ম উল্লেখ করে দেই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চিকিৎসকদের ভাষাগত সমস্যা নিরসনে এ হাসপাতালে স্বেচ্ছাশ্রম দেন ১৫ কিশোর। তাদেরই একজন নবম শ্রেণির ছাত্র আরিফ হাসান ইলশাম। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে বন্ধুদের সঙ্গে সে দোভাষীর কাজ শুরু করেছিলেন। হাসপাতালে দেখা গেল ইলশামকে জড়িয়ে ধরছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ জানান, তারা কৃতজ্ঞ এ হাসপাতালের সেবা ও আন্তরিকতায়। কিছু হলেই তাই ছুটে আসেন- তাদেরই দেয়া নামের ‘খালেদা জিয়া হাসপাতালে’।
হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পেছনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রয়েছেন মূল ভূমিকায়। লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় টেলিভিশনে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব দেখে সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে একটি রোহিঙ্গা ত্রাণ কমিটি গঠন করেন তিনি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক করে গঠিত রোহিঙ্গা ত্রাণ কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ আলী চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও রুহুল কবির রিজভী। যে কমিটির তত্ত্বাবধানে পরবর্তীতে ড্যাবের অস্থায়ী হেলথ ক্যাম্পটিকেই পরিণত করা হয় হাসপাতালে। পরে ৩০শে অক্টোবর খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। হাসপাতালে নিয়মিত অনুদান দিয়ে আসছেন- মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু, প্রবাসী সংগঠনের চাইল্ড অব অ্যাডাম, নেইবারহুড লাভ অ্যান্ড পিস অর্গানাইজেশন। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অনুদান, চিকিৎসক, নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সমিতি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে চলছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হাসপাতালটির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিএনপির ত্রাণ কমিটি।
হাসপাতালটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন ড্যাব মহাসচিব ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি জানান, বিএনপি অস্থায়ী হাসপাতালটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদন পেতে নানামুখী বেগ পেতে হয়। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অনুরোধে সৌদি আরব প্রবাসী মোশতাক আহমেদ বালুখালী বাজারে তার বাউন্ডারি ঘেরা দোতলা বাড়িটি হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দেন। অনুমতি পাওয়ার পর ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয় হাসপাতালে। গর্ভবতীদের জন্য ডেলিভারি রুম, রোগীদের বিশ্রাম কক্ষ, ফার্মেসি, জরুরি বিভাগ, পুরুষ বহির্বিভাগ, নারী বহির্বিভাগ, ড্রেসিং কর্নার, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও আবাসিক চিকিৎসক এবং নার্সের জন্য থাকার ঘর নির্মাণ করা হয়। ড্রেসিংয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, প্রোটিন মিক্স ও বিস্কুট, পানি এবং অ্যান্টিসেপটিক সাবান সংগ্রহ করা হয়। গর্ভবতী মায়েদের বিতরণের জন্য ২৫ টন প্রোটিন মিক্স কিনে দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ডা. জাহিদ বলেন, প্রথম আড়াই মাস বুলেটবিদ্ধ, কাটা ছেঁড়ায় আহত ও জ্বর-সর্দি আক্রান্ত মিলিয়ে দৈনিক কয়েক হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তাদের ১৮-৩৫ জনের চিকিৎসক টিম। পুরোপুরি স্বেচ্ছাব্রতে তারা এ চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এখন রোগীর সংখ্যা যেমন কমেছে তেমনি শনাক্ত হচ্ছে নানা ভাইরাল রোগ। ৩রা জুলাই পর্যন্ত এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে চার লাখ রোগী। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় লোকজন চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছিল তাই স্থানীয়দেরও চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি। হাসপাতালের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে ও স্থানীয়দের চাহিদা মেনে হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছি। রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ ও ড্যাবের মতো প্রফেশনাল অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হওয়ায় আমরা প্রচলিত নিয়মে অনুদান চাইতে বা নিতে পারি না। এখন হাসপাতালটি বন্ধ করে দিলে রোগীরা বঞ্চিত হবে। তারপরও যতদিন সম্ভব আমরা হাসপাতালটির কার্যক্রম চালিয়ে নিতে চাই।
হাসপাতালে ল্যাব প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন সঞ্জয় বালা ও নাজিমউদ্দিন। সঞ্জয় বালা জানান, বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে রোগীদের ব্লাড, ইউরিন ও বায়োকেমিস্ট্রি টেস্ট করা হয়। সামপ্রতিক সময়ে প্রতিদিনই ২৫-৩০ জন করে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এছাড়া শনাক্ত হচ্ছে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও ডিপথেরিয়া রোগী। রোগীদের পলিপ্যাকযুক্ত রিপোর্ট কার্ড দেয়ার পাশাপাশি রোগ শনাক্তকৃতদের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে। হাসপাতালের আবাসিক দুই চিকিৎসক সিফাত ও আসিফ জানান, এখনো প্রতিদিন ৪-৫শ’ রোগী চিকিৎসা নেন। রোগীদের বেশিরভাগই ডায়রিয়া, চর্মরোগ, জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, দাঁতের ব্যথা, ম্যালেরিয়াসহ নানা ভাইরাল রোগে আক্রান্ত। হাসপাতাল থেকেই রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের নেবুলাইজার সুবিধা দেয়া হয়। হাসপাতালে একমাত্র আবাসিক নারী চিকিৎসক ফাতেমা রয়েছেন ৮ মাস ধরে। তিনি জানান, প্রথমদিকে ভাষাগত দূরত্বের কারণে কিছুটা সমস্যা হতো। আমাদের কিশোর অনুবাদ টিমের সদস্যদের সাহায্যে আমরা বুঝে নিতাম। এখন আমরা তাদের ভাষা কিছুটা বুঝি, তারাও আমাদের বুঝাতে পারেন। রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে গর্ভবতীর সংখ্যাই বেশি। তবে রোহিঙ্গা নারীরা আগের তুলনায় অনেক স্বাস্থ্য সচেতন।
হাসপাতালে মিডওয়াইফ লিপি জানান, আমরা গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কার্ডের মাধ্যমে ফলোআপ, টিকাদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরামর্শ দেই। নরমাল ডেলিভারিতে সহায়তা করি। গর্ভবতী ও গর্ভপরবর্তী সময়ে ফুড সাপ্লিমেন্ট দিই। রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে রোগীদের নাম, ব্লক ও ক্যাম্পের ঠিকানা এবং রোগের ইতিহাস সবই সংরক্ষণ করি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাউন্সেলিং এবং ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাম্পেইন করি। এখন অনেকেই ইনজেক্টেবল মেথড ব্যবহার করছেন। আশার বিষয় হচ্ছে, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। হাসপাতালে দুইজন ফার্মাসিস্টের মধ্যে নাজিমউদ্দিন বলেন, আমরা চিকিৎসকদের উল্লিখিত ওষুধগুলো নির্ভুলভাবে রোগীদের বিতরণ করি। প্রতিটি ওষুধের প্যাকেট বা পাতায় মার্কার পেন দিয়ে সেবনের নিয়ম উল্লেখ করে দেই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চিকিৎসকদের ভাষাগত সমস্যা নিরসনে এ হাসপাতালে স্বেচ্ছাশ্রম দেন ১৫ কিশোর। তাদেরই একজন নবম শ্রেণির ছাত্র আরিফ হাসান ইলশাম। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে বন্ধুদের সঙ্গে সে দোভাষীর কাজ শুরু করেছিলেন। হাসপাতালে দেখা গেল ইলশামকে জড়িয়ে ধরছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ জানান, তারা কৃতজ্ঞ এ হাসপাতালের সেবা ও আন্তরিকতায়। কিছু হলেই তাই ছুটে আসেন- তাদেরই দেয়া নামের ‘খালেদা জিয়া হাসপাতালে’।
No comments