তোলাবাজির উৎসব by শুভ্র দেব
ঈদকে
ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। বেপরোয়া
চাঁদাবাজিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চাঁদা দিতে নারাজি
ব্যবসায়ীদের দেয়া হয় নানা হুমকি-ধমকি। কোথাও কোথাও দেখানো হচ্ছে অস্ত্রের
ভয়ভীতি। তাই বাধ্য হয়ে অনেক ব্যবসায়ী চাঁদা তুলে দিচ্ছেন চাঁদাবাজদের কাছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজদের কয়েক
শতাধিক গ্রুপ। নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অন্তত শতাধিক গডফাদার। রাজনৈতিক দলের
নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের নামে উঠানো হয় চাঁদা। এছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত
কারাবন্দি ও দেশ পলাতক আসামিদের নাম ভাঙিয়ে হচ্ছে চাঁদাবাজি। নিয়মিতদের
পাশাপাশি সক্রিয় মৌসুমি চাঁদাবাজরা। বাদ যায়নি পাড়া-মহল্লার উঠতি
সন্ত্রাসীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত মার্কেট, বিপণিবিতান, পরিবহন সেক্টর সর্বত্রই চাঁদাবাজি। আর এসব চাঁদা নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের নামে নানা অজুহাতে। বিপণিবিতান, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, বাস চালক-মালিক, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় চাঁদা। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর চাঁদার হার দ্বিগুণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। একটি দুটি গ্রুপ নয় একজন ব্যবসায়ীকে একাধিক গ্রুপকে দিতে হচ্ছে টাকা। সব মিলিয়ে এবারের ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা বেশ আতঙ্কের মধ্যদিয়ে সময় পার করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শতাধিক গডফাদারের মদতে শুধু রাজধানীতে চাঁদা তোলার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রুপ কাজ করছে। তারা বিভিন্ন নেতাদের নাম বলে টাকা তুলেন। ব্যবসার ধরন বুঝে চাঁদার হার নির্ধারণ করেন। অপরাগতা দেখালে ভয়ভীতির পাশাপাশি করা হয় অশোভন আচরণ। অনেক সময় নগদ টাকার পাশাপাশি কাপড় দাবি করা হচ্ছে। গত কয়েকদিন সরজমিন রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, ফরচুন সুপার মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চাঁদনীচক, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় বাজার, মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, টঙ্গী, পুরান ঢাকার একাধিক মার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ আরো একাধিক এলাকার মার্কেটের ব্যবসায়ী ও মতিঝিল, গুলিস্তান, হলিডে মার্কেট, ফার্মগেট, উত্তরা, বিমানবন্দর, মিরপুর, শেরেবাংলানগর, নিউমার্কেটসহ আরো কিছু এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে চাঁদাবাজির তথ্য।
দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট ইসলামপুর। এ বছর সেখান থেকে উঠানো হয়েছে কয়েক কোটি টাকার চাঁদা। ইসলামপুরের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। আলী হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী জানান, ভেবেছিলাম এবছর কোনো চাঁদা দেব না। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যায় এবার বেশ অভাব-অনটনে কাটছে। কিন্তু এ বছর আমাকে আরো দ্বিগুণ টাকা দিতে হচ্ছে। বারবার যখন বিভিন্ন অজুহাতে এসে ধর্না দিচ্ছিল তখন আর না দিয়ে পারলাম না। নিউমার্কেটের কসমেটিকস ব্যবসায়ী জাফর বলেন, ইফতার পার্টির নামে দুবার টাকা দিয়েছি। না জানি ঈদের আগ পর্যন্ত আর কত টাকা দিতে হয়। তিনি বলেন, দল বেঁধে যখন অনেকেই আসে তখন আর কিছু করার থাকে না। কারণ, ব্যবসা করতে হলে না দিয়ে কোনো উপায় নাই। গাউছিয়ার ব্যবসীয় আনোয়ার বলেন, এখন পর্যন্ত কত সংগঠন কত অজুহাতে যে আসছে, তার ঠিক নাই। আরও অনেক আসবে। একেক সংগঠনের চাঁদার রেট একেক রকম। গুলিস্তান সুন্দরবন মার্কেটের ব্যবসায়ী করিম মিয়া জানান, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে কোনো লাভ নেই। একের পর এক আসছে। সাধ্যমতো যা পারি দিচ্ছি। চাঁদা দেব না- এই বলে আর রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। দিতেই হবে যখন, বুঝিয়ে যত কমে পারা যায়। ফার্মগেটের ব্যবসায়ী আক্তার বলেন, এটা নতুন কিছু না। সারা বছরই দিতে হয়। রমজান মাস আসলে একটু বেশি বাজেট লাগে। দলে দলে আসবে আর নিয়ে চলে যাবে। দিতে পারব কি না বা সমস্যা আছে কি না তার হিসাব করবে না।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারি হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ১৪৭টি শপিংমল রয়েছে। বাস্তবে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। আর এসব শপিংমলে অন্তত লাখ খানেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে শুরু করে শ্রেণিভেদে ভেদে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকার ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় আরো বেশি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন পুরো রমজান মাসে শুধু ঢাকাতেই ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হবে।
সূত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা তোলায় আতঙ্ক একটু বেশি। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ আছেন কারাগারে। দেশ পলাতকের পাশাপাশি আবার অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। কিন্তু আড়ালে থেকেও তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তোলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
শপিংমলের মতো বাদ যায়নি ফুটপাতে চাঁদাবাজি। নামে-বেনামে সংগঠনের নামে নিয়মিত চাঁদার পাশাপাশি তোলা হচ্ছে ইফতার ও ঈদকেন্দ্রিক চাঁদা। চাঁদা না দিলেও ফুটপাতে বসে ব্যবসা করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনও অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের সিটি করপোরেশন, বন্দর, হাটবাজার ও জেলা-উপজেলার নিবন্ধনকৃত হকার আড়াই লাখ। এরমধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই আছে প্রায় এক লাখের ওপরে হকার। এর বাইরে অনিবন্ধিত ও মৌসুমী হকার আরো কয়েক লাখ। ঈদকে সামনে রেখে এসব হকারের কাছ থেকে নেয়া হয় কয়েকশ কোটি টাকা। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখন ভালো বিক্রি শুরু হয়নি। ১০ রমজানের পর থেকে চাঁদ রাত পর্যন্ত ভালো বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ব্যবসা শুরু হওয়ার আগেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। গুলিস্তানের হকার রিয়াজ মিয়া বলেন, যারা চাঁদা তুলে তারা- এমন কিছু নেতার নাম বলে তখন আর কিছু করার থাকে না। আর চাঁদা না দিলে নানা হয়রানি করা হয়। ফার্মগেটের হাকার জাফর আলী বলেন, ব্যবসা হোক আর না হোক চাঁদার টাকা ঠিকই দিতে হয়। মিরপুরের হকার রুহুল আমিন বলেন, রমজান মাসে আলাদা বাজেট করে রাখতে হয়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারা যায় না।
রাজধানীতে ফুটপাত থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য প্রায় ৫ শতাধিক চাঁদাবাজ রয়েছে। তারা লাইনম্যান নামে পরিচিত। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা উঠানোর কাজ করেন। তাদের সহযোগিতা করেন স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি ও পুলিশ।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম মানবজমিনকে বলেন, রমজানের শুরু থেকে চাঁদাবাজি চলছে। ঈদ যত সামনে আসবে ততই চাঁদার রেট বেড়ে যাবে। শুরুতে চাঁদা নেয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। ১০ থেকে ২০ রমজান পর্যন্ত হবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আর চাঁদ রাত পর্যন্ত কয়েক গুন বেড়ে হয়ে যাবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা অনেক আন্দোলন করছি। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে একাধিক মামলা। কিন্তু তাদের কখনই গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ, তারা প্রত্যেকেই পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই কাজ করে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার পাশাপাশি পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে আরো কিছু চক্র। যারা ঈদ কেন্দ্রিক দূরপাল্লার বিভিন্ন বাস থেকে চাঁদা ওঠায়। খোঁজ নিয়ে জানা, গেছে ঈদ যাত্রার এখনও বাকি। কিন্তু এখনই কিছু চাঁদাবাজরা রাজধানীতে প্রবেশ ও বাহির পথে চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। নিয়মিত চাঁদাবাজির পাশাপাশি শুরু হয়েছে ইফতার মাহফিলসহ আরো নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ও ঢাকার টার্মিনালগুলোতে প্রবেশকালে চাঁদা তোলা হয়। এর বাইরে খোদ ট্রাফিক পুলিশও কাগজপত্র চেক করার নামে চালকদের হয়রানি করে টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক চালক। আবার দূরপাল্লার অনেক যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, এখনই চালকরা বাড়তি ভাড়া নেয়া শুরু করে দিয়েছে। বাড়তি ভাড়া নেয়ার কারণ জানতে চাইলেও তারা কোনো সদত্তর দিচ্ছেন না। তবে চালকরা জানিয়েছেন, তাদের খরচ বেড়েছে। ইঞ্জিন স্ট্যার্ট দিলেই একাধিক ঘাটে তাদের টাকা দিতে হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এসময়টা একটু বেশি তৎপর থাকে। আমাদের কাছে যদি কেউ অভিযোগ করে তবে আমরা ব্যবস্থা নেব। এজন্য পুলিশের কাছে সরাসরি ফোন করে অভিযোগ দেয়া যাবে। অথবা আমাদের জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে অভিযোগ দেয়া যাবে। তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রবেশ ও বাহির পথে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করবে। হাতেনাতে এধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত মার্কেট, বিপণিবিতান, পরিবহন সেক্টর সর্বত্রই চাঁদাবাজি। আর এসব চাঁদা নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের নামে নানা অজুহাতে। বিপণিবিতান, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, বাস চালক-মালিক, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় চাঁদা। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর চাঁদার হার দ্বিগুণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। একটি দুটি গ্রুপ নয় একজন ব্যবসায়ীকে একাধিক গ্রুপকে দিতে হচ্ছে টাকা। সব মিলিয়ে এবারের ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা বেশ আতঙ্কের মধ্যদিয়ে সময় পার করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শতাধিক গডফাদারের মদতে শুধু রাজধানীতে চাঁদা তোলার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রুপ কাজ করছে। তারা বিভিন্ন নেতাদের নাম বলে টাকা তুলেন। ব্যবসার ধরন বুঝে চাঁদার হার নির্ধারণ করেন। অপরাগতা দেখালে ভয়ভীতির পাশাপাশি করা হয় অশোভন আচরণ। অনেক সময় নগদ টাকার পাশাপাশি কাপড় দাবি করা হচ্ছে। গত কয়েকদিন সরজমিন রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, ফরচুন সুপার মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চাঁদনীচক, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় বাজার, মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, টঙ্গী, পুরান ঢাকার একাধিক মার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ আরো একাধিক এলাকার মার্কেটের ব্যবসায়ী ও মতিঝিল, গুলিস্তান, হলিডে মার্কেট, ফার্মগেট, উত্তরা, বিমানবন্দর, মিরপুর, শেরেবাংলানগর, নিউমার্কেটসহ আরো কিছু এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে চাঁদাবাজির তথ্য।
দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট ইসলামপুর। এ বছর সেখান থেকে উঠানো হয়েছে কয়েক কোটি টাকার চাঁদা। ইসলামপুরের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। আলী হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী জানান, ভেবেছিলাম এবছর কোনো চাঁদা দেব না। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যায় এবার বেশ অভাব-অনটনে কাটছে। কিন্তু এ বছর আমাকে আরো দ্বিগুণ টাকা দিতে হচ্ছে। বারবার যখন বিভিন্ন অজুহাতে এসে ধর্না দিচ্ছিল তখন আর না দিয়ে পারলাম না। নিউমার্কেটের কসমেটিকস ব্যবসায়ী জাফর বলেন, ইফতার পার্টির নামে দুবার টাকা দিয়েছি। না জানি ঈদের আগ পর্যন্ত আর কত টাকা দিতে হয়। তিনি বলেন, দল বেঁধে যখন অনেকেই আসে তখন আর কিছু করার থাকে না। কারণ, ব্যবসা করতে হলে না দিয়ে কোনো উপায় নাই। গাউছিয়ার ব্যবসীয় আনোয়ার বলেন, এখন পর্যন্ত কত সংগঠন কত অজুহাতে যে আসছে, তার ঠিক নাই। আরও অনেক আসবে। একেক সংগঠনের চাঁদার রেট একেক রকম। গুলিস্তান সুন্দরবন মার্কেটের ব্যবসায়ী করিম মিয়া জানান, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে কোনো লাভ নেই। একের পর এক আসছে। সাধ্যমতো যা পারি দিচ্ছি। চাঁদা দেব না- এই বলে আর রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। দিতেই হবে যখন, বুঝিয়ে যত কমে পারা যায়। ফার্মগেটের ব্যবসায়ী আক্তার বলেন, এটা নতুন কিছু না। সারা বছরই দিতে হয়। রমজান মাস আসলে একটু বেশি বাজেট লাগে। দলে দলে আসবে আর নিয়ে চলে যাবে। দিতে পারব কি না বা সমস্যা আছে কি না তার হিসাব করবে না।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারি হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ১৪৭টি শপিংমল রয়েছে। বাস্তবে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। আর এসব শপিংমলে অন্তত লাখ খানেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে শুরু করে শ্রেণিভেদে ভেদে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকার ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় আরো বেশি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন পুরো রমজান মাসে শুধু ঢাকাতেই ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হবে।
সূত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা তোলায় আতঙ্ক একটু বেশি। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ আছেন কারাগারে। দেশ পলাতকের পাশাপাশি আবার অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। কিন্তু আড়ালে থেকেও তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তোলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
শপিংমলের মতো বাদ যায়নি ফুটপাতে চাঁদাবাজি। নামে-বেনামে সংগঠনের নামে নিয়মিত চাঁদার পাশাপাশি তোলা হচ্ছে ইফতার ও ঈদকেন্দ্রিক চাঁদা। চাঁদা না দিলেও ফুটপাতে বসে ব্যবসা করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনও অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের সিটি করপোরেশন, বন্দর, হাটবাজার ও জেলা-উপজেলার নিবন্ধনকৃত হকার আড়াই লাখ। এরমধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই আছে প্রায় এক লাখের ওপরে হকার। এর বাইরে অনিবন্ধিত ও মৌসুমী হকার আরো কয়েক লাখ। ঈদকে সামনে রেখে এসব হকারের কাছ থেকে নেয়া হয় কয়েকশ কোটি টাকা। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখন ভালো বিক্রি শুরু হয়নি। ১০ রমজানের পর থেকে চাঁদ রাত পর্যন্ত ভালো বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ব্যবসা শুরু হওয়ার আগেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। গুলিস্তানের হকার রিয়াজ মিয়া বলেন, যারা চাঁদা তুলে তারা- এমন কিছু নেতার নাম বলে তখন আর কিছু করার থাকে না। আর চাঁদা না দিলে নানা হয়রানি করা হয়। ফার্মগেটের হাকার জাফর আলী বলেন, ব্যবসা হোক আর না হোক চাঁদার টাকা ঠিকই দিতে হয়। মিরপুরের হকার রুহুল আমিন বলেন, রমজান মাসে আলাদা বাজেট করে রাখতে হয়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারা যায় না।
রাজধানীতে ফুটপাত থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য প্রায় ৫ শতাধিক চাঁদাবাজ রয়েছে। তারা লাইনম্যান নামে পরিচিত। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা উঠানোর কাজ করেন। তাদের সহযোগিতা করেন স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি ও পুলিশ।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম মানবজমিনকে বলেন, রমজানের শুরু থেকে চাঁদাবাজি চলছে। ঈদ যত সামনে আসবে ততই চাঁদার রেট বেড়ে যাবে। শুরুতে চাঁদা নেয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। ১০ থেকে ২০ রমজান পর্যন্ত হবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আর চাঁদ রাত পর্যন্ত কয়েক গুন বেড়ে হয়ে যাবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা অনেক আন্দোলন করছি। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে একাধিক মামলা। কিন্তু তাদের কখনই গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ, তারা প্রত্যেকেই পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই কাজ করে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার পাশাপাশি পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে আরো কিছু চক্র। যারা ঈদ কেন্দ্রিক দূরপাল্লার বিভিন্ন বাস থেকে চাঁদা ওঠায়। খোঁজ নিয়ে জানা, গেছে ঈদ যাত্রার এখনও বাকি। কিন্তু এখনই কিছু চাঁদাবাজরা রাজধানীতে প্রবেশ ও বাহির পথে চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। নিয়মিত চাঁদাবাজির পাশাপাশি শুরু হয়েছে ইফতার মাহফিলসহ আরো নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ও ঢাকার টার্মিনালগুলোতে প্রবেশকালে চাঁদা তোলা হয়। এর বাইরে খোদ ট্রাফিক পুলিশও কাগজপত্র চেক করার নামে চালকদের হয়রানি করে টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক চালক। আবার দূরপাল্লার অনেক যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, এখনই চালকরা বাড়তি ভাড়া নেয়া শুরু করে দিয়েছে। বাড়তি ভাড়া নেয়ার কারণ জানতে চাইলেও তারা কোনো সদত্তর দিচ্ছেন না। তবে চালকরা জানিয়েছেন, তাদের খরচ বেড়েছে। ইঞ্জিন স্ট্যার্ট দিলেই একাধিক ঘাটে তাদের টাকা দিতে হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এসময়টা একটু বেশি তৎপর থাকে। আমাদের কাছে যদি কেউ অভিযোগ করে তবে আমরা ব্যবস্থা নেব। এজন্য পুলিশের কাছে সরাসরি ফোন করে অভিযোগ দেয়া যাবে। অথবা আমাদের জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে অভিযোগ দেয়া যাবে। তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রবেশ ও বাহির পথে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করবে। হাতেনাতে এধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
No comments