সাংস্কৃতিক কূটনীতি: হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে সমস্যার কথা এখানে উত্থাপন করতে চাই না
বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে শুক্রবার
ঠিক দুপুরে নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সঙ্গে
ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঐতিহাসিক এই
মুহূর্তে সকলের মধ্যে ছিল খুশির রেশ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ
ভবনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
পূর্ব নির্ধারিত সূচিমতে বৈঠকটি এক ঘণ্টা স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু সেটি কতক্ষণ স্থায়ী হয়েছে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ব্রিফিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বৈঠক বিষয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাই কমিশনের বরাতে দাবি করা হয়েছে বৈঠকটি ‘আধঘন্টা’ স্থায়ী হয়েছে। ওই রিপোর্টে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপিকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে মোটা দাগে নিরাপত্তা ও রাজনীতির বিষয়টি ছিল। প্রতিমন্ত্রীর ভাষায়Ñ যদিও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না তারপরও বলতে পারিÑ বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে কথা হয়েছে। সেখানে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারত একই অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বাংলাদেশের বহু আকাঙ্খিত তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে সেই বৈঠকে কোন আলোচনা হয়েছে কি-না?
সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু না বললেও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিস্তা সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর বাংলাদেশের নেতৃত্বের আস্থা থাকার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন শাহরিয়ার আলম।
উল্লেখ্য, মোদির প্রতিবেশী অগ্রাধিকার নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই ‘প্রথম’ বলে দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়ে আসছে। কিন্তু গত ১১ই মে নেপাল সফরে মোদি ‘নেপাল কামিং ফার্স্ট’ বা ‘নেপাল শীর্ষ অবস্থানে চলে আসছে’ বলে উল্লেখ করেন। মোদির ওই বক্তব্যের মাত্র ১৪ দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি হলো। পর্যবেক্ষকরা তাকিয়ে আছেন এবার দিল্লির তরফে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে কি বলা হয় তা দেখার জন্য। আদৌ কি নেপাল ফার্স্ট হয়ে যাচ্ছে?
বাংলাদেশ-ভারত যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে- প্রধানমন্ত্রী: এদিকে শান্তি নিকেতনে দেয়া দীর্ঘ বক্তৃতায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘বাংলাদেশ ভবন’র উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমরা দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র একসঙ্গে এগোতে চাই। পারস্পরিক সমস্যাগুলো আমাদের একে একে সমাধান করে নিতে হবে। এসময় দুই দেশের বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক বর্তমানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
পারস্পরিক সহযোগিতায় দুই দেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৌশলগত বন্ধুত্ব অপরাপর বিশ্বের জন্য ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিতে পারি যে, উভয় দেশ সহযোগিতার এই মনোভাব ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে। শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একত্রে চলতে চায় এবং এ লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যকার অনেক সমস্যার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে আমাদের এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে, যা আমি এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে এখানে তা উত্থাপন করতে চাই না। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি যে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠেও একই আশাবাদের কথা শোনা যায়। মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, পরস্পরের বিকাশে সহযোগিতা করছে তা অন্যদের জন্যও একটি শিক্ষা, একটি উদাহরণ। শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তা অর্জনে ভারতের ‘পূর্ণ সমর্থন’ থাকবে বলেও আশ্বাস দেন মোদি।
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল শান্তি নিকেতনে ‘বাংলাদেশ ভবন’ এর উদ্বোধন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেয়া। ওই অনুষ্ঠানের সাইড লাইনে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। তবে এই সফর ঘিরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিসহ দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো গত কয়েকদিন ধরেই ঘুরে ফিরে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়। এসব অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি সেসব আলোচনাকে আরও উসকে দিয়েছে, কেননা তার আপত্তিতেই তিস্তা চুক্তি আটকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। যদিও আগের রাতেই মমতা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ সফর তিস্তা বা কোনো রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য নয়। এটি কালচারাল এক্সচেঞ্জের সফর।
বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা হয়তো এ কারণেই বলেছেন, আমরা অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। কিছুটা বাকি আছে, কিন্তু আমি সে কথা বলে আমাদের এ চমৎকার অনুষ্ঠান নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু আমি আশা করি, যেকোনো সমস্যা আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমেই সমাধান করতে পারব।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ভবন দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ভবন হবে এমন একটি অনন্য কেন্দ্র যেখানে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখাপড়া ও গবেষণা করতে পারবে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত চত্বরে বাংলাদেশ ভবন স্থাপনে তিনি অভিভূত; প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ভারতী চত্বরে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পশ্চিম বাংলা সরকার, ভারত সরকার ভারতের বন্ধুভাবাপন্ন জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরো জোরদার হবে। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে এটি ছোট এক টুকরো বাংলাদেশ, যেখান থেকে বাংলাদেশের চেতনা প্রতিপালিত হবে। রবীন্দ্রনাথের এই প্রভাব নিজস্বভাবেই অনন্য হয়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা এবং সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, কবি, গায়ক এবং শিল্পীসহ উভয় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ভবনের ব্যবস্থাপনার জন্য এককালীন ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এ কারণে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করেন। তিনি আরো বলেন, ঐতিহাসিককাল থেকেই বাংলাদেশ-ভারতের জনগণ সামাজিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি এসময় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয়দের সহায়তার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। এছাড়া ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর ভারতে আশ্রয়দানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দু’দিনের সফরে গতকালই কলকাতা যান প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি জোড়াসাঁকোর ‘ঠাকুর বাড়ি’ পরিদর্শন করেন। সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শেখ হাসিনা সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণে আজ (শনিবার) আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেয়ার কথা রয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে কলকাতায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী নেতাজি জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। তিনি সেখানে নেতাজির বিছানায় ফুলেল শুভেচ্ছা জানাবেন এবং দর্শনার্থী বইতে স্বাক্ষর করবেন। প্রধানমন্ত্রী শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, মসিউর রহমান, গওহর রিজভী, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী এই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান খান, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন।
এছাড়া ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী মোজাম্মেল বাবু, আওয়ামী লীগ নেতা দীপু মনি ও শেখ হেলাল উদ্দিন, অসীম কুমার উকিল, এসএম কামাল, শামসুন্নাহার চাঁপা, পারভিন জামান কল্পনা, যুবলীগ নেতা অপু উকিল রয়েছেন শান্তি নিকেতনের এই সফরে।
বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী প্রধানমন্ত্রী আরও যা বললেন-
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতের নয়, তিনি আমাদেরও। রবীন্দ্রনাথ তার অধিকাংশ কবিতা বাংলাদেশে বসেই লিখেছিলেন। তাছাড়া ভারতের মতো বাংলাদেশেরও জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের লেখা। তিনি বলেন, মানুষ ও প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে এই শান্তিনিকেতনে। আর তাই এখানে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। এই ভবনের ডিজাইনের মধ্যে তা সুস্পষ্ট। অনুষ্ঠানের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশ ভবনটি অপূর্ব হয়েছে। আগামী দিনে এটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হবে বলে মমতা আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে একটি বঙ্গবন্ধু ভবনও করতে চাই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চান তিনি। এর আগে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে ভাষণ দিতে গিয়ে আচার্য নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা দেশ হলেও সহযোগিতা এই দুই দেশকে জুড়ে দিয়েছে। আর তারই উদাহরণ হলো বাংলাদেশ ভবন। তিনি আরও বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, আমি অতিথি হিসেবে এখানে আসিনি। এসেছি আচার্য হিসেবে। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এসে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। মোদি বলেন, গোটা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ নন্দিত। তিনিই প্রথম বিশ্বনাগরিক। মোদি তার দীর্ঘ ৩৫ মিনিটের ভাষণে বলেন, রবীন্দ্রনাথ গোটা বিশ্বকে আপন করে নিয়েছিলেন। আর তার সেই বিশ্বভাবনার ফসল হলো বিশ্বভারতী। মোদি তার ভাষণ শুরু করেছিলেন বাংলায়। সমাবর্তন উৎসবও ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী।
মোদির ভাষায়, এই আম্রকুঞ্জ অতীতে বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে। এদিনও বিশ্বভারতীর সমাবর্তন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে। একই মঞ্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রথম বিশ্বভারতীর কোনো সমাবর্তন মঞ্চে উপস্থিত থাকলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ৪২ বছর আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সমাবর্তনে উপস্থিত থাকলেও ছিলেন দর্শক আসনে। এছাড়াও মঞ্চে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী এবং বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন। সমাবর্তন শেষে মমতাকে সঙ্গে নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী পূর্বপল্লীতে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করেন। এর আগে সকালে দুদিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলকাতার দমদম সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে ভারতের বায়ু সেনার একটি হেলিকপ্টারে তিনি শান্তিনিকেতন যান। হেলিপ্যাড থেকে শেখ হাসিনা রবীন্দ্রভবনে পৌঁছালে মোদি তাকে অভ্যর্থনা জানান।
এই সময় হাসিনার সঙ্গে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা। সেখানে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এরপর দুজনই সেখানে রাখা স্মারক মন্তব্য বইতে তাদের মতামত লিপিবদ্ধ করেন। সেখান থেকে বিশ্বভারতীর প্রথা অনুযায়ী দুদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও মোদি, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরী লাল ত্রিপাঠী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়সহ সকলেই হেঁটে আম্রকুঞ্জের মূল অনুষ্ঠানস্থলে আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চে হাসিনা ও মোদির পাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। প্রথা অনুযায়ী আচার্য মোদি উপাচার্যের হাতে একটি ছাতিম পাতা তুলে দেয়ার মাধ্যমে সমাবর্তন সূচনার নির্দেশ দেন। বেদ গান ও রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে সমাবর্তনের উদ্বোধন হয়। এরপর স্বাগত ভাষণ দেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন। ভাষণ দেন অতিথি হিসেবে উপস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সন্ন্যাসী। সেই ভাষণ শেষে মোদি তার ভাষণ দেন।
কিন্তু সেটি কতক্ষণ স্থায়ী হয়েছে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ব্রিফিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বৈঠক বিষয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাই কমিশনের বরাতে দাবি করা হয়েছে বৈঠকটি ‘আধঘন্টা’ স্থায়ী হয়েছে। ওই রিপোর্টে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপিকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে মোটা দাগে নিরাপত্তা ও রাজনীতির বিষয়টি ছিল। প্রতিমন্ত্রীর ভাষায়Ñ যদিও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না তারপরও বলতে পারিÑ বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে কথা হয়েছে। সেখানে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারত একই অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বাংলাদেশের বহু আকাঙ্খিত তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে সেই বৈঠকে কোন আলোচনা হয়েছে কি-না?
সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু না বললেও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিস্তা সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর বাংলাদেশের নেতৃত্বের আস্থা থাকার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন শাহরিয়ার আলম।
উল্লেখ্য, মোদির প্রতিবেশী অগ্রাধিকার নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই ‘প্রথম’ বলে দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়ে আসছে। কিন্তু গত ১১ই মে নেপাল সফরে মোদি ‘নেপাল কামিং ফার্স্ট’ বা ‘নেপাল শীর্ষ অবস্থানে চলে আসছে’ বলে উল্লেখ করেন। মোদির ওই বক্তব্যের মাত্র ১৪ দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি হলো। পর্যবেক্ষকরা তাকিয়ে আছেন এবার দিল্লির তরফে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে কি বলা হয় তা দেখার জন্য। আদৌ কি নেপাল ফার্স্ট হয়ে যাচ্ছে?
বাংলাদেশ-ভারত যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে- প্রধানমন্ত্রী: এদিকে শান্তি নিকেতনে দেয়া দীর্ঘ বক্তৃতায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘বাংলাদেশ ভবন’র উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমরা দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র একসঙ্গে এগোতে চাই। পারস্পরিক সমস্যাগুলো আমাদের একে একে সমাধান করে নিতে হবে। এসময় দুই দেশের বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক বর্তমানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
পারস্পরিক সহযোগিতায় দুই দেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৌশলগত বন্ধুত্ব অপরাপর বিশ্বের জন্য ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিতে পারি যে, উভয় দেশ সহযোগিতার এই মনোভাব ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে। শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একত্রে চলতে চায় এবং এ লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যকার অনেক সমস্যার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে আমাদের এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে, যা আমি এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে এখানে তা উত্থাপন করতে চাই না। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি যে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠেও একই আশাবাদের কথা শোনা যায়। মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, পরস্পরের বিকাশে সহযোগিতা করছে তা অন্যদের জন্যও একটি শিক্ষা, একটি উদাহরণ। শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তা অর্জনে ভারতের ‘পূর্ণ সমর্থন’ থাকবে বলেও আশ্বাস দেন মোদি।
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল শান্তি নিকেতনে ‘বাংলাদেশ ভবন’ এর উদ্বোধন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেয়া। ওই অনুষ্ঠানের সাইড লাইনে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। তবে এই সফর ঘিরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিসহ দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো গত কয়েকদিন ধরেই ঘুরে ফিরে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়। এসব অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি সেসব আলোচনাকে আরও উসকে দিয়েছে, কেননা তার আপত্তিতেই তিস্তা চুক্তি আটকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। যদিও আগের রাতেই মমতা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ সফর তিস্তা বা কোনো রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য নয়। এটি কালচারাল এক্সচেঞ্জের সফর।
বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা হয়তো এ কারণেই বলেছেন, আমরা অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। কিছুটা বাকি আছে, কিন্তু আমি সে কথা বলে আমাদের এ চমৎকার অনুষ্ঠান নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু আমি আশা করি, যেকোনো সমস্যা আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমেই সমাধান করতে পারব।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ভবন দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ভবন হবে এমন একটি অনন্য কেন্দ্র যেখানে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখাপড়া ও গবেষণা করতে পারবে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত চত্বরে বাংলাদেশ ভবন স্থাপনে তিনি অভিভূত; প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ভারতী চত্বরে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পশ্চিম বাংলা সরকার, ভারত সরকার ভারতের বন্ধুভাবাপন্ন জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরো জোরদার হবে। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে এটি ছোট এক টুকরো বাংলাদেশ, যেখান থেকে বাংলাদেশের চেতনা প্রতিপালিত হবে। রবীন্দ্রনাথের এই প্রভাব নিজস্বভাবেই অনন্য হয়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা এবং সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, কবি, গায়ক এবং শিল্পীসহ উভয় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ভবনের ব্যবস্থাপনার জন্য এককালীন ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এ কারণে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করেন। তিনি আরো বলেন, ঐতিহাসিককাল থেকেই বাংলাদেশ-ভারতের জনগণ সামাজিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি এসময় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয়দের সহায়তার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। এছাড়া ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর ভারতে আশ্রয়দানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দু’দিনের সফরে গতকালই কলকাতা যান প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি জোড়াসাঁকোর ‘ঠাকুর বাড়ি’ পরিদর্শন করেন। সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শেখ হাসিনা সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণে আজ (শনিবার) আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেয়ার কথা রয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে কলকাতায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী নেতাজি জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। তিনি সেখানে নেতাজির বিছানায় ফুলেল শুভেচ্ছা জানাবেন এবং দর্শনার্থী বইতে স্বাক্ষর করবেন। প্রধানমন্ত্রী শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, মসিউর রহমান, গওহর রিজভী, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী এই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান খান, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন।
এছাড়া ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী মোজাম্মেল বাবু, আওয়ামী লীগ নেতা দীপু মনি ও শেখ হেলাল উদ্দিন, অসীম কুমার উকিল, এসএম কামাল, শামসুন্নাহার চাঁপা, পারভিন জামান কল্পনা, যুবলীগ নেতা অপু উকিল রয়েছেন শান্তি নিকেতনের এই সফরে।
বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী প্রধানমন্ত্রী আরও যা বললেন-
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতের নয়, তিনি আমাদেরও। রবীন্দ্রনাথ তার অধিকাংশ কবিতা বাংলাদেশে বসেই লিখেছিলেন। তাছাড়া ভারতের মতো বাংলাদেশেরও জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের লেখা। তিনি বলেন, মানুষ ও প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে এই শান্তিনিকেতনে। আর তাই এখানে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। এই ভবনের ডিজাইনের মধ্যে তা সুস্পষ্ট। অনুষ্ঠানের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশ ভবনটি অপূর্ব হয়েছে। আগামী দিনে এটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হবে বলে মমতা আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে একটি বঙ্গবন্ধু ভবনও করতে চাই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চান তিনি। এর আগে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে ভাষণ দিতে গিয়ে আচার্য নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা দেশ হলেও সহযোগিতা এই দুই দেশকে জুড়ে দিয়েছে। আর তারই উদাহরণ হলো বাংলাদেশ ভবন। তিনি আরও বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, আমি অতিথি হিসেবে এখানে আসিনি। এসেছি আচার্য হিসেবে। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এসে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। মোদি বলেন, গোটা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ নন্দিত। তিনিই প্রথম বিশ্বনাগরিক। মোদি তার দীর্ঘ ৩৫ মিনিটের ভাষণে বলেন, রবীন্দ্রনাথ গোটা বিশ্বকে আপন করে নিয়েছিলেন। আর তার সেই বিশ্বভাবনার ফসল হলো বিশ্বভারতী। মোদি তার ভাষণ শুরু করেছিলেন বাংলায়। সমাবর্তন উৎসবও ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী।
মোদির ভাষায়, এই আম্রকুঞ্জ অতীতে বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে। এদিনও বিশ্বভারতীর সমাবর্তন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে। একই মঞ্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রথম বিশ্বভারতীর কোনো সমাবর্তন মঞ্চে উপস্থিত থাকলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ৪২ বছর আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সমাবর্তনে উপস্থিত থাকলেও ছিলেন দর্শক আসনে। এছাড়াও মঞ্চে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী এবং বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন। সমাবর্তন শেষে মমতাকে সঙ্গে নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী পূর্বপল্লীতে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করেন। এর আগে সকালে দুদিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলকাতার দমদম সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে ভারতের বায়ু সেনার একটি হেলিকপ্টারে তিনি শান্তিনিকেতন যান। হেলিপ্যাড থেকে শেখ হাসিনা রবীন্দ্রভবনে পৌঁছালে মোদি তাকে অভ্যর্থনা জানান।
এই সময় হাসিনার সঙ্গে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা। সেখানে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এরপর দুজনই সেখানে রাখা স্মারক মন্তব্য বইতে তাদের মতামত লিপিবদ্ধ করেন। সেখান থেকে বিশ্বভারতীর প্রথা অনুযায়ী দুদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও মোদি, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরী লাল ত্রিপাঠী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়সহ সকলেই হেঁটে আম্রকুঞ্জের মূল অনুষ্ঠানস্থলে আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চে হাসিনা ও মোদির পাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। প্রথা অনুযায়ী আচার্য মোদি উপাচার্যের হাতে একটি ছাতিম পাতা তুলে দেয়ার মাধ্যমে সমাবর্তন সূচনার নির্দেশ দেন। বেদ গান ও রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে সমাবর্তনের উদ্বোধন হয়। এরপর স্বাগত ভাষণ দেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন। ভাষণ দেন অতিথি হিসেবে উপস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সন্ন্যাসী। সেই ভাষণ শেষে মোদি তার ভাষণ দেন।
No comments