নগর সরকার নাকি রাজউকের স্বশাসন? by কাজী মাসেলউল্লাহ

রাজউকের তৈরি ২০ বছর মেয়াদি ‘ঢাকা স্ট্রাকচার প্লানের’ খসড়া প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এখন এর ওপর চলছে জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ঢাকা শহর ও এর আশপাশের বৃহত্তর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা মহানগরীর আঞ্চলিক উন্নয়ন- বিশেষত ভৌত উন্নয়নের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করা। ১৩ অধ্যায়ে বিভক্ত প্রতিবেদনের শেষ অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়ছে। কারণ, সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে কোনো পরিকল্পনাই সঠিকভাবে কার্যকর হবে না।
অধ্যায়ের শুরুতে ঢাকা শহরকে ঘিরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সমস্যাকে সবচেয়ে প্রকট হিসেবে ধরা যায়। প্রথমটি জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের অভাব। বিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অভাবের পাশাপাশি সেবা ও উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে সমস্যার বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সুশাসন প্রশ্নে রাজউকের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড। সমস্যাগুলোকে যথার্থভাবে তুলে ধরার জন্য এ প্রতিবেদনের পরামর্শক বা পরামর্শকদের ধন্যবাদ জানাতে হবে। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে প্রতিবেদনটিতে যে নীতি ও কৌশল গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে তার অধিকাংশই অনেকটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বরং এ সুপারিশগুলো অনুসরণ করলে সমস্যা আরও বাড়বে। প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিষ্ঠান রাজউকের কর্তাব্যক্তিদের কাছে পুরো ঢাকা মহানগরীর জনগণ আরও জিম্মি হয়ে পড়বে। ব্যাপারটাকে খোলাসা করার জন্য আগে দেখা যাক রাজউকের ওই প্রতিবেদনে কী কী পরামর্শ বা সুপারিশ করা হয়েছে।
এতে বলা হচ্ছে, রাজউককে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এছাড়া, রাজউক পুরো ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন কাজের প্রধান সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। যেহেতু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ট সামর্থ্য নেই, তাই তারা রাজউক অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুসরণ করে কাজ করবে। অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থার ভেতর সমন্বয়ের জন্য রাজউক মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলো (যেমন- সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ) রাজউককে সহায়তা করবে। আবার এটিও বলা হচ্ছে, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজউকের কর্মকাণ্ডের ভেতর সুনির্দিষ্ট বিভাজন থাকতে হবে। সর্বোপরি, এসব সুপারিশ মেনে রাজউককে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।
অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থাকে সমন্বয়ের জন্য রাজউক কীভাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে? অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো ভৌত পরিকল্পনাকে অতটা গুরুত্ব দেয় না; কিন্তু তাদের কর্মপরিধি রাজউকের চেয়ে নেহায়েত কম এটি দাবি করা যায় না। ধরে নিলাম, রাজউক যেহেতু মূল পরিকল্পনাকারী, তাই সমন্বয়ের মুখ্য ভূমিকা রাজউক পালন করবে। কিন্তু, বাস্তবতা কি তাই বলে যে অন্যান্য সংস্থা এ সমন্বয়ের জন্য রাজউককে সহায়তা করবে? রাজউক ও অন্যান্য সংস্থার যে আইনি কাঠামো আছে তাতে কি তাদের এই সহায়তার জন্য বাধ্য করা যায়? যায় না। তারপর, রাজউক ও স্থানীয় সরকারের কাজের বিভাজন করে কি সমন্বয় বাড়ানো যাবে, নাকি এটি আরও বেশি সমন্বয়হীনতা তৈরি করবে?
এরকম বিভাজন তো আরও বেশি একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর সংস্কৃতিকে উসকে দেবে। কারণ, সবকিছু বিভক্ত করে দেখা সম্ভব নয়। বরং, এমন কিছু করা উচিত যাতে সবাই সহাবস্থানে থেকে কাজ করে। সেটা কীভাবে করা যায় তার কিছুটা ইঙ্গিত ওই প্রতিবেদনেও দেয়া আছে; কিন্তু সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। অথচ অনেক গৌণ বিষয় বিস্তরভাবে বলা হয়েছে। যেমন রাজউক নিলামের মাধ্যমে আবাসিক প্লট বিক্রি ও আয়-উপার্জন করতে পারবে।
প্রতিবেদনে রাজউককে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ছে। আসলে এখানেই বোঝা যায়, যারা প্লান করেছেন তারা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরো ঢাকা মহানগরীর জন্য একটি একক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দরকার, যেটি সব নাগরিকের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। এমন একটি সংস্থা দরকার যা পুরো ঢাকা শহরের সব সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে পরিচালনা করবে। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবেদনে সেরকম কোনো প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা দেয়া হয়নি। বরং রাজউকের মতো একটি অনির্বাচিত সংস্থার অধীনে অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করার মাধ্যমে রাজউককে অধিক ক্ষমতাশালী করার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজউককে সব কাজের নিয়ন্ত্রক বা সমন্বয়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ অধ্যায়ের একেবারে শেষ ভাগে দায়সারাভাবে ‘নগর সরকারে’র কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘নগর সরকার’ই হবে সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান। রাজউক সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তা ক্ষেত্র বিশেষে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে কাজ করতে পারে, যেমন- রাজউকের পরিকল্পনা শাখাকে শক্তিশালী করা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা। সেটা সুস্পষ্টভাবে এ স্ট্রাকচার প্লানে বলতে হবে। যাতে খুব দ্রুতই এমন একটি সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া যায়। প্রশ্ন আসে, কেমন হবে সেই নগর সরকারের রূপরেখা? ঢাকা শহর তো একাধিক স্থানীয় সরকার ইউনিটে বিভক্ত। এ রূপরেখার একটি সফল উদাহরণ ওই প্রতিবেদনেই দেয়া আছে। কিন্তু সেটা শুধু উদাহরণ হিসেবেই দেয়া আছে, স্বল্প পরিসরেও কেন জানি তা ব্যাখ্যা করা হয়নি বা ওই উদাহরণকে মাথায় রেখে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। যেমন- ওই প্রতিবেদনে উল্লেখিত মেট্রোপলিটন ম্যানিলা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখব ১৭টি শহর নিয়ে ওই কর্তৃপক্ষ গঠিত। সেই কর্তৃপক্ষের অধীনে উন্নয়ন পরিকল্পনা, যোগাযোগ, ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, এমনকি জননিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে। কর্তৃপক্ষটি নিয়ন্ত্রিত হয় নির্বাচিত মেয়রদের দ্বারা। নির্বাচিত মেয়রদের নিয়ে মেট্রো ম্যানিলা কাউন্সিল গঠিত। অনেক অনির্বাচিত সরকারি কর্মকর্তা (যেমন- পুলিশ প্রধান, পাবলিক ওয়ার্ক ও হাইওয়ে বিভাগের প্রধান, পর্যটন বিভাগের প্রধান ইত্যাদি) পদাধিকার বলে সেই কাউন্সিলের সদস্য; কিন্তু তাদের যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেটা নির্দেশনা দেন সেটা পালন করেন। যদিও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন ম্যানিলার খুবই শক্তিশালী ভূমিকা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই সংস্থাটি স্থানীয় পৌর প্রশাসনের ক্ষমতাকে খর্ব করে। এ সংস্থা মূলত সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করে যা পৌর প্রশাসনের সীমানা ও সামর্থ্যরে ভেতর থেকে করা যায় না, যে সমস্যাগুলোকে পুরো আঞ্চলিক পরিধি বজায় রেখে প্রতিটি শহরকে একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়।
তবে এটি ঠিক মেট্রো ম্যানিলা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো একটি নগর সরকার রাতারাতি ঢাকার ক্ষেত্রে করা যাবে না। কারণ, এখানে অপেক্ষাকৃত নিুমাত্রার শাসন (লো গভর্নেন্স) বিদ্যমান। হঠাৎ করে উচ্চমাত্রার শাসন (হাই গভর্নেন্স) এখানে খাপ খাবে না। কিন্তু আমরা হাই গভর্নেন্সের দিকে যাত্রা করতে পারি। সেক্ষেত্রে কেমন হবে আমাদের যাত্রাপথ? এখানে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরছি। আশা করি যথাযথ কর্তৃপক্ষ সুপারিশ তিনটিকে আমলে নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখবেন।
এক, স্বল্পমেয়াদের জন্য পুরো ঢাকা মহানগরীর জন্য একটি সমন্বয়কারী বোর্ড স্থাপন করা। এর নেতৃত্ব দেবেন স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত মেয়ররা। তাদের অধীনে স্টিয়ারিং কমিটি বা সাব-কমিটি করে তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। ঢাকা মহানগরীর অধীনে যেসব ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে তাদের প্রতিনিধিরাও এ সাব-কমিটিতে থাকবেন। এ বোর্ড এবং সাব-কমিটি বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার ভেতর সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। স্ট্রাকচার প্লান পাস হলে যে বিশদ পরিকল্পনার কাজ শুরু হবে তাতে এ বোর্ড জনগণের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। জনগণের পূর্ণ অংশগ্রহণ একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব, কারণ তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। বিশদ পরিকল্পনা যাতে অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয় তার সমন্বয় করবে এ বোর্ড। এভাবে কাজ করতে থাকলে স্থানীয় প্রতিনিধিরাও নির্বাহীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করবে। বোর্ডের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালনের জন্য আইনি ক্ষমতা দিতে হবে।
দুই, মধ্যমেয়াদে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কাজের জবাবদিহিতা ওয়ার্ড (ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে, কারণ এখানে এক একটি ওয়ার্ডের জনসংখ্যা অনেক পৌরসভার সমান), পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায় থেকে করতে হবে। অন্তত যেসব সেবা সরাসরি বাসযোগ্য পরিবেশকে প্রভাবিত করে, যেমন- পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, যাতায়াত ব্যবস্থা, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ইমারত নির্মাণ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তৃণমূল পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এসব সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়ন হতে হবে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা অনুরূপ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে।
তিন, দীর্ঘমেয়াদে মেট্রো ঢাকা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা অনুরূপ নামে একটি নগর সরকার গড়ে তুলতে হবে যার অধীনে ওয়াসা, রাজউকসহ অনান্য প্রতিষ্ঠান যারা কেবল ঢাকা মহানগরীতে কাজ করে তারা চলে আসবে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে কাজ করবে, যেমন- রাজউক কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ও ভূমি উন্নয়ন শাখা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ পথ ধরে এগোলে মনে করি, যে তিনটি সমস্যার কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে (জনগণের প্রতিনিধিত্বের অভাব, বিকেন্দ্রীকরণের অভাব, সমন্বয়ের অভাব) ভবিষ্যতে তা দূর হবে। বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই সুপারিশগুলো প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি। খসড়া স্ট্রাকচার প্লানে রাজউককে অধিক ক্ষমতাশালী করার যে প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে, তা একেবারেই অবাস্তব বলে মনে হয়েছে। নির্বাহী বা অনুরূপ ক্ষমতাপ্রাপ্ত লোকজনদের দিয়ে পুরো ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন পরিচালনা করলে তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কখনই ঘটবে না। বরং, স্বায়ত্তশাসনপ্রাপ্ত নির্বাহী ক্ষমতা সুষম এবং প্রকৃত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে আরও সীমিত করে ফেলবে।
কাজী মাসেলউল্লাহ : নগর গবেষক, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
kazimasel@bracu.ac.bd

No comments

Powered by Blogger.