বাংলাদেশ যেখানে ভালো আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে by আনিসুল হক
বিশ্ব
আইনশৃঙ্খলা সূচকে বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে আছে। আমেরিকাভিত্তিক গবেষণা ও
জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ গত সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব
আইনশৃঙ্খলা প্রতিবেদন–২০১৫ প্রকাশ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৫ সালে
প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের আছে দুই হাজারেরও বেশি কর্মী।
তারা বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ করে পৃথিবীব্যাপী। ১৪১টা দেশে ১ লাখ ৪২ হাজার
মানুষের মধ্যে তারা জরিপ চালিয়েছে নিজ এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে।
তাদের প্রকাশিত বিশ্ব আইনশৃঙ্খলা সূচক ২০১৪-তে বাংলাদেশের অবস্থান ভালোর দিকে, ১৪১টা দেশের মধ্যে প্রথম ৩০টির মধ্যেই আছে বাংলাদেশ। আর যৌথভাবে একই নম্বর পাওয়াদের একটা স্থানে ধরলে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। সবচেয়ে ভালো সিঙ্গাপুর, তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৮৯। এরপর উজবেকিস্তান, তারা পেয়েছে ৮৮, ৮৭ নম্বর পেয়ে যৌথভাবে তৃতীয় হংকং আর ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৮, বাংলাদেশ ভালো করেছে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে, জাপান কিংবা নিউজিল্যান্ডের অবস্থান বাংলাদেশের সমান। আমাদের আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়েও ভালো অবস্থানে আছে মিয়ানমার আর শ্রীলঙ্কা। ভারত কিংবা পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের চেয়ে খারাপ। ভারত পেয়েছে ৬৭, পাকিস্তান ৬০; এদের অবস্থান লেবানন কিংবা ফিলিস্তিনের পরে।
এই জরিপ কিন্তু নাগরিকদের মনে নিরাপত্তার আশ্বাস কতটা, তার ওপর ভিত্তি করে করা। তিনটা প্রশ্ন করা হয়েছিল নাগরিকদের—আপনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানকার পুলিশের ওপরে কি আপনার আস্থা আছে? আপনি রাতে চলাচল করাটা কি নিরাপদ মনে করেন? জরিপের সময় জানতে চাওয়া হয়েছিল, গত ১২ মাসে আপনার বা আপনার পরিবারের কারও কি টাকা বা সম্পদ চুরি গেছে?
এই সব প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের নাগরিকেরা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের চেয়েও পুলিশের ওপর, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বেশি আস্থা রেখেছেন, এই তথ্যটা কিন্তু মূল্যবান। নিরাপত্তা আসলে নিরাপত্তার ধারণা। ৬ নভেম্বর প্রথম আলোয় এই কলামেই আমার লেখার শিরোনাম ছিল—‘এ দেশে এখন কে নিরাপদ?’ সেখানেও আমি বলেছিলাম, নিরাপত্তার ধারণাটা আসলে মনের ব্যাপার, চিত্তের স্বাধীনতাই আসল স্বাধীনতা। নইলে মানুষ নিজের বিছানাতেই বেশি মারা যায়, তবু নিজের বিছানাটাকেই মানুষ বেশি নিরাপদ বলে মনে করে। বাংলাদেশের মানুষ নিজেকে অন্য অনেক দেশের মানুষের চেয়ে বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন, তাঁদের পুলিশের ওপর আস্থা আছে, তাঁরা রাতে চলতে ভয় পান না এবং ২০১৪ সালে জরিপটি হওয়ার আগের ১২ মাসে তাঁর পরিবারে কোনো চুরির ঘটনা ঘটেনি—এটা একটা খুবই ইতিবাচক তথ্য।
এখান থেকে আমাদের প্রেরণা নিতে হবে। যদিও এই জরিপ গত বছরের, এরই মধ্যে দেশে ঘটে গেছে অনেক খুনখারাবি এবং এ বছর জানুয়ারিও গেছে পেট্রলবোমার ভয়ে-আতঙ্কে, তবু মনে রাখলে ভালো করা হবে যে ২০১৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি গিয়েছিল আরও খারাপ। সেদিক থেকে গ্যালাপ প্রকাশিত এই সূচক থেকে আমরা প্রেরণা নিতে পারি।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রসদ কম। আধুনিক প্রযুক্তিতে তারা সুসজ্জিত নয়। তাদের অস্ত্র থাকলে গুলি থাকে না, যে অস্ত্র যাঁর কাছে আছে, সেই অস্ত্র চালনায় তাঁর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকায় এ রকম একটা প্রতিবেদন পড়ে মনটা দমে গেল। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সন্ত্রাসীরা যতটা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তা শনাক্ত করা ও দমন করার মতো প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই। তিনি মনে করেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আমাদের বিশেষ প্রশিক্ষিত ইউনিট দরকার। মুখপাত্র নিজেই যখন এ কথা বলেন, তখন আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ না বেড়ে পারে না। কিংবা বাংলাদেশের একটা জেলা শহরে কারারক্ষীকে ক্ষুর দিয়ে আক্রমণ করার পর ঘোষণা এল, এরপর কারারক্ষী কারা এলাকার বাইরে গেলে ইউনিফর্ম পরে যাবেন না—এই ঘোষণা নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের মনে নিরাপত্তার কোন আশ্বাসটা জোগাবে? অর্থবল, লোকবল, রসদ, সাজসরঞ্জামের এতটা অপ্রতুলতা! আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আছে দুর্নীতি। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের পুলিশ, আমাদের র্যাব, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে দক্ষতা, যোগ্যতার পরিচয় এর আগে দিয়েছে, তাতে তাদের ওপর আমাদের শ্রদ্ধা না এসে পারে না। এই সমাজে বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে পুলিশ চাইলে পারে না, এমন কিছু নেই। কখনো কখনো পুলিশ চায় না, কখনো কখনো পুলিশকে চাইতে দেওয়া হয় না। তা না হলে পুলিশ যেকোনো অপরাধ দমন করতে পারে, যেকোনো অপরাধীকে শনাক্ত করে ধরে ফেলতে পারে।
এই বিশ্বাসটাই মূল্যবান। গ্যালাপের জরিপে হয়তো এই মনোভাবটাই প্রকাশিত হয়েছে। আর পরিসংখ্যান দিয়ে দেখলেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো। কিন্তু সমস্যা তো কেবল চুরি-ডাকাতির নয়। সমস্যা কেবল যৌতুক, নারী নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতির নয়। এখন পৃথিবীজুড়েই নিরাপত্তার যে সমস্যা, তার কারণ বৈশ্বিক। যে কারণ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ নিজেরা খুব কমই দায়ী, ঠিক জলবায়ুর পরিবর্তনের বিপদের মতোই, বিপদ আমরা সৃষ্টি করিনি, কিন্তু সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছি আমরাই।
আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালোও করছে বাংলাদেশই। তেমনি বিশ্বব্যাপী উগ্রপন্থা, জঙ্গিবাদের যে বিপদ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে ভালো করব আমরাই—গ্যালাপের জরিপ আমাদের সেই প্রেরণা জোগাচ্ছে।
এর মূলে আছে বাংলাদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের মানুষ বীর, কিন্তু নিষ্ঠুর নয়; বাংলাদেশের মানুষ মোটের ওপর আসলেই শান্তিকামী। বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিনও পররাজ্যে হামলা করেনি, সাম্রাজ্য বিস্তার করতে যায়নি। নিজেরা ধান উৎপাদন করে, মসলিন উৎপাদন করে এই দেশের মানুষ সুখে ছিল। এই দেশের মানুষ ধার্মিক, ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ কিংবা মতান্ধ নয়। এই দেশে ধর্ম প্রচারিত হয়েছে সুফি সাধক, আউলিয়া, দরবেশদের মাধ্যমে; তাঁরা প্রচার করেছেন সাম্যের বাণী, ভালোবাসার কথা। মোগলরা এই দেশে এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাননি, মুসলমান শাসকেরা বাংলা সাহিত্যকে উৎসাহিত করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। তাঁরা এখানে থিতু হয়েছেন, বিয়েশাদি করে স্থানীয় হয়ে গেছেন।
কিন্তু সারা পৃথিবীতে অন্যত্র যেমন, আমাদের দেশও বিশ্বায়িত সন্ত্রাসবাদের বিপদের আওতামুক্ত নয়। এ থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত রাখতে আমাদের পারতেই হবে। সেটা করার জন্য দরকার হবে ৩৬০ ডিগ্রি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। এ জন্য দরকার হবে গণতন্ত্র, বাক্-স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। মানুষকে কথা বলতে না দিলে, বিরুদ্ধ মত,ÿ ক্ষোভ প্রকাশিত হতে না দিলে তা নিজেকে প্রকাশের জন্য বাঁকা পথ গ্রহণ করে। এ জন্য দরকার শিক্ষা, শিক্ষা মানে সুশিক্ষা। সেই শিক্ষা, যা মানুষের মনকে আলোকিত করে, তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে। শুধু ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা এমবিএ, বিবিএ পড়লে হয় না। অন্যদিকে যাঁরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন, তাঁদের জন্য দরকার মূলধারার জীবিকা অবলম্বনের দক্ষতা। তাঁরা যেন চাকরিবাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, মূলধারার জীবনযাপন করতে পারেন। তাঁদের যেন প্রান্তে ঠেলে দেওয়া না হয়। আসলে সমস্যার মূল যেন কেবল আইনশৃঙ্খলার মাটিতে খোঁজা নয়, এর মূল নিহিত আছে রাজনীতিতে এবং শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজে।
বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ ভালো করবেন, অনেকেই বৈষয়িক উন্নতি করবেন খুব বেশি। আমাদের আকাশরেখা বদলে যাচ্ছে গগনচুম্বী ভবন দিয়ে, আমাদের আকাশরেল হবে, পাতালরেল হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়ি চলবে আমাদের রাস্তা দিয়ে। আর অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষ কি পেছনে পড়ে রইবে? কিংবা একটা শ্রেণির মানুষ কি এই উন্নতির ইঁদুর দৌড়ের ট্র্যাকের বাইরে থাকবে? বাইরে থাকলে তারা কি সেটা মুখ বুজে সহ্য করবে? যেখানে বাইরের প্ররোচনা, অর্থায়ন, যোগাযোগ খুব একটা বাস্তব ঘটনা। আর বাংলাদেশ নিরুপদ্রবভাবে ভালোই করতে থাকবে, বাইরের শক্তিগুলোও কি তা হতে দিতে চাইবে?
কাজেই আজকে আমরা নিরাপত্তার যে ঝুঁকির মধ্যে আছি, তা সমাধানের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দক্ষ, যোগ্য করে তোলা, তাদের আধুনিক প্রযুক্তিতে বলীয়ান করা, তাদের প্রশিক্ষিত করা, আলাদা আইটি ইউনিট গড়ে তোলা, জনবল, অর্থবল, রসদ বাড়ানো—এসব তো একেবারে প্রাথমিক কাজ। পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপ। এবং দরকার জনগণকে যুক্ত রাখা। জনগণ চায় না বলেই এই দেশে চরমপন্থা কোনো দিনও সুবিধা করতে পারেনি। শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন যারা নিয়েছিল, তারা নিজেরাই মারামারি করে নিঃশেষিত হয়ে গেছে। কারণ, জনগণ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে, সন্ত্রাস করে পৃথিবীতে কেউ তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। নিজের মতবাদের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণিত হয় ভালোবাসার বাণী, শান্তির বার্তা, উৎকর্ষের অঙ্গীকার প্রচার করার মাধ্যমে। ১৯ নভেম্বর আবুল মোমেন প্রথম আলোয় একটা চমৎকার লেখা লিখেছেন। ইসলাম সারা পৃথিবীতে তার নিশান উড়িয়েছিল তখনই, যখন মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্পকলা, স্থাপত্যে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিল। শারজা ইসলামিক ঐতিহ্য জাদুঘর পরিদর্শনকালে আমার বারবার এ কথাই মনে হচ্ছিল। অ্যালজেবরা কথাটা আরবি। আবার শূন্য বা জিরোর ধারণা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে ভারত। মুসলমানরা গ্রিসের জ্ঞান অনুবাদ করে আরবিতে, পরে পশ্চিম আবার সেটা অনুবাদ করে নেয় আরবি থেকে। শারজা জাদুঘরের দেয়ালে লেখা আছে—মুসলমানরা ভালো করেছিল, এর কারণ তারা অন্যদের জ্ঞানকেও গ্রহণ করেছিল মূল্যবান বলে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকিত ভুবনের দিকে আমাদের মনের দরজা-জানালা সব খুলে রাখতে হবে। আর প্রচার করতে হবে ভালোবাসার কথা। কবির ভাষায়:
ও ভাই ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে
গোলাগুলির গোলেতে নয় গভীর ভালোবেসে।
ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়,
সে যে সৃজন পরিচয়।
প্রত্যেকের অন্তরে ভালোবাসা জাগ্রত করতে হবে। পৃথিবীর মোড়লেরা সেটা চান না। তাঁদের দরকার হয় যুদ্ধ, উন্মত্ততা। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষেরা শান্তির পক্ষে ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে এক জোট যদি হয়, সোচ্চার যদি হয়, তাহলেই কেবল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে আমরা বাঁচতে পারব। আর আমাদের দেশটাকে শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আমাদের সবার, সর্বাধিক দায়িত্ব দেশ-পরিচালকদের, কিন্তু প্রতিটা নাগরিকেরই কিছু না–কিছু করণীয় আছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
তাদের প্রকাশিত বিশ্ব আইনশৃঙ্খলা সূচক ২০১৪-তে বাংলাদেশের অবস্থান ভালোর দিকে, ১৪১টা দেশের মধ্যে প্রথম ৩০টির মধ্যেই আছে বাংলাদেশ। আর যৌথভাবে একই নম্বর পাওয়াদের একটা স্থানে ধরলে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। সবচেয়ে ভালো সিঙ্গাপুর, তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৮৯। এরপর উজবেকিস্তান, তারা পেয়েছে ৮৮, ৮৭ নম্বর পেয়ে যৌথভাবে তৃতীয় হংকং আর ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৮, বাংলাদেশ ভালো করেছে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে, জাপান কিংবা নিউজিল্যান্ডের অবস্থান বাংলাদেশের সমান। আমাদের আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়েও ভালো অবস্থানে আছে মিয়ানমার আর শ্রীলঙ্কা। ভারত কিংবা পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের চেয়ে খারাপ। ভারত পেয়েছে ৬৭, পাকিস্তান ৬০; এদের অবস্থান লেবানন কিংবা ফিলিস্তিনের পরে।
এই জরিপ কিন্তু নাগরিকদের মনে নিরাপত্তার আশ্বাস কতটা, তার ওপর ভিত্তি করে করা। তিনটা প্রশ্ন করা হয়েছিল নাগরিকদের—আপনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানকার পুলিশের ওপরে কি আপনার আস্থা আছে? আপনি রাতে চলাচল করাটা কি নিরাপদ মনে করেন? জরিপের সময় জানতে চাওয়া হয়েছিল, গত ১২ মাসে আপনার বা আপনার পরিবারের কারও কি টাকা বা সম্পদ চুরি গেছে?
এই সব প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের নাগরিকেরা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের চেয়েও পুলিশের ওপর, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বেশি আস্থা রেখেছেন, এই তথ্যটা কিন্তু মূল্যবান। নিরাপত্তা আসলে নিরাপত্তার ধারণা। ৬ নভেম্বর প্রথম আলোয় এই কলামেই আমার লেখার শিরোনাম ছিল—‘এ দেশে এখন কে নিরাপদ?’ সেখানেও আমি বলেছিলাম, নিরাপত্তার ধারণাটা আসলে মনের ব্যাপার, চিত্তের স্বাধীনতাই আসল স্বাধীনতা। নইলে মানুষ নিজের বিছানাতেই বেশি মারা যায়, তবু নিজের বিছানাটাকেই মানুষ বেশি নিরাপদ বলে মনে করে। বাংলাদেশের মানুষ নিজেকে অন্য অনেক দেশের মানুষের চেয়ে বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন, তাঁদের পুলিশের ওপর আস্থা আছে, তাঁরা রাতে চলতে ভয় পান না এবং ২০১৪ সালে জরিপটি হওয়ার আগের ১২ মাসে তাঁর পরিবারে কোনো চুরির ঘটনা ঘটেনি—এটা একটা খুবই ইতিবাচক তথ্য।
এখান থেকে আমাদের প্রেরণা নিতে হবে। যদিও এই জরিপ গত বছরের, এরই মধ্যে দেশে ঘটে গেছে অনেক খুনখারাবি এবং এ বছর জানুয়ারিও গেছে পেট্রলবোমার ভয়ে-আতঙ্কে, তবু মনে রাখলে ভালো করা হবে যে ২০১৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি গিয়েছিল আরও খারাপ। সেদিক থেকে গ্যালাপ প্রকাশিত এই সূচক থেকে আমরা প্রেরণা নিতে পারি।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রসদ কম। আধুনিক প্রযুক্তিতে তারা সুসজ্জিত নয়। তাদের অস্ত্র থাকলে গুলি থাকে না, যে অস্ত্র যাঁর কাছে আছে, সেই অস্ত্র চালনায় তাঁর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকায় এ রকম একটা প্রতিবেদন পড়ে মনটা দমে গেল। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সন্ত্রাসীরা যতটা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তা শনাক্ত করা ও দমন করার মতো প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই। তিনি মনে করেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আমাদের বিশেষ প্রশিক্ষিত ইউনিট দরকার। মুখপাত্র নিজেই যখন এ কথা বলেন, তখন আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ না বেড়ে পারে না। কিংবা বাংলাদেশের একটা জেলা শহরে কারারক্ষীকে ক্ষুর দিয়ে আক্রমণ করার পর ঘোষণা এল, এরপর কারারক্ষী কারা এলাকার বাইরে গেলে ইউনিফর্ম পরে যাবেন না—এই ঘোষণা নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের মনে নিরাপত্তার কোন আশ্বাসটা জোগাবে? অর্থবল, লোকবল, রসদ, সাজসরঞ্জামের এতটা অপ্রতুলতা! আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আছে দুর্নীতি। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের পুলিশ, আমাদের র্যাব, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে দক্ষতা, যোগ্যতার পরিচয় এর আগে দিয়েছে, তাতে তাদের ওপর আমাদের শ্রদ্ধা না এসে পারে না। এই সমাজে বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে পুলিশ চাইলে পারে না, এমন কিছু নেই। কখনো কখনো পুলিশ চায় না, কখনো কখনো পুলিশকে চাইতে দেওয়া হয় না। তা না হলে পুলিশ যেকোনো অপরাধ দমন করতে পারে, যেকোনো অপরাধীকে শনাক্ত করে ধরে ফেলতে পারে।
এই বিশ্বাসটাই মূল্যবান। গ্যালাপের জরিপে হয়তো এই মনোভাবটাই প্রকাশিত হয়েছে। আর পরিসংখ্যান দিয়ে দেখলেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো। কিন্তু সমস্যা তো কেবল চুরি-ডাকাতির নয়। সমস্যা কেবল যৌতুক, নারী নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতির নয়। এখন পৃথিবীজুড়েই নিরাপত্তার যে সমস্যা, তার কারণ বৈশ্বিক। যে কারণ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ নিজেরা খুব কমই দায়ী, ঠিক জলবায়ুর পরিবর্তনের বিপদের মতোই, বিপদ আমরা সৃষ্টি করিনি, কিন্তু সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছি আমরাই।
আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালোও করছে বাংলাদেশই। তেমনি বিশ্বব্যাপী উগ্রপন্থা, জঙ্গিবাদের যে বিপদ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে ভালো করব আমরাই—গ্যালাপের জরিপ আমাদের সেই প্রেরণা জোগাচ্ছে।
এর মূলে আছে বাংলাদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের মানুষ বীর, কিন্তু নিষ্ঠুর নয়; বাংলাদেশের মানুষ মোটের ওপর আসলেই শান্তিকামী। বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিনও পররাজ্যে হামলা করেনি, সাম্রাজ্য বিস্তার করতে যায়নি। নিজেরা ধান উৎপাদন করে, মসলিন উৎপাদন করে এই দেশের মানুষ সুখে ছিল। এই দেশের মানুষ ধার্মিক, ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ কিংবা মতান্ধ নয়। এই দেশে ধর্ম প্রচারিত হয়েছে সুফি সাধক, আউলিয়া, দরবেশদের মাধ্যমে; তাঁরা প্রচার করেছেন সাম্যের বাণী, ভালোবাসার কথা। মোগলরা এই দেশে এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাননি, মুসলমান শাসকেরা বাংলা সাহিত্যকে উৎসাহিত করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। তাঁরা এখানে থিতু হয়েছেন, বিয়েশাদি করে স্থানীয় হয়ে গেছেন।
কিন্তু সারা পৃথিবীতে অন্যত্র যেমন, আমাদের দেশও বিশ্বায়িত সন্ত্রাসবাদের বিপদের আওতামুক্ত নয়। এ থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত রাখতে আমাদের পারতেই হবে। সেটা করার জন্য দরকার হবে ৩৬০ ডিগ্রি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। এ জন্য দরকার হবে গণতন্ত্র, বাক্-স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। মানুষকে কথা বলতে না দিলে, বিরুদ্ধ মত,ÿ ক্ষোভ প্রকাশিত হতে না দিলে তা নিজেকে প্রকাশের জন্য বাঁকা পথ গ্রহণ করে। এ জন্য দরকার শিক্ষা, শিক্ষা মানে সুশিক্ষা। সেই শিক্ষা, যা মানুষের মনকে আলোকিত করে, তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে। শুধু ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা এমবিএ, বিবিএ পড়লে হয় না। অন্যদিকে যাঁরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন, তাঁদের জন্য দরকার মূলধারার জীবিকা অবলম্বনের দক্ষতা। তাঁরা যেন চাকরিবাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, মূলধারার জীবনযাপন করতে পারেন। তাঁদের যেন প্রান্তে ঠেলে দেওয়া না হয়। আসলে সমস্যার মূল যেন কেবল আইনশৃঙ্খলার মাটিতে খোঁজা নয়, এর মূল নিহিত আছে রাজনীতিতে এবং শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজে।
বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ ভালো করবেন, অনেকেই বৈষয়িক উন্নতি করবেন খুব বেশি। আমাদের আকাশরেখা বদলে যাচ্ছে গগনচুম্বী ভবন দিয়ে, আমাদের আকাশরেল হবে, পাতালরেল হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়ি চলবে আমাদের রাস্তা দিয়ে। আর অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষ কি পেছনে পড়ে রইবে? কিংবা একটা শ্রেণির মানুষ কি এই উন্নতির ইঁদুর দৌড়ের ট্র্যাকের বাইরে থাকবে? বাইরে থাকলে তারা কি সেটা মুখ বুজে সহ্য করবে? যেখানে বাইরের প্ররোচনা, অর্থায়ন, যোগাযোগ খুব একটা বাস্তব ঘটনা। আর বাংলাদেশ নিরুপদ্রবভাবে ভালোই করতে থাকবে, বাইরের শক্তিগুলোও কি তা হতে দিতে চাইবে?
কাজেই আজকে আমরা নিরাপত্তার যে ঝুঁকির মধ্যে আছি, তা সমাধানের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দক্ষ, যোগ্য করে তোলা, তাদের আধুনিক প্রযুক্তিতে বলীয়ান করা, তাদের প্রশিক্ষিত করা, আলাদা আইটি ইউনিট গড়ে তোলা, জনবল, অর্থবল, রসদ বাড়ানো—এসব তো একেবারে প্রাথমিক কাজ। পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপ। এবং দরকার জনগণকে যুক্ত রাখা। জনগণ চায় না বলেই এই দেশে চরমপন্থা কোনো দিনও সুবিধা করতে পারেনি। শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন যারা নিয়েছিল, তারা নিজেরাই মারামারি করে নিঃশেষিত হয়ে গেছে। কারণ, জনগণ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে, সন্ত্রাস করে পৃথিবীতে কেউ তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। নিজের মতবাদের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণিত হয় ভালোবাসার বাণী, শান্তির বার্তা, উৎকর্ষের অঙ্গীকার প্রচার করার মাধ্যমে। ১৯ নভেম্বর আবুল মোমেন প্রথম আলোয় একটা চমৎকার লেখা লিখেছেন। ইসলাম সারা পৃথিবীতে তার নিশান উড়িয়েছিল তখনই, যখন মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্পকলা, স্থাপত্যে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিল। শারজা ইসলামিক ঐতিহ্য জাদুঘর পরিদর্শনকালে আমার বারবার এ কথাই মনে হচ্ছিল। অ্যালজেবরা কথাটা আরবি। আবার শূন্য বা জিরোর ধারণা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে ভারত। মুসলমানরা গ্রিসের জ্ঞান অনুবাদ করে আরবিতে, পরে পশ্চিম আবার সেটা অনুবাদ করে নেয় আরবি থেকে। শারজা জাদুঘরের দেয়ালে লেখা আছে—মুসলমানরা ভালো করেছিল, এর কারণ তারা অন্যদের জ্ঞানকেও গ্রহণ করেছিল মূল্যবান বলে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকিত ভুবনের দিকে আমাদের মনের দরজা-জানালা সব খুলে রাখতে হবে। আর প্রচার করতে হবে ভালোবাসার কথা। কবির ভাষায়:
ও ভাই ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে
গোলাগুলির গোলেতে নয় গভীর ভালোবেসে।
ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়,
সে যে সৃজন পরিচয়।
প্রত্যেকের অন্তরে ভালোবাসা জাগ্রত করতে হবে। পৃথিবীর মোড়লেরা সেটা চান না। তাঁদের দরকার হয় যুদ্ধ, উন্মত্ততা। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষেরা শান্তির পক্ষে ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে এক জোট যদি হয়, সোচ্চার যদি হয়, তাহলেই কেবল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে আমরা বাঁচতে পারব। আর আমাদের দেশটাকে শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আমাদের সবার, সর্বাধিক দায়িত্ব দেশ-পরিচালকদের, কিন্তু প্রতিটা নাগরিকেরই কিছু না–কিছু করণীয় আছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments