ইন্দিরা গান্ধী এপ্রিলেই ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন by ওয়ালিউল হক
মুক্তিযুদ্ধের
শুরুতে অর্থাৎ ‘৭১-এর এপ্রিলের প্রথমেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী
ঢাকা দখলের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু ভারতীয়
সেনা কর্তৃপক্ষ ঢাকা দখলে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেই বলে অপারগতা প্রকাশ করলে
মিসেস গান্ধী ক্ষুব্ধ হন এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকেই ঢাকা
দখলের নির্দেশ দেন। ওপরের তথ্যটি পাকিস্তানি কোনো সেনা কর্মকর্তার দেয়া
তথ্য বলে মনে হলেও আসলে এ তথ্যটি প্রকাশ করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর
ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তার
লেখা 'Surrender at Dacca : Birth of a Nation' বইয়ে। কলকাতায়
জন্মগ্রহণকারী ও ইহুদি ধর্মাবলম্বী জেনারেল জ্যাকব যুদ্ধের সময়
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়টি তদারক করেন।
আমরা যারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, তারা বহু বছর ধরে জেনে আসছিলাম, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ভারতে প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয়। যার ফলে ভারতকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয় এবং ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করার পর ভারত পাল্টা আক্রমণ অভিযান শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা দখল করে।
মজার ব্যাপার হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা দখলের জন্য সেনাবাহিনীকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা অনেকের জানা থাকলেও বিএসএফকে যে ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা অনেকেরই জানা নেই। যেমন- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতের বিভিন্ন রকম সাহায্য-সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে নিজেই প্রশ্ন উত্থাপন করেন এই বলে যে, ভারত যখন ঘটনার সাথে এতটাই জড়িত, তখন তারা মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে সামরিক অভিযান চালিয়ে সমস্যার সমাধান করে ফেলল না কেন? কারণ সে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল শোচনীয়। অবশ্য প্রশ্ন উত্থাপন করার সাথে সাথে ভারতের মেজর জেনারেল ডি কে পালিতের বরাত দিয়ে তিনি প্রশ্নের উত্তরও জানিয়ে দিয়েছেন। ডি কে পালিতের মতে, পাঁচ হাজার কোটি রুপির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন থাকায় এবং সেই সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবস্থা নেয়া তখনো বাকি থাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না (পৃ-৯৮)।
জেনারেল জ্যাকব তার বইয়ে লিখেছেন, এপ্রিলের শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেক শ’ টেলিফোনে জানান যে, সরকার চাইছে ইস্টার্ন কমান্ড অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করুক। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘এটা অবাস্তব। কারণ আমাদের হাতে আছে শুধু পার্বত্য এলাকায় অভিযান পরিচালনার উপযোগী মাউন্টেন ডিভিশন। তাদের কাছে ব্রিজ তৈরির কোনো ধরনের সাজ-সরঞ্জাম নেই এবং সমতলে চলাচলের উপযোগী যানবাহনের পরিমাণও তাদের খুবই কম। কলকাতা থেকে ঢাকার মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ও চওড়া স্রোতস্বিনী নদী আছে। আবার বাংলাদেশের অপর পাশে আগরতলার প্রতিরোধব্যবস্থাও ভঙ্গুর। প্রতিরক্ষার জন্য সেখানে শুধু এক গ্যারিসন ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন আছে। দুরূহ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে শক্তি বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। আমাদের মাউন্টেন ডিভিশনগুলোকে উপযুক্ত সরঞ্জামে সজ্জিত করে নদীবহুল অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতেও বেশ সময় লেগে যাবে। আসন্ন বর্ষাকালে নিমজ্জিত ধানক্ষেতের কারণে সেতুবিহীন নদীগুলো পার হওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে রওয়ানা দিলেও আমরা বড়জোর পদ্মা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির পক্ষে বিশ্বজনমত তখনো পর্যন্ত সংগঠিত হয়নি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও পূর্ব পাকিস্তানের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে ততটা ওয়াকিবহাল ছিল না।’
জেনারেল মানেক শ’ জানতে চাইলেন, কবে নাগাদ আমরা তৈরি হতে পারব। আমি জানালাম, ‘আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম দেয়া হলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আমরা তৈরি হতে পারব। এর মধ্যে বর্ষার পানি সরে গিয়ে রাস্তাঘাটও চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠবে।’ হতাশ বিরক্ত মানেক শ’ বললেন, এ বিষয়ে পরে তিনি আমার সাথে কথা বলবেন।
পরদিন জেনারেল মানেক শ’ আবার ফোন করে যখন বললেন, উচ্চপর্যায়ের সরকারি আমলারা সেনাবাহিনীকে ‘কাপুরুষ না হলেও অতি-সাবধানী’ বলে অভিহিত করেছেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল তখন স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ। তিনি বললেন, বিষয়টি আমাদের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থেকে আমি বললাম যে, তিনি ইচ্ছে করলে সরকারকে জানিয়ে দিতে পারেন, ইস্টার্ন কমান্ডই টালবাহানা করছে এবং তারাই এই দেরির জন্য দায়ী। এই কথার ফলে তীব্র অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার একটা আশঙ্কা আমরা সৃষ্টি করলাম। তার পরেও এটা জেনারেল মানেক শ’র কৃতিত্ব ও সাহসিকতা যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আমাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
এর অব্যবহিত পরে আমার সাথে সাক্ষাতের জন্য বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) ডিরেক্টর জেনারেল কে রুস্তমজীর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ফোর্ট উইলিয়ামে আমার বাসায় আসেন। তার সাথে ছিলেন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলক মজুমদার ও মেজর জেনারেল নরিন্দর সিং। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন খুব উত্তেজিত। রুস্তমজী বললেন, হাতে বেশি সময় নেই, অথচ করণীয় কাজ প্রচুর। আমি জানতে চাইলাম, তিনি কিসের কথা বলছেন। তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানিদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়ানোর কাজটা ইস্টার্ন কমান্ড করতে রাজি না হওয়ায় সরকার বিএসএফের ওপর এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে।’ তিনি রসিকতা করছেন মনে করে আমি হেসে উঠলাম। কিন্তু গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন, আগামী দু-তিন সপ্তাহ পরে ঢাকায় যে বিজয়ী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তিনি নিয়েছেন, তাতে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে একটা দল পাঠানোর জন্য ইস্টার্ন কমান্ডকে আমন্ত্রণ জানাতেই তার এখানে আসা। এর মধ্যে নদীর ওপারে একটা অক্সিজেন প্লান্টে হঠাৎ বিস্ফোরণের আলোয় আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আমি বর্তমানে ফিরে এলাম। আমি অনুধাবন করলাম যে, তারা সত্যিই সিরিয়াস এবং তারা বিশ্বাস করেন যে, সেনাবাহিনী তার সব শক্তি ও সংস্থান দিয়েও যা করতে পারবে না বলে এই মুহূর্তে মনে করছে, সেটা করার ক্ষমতা তাদের আছে।
যখন আমি রাজস্থানে ১২ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডে ছিলাম, তখন থেকেই রুস্তমজীকে আমি চিনি। তাকে আমি বললাম, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তার বাহিনীকে ফিরে আসতে হবে। তিনি যদি তার বাহিনীকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগাতে চান, তাহলে তার উচিত হবে সুন্দরবনের জলাভূমিতে অথবা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করা। এর ফলে তিনি ভবিষ্যতে সুবিধাজনকভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে পারবেন।
বিএসএফের পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু একটা ঘটনার উল্লেখ করলে সেখান থেকেই অনেক কিছু বোঝা যাবে বলে আমার ধারণা। সপ্তাহ দুয়েক পরে যশোর রোডের বনগাঁ সীমান্ত পোস্টে নিয়োজিত বিএসএফের কমান্ডিং অফিসারের একটা ফোন পেলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক মাইল ভেতরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ঘেরাও করে ফেলেছে এবং পাকিস্তানি ট্যাংক তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত। আমি জানতাম, ওই এলাকায় কোনো পাকিস্তানি ট্যাংক নেই। এই ফোনের আসল উদ্দেশ্য ছিল লড়াইয়ের মধ্যে আমাদের আগেই জড়িয়ে ফেলা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের উদ্ধারের জন্য উদ্ধারকারী সেনাদল সেখানে পৌঁছাতে পারবে কি না। তিনি বললেন, পারবে। আমি তখন বললাম, যে পথ দিয়ে উদ্ধারকারী সেনাদল পৌঁছাতে পারবে, সেই একই পথ দিয়ে তাদেরও বেরিয়ে আসতে পারা উচিত। শেষ পর্যন্ত যদি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অথবা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কোনো অংশকে সাথে পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরও আমি সাথে নিয়ে নিতে বললাম। সীমান্তের এপার থেকে আমরা তাদের কাভার করব। তার পরে আমরা একটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন বর্ডার পোস্টে পাঠাই তাদের কাভার করার জন্য এবং এভাবেই বিএসএফের প্রত্যর্পণ শেষ হয়। প্রকাশিত পাকিস্তানি সূত্র অনুযায়ী, বিএসএফের ছয়জন সদস্যকে বন্দী করা হয় এবং পাকিস্তানিরা পরবর্তী সময়ে ঢাকায় তাদের প্যারেড করায়। এটাই ছিল ঢাকায় বিএসএফের বিজয়ী কুচকাওয়াজ! আনিসুর রহমান শাহমুদ অনূদিত, (পৃ: ২১-২৩)
পরবর্তী প্যারায় জেনারেল জ্যাকব বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী সম্পর্কে লেখেন, ‘রুস্তমজীকে আমি একজন দক্ষ ও বাস্তব-বুদ্ধিসম্পন্ন অফিসার হিসেবে জানতাম। আমি জানি না, কেন তিনি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এরকম একটি অভিযানে তার সৈন্যদের নিয়োজিত করলেন। হয়তো প্রচণ্ড চাপের মুখে তিনি এটা করেছেন অথবা তিনি চেয়েছিলেন, তার পরিশ্রমে গড়ে তোলা বিএসএফের জন্য এই সাফল্য বাড়তি প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে কিংবা এটাও হতে পারে যে, পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের অতিরঞ্জিত বর্ণনা তাকে প্রভাবিত করেছিল। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বিএসএফের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো তারা তাদের সাধ্য অনুযায়ী পালন করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিএসএফ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং অপরিসীম অবদান রেখেছে। প্রাথমিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও রুস্তমজী ও তার বাহিনী পরবর্তী সময়ে যে সাফল্য লাভ করেছেন, সেই কৃতিত্ব অবশ্যই তাদের প্রাপ্য’ (পৃ:-২৩)।
ইন্দিরা গান্ধী যে বিএসএফকে ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার স্বীকৃতি পাওয়া যায় বিএসএফের প্রধান জেনারেল রুস্তমজীর নোটের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ শীর্ষক গ্রন্থে। ড. মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ওই বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শিলিগুড়িতে অবস্থিত সেনাসদরে যান এবং পরদিন কুচবিহারে অবস্থিত একটি উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শন করেন। উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনের পর বিএসএফের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলক মজুমদারকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এমতাবস্থায় কখন ঢাকা যাওয়ার প্রত্যাশা করছেন?’ গোলক বললেন, ‘কখনো না- যতক্ষণ না আপনার সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে।’ ‘কেনো? আমি বিএসএফকে একাই কাজ করার কথা বলেছি।’ ‘বিএসএফ এ কাজ একা করতে পারবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংকবহর, কামান ও বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। সেজন্য আমাদের সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীরও সংযুক্ত হওয়ার দরকার আছে’ (পৃ:৫৪)। উপরিউক্ত কথোপকথন থেকে বোঝা যায়, ইন্দিরা গান্ধী আসলেই বিএসএফকে ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আমরা যারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, তারা বহু বছর ধরে জেনে আসছিলাম, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ভারতে প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয়। যার ফলে ভারতকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয় এবং ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করার পর ভারত পাল্টা আক্রমণ অভিযান শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা দখল করে।
মজার ব্যাপার হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা দখলের জন্য সেনাবাহিনীকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা অনেকের জানা থাকলেও বিএসএফকে যে ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা অনেকেরই জানা নেই। যেমন- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতের বিভিন্ন রকম সাহায্য-সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে নিজেই প্রশ্ন উত্থাপন করেন এই বলে যে, ভারত যখন ঘটনার সাথে এতটাই জড়িত, তখন তারা মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে সামরিক অভিযান চালিয়ে সমস্যার সমাধান করে ফেলল না কেন? কারণ সে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল শোচনীয়। অবশ্য প্রশ্ন উত্থাপন করার সাথে সাথে ভারতের মেজর জেনারেল ডি কে পালিতের বরাত দিয়ে তিনি প্রশ্নের উত্তরও জানিয়ে দিয়েছেন। ডি কে পালিতের মতে, পাঁচ হাজার কোটি রুপির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন থাকায় এবং সেই সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবস্থা নেয়া তখনো বাকি থাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না (পৃ-৯৮)।
জেনারেল জ্যাকব তার বইয়ে লিখেছেন, এপ্রিলের শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেক শ’ টেলিফোনে জানান যে, সরকার চাইছে ইস্টার্ন কমান্ড অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করুক। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘এটা অবাস্তব। কারণ আমাদের হাতে আছে শুধু পার্বত্য এলাকায় অভিযান পরিচালনার উপযোগী মাউন্টেন ডিভিশন। তাদের কাছে ব্রিজ তৈরির কোনো ধরনের সাজ-সরঞ্জাম নেই এবং সমতলে চলাচলের উপযোগী যানবাহনের পরিমাণও তাদের খুবই কম। কলকাতা থেকে ঢাকার মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ও চওড়া স্রোতস্বিনী নদী আছে। আবার বাংলাদেশের অপর পাশে আগরতলার প্রতিরোধব্যবস্থাও ভঙ্গুর। প্রতিরক্ষার জন্য সেখানে শুধু এক গ্যারিসন ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন আছে। দুরূহ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে শক্তি বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। আমাদের মাউন্টেন ডিভিশনগুলোকে উপযুক্ত সরঞ্জামে সজ্জিত করে নদীবহুল অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতেও বেশ সময় লেগে যাবে। আসন্ন বর্ষাকালে নিমজ্জিত ধানক্ষেতের কারণে সেতুবিহীন নদীগুলো পার হওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে রওয়ানা দিলেও আমরা বড়জোর পদ্মা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির পক্ষে বিশ্বজনমত তখনো পর্যন্ত সংগঠিত হয়নি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও পূর্ব পাকিস্তানের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে ততটা ওয়াকিবহাল ছিল না।’
জেনারেল মানেক শ’ জানতে চাইলেন, কবে নাগাদ আমরা তৈরি হতে পারব। আমি জানালাম, ‘আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম দেয়া হলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আমরা তৈরি হতে পারব। এর মধ্যে বর্ষার পানি সরে গিয়ে রাস্তাঘাটও চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠবে।’ হতাশ বিরক্ত মানেক শ’ বললেন, এ বিষয়ে পরে তিনি আমার সাথে কথা বলবেন।
পরদিন জেনারেল মানেক শ’ আবার ফোন করে যখন বললেন, উচ্চপর্যায়ের সরকারি আমলারা সেনাবাহিনীকে ‘কাপুরুষ না হলেও অতি-সাবধানী’ বলে অভিহিত করেছেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল তখন স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ। তিনি বললেন, বিষয়টি আমাদের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থেকে আমি বললাম যে, তিনি ইচ্ছে করলে সরকারকে জানিয়ে দিতে পারেন, ইস্টার্ন কমান্ডই টালবাহানা করছে এবং তারাই এই দেরির জন্য দায়ী। এই কথার ফলে তীব্র অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার একটা আশঙ্কা আমরা সৃষ্টি করলাম। তার পরেও এটা জেনারেল মানেক শ’র কৃতিত্ব ও সাহসিকতা যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আমাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
এর অব্যবহিত পরে আমার সাথে সাক্ষাতের জন্য বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) ডিরেক্টর জেনারেল কে রুস্তমজীর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ফোর্ট উইলিয়ামে আমার বাসায় আসেন। তার সাথে ছিলেন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলক মজুমদার ও মেজর জেনারেল নরিন্দর সিং। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন খুব উত্তেজিত। রুস্তমজী বললেন, হাতে বেশি সময় নেই, অথচ করণীয় কাজ প্রচুর। আমি জানতে চাইলাম, তিনি কিসের কথা বলছেন। তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানিদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়ানোর কাজটা ইস্টার্ন কমান্ড করতে রাজি না হওয়ায় সরকার বিএসএফের ওপর এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে।’ তিনি রসিকতা করছেন মনে করে আমি হেসে উঠলাম। কিন্তু গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন, আগামী দু-তিন সপ্তাহ পরে ঢাকায় যে বিজয়ী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তিনি নিয়েছেন, তাতে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে একটা দল পাঠানোর জন্য ইস্টার্ন কমান্ডকে আমন্ত্রণ জানাতেই তার এখানে আসা। এর মধ্যে নদীর ওপারে একটা অক্সিজেন প্লান্টে হঠাৎ বিস্ফোরণের আলোয় আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আমি বর্তমানে ফিরে এলাম। আমি অনুধাবন করলাম যে, তারা সত্যিই সিরিয়াস এবং তারা বিশ্বাস করেন যে, সেনাবাহিনী তার সব শক্তি ও সংস্থান দিয়েও যা করতে পারবে না বলে এই মুহূর্তে মনে করছে, সেটা করার ক্ষমতা তাদের আছে।
যখন আমি রাজস্থানে ১২ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডে ছিলাম, তখন থেকেই রুস্তমজীকে আমি চিনি। তাকে আমি বললাম, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তার বাহিনীকে ফিরে আসতে হবে। তিনি যদি তার বাহিনীকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগাতে চান, তাহলে তার উচিত হবে সুন্দরবনের জলাভূমিতে অথবা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করা। এর ফলে তিনি ভবিষ্যতে সুবিধাজনকভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে পারবেন।
বিএসএফের পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু একটা ঘটনার উল্লেখ করলে সেখান থেকেই অনেক কিছু বোঝা যাবে বলে আমার ধারণা। সপ্তাহ দুয়েক পরে যশোর রোডের বনগাঁ সীমান্ত পোস্টে নিয়োজিত বিএসএফের কমান্ডিং অফিসারের একটা ফোন পেলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক মাইল ভেতরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ঘেরাও করে ফেলেছে এবং পাকিস্তানি ট্যাংক তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত। আমি জানতাম, ওই এলাকায় কোনো পাকিস্তানি ট্যাংক নেই। এই ফোনের আসল উদ্দেশ্য ছিল লড়াইয়ের মধ্যে আমাদের আগেই জড়িয়ে ফেলা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের উদ্ধারের জন্য উদ্ধারকারী সেনাদল সেখানে পৌঁছাতে পারবে কি না। তিনি বললেন, পারবে। আমি তখন বললাম, যে পথ দিয়ে উদ্ধারকারী সেনাদল পৌঁছাতে পারবে, সেই একই পথ দিয়ে তাদেরও বেরিয়ে আসতে পারা উচিত। শেষ পর্যন্ত যদি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অথবা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কোনো অংশকে সাথে পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরও আমি সাথে নিয়ে নিতে বললাম। সীমান্তের এপার থেকে আমরা তাদের কাভার করব। তার পরে আমরা একটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন বর্ডার পোস্টে পাঠাই তাদের কাভার করার জন্য এবং এভাবেই বিএসএফের প্রত্যর্পণ শেষ হয়। প্রকাশিত পাকিস্তানি সূত্র অনুযায়ী, বিএসএফের ছয়জন সদস্যকে বন্দী করা হয় এবং পাকিস্তানিরা পরবর্তী সময়ে ঢাকায় তাদের প্যারেড করায়। এটাই ছিল ঢাকায় বিএসএফের বিজয়ী কুচকাওয়াজ! আনিসুর রহমান শাহমুদ অনূদিত, (পৃ: ২১-২৩)
পরবর্তী প্যারায় জেনারেল জ্যাকব বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী সম্পর্কে লেখেন, ‘রুস্তমজীকে আমি একজন দক্ষ ও বাস্তব-বুদ্ধিসম্পন্ন অফিসার হিসেবে জানতাম। আমি জানি না, কেন তিনি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এরকম একটি অভিযানে তার সৈন্যদের নিয়োজিত করলেন। হয়তো প্রচণ্ড চাপের মুখে তিনি এটা করেছেন অথবা তিনি চেয়েছিলেন, তার পরিশ্রমে গড়ে তোলা বিএসএফের জন্য এই সাফল্য বাড়তি প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে কিংবা এটাও হতে পারে যে, পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের অতিরঞ্জিত বর্ণনা তাকে প্রভাবিত করেছিল। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বিএসএফের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো তারা তাদের সাধ্য অনুযায়ী পালন করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিএসএফ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং অপরিসীম অবদান রেখেছে। প্রাথমিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও রুস্তমজী ও তার বাহিনী পরবর্তী সময়ে যে সাফল্য লাভ করেছেন, সেই কৃতিত্ব অবশ্যই তাদের প্রাপ্য’ (পৃ:-২৩)।
ইন্দিরা গান্ধী যে বিএসএফকে ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার স্বীকৃতি পাওয়া যায় বিএসএফের প্রধান জেনারেল রুস্তমজীর নোটের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ শীর্ষক গ্রন্থে। ড. মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ওই বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শিলিগুড়িতে অবস্থিত সেনাসদরে যান এবং পরদিন কুচবিহারে অবস্থিত একটি উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শন করেন। উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনের পর বিএসএফের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলক মজুমদারকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এমতাবস্থায় কখন ঢাকা যাওয়ার প্রত্যাশা করছেন?’ গোলক বললেন, ‘কখনো না- যতক্ষণ না আপনার সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে।’ ‘কেনো? আমি বিএসএফকে একাই কাজ করার কথা বলেছি।’ ‘বিএসএফ এ কাজ একা করতে পারবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংকবহর, কামান ও বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। সেজন্য আমাদের সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীরও সংযুক্ত হওয়ার দরকার আছে’ (পৃ:৫৪)। উপরিউক্ত কথোপকথন থেকে বোঝা যায়, ইন্দিরা গান্ধী আসলেই বিএসএফকে ঢাকা দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
No comments