যেভাবে এল তিন সিরিজ জয় by তারেক মাহমুদ
ক্রিকেটাঙ্গনে
এখন ‘কমন’ রসিকতা—আর কোনো দল তো বাংলাদেশে খেলতে আসবে না। এখানে এলেই
যে সবাই হারে! নিশ্চয়ই এখন সব দল বাংলাদেশকে নিজেদের দেশে ডেকে নিয়ে খেলতে
চাইবে।
রসিকতাকে রসিকতার মধ্যে রাখাই ভালো। তবে বাস্তবতাও কি এর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন? পাকিস্তান, ভারতের পর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও ওয়ানডে সিরিজে হারিয়ে বাংলাদেশ তো আসলেই নিজেদের মাঠে হুংকার ছাড়ল! কী এমন জাদুমন্ত্র লুকিয়ে আছে এই ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে? বাংলাদেশে এসে কেন সবাইকেই বিদায় নিতে হচ্ছে লেজ গুটিয়ে? তিন সিরিজে বাংলাদেশ দলকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে সেটাই খুঁজে বের করতে চেয়েছেন তারেক মাহমুদ
রসিকতাকে রসিকতার মধ্যে রাখাই ভালো। তবে বাস্তবতাও কি এর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন? পাকিস্তান, ভারতের পর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও ওয়ানডে সিরিজে হারিয়ে বাংলাদেশ তো আসলেই নিজেদের মাঠে হুংকার ছাড়ল! কী এমন জাদুমন্ত্র লুকিয়ে আছে এই ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে? বাংলাদেশে এসে কেন সবাইকেই বিদায় নিতে হচ্ছে লেজ গুটিয়ে? তিন সিরিজে বাংলাদেশ দলকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে সেটাই খুঁজে বের করতে চেয়েছেন তারেক মাহমুদ
পাকিস্তান: লক্ষ্যই ছিল সিরিজ জয়
বিশ্বকাপের পর পরই হলো পাকিস্তান সিরিজ। একে তো দেশের মাটিতে খেলা, তার ওপর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে আসার আত্মবিশ্বাসও তখন সঙ্গী। বড় কিছুর স্বপ্ন তাই চলেই আসছিল। স্বপ্নের পরিধি বাড়িয়ে দিল পাকিস্তানের অনভিজ্ঞ দল। কাউকে বাদ দেওয়া হলো, কেউ নিলেন অবসর। বাংলাদেশের সামনে খুলে গেল সম্ভাবনার দরজা। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার ভাষায়, ‘বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তানকে অন্তত দুটি ওয়ানডেতে হারানোর সামর্থ্য আমাদের আছে।’
দুটি নয়, একে একে তিনটি ওয়ানডেই জিতে গেল বাংলাদেশ! কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার মন্ত্র যেন দলের শিরায় বইয়ে দিল আত্মবিশ্বাসের তাজা স্রোত। একেক দলের বিপক্ষে ‘রণকৌশল’ একেক রকম হতেই পারে। তবে পাকিস্তান সিরিজের সাফল্যে একটা বিশেষ প্রতিজ্ঞা ভর করল দলের মধ্যে, খেলতে হবে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট। ‘এই একটা জায়গায় আমরা কোনো সিরিজেই আপস করিনি। অনেক সমালোচনার পরও আট ব্যাটসম্যান খেলানোর পরিকল্পনায় অটল ছিলাম। দলের জন্য যেটা ভালো মনে করেছি সেটাই করেছি’—বলেছেন অধিনায়ক
ভারত: এগিয়ে দিল প্রথম জয়টাই
ভারতকে অনভিজ্ঞ পাকিস্তানের মতো সহজ ভাবার কারণ ছিল না। তবু জয়ের ধারা থেকে এই সিরিজেও সরতে চায়নি বাংলাদেশ। লক্ষ্য ছিল অন্তত একটি হলেও ম্যাচ জেতার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরের সিরিজেও জয়ের অভ্যাসটা সঙ্গী থাকে তাহলে। কিন্তু প্রথম ওয়ানডেতেই সেই কাঙ্ক্ষিত জয় এসে যাবে, তা কে ভেবেছিল! ওই এক জয় পুরো সিরিজের চিত্রনাট্যই বদলে দিল।
ভারত সিরিজে চমক ছিলেন তরুণ বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। অধিনায়ক মাশরাফির দৃষ্টিতে যিনি একাই গড়ে দিয়েছেন ব্যবধান, ‘মুস্তাফিজকে দলে নেওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছিল আমরা কিছু একটা করতে পারব।’
সেই ‘কিছু একটা’ শেষ পর্যন্ত গিয়ে থামল সিরিজ জয়ে। কিন্তু শেষ ম্যাচে এ কোন বাংলাদেশ? টানা ম্যাচ খেলার ক্লান্তির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই হোক, কিংবা আত্মতৃপ্তি বা অন্য কিছু; জয়ের ধারাবাহিকতা শেষ ম্যাচ পর্যন্ত ধরে রাখা গেল না। সিরিজ শেষে মাশরাফি অবশ্য বলেছেন, ভারতকে হোয়াইটওয়াশ করার যে প্রত্যাশা ভর করেছিল দলের ওপর, কাল হয়েছে সেটাই। ভয়ডরহীন ক্রিকেটের পাশাপাশি ‘নির্ভার ক্রিকেট’ খেলার স্লোগানও উচ্চারিত হয় এই সিরিজের পর।
দ. আফ্রিকা : সবচেয়ে বড় সাফল্য
পাকিস্তান, ভারতের বিপক্ষে এক মাসের মধ্যে দুটি সিরিজ জয় প্রত্যাশার সীমায় নিয়ে আসে দক্ষিণ আফ্রিকাকেও। প্রথমে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য সিরিজের শুরু অস্বস্তি দিয়ে। তারপরও ভারত সিরিজের মতো প্রথম ম্যাচটিকেই পাখির চোখ করে বাংলাদেশ। যেভাবেই হোক জিততে হবে এই ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে জিতলে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত সিরিজে থাকা যায়।
তবে এবার হলো না। হার দিয়ে শুরু দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ। সেই হার উসকে দেয় সমালোচনার বিষবাষ্প। তাহলে কি পুরোনো দিনে ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট? শেষ হয়ে গেল সাফল্যের মধুচন্দ্রিমা!
না, আহত বাঘ শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে। মাশরাফির দলও পিছু হটল না। ঢাকায় পরের ম্যাচেই সমতা এনে চট্টগ্রামে হ্যাটট্রিক সিরিজ জয়ের উৎসব করল বাংলাদেশ। মাশরাফির দৃষ্টিতে তো তিন সিরিজ জয়ের মধ্যে এটাই সবচেয়ে এগিয়ে, ‘আমরা আমাদের আসল চেহারাটা দেখিয়েছি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ওদের মতো দলের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ হেরেও ২-১-এ সিরিজ জয় বিরাট সাফল্য। আমাদের ক্রিকেটের জন্যই অন্য রকম পাওয়া এটা।’
সিরিজ জয়ের ঝা-চকচকে সব ট্রফিতে ভরে উঠেছে বিসিবির শোকেস। তবে ট্রফি নয়, তিন সিরিজে তিন রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও শেষ হাসি হাসতে পারাটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বাংলাদেশের। প্রথম সিরিজে পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়ার পরও ভারতের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশের চাপ নিতে না পারা আরেকবার তাদের সামর্থ্যকে দাঁড় করিয়েছিল আত্মোপলব্ধির আয়নার সামনে। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে বাংলাদেশ করে দেখিয়েছে আসল কাজটা, যা এত দিন অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দলের কাছেই দেখেছে সবাই। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পেশাদার দলের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে হেরেও ঘুরে দাঁড়িয়ে সিরিজ জেতা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক মাইলফলক।
মাশরাফির দৃষ্টিতে অবশ্য এটাই পেশাদারি। বড় দল হয়ে ওঠার লক্ষণ, ‘আপনি যখন সব সময় জিততে থাকবেন তখন জেতাটা সহজ হয়ে যায়। যেকোনো দলের বিপক্ষেই তখন ছন্দে থাকবেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়টা এখানেই আলাদা।’ তাঁর হিসাবে, তিন সিরিজেই ৯০ শতাংশ পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পেরেছে বাংলাদেশ। সাফল্যের আসল রহস্য লুকিয়ে এখানেই।
No comments