স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার গণভোট by সাযযাদ কাদির
ইতিহাসে, প্রত্নতত্ত্বে, কিংবদন্তিতে সুবিখ্যাত ট্রয় নগরী এখন তুরস্কের অন্তঃপাতী ট্রুভা। এর পাশেই দারদানেলেস প্রণালী। সেখানে আইদা পর্বতের উপরে স্থাপিত দারদানা নগরীর রাজপুত্র ছিলেন আনকাইসিস ও দেবী ভেনাস (আফরোদিতি)-র প্রেমজ সন্তান ইনিয়াস। ট্রয় যুদ্ধের অন্যতম বীর নায়ক তিনি। তাঁর বংশধর ব্রুটাস বা ব্রুট অভ ট্রয় পত্তন করেন বর্তমান বৃটেনের, তিনিই প্রথম রাজা বৃটেনের। এ উপকথার হদিস মেলে নবম শতকের ওয়েলশ সন্ত নেনিয়াস রচিত ‘হিসটোরিয়া বৃটোনাম’ নামের ইতিবৃত্তে। এ বৃত্তান্তের আরও বিশদ রূপ মেলে দ্বাদশ শতকের ওয়েলশ যাজক জিওফ্রে অভ মনমুথ রচিত ‘হিসটোরিয়া রিগাম বৃটানিয়া’য়। ইংরেজদের লোককথায় বলা হয়, ব্রুটাসের তিন পুত্র- লোকরিনাস, আলবানাকটাস ও কামবার। মৃত্যুর আগে লোকরিনাসকে ইংল্যান্ড, আলবানাকটাসকে স্কটল্যান্ড এবং কামবারকে ওয়েলশ শাসনের ভার দিয়ে যান তিনি। এ কিংবদন্তি মানতে রাজি নন স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মানুষ। তাঁদের লোককথায় রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৃত্তান্ত। সে বৃত্তান্ত অনুযায়ী জনপদ হিসেবে স্কটল্যান্ডের পত্তন আরও অনেক আগে। গ্রিক রাজপুত্র গোইডেল গ্লাস ও মিশরীয় ফারাও-দুহিতা স্কটা-র বংশধর বলে নিজেদের দাবি করেন তাঁরা। তাঁদের বিশ্বাস, ঐতিহ্যিক ‘স্টোন অভ ডেসটিনি’ মিশর থেকে স্কটা-ই এনেছেন স্কটল্যান্ডে।
দু’টি অঞ্চলের মানুষের এই স্বাতন্ত্র্যচেতনার পরিচয় মেলে সেই পৌরাণিক যুগ থেকেই। তবে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু ১২৯৬ অব্দ থেকে। ওই বছর ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড যুদ্ধাভিযান চালান স্কটল্যান্ডে। হানাদারদের তাড়িয়ে দিতে স্কটল্যান্ডের মানুষ যুদ্ধ শুরু করে উইলিয়াম ওয়ালেস-এর নেতৃত্বে। পরের বছর বিদ্রোহ করেন রবার্ট দ্য ব্রুস। যুদ্ধ চলে বছরের পর বছর। শেষে ১৩১৪ সালে বানোকবার্ন-এর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে ইংরেজ বাহিনী। ওই যুদ্ধের ঠিক ৭০০ বছর পর, আসছে বৃহস্পতিবার ১৮ই সেপটেম্বর, আবারও এক স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ড তথা গ্রেট বৃটেন তথা যুক্তরাজ্যের মুখোমুখি হয়েছে স্কটল্যান্ড। এ যুদ্ধ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, রক্তপাতহীন। ওই দিন গণভোট হবে স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে। এ গণভোটের জন্য অবশ্য সংগ্রাম করতে হয়েছে অনেক। সে সংগ্রামের শুরু ১৯৩৪ সালে। ওই বছর গঠিত হয় স্বাধীনতাপন্থি রাজনৈতিক দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এস এন পি)। এ দল পার্লামেন্টে প্রথম আসন পায় ১৯৪৫ সালে। ১৯৭৩ সালে স্কটল্যান্ড ও ওয়েলশ-এ দায়িত্ব হস্তান্তরের সুপারিশ করে কিলব্র্যান্ডন কমিশন। ১৯৭৯ সালে গণভোট হয় স্কটল্যান্ডে দায়িত্ব হস্তান্তর প্রশ্নে, কিন্তু প্রয়োজনীয় ৪০% ভোট পেতে ব্যর্থ হন হস্তান্তরপন্থিরা। মারগারেট থ্যাচারের রক্ষণশীল সরকার পোল ট্যাক্স চালু করায় স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ১৯৭৯ সাল থেকে। ১৯৯৬ সালে রাজা-রানীর অভিষেক শিলা হিসেবে ব্যবহৃত ‘স্টোন অভ ডেসটিনি’ স্কটল্যান্ডে ফেরত পাঠায় বৃটিশ সরকার। ১৯৭৭ সালের গণভোটে বিপুল সমর্থন পায় কর-বৃদ্ধির ক্ষমতা সহ স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার দাবি। ১৯৯৮ সালে প্রণীত হয় স্কটিশ অ্যাক্ট- দেয়া হয় স্কটিশ পার্লামেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে দায়িত্ব। ১৯৯৯ সালে ১২৯ সদস্যের স্কটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টি পায় ৫৬ আসন, এসএনপি পায় ৩৫ আসন। ২০০৪ সালে হলিরুড-এ রাজকীয় উদ্বোধন হয় স্কটিশ পার্লামেন্টের। ২০০৭ সালে স্কটিশ সরকারের উদ্যোগে জাতীয় সংলাপ শুরু হয় স্কটল্যান্ডের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। ২০০৭ সালে কয়েকটি ইস্যুতে গ্রিন পার্টির সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে এসএনপি। ২০১১ সালে ফার্স্ট মিনিস্টার অ্যালেক্স সালমন্ড-এর নেতৃত্বে ৬৯ আসন পেয়ে স্কটল্যান্ডের প্রথম সংখ্যাগুরু সরকার গঠন করে এসএনপি। ২০১২ সালের অকটোবরে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও অ্যালেক্স সালমন্ড স্বাক্ষর করেন ‘এডিনবরা এগ্রিমেন্ট’, খুলে যায় স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের পথ। ২০১৩ সালের নভেম্বরে স্কটিশ সরকার স্বাধীনতার পক্ষে কি ও কেন তুলে ধরে প্রকাশ করে স্কটল্যান্ড’স ফিউচার শীর্ষক শ্বেতপত্র। অবশেষে আগামী বৃহস্পতিবার গণভোট।
এখন এই শেষ সপ্তাহে পক্ষে বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণা চলছে তুঙ্গে। জরিপের পর জরিপ চলছে, প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিদিন। মিডিয়ায় এই হ্যাঁ তো এই না অবস্থা। তবে সব মিলিয়ে প্রচারে এগিয়ে আছে না-পন্থিরা। বিবিসি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যম পক্ষপাতিত্বমূলক প্রচার চালাচ্ছে বলে প্রতিবাদ উঠেছে জোরেশোরে। স্কটিশরা দু’ ভাগ হয়ে গেছে প্রায় সমান-সমান। হাঁ-পন্থিদের পক্ষে বরাবরই জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছেন প্রখ্যাত অভিনেতা স্যন কনেরি সহ অনেক নন্দিত স্কটম্যান। অন্যদিকে স্কটউওম্যান বেস্টসেলার লেখিকা জে কে রোলিং নেমেছেন না-পন্থিদের পক্ষে। তাঁদের প্রচার-তহবিলে দিয়েছেন ১০ লাখ পাউন্ড।
স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পাবে কি স্কটল্যান্ড? বলা সম্ভব নয় কোনও ভাবেই। ১৯৮০ ও ১৯৯৫ সালে এমনই গণভোট হয়েছিল কুইবেক-এ, কানাডা থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন ওই ফরাসিভাষী প্রদেশের মানুষ। কিন্তু জয়যুক্ত হয় না-ভোট। শেষের বার অবশ্য সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান হাঁ-পন্থিরা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতা, মুক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি তুলে নির্যাতিত হচ্ছে বহু জাতি, জাতিসত্তা, জনগোষ্ঠী- অনেকে বেছে নিয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষের পথ। শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় ব্যর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ। এ অবস্থায় গণভোটের মাধ্যমে জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে কুইবেকের পর নিশ্চয়ই এক আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে স্কটল্যান্ড।
১২.০৯.২০১৪
দু’টি অঞ্চলের মানুষের এই স্বাতন্ত্র্যচেতনার পরিচয় মেলে সেই পৌরাণিক যুগ থেকেই। তবে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু ১২৯৬ অব্দ থেকে। ওই বছর ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড যুদ্ধাভিযান চালান স্কটল্যান্ডে। হানাদারদের তাড়িয়ে দিতে স্কটল্যান্ডের মানুষ যুদ্ধ শুরু করে উইলিয়াম ওয়ালেস-এর নেতৃত্বে। পরের বছর বিদ্রোহ করেন রবার্ট দ্য ব্রুস। যুদ্ধ চলে বছরের পর বছর। শেষে ১৩১৪ সালে বানোকবার্ন-এর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে ইংরেজ বাহিনী। ওই যুদ্ধের ঠিক ৭০০ বছর পর, আসছে বৃহস্পতিবার ১৮ই সেপটেম্বর, আবারও এক স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ড তথা গ্রেট বৃটেন তথা যুক্তরাজ্যের মুখোমুখি হয়েছে স্কটল্যান্ড। এ যুদ্ধ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, রক্তপাতহীন। ওই দিন গণভোট হবে স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে। এ গণভোটের জন্য অবশ্য সংগ্রাম করতে হয়েছে অনেক। সে সংগ্রামের শুরু ১৯৩৪ সালে। ওই বছর গঠিত হয় স্বাধীনতাপন্থি রাজনৈতিক দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এস এন পি)। এ দল পার্লামেন্টে প্রথম আসন পায় ১৯৪৫ সালে। ১৯৭৩ সালে স্কটল্যান্ড ও ওয়েলশ-এ দায়িত্ব হস্তান্তরের সুপারিশ করে কিলব্র্যান্ডন কমিশন। ১৯৭৯ সালে গণভোট হয় স্কটল্যান্ডে দায়িত্ব হস্তান্তর প্রশ্নে, কিন্তু প্রয়োজনীয় ৪০% ভোট পেতে ব্যর্থ হন হস্তান্তরপন্থিরা। মারগারেট থ্যাচারের রক্ষণশীল সরকার পোল ট্যাক্স চালু করায় স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ১৯৭৯ সাল থেকে। ১৯৯৬ সালে রাজা-রানীর অভিষেক শিলা হিসেবে ব্যবহৃত ‘স্টোন অভ ডেসটিনি’ স্কটল্যান্ডে ফেরত পাঠায় বৃটিশ সরকার। ১৯৭৭ সালের গণভোটে বিপুল সমর্থন পায় কর-বৃদ্ধির ক্ষমতা সহ স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার দাবি। ১৯৯৮ সালে প্রণীত হয় স্কটিশ অ্যাক্ট- দেয়া হয় স্কটিশ পার্লামেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে দায়িত্ব। ১৯৯৯ সালে ১২৯ সদস্যের স্কটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টি পায় ৫৬ আসন, এসএনপি পায় ৩৫ আসন। ২০০৪ সালে হলিরুড-এ রাজকীয় উদ্বোধন হয় স্কটিশ পার্লামেন্টের। ২০০৭ সালে স্কটিশ সরকারের উদ্যোগে জাতীয় সংলাপ শুরু হয় স্কটল্যান্ডের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। ২০০৭ সালে কয়েকটি ইস্যুতে গ্রিন পার্টির সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে এসএনপি। ২০১১ সালে ফার্স্ট মিনিস্টার অ্যালেক্স সালমন্ড-এর নেতৃত্বে ৬৯ আসন পেয়ে স্কটল্যান্ডের প্রথম সংখ্যাগুরু সরকার গঠন করে এসএনপি। ২০১২ সালের অকটোবরে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও অ্যালেক্স সালমন্ড স্বাক্ষর করেন ‘এডিনবরা এগ্রিমেন্ট’, খুলে যায় স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের পথ। ২০১৩ সালের নভেম্বরে স্কটিশ সরকার স্বাধীনতার পক্ষে কি ও কেন তুলে ধরে প্রকাশ করে স্কটল্যান্ড’স ফিউচার শীর্ষক শ্বেতপত্র। অবশেষে আগামী বৃহস্পতিবার গণভোট।
এখন এই শেষ সপ্তাহে পক্ষে বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণা চলছে তুঙ্গে। জরিপের পর জরিপ চলছে, প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিদিন। মিডিয়ায় এই হ্যাঁ তো এই না অবস্থা। তবে সব মিলিয়ে প্রচারে এগিয়ে আছে না-পন্থিরা। বিবিসি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যম পক্ষপাতিত্বমূলক প্রচার চালাচ্ছে বলে প্রতিবাদ উঠেছে জোরেশোরে। স্কটিশরা দু’ ভাগ হয়ে গেছে প্রায় সমান-সমান। হাঁ-পন্থিদের পক্ষে বরাবরই জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছেন প্রখ্যাত অভিনেতা স্যন কনেরি সহ অনেক নন্দিত স্কটম্যান। অন্যদিকে স্কটউওম্যান বেস্টসেলার লেখিকা জে কে রোলিং নেমেছেন না-পন্থিদের পক্ষে। তাঁদের প্রচার-তহবিলে দিয়েছেন ১০ লাখ পাউন্ড।
স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পাবে কি স্কটল্যান্ড? বলা সম্ভব নয় কোনও ভাবেই। ১৯৮০ ও ১৯৯৫ সালে এমনই গণভোট হয়েছিল কুইবেক-এ, কানাডা থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন ওই ফরাসিভাষী প্রদেশের মানুষ। কিন্তু জয়যুক্ত হয় না-ভোট। শেষের বার অবশ্য সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান হাঁ-পন্থিরা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতা, মুক্তি, আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি তুলে নির্যাতিত হচ্ছে বহু জাতি, জাতিসত্তা, জনগোষ্ঠী- অনেকে বেছে নিয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষের পথ। শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় ব্যর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ। এ অবস্থায় গণভোটের মাধ্যমে জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে কুইবেকের পর নিশ্চয়ই এক আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে স্কটল্যান্ড।
১২.০৯.২০১৪
No comments