দিল্লি ও ঢাকার উচিত সমস্যার দ্রুত সমাধান করা -বিশেষ সাক্ষাৎকারে এম জে আকবর by সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক এম
জে আকবর এখন ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র। সানডে, দ্য
টেলিগ্রাফ ও ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য
বই শেড অব সোর্ডস: জিহাদ অ্যান্ড দ্য কনফ্লিক্ট বিটুইন ইসলাম অ্যান্ড
ক্রিশ্চিয়ানিটি (২০০৩), ব্লাড ব্রাদার্স-এ ফ্যামিলি সাগা (২০০৬) ও
টিন্ডারবক্স: দি পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার অব পাকিস্তান (২০১২)। সম্প্রতি ঢাকা
সফরকালে তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
>>>সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো : হঠাৎ বিজেপিতে কেন? এটা আপনার ঢাকার বন্ধুদেরও অবাক করেছে।
এম জে আকবর : এর প্রচুর জবাব দিয়েছি। এটা যদিও ব্যক্তিগত বিষয় তবুও বলি, বিজেপি সম্পর্কে লোকের যে ধারণা, সেটা অত্যন্ত ভ্রান্ত ব্যাখ্যাপ্রসূত। আর সবচেয়ে স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নরেন্দ্র মোদিই দিয়েছেন। গত বছরের ১৫ আগস্টে প্রথমেই তিনি ভারতকে সংজ্ঞায়িত করলেন। বললেন, পাবলিক লাইফ (জনজীবন) পরিচালিত হবে ভারতের সংবিধান দ্বারা। আর ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। সুতরাং অঙ্গীকারের জায়গাটা এখানেই ফয়সালা হলো। দর্শনগত দিকও এতে স্পষ্ট।
প্রথম আলো : দর্শনের কথা যদি বলেন, তাহলে তো বলতে হয় যে আপনি নিজে মনে করেন যে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত লাকুম দিনুকুম (যার ধর্ম তার কাছে)-এর সঙ্গে আপনি ভারতীয় সংবিধানের বিরোধ দেখেন না।
এম জে আকবর : হ্যাঁ, ঠিক।
প্রথম আলো : লাকুম দিনুকুম-এর সঙ্গে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের কি বিরোধ নেই? এর মধ্যে কীভাবে তার সমন্বয় ঘটাবেন?
এম জে আকবর : কোনো অসুবিধা দেখি না। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, হিন্দুত্ববাদ হলো সাংস্কৃতিক বাস্তবতা।
প্রথম আলো : বিজেপি কি সেটা কেবল এই অর্থেই ব্যবহার করে?
এম জে আকবর :ওই অর্থেই ব্যবহার করে। কোনো ধরনের নিরাপত্তাবোধহীনতা সৃষ্টির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যা চলছে সেটা একটা অসম্ভব, সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাসযোগ্য আনফিজিবল মাইন্ডসেট। এটা সাংস্কৃতিক মাইন্ডসেট। যেহেতু সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, একটু ভেবে বলি। যেমন এই আমরা কথা বলছি, এই মুহূর্তে একটা সংকট হয়ে যাচ্ছে। আর ওই রকম একটা সংকট যখন আমাদের ওপর একটা আক্রমণ হচ্ছে। তখন ভাবি সব ভুলে যাব। তখন মগজে যা লেখা থাকে সেটা বেরোবে। আমার মনে পড়ে গান্ধী ময়দানে ঘটনা ঘটেছিল। সেটা বিহারের পাটনায়। গত বছরের অক্টোবরে মোদি যখন বক্তব্য দেন, তখন তাঁর ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালাল। খুবই ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা। ওনার ওপর তখন ২০০ ক্যামেরা। সেটা ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত উত্তেজনাকর মুহূর্ত। দুবৃর্ত্তরা ধরা পড়েছে। ষড়যন্ত্রও উদ্ঘাটিত হয়েছে। তখন তিনি কী বললেন, আমি সেটা হিন্দিতে বলতে চাই। আপনি সেটা বাংলায় তরজমা করে দেবেন। প্রথমেই বললেন, উসকানি যতই আসুক, শান্তির কোনো বিকল্প নেই। তারপর তিনি বললেন, হিন্দুকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ও মুসলমানের সঙ্গে লড়বে, নাকি গরিবির সঙ্গে লড়বে। আর মুসলিমদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা হিন্দুর বিরুদ্ধে লড়বে, না গরিবির বিরুদ্ধে লড়বে। আমাদের শত্রু গরিবি। যত দিন না একত্র হচ্ছি তত দিন তো আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারব না। এরপর বললেন, সামগ্রিক বিষয় হলো আপনি কী ধরনের মুসলিম দেখতে চান? মোদি মুসলমানদের এক হাতে কোরআন অন্য হাতে কম্পিউটার দেখতে চান।
প্রথম আলো : কিন্তু আমরা এতকাল বিজেপিকে একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে জেনে এসেছি। আপনার বহু লেখালেখিও সেই সাক্ষ্য দেবে।
এম জে আকবর : সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমরা সবাই লিখেছি। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমি কংগ্রেসের ওপর লিখিনি? হাজার হাজার দাঙ্গা সম্পর্কে লিখেছি। মোদির গুজরাটের রায়ট নিয়েই এই বিতর্কটা হচ্ছে। ১০ বছর হয়ে গেল। কংগ্রেস যত চেষ্টা করতে পারত, সরকার, পুলিশ, সিবিআই ও বিচার বিভাগের সব উপাদান ব্যবহার করেছে। বিষয়টি লোয়ার কোর্টস, মিডল কোর্টস এবং সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত করেছে। কেউ তাঁর (মোদি) ওপরে ব্যক্তিগতভাবে দায় চাপাতে সক্ষম হননি।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে বিজেপির বর্তমান যে নীতি, সেটা কোথায়, কতটুকু সংগতিপূর্ণ বা অসংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়?
এম জে আকবর : প্রথম থেকে এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মাথা বেশ পরিষ্কার। তাঁর বিদেশনীতির কয়েকটি কদম আমরা দেখতে পেয়েছি। এবার তিনি প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে দক্ষিণ এশিয়ার না, বলব ভারতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের শতকরা ৩০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাদের কীভাবে ওপরে নিয়ে আসা যায়। যখন তিনি বললেন যে তাঁর মা কাজের বুয়ার কাজ করতেন। বুয়ার কাজ করে আমাদের খাওয়াতেন; ১০/১১ বছর বয়সে রেলস্টেশনে চা বিক্রি করেছেন, এসব কথা বলেছেন রেডফোর্টে গিয়ে, আর কোনো প্রধানমন্ত্রীর হিম্মত হয়নি এসব বলার। যখন তিনি নারীদের টয়লেট সমস্যার কথা বলেন, তখন কি আমরা ভাবতে পারি যে তাদের অবমাননা ও স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়টি কত গভীরভাবে অনুভব করেন।
সংসদে নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতেই বললেন, গরিবদের জন্যই যদি সরকার না করা যায়, তাহলে সরকার বলতে আমরা কী বুঝব? এটা কিন্তু তাঁর ওই রাজনৈতিক দর্শনেরই সম্প্রসারণ। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র্যপীড়িত ভূমি। তিনি বললেন, আমরা সংঘাতে থাকলে কোনো সমস্যার সুরাহা করতে পারব না। কিন্তু সহযোগিতার সংস্কৃতি এবং পরিবেশ সৃষ্টির যে চেষ্টা তিনি করছেন, তার বার্তাটা কিন্তু সাদরে গৃহীত হয়েছে। এটা কিন্তু তাঁর ওই দর্শনেরই একটি সম্প্রসারণ। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র্য জলাভূমি।
প্রথম আলো : এখানেই...
এম জে আকবর : না। আমাকে বলতে দিন। এটা বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র্য ডোবা। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, আমরা সংঘাতে থাকলে কোনো সমস্যার সুরাহা করতে পারব না। প্রথমত, একমাত্র সহযোগিতা হলেই পারব। দ্বিতীয় কথা হলো, কোনো জাতিই কিন্তু বিগ ব্রাদার নয়। প্রত্যেকেই সমান। সবাই সমান। আয়তন দিয়ে বড় ভাই বা ছোট ভাই হওয়া যায় না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যতই সমস্যা থাকুক সেটা সমাধোনের বাইরে নয়। ভাইদের মধ্যেও টেনশন থাকে। কিন্তু আপনি হয়তো অবাক হয়ে যাবেন, নেপালে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ১৭ বছর যাননি। সেখানে গিয়ে উনি বললেন, দিজ ইজ নো বিগ ব্রাদার স্টেট। আমি খুবই আশাবাদী। সব সমস্যার সমাধান তো সম্ভব নয়। কিন্তু সংস্কৃতি এবং পরিবেশ সৃষ্টির যে চেষ্টা করছেন, তার বার্তাটা কিন্তু উষ্ণতার সঙ্গে সাদরে গৃহীত হয়েছে।
প্রথম আলো : মোদি সরকার বাংলাদেশে কংগ্রেসের চেয়ে ভারতীয় সহায়তা হ্রাস করেছে। তাঁর নিকট প্রতিবেশীদের থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম। তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন কি?
এম জে আকবর : আমি এর বিস্তারিত জানি না।
প্রথম আলো : ভারতে সরকার পরিবর্তনের পরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন কেমন?
এম জে আকবর : বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র। একটি জাতি। মর্যাদার সঙ্গে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। আমি বেশি বলতে চাই না। কারণ, এর একটি প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র। তার সঙ্গে সম্মান ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়তে হবে। আপনাকে অবশ্যই অর্থনৈতিক সহযোগিতা খুঁজে বের করতে হবে। আপনাকে বিনিয়োগ খুঁজতে হবে। আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করতেন, ভারতীয় বাণিজ্যের মধ্যে বিনিয়োগ এখানে কতটা এসেছে বা আসছে, সেটা আমি অধিকতর নিজের বলে গ্রহণ করতাম। কারণ, বিনিয়োগ আপনাকে কবুল করতে হবে। বিনিয়োগেই দুই দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত। কারণ, এটা একটা যৌথ সহযোগিতামূলক বিষয়। মোদি সাহায্যের জন্য জাপান সফরে যাননি।
প্রথম আলো : আপনার কথায় ওই সফর একটা রূপান্তরকরণ।
এম জে আকবর : নিশ্চয়ই। ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে তাদের শর্তে। আমাদের দেশে ৫০টি বড় শহর আছে। আমরা জাপানকে বলব তোমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আছে। আমি ভারতীয় সরকারের নই। আমি মনে করি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিহিত আমরা কতখানি প্রকৃত অভিন্ন সম্পদ সৃষ্টি করতে পারি তার ওপর। দক্ষিণ এশিয়ায় এটা কতটা পারি তার ওপর। সমৃদ্ধি এখানে অংশীদারিমূলক সমৃদ্ধি। আমাদের বিনিয়োগ পরিণত হচ্ছে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও মানবসম্পদ বিনিয়োগে।
প্রথম আলো : এতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইচ্ছা আছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে সমস্যা ছিল, সেটা এখন আর খুব বড় বাধা নয় বলে মনে করেন?
এম জে আকবর : না, এখন আর কোনো বাধা মনে হয় না।
প্রথম আলো : পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একটা পরিবর্তন এসে গেছে? একটা সময়ই তো সাম্প্রদায়িকতাকেই প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেটা আজ উল্টে গেছে?
এম জে আকবর : আমি এখানে এসেছি গত চার দিন হলো। আমি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের চোখ দেখেছি। দেখলাম, তারা সব ধরনের ‘হ্যাংওভার অব বিটারনেস’ বা তিক্ততার রেশ ধরে থাকতে আগ্রহী নয়। তারা নিজেদের জন্য উন্নত জীবন চায়। চাকরি চায়। চাকরি না দিলে মর্যাদা কোথা থেকে আসবে? চাকরি না দিলে আত্মমর্যাদা কোথা থেকে আসবে? উত্তর প্রদেশে পরাজয়ের একটা বড় কারণ হলো ১০ বছরে ওরা মাত্র দেড় কোটি চাকরি সৃষ্টি করেছে। ভেবে দেখো, আমার বয়স ২০। আমার ৩০ হয়ে গেল কিন্তু চাকরি পাইনি। সেখানে কি আর কোনো আশা থাকে? পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ওপর বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে একটি ধ্বংসকর তত্ত্ব (পরনিশাস থিওরি) আরোপ করা হয়েছে। সেটা হলো ট্রিকল ডাউন। আমি বিশ্বব্যাংককে বললাম, তোমরা কি জানো তোমরা কী বলছ? ট্রিকল ডাউন মানে যার সুইমিংপুল আছে, তাকে তুমি ঝরনা দেবে। আর যে পিয়াসে মরে যাচ্ছে, তাকে তুমি নালকার দুটি-তিনটি ফোঁটা দেবে। বিশ্বব্যাংকের এই নীতি ভারতের জন ধান কর্মসূচি উল্টে দিচ্ছে। আর সেটাই হলো ট্রিকলআপ।
প্রথম আলো : বাংলাদেশে অনেকেই এটা জানতে আগ্রহী হবেন যে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান কতগুলো সমস্যা, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি এবং স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের ব্যাপারে কত দূর কী হলো?
এম জে আকবর : এই প্রশ্ন করা আপনার অধিকার। আমি এতটুকুই জানি, সরকার কী করবে বা করবে না, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আমার নিয়তটা কী সেটা তো আমি বলতে পারি?
প্রথম আলো : জি, সেটাই বলুন।
এম জে আকবর : নিয়তটা হচ্ছে, কোনো সমস্যা যত তাড়াতাড়ি সমাধান করা যায়, তা-ই করো। সমস্যাকে জিইয়ে রেখো না। সেটা করলে তা সম্পর্কের ওপর বোঝা সৃষ্টি করবে। এবং ‘ডোন্ট ট্রিট বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল।’ মানে হলো, আচ্ছা ঠিক আছে, একটা আলোচনা হয়ে গেল। মেক অ্যান এফর্ট।
প্রথম আলো : এর আগে আমরা ধারণা পেলাম যে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার রাজি ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজি না হওয়ায় তা আটকে গেল। আপনাদের সংবিধান কী বলে? আইন কী বলে? প্রতিবেশীকে পানির হিস্যা দেওয়া কি রাজ্যের বিষয়? তারা কখনো না চাইলে কেন্দ্রীয় সরকারের কি কিছুই করার নেই? তিস্তা নয়, আপনি সাধারণভাবেই বলুন।
এম জে আকবর :এটা আপনার বৈধ প্রশ্ন। আমাদের ফেডারেল সরকার। সুতরাং তার ফেডারেল সম্পর্ক তো আছেই। রাজ্যের ক্ষমতা কোনো দিন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। আমাদের ফেডারেল পদ্ধতির একটা অনন্য চরিত্র আছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনো জিওগ্রাফির ওপর কোনো হুকুমত করে না। অল দ্য জিওগ্রাফি ইজ রুলড বাই স্টেট গভর্নমেন্ট।
প্রথম আলো : পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস আছে। মমতাকে হটিয়ে পরের নির্বাচনে বিজেপি সেখানে আসতে পারে বলে তারা আশাবাদী। তাহলে কি তিস্তার জন্য আমাদের ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে?
এম জে আকবর : এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর আমাদের বিদেশমন্ত্রী জানবেন। কিন্তু আমার যে জবাবটা, সেটা জেনে আপনারা হয়তো অবাক হবেন যে আমরা চেষ্টা করব, এটাকে সমাধানের জন্য। নিশ্চিতভাবেই। কারণ, আমি আপনাকে এটা বলতে পারি, বিজেপি সরকার সম্পর্ক উন্নততর করতে আগ্রহী। কেবল বাংলাদেশের সঙ্গেই নয়, সরকার জনগণের সঙ্গে উন্নততর সম্পর্ক করতে চায়।
প্রথম আলো : মানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে—
এম জে আকবর : জনগণের সঙ্গে। কারণ, আমরা প্রতিবেশী।
প্রথম আলো : আপনি সম্ভবত বলতে চাইছেন যে এই জনগণের কোনো সীমান্ত নেই।
এম জে আকবর : জনগণ। সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রাখা জনগণের সঙ্গে। এবং অবশ্যই আমরা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। নির্বাচিত সরকার যেই হোক, আমরা তার সঙ্গেই উত্তম সম্পর্ক রাখব।
প্রথম আলো : এই জনগণ প্রসঙ্গে একটা ধারণা সামনে আসে। আপনি একটু আগেই বলছিলেন যে সাম্প্রদায়িকতা চলে গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরই কেবল তারা পুনর্বাসন দেবে। চাকরি দেবে। অন্ধ্রে শুরুও করেছে। এই লাইনে চলতে মমতাকে বিজেপি চাপ দিচ্ছে। একে আপনি কীভাবে দেখছেন? যদিও আমরা চাই না, কিন্তু ধর্মের জায়গা থেকে এটা তো দেখা হচ্ছে।
এম জে আকবর : আমিও সেটা মনে করি। আমাদের সমস্যাটা কী? সমস্যা হলো তো অবৈধ অভিবাসন?
প্রথম আলো :হ্যাঁ। এবং সেটা যে ধর্মেরই হোক।
এম জে আকবর : যখন অবৈধ, তখন অবৈধ। ঠিক আছে? আমাদের ইতিহাসও তো আছে। আমাদেরকে আমাদের অ্যাটিচুডের মধ্যে ইতিহাসকে ধারণ করতে হবে। কিন্তু আমি সত্যি বলছি এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলছি যে এসব ইস্যু মিটে যাবে। এটা সাধারণভাবে (ব্রডলি) বলছি, সামগ্রিকভাবে (হোললি) নয়। সাধারণভাবে ইতিহাসে দেখা যায়, অভিবাসন হলো অর্থনৈতিক ঘটনাবলির পরিণাম।
প্রথম আলো : এখানেও তা-ই ঘটছে।
এম জে আকবর : তাহলে আপনি সেটা মানছেন? এখন যদি বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে শুরু করে তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অভিবাসন কমবে। আমি চারপাশে দেখেছি, তারা গ্রিসে যাচ্ছে, তারা ইতালি যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে?
প্রথম আলো : বাংলাদেশের একজন বন্ধু হিসেবে বলুন, আমাদের এখানে ১৫৩ আসনে ভোট না করে নির্বাচন নিয়ে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ বিষয়ে ভারত মনে করছে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে অস্থিতিশীলতা বাড়লেও তাতে ভারতের স্বার্থের ক্ষতি নেই। এটা আপনি কীভাবে দেখেন?
এম জে আকবর : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের কোনো আগ্রহ নেই।
প্রথম আলো : সেটা এখানে যে ধরনের সরকারই হোক না কেন?
এম জে আকবর : সেটা আপনাদের ব্যাপার, ভারতের ব্যাপার নয়। আমি আপনার বন্ধু, সেটা বাংলাদেশে নয়। আপনার সরকার গ্রহণ করবে এদিক থেকে, ওদিক থেকে, সেটা আপনার ব্যাপার। আমাদের মতে কী এসে-যায়?
প্রথম আলো : কিন্তু গণতন্ত্রের উন্নয়নে—
এম জে আকবর : সেটা আপনার দায়িত্ব। আপনারা যা মনে করেন। এটা আপনার সমস্যা, আমাদের নয়। যিনিই বৈধ (লেজিটিমেট) সরকার হবেন। শেখ হাসিনা আছেন, বেশ ভালো। সেটা আপনারা যেমন চান, পাঁচ বছরের পরে নির্বাচন করতে চান, করুন। আগে করতে চাইলে সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। আমাদের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই।
প্রথম আলো :ইউরোপীয় সংসদে, ব্রিটেনে যখন রেজুলেশন হয়েছে, ভারতকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক মেশিন—
এম জে আকবর : আমি আপনাকে এক্ষুনি বললাম, আমরা প্রত্যেকে সমান। আমরা শক্তিশালী নই। আমি আপনাকে পুনর্বার বলছি, আমরা উভয়ে সমমর্যাদাসম্পন্ন জাতি।
প্রথম আলো : একটি ধারণাগত জায়গা থেকে—
এম জে আকবর : আমি কোনো ধারণার ব্যাপারে আগ্রহী নই। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, আমরা উভয়ে সমমর্যাদাসম্পন্ন জাতি। আপনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আপনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আমাদের অভ্যন্তরীণ। ঠিক আছে? এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছুই বলার নেই।
প্রথম আলো : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিজেপি আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
এম জে আকবর : সব রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের অংশ। আপনার সঙ্গে আমি কথা বলছি। যদি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আমার সাক্ষাৎকার নিতে চায়, তাহলে আমি না বলে দেব?
প্রথম আলো : তাহলে কি এটা রুটিনের বাইরে নয়?
এম জে আকবর :এটা তো সাধারণ প্রক্রিয়া। আমি জানি না এখানে কী ঘটে, আমাদের দেশে কোনো ভিআইপি এলে সর্বদাই তিনি বা তাঁরা বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকলে সোনিয়া বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। সবাই যেতেন। এটা তো সরকারি সফরসূচির অংশ। আর সেটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। হারলেও তো আপনি বাংলাদেশে কিছু জনমতের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমি চার দিন আছি। অনেকেই সাক্ষাৎ করেছেন। আমার কী এসে-যায়? তবে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ রাজনীতি বাংলাদেশের ব্যাপার। আমরা প্রত্যেক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন জাতির সঙ্গে উষ্ণতম সম্পর্ক চাই।
প্রথম আলো : মোদি প্রথম ভুটান গিয়ে তাঁর প্রতিবেশী নীতি যে শক্তিশালী, সেটা বুঝিয়েছেন।
এম জে আকবর : ওটাই তাঁর মুখ্যনীতি।
প্রথম আলো : ভুটানে, নেপালে গেলেন। বাংলাদেশে তাঁর সফর কি নিকট ভবিষ্যতে আসন্ন?
এম জে আকবর : এটা বলতে আমার কোনোই দ্বিধা নেই যে কিছু হচ্ছে, তা আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। প্রধানমন্ত্রীর সফর জটিল বিষয়। এটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুরাহা হওয়া উচিত। শপথ অনুষ্ঠানে যখন আর সবাই এল, শেখ হাসিনা আসতে পারেননি।
প্রথম আলো : সেটা তো তাঁর জাপান সফরের কারণে।
এম জে আকবর : স্বাভাবিক। ওনার একটা অ্যারেঞ্জড ভিজিট আছে, সেখানে মনে করার তো কিছু নেই। সেটা দেশ শাসনের একটা বাধ্যবাধকতা। তাই উভয় দিক থেকে দিনপঞ্জি, সময় সব দেখেটেখে নিয়ে পরস্পরের জন্য সুবিধাজনক সময়ে সম্ভবত একটি তারিখ স্থির হবে।
প্রথম আলো : শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকায় ভারতীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তাড়া দিয়েছেন। এটা আগে দেখা যায়নি। ট্রানজিটসহ অনেক কিছুর সুরাহায় ভারত সন্তুষ্ট। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একটা হতাশা আসতে পারে। কারণ, শেখ হাসিনা নতুন করে শুরুর পরেও লম্বা সময় কেটে গেল। তিস্তা ও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ঝুলেই রইল। বলেছেন দ্রুত হবে, নির্দিষ্ট করে বলা যায় কি?
এম জে আকবর : না। আমার পক্ষে বলা যায় না। আমি তো সরকারে নই।
প্রথম আলো : আপনি তো বিজেপিতে।
এম জে আকবর : বলছি তো, আমাদের হৃদয়ে উন্নত সম্পর্ক। আর উন্নত সম্পর্ক মানে দ্রুততার সঙ্গে পারস্পরিক সমস্যার সমাধান করা। সেটাই হওয়া উচিত উভয় জাতির অবজেকটিভস। সমস্যার সমাধান করা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির অংশ হওয়া উচিত।
প্রথম আলো : ভুটান, নেপাল বা অন্যদের সঙ্গে মোদি যেভাবে সম্পর্কের উন্নতিসাধন করছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করে কি কিছু বলা যায়?
এম জে আকবর : এগুলো আসলে ভাষার অর্থঘটিত। (হাসি) আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু কে? দ্বিতীয় বন্ধু কে, তৃতীয় বন্ধু কে, পররাষ্ট্রনীতি আসলে এভাবে ব্যাংকিং পদ্ধতিতে চলে না। আমরা সবাই বন্ধু, সেটাই বড় লক্ষ্য। এর অর্থ হলো নিজেদের ভেতর বিরোধাত্মক ইস্যুসমূহ দূর করে ফেলা। এবং এটা খুবই স্পষ্ট যে সেটা অর্জন করাই হলো দিল্লির লক্ষ্য।
প্রথম আলো : গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে এসে আপনি কী দেখলেন, কী অনুভব করলেন? নাড়ির স্পন্দন কি টের পেলেন?
এম জে আকবর: আমি এখানে শুনতে এসেছি।
প্রথম আলো : আপনার এ সফর কি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ধরনের।
এম জে আকবর : আমি শুনতে এসেছি। অনেক দিন আসিনি।
প্রথম আলো : আপনি কী শুনতে পেলেন? যদি সংক্ষেপে বলেন।
এম জে আকবর : (হাসি) সবচেয়ে যেটা খুব ভালো লাগছে, আপনার হাসি আমি শুনতে পাচ্ছি। আপনার ক্রোধ শুনছি না।
প্রথম আলো : আপনি একটি পার্থক্য এনেছিলেন। যখন সাংবাদিকতা করবেন তখন রাজনীতি নয়। আর রাজনীতি করলে সাংবাদিকতা নয়। আপনার কি মনে হয় এটা একটা আন্তর্জাতিক রীতি হতে পারে। এর কি একটা সমালোচনা করা যায় না যে এখানে একটা সুবিধাবাদ রয়েছে।
এম জে আকবর : সুবিধাবাদ কেন হবে?
প্রথম আলো : এটা কি খুব নীতিনিষ্ঠ বলবেন?
এম জে আকবর : আমার তো মনে হয় এটা নীতির ওপর। কেননা অনেকেই দুটো করেন। আমি যখন সম্পাদক হব, তখন নিরপেক্ষ থাকব, সেটা আমার ধর্ম। আমি দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারি না। যখন আমি দলে আছি, তখন আমি প্রকৃতপক্ষেই দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তা আমি সম্পাদক কী করে হব। সে জন্য যোগদান করার আগে আমি যত সম্পাদকীয় পদে ছিলাম, সব থেকে পদত্যাগ করেছি। এখন আমার কোনো শেয়ার নেই। শেয়ার আগেই বিক্রি করে দিয়েছিলাম। কারণ, কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মিডিয়া ও রাজনীতিতে অনুগত থাকতে পারে না।
প্রথম আলো : এই মুহূর্তে মিডিয়ায় আপনার কোনো বিনিয়োগ নেই। আর সেটা রাজনীতিতে আসবেন বলে সুচিন্তিতভাবে করেছেন, যাতে সাংবাদিক হিসেবে আপনার সততা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে?
এম জে আকবর : একদম সঠিক। আমরা কেউ ফেরেশতা নই। এখন যত দূর সম্ভব সম্পাদক ও রাজনীতিক হিসেবে ইন্টেগ্রিটি রাখতে পারি, জীবনে যদি এটা করে যাই, সেটাই হবে আমার জন্য মোর দ্যান এনাফ।
প্রথম আলো : ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবেশ করছে। এতে কি তার প্রতিবেশীদের নিয়ে চলার লক্ষ্য রয়েছে? যদি থাকে তাহলে তার বহিঃপ্রকাশ কী?
এম জে আকবর : অবশ্যই রয়েছে। দেখুন আমরা উঠলে, যত দিন আমরা সবাই না উঠি, একা ওঠা মুশকিল হবে।
প্রথম আলো : এটা ভারতের উপলব্ধির মধ্যে আছে?
এম জে আকবর : অ্যাবসলিউটলি। আর সবাই উঠলে দেখবেন মহলটা কী রকম হয়ে যায়। সেটা হবে ট্রান্সফরমেশনাল মহল। অলমোস্ট রেভ্যুলেশনারি মহল।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
এম জে আকবর : ধন্যবাদ।
>>>সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো : হঠাৎ বিজেপিতে কেন? এটা আপনার ঢাকার বন্ধুদেরও অবাক করেছে।
এম জে আকবর : এর প্রচুর জবাব দিয়েছি। এটা যদিও ব্যক্তিগত বিষয় তবুও বলি, বিজেপি সম্পর্কে লোকের যে ধারণা, সেটা অত্যন্ত ভ্রান্ত ব্যাখ্যাপ্রসূত। আর সবচেয়ে স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নরেন্দ্র মোদিই দিয়েছেন। গত বছরের ১৫ আগস্টে প্রথমেই তিনি ভারতকে সংজ্ঞায়িত করলেন। বললেন, পাবলিক লাইফ (জনজীবন) পরিচালিত হবে ভারতের সংবিধান দ্বারা। আর ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। সুতরাং অঙ্গীকারের জায়গাটা এখানেই ফয়সালা হলো। দর্শনগত দিকও এতে স্পষ্ট।
প্রথম আলো : দর্শনের কথা যদি বলেন, তাহলে তো বলতে হয় যে আপনি নিজে মনে করেন যে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত লাকুম দিনুকুম (যার ধর্ম তার কাছে)-এর সঙ্গে আপনি ভারতীয় সংবিধানের বিরোধ দেখেন না।
এম জে আকবর : হ্যাঁ, ঠিক।
প্রথম আলো : লাকুম দিনুকুম-এর সঙ্গে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের কি বিরোধ নেই? এর মধ্যে কীভাবে তার সমন্বয় ঘটাবেন?
এম জে আকবর : কোনো অসুবিধা দেখি না। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, হিন্দুত্ববাদ হলো সাংস্কৃতিক বাস্তবতা।
প্রথম আলো : বিজেপি কি সেটা কেবল এই অর্থেই ব্যবহার করে?
এম জে আকবর :ওই অর্থেই ব্যবহার করে। কোনো ধরনের নিরাপত্তাবোধহীনতা সৃষ্টির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যা চলছে সেটা একটা অসম্ভব, সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাসযোগ্য আনফিজিবল মাইন্ডসেট। এটা সাংস্কৃতিক মাইন্ডসেট। যেহেতু সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, একটু ভেবে বলি। যেমন এই আমরা কথা বলছি, এই মুহূর্তে একটা সংকট হয়ে যাচ্ছে। আর ওই রকম একটা সংকট যখন আমাদের ওপর একটা আক্রমণ হচ্ছে। তখন ভাবি সব ভুলে যাব। তখন মগজে যা লেখা থাকে সেটা বেরোবে। আমার মনে পড়ে গান্ধী ময়দানে ঘটনা ঘটেছিল। সেটা বিহারের পাটনায়। গত বছরের অক্টোবরে মোদি যখন বক্তব্য দেন, তখন তাঁর ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালাল। খুবই ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা। ওনার ওপর তখন ২০০ ক্যামেরা। সেটা ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত উত্তেজনাকর মুহূর্ত। দুবৃর্ত্তরা ধরা পড়েছে। ষড়যন্ত্রও উদ্ঘাটিত হয়েছে। তখন তিনি কী বললেন, আমি সেটা হিন্দিতে বলতে চাই। আপনি সেটা বাংলায় তরজমা করে দেবেন। প্রথমেই বললেন, উসকানি যতই আসুক, শান্তির কোনো বিকল্প নেই। তারপর তিনি বললেন, হিন্দুকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ও মুসলমানের সঙ্গে লড়বে, নাকি গরিবির সঙ্গে লড়বে। আর মুসলিমদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা হিন্দুর বিরুদ্ধে লড়বে, না গরিবির বিরুদ্ধে লড়বে। আমাদের শত্রু গরিবি। যত দিন না একত্র হচ্ছি তত দিন তো আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারব না। এরপর বললেন, সামগ্রিক বিষয় হলো আপনি কী ধরনের মুসলিম দেখতে চান? মোদি মুসলমানদের এক হাতে কোরআন অন্য হাতে কম্পিউটার দেখতে চান।
প্রথম আলো : কিন্তু আমরা এতকাল বিজেপিকে একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে জেনে এসেছি। আপনার বহু লেখালেখিও সেই সাক্ষ্য দেবে।
এম জে আকবর : সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমরা সবাই লিখেছি। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমি কংগ্রেসের ওপর লিখিনি? হাজার হাজার দাঙ্গা সম্পর্কে লিখেছি। মোদির গুজরাটের রায়ট নিয়েই এই বিতর্কটা হচ্ছে। ১০ বছর হয়ে গেল। কংগ্রেস যত চেষ্টা করতে পারত, সরকার, পুলিশ, সিবিআই ও বিচার বিভাগের সব উপাদান ব্যবহার করেছে। বিষয়টি লোয়ার কোর্টস, মিডল কোর্টস এবং সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত করেছে। কেউ তাঁর (মোদি) ওপরে ব্যক্তিগতভাবে দায় চাপাতে সক্ষম হননি।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে বিজেপির বর্তমান যে নীতি, সেটা কোথায়, কতটুকু সংগতিপূর্ণ বা অসংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়?
এম জে আকবর : প্রথম থেকে এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মাথা বেশ পরিষ্কার। তাঁর বিদেশনীতির কয়েকটি কদম আমরা দেখতে পেয়েছি। এবার তিনি প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে দক্ষিণ এশিয়ার না, বলব ভারতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের শতকরা ৩০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাদের কীভাবে ওপরে নিয়ে আসা যায়। যখন তিনি বললেন যে তাঁর মা কাজের বুয়ার কাজ করতেন। বুয়ার কাজ করে আমাদের খাওয়াতেন; ১০/১১ বছর বয়সে রেলস্টেশনে চা বিক্রি করেছেন, এসব কথা বলেছেন রেডফোর্টে গিয়ে, আর কোনো প্রধানমন্ত্রীর হিম্মত হয়নি এসব বলার। যখন তিনি নারীদের টয়লেট সমস্যার কথা বলেন, তখন কি আমরা ভাবতে পারি যে তাদের অবমাননা ও স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়টি কত গভীরভাবে অনুভব করেন।
সংসদে নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতেই বললেন, গরিবদের জন্যই যদি সরকার না করা যায়, তাহলে সরকার বলতে আমরা কী বুঝব? এটা কিন্তু তাঁর ওই রাজনৈতিক দর্শনেরই সম্প্রসারণ। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র্যপীড়িত ভূমি। তিনি বললেন, আমরা সংঘাতে থাকলে কোনো সমস্যার সুরাহা করতে পারব না। কিন্তু সহযোগিতার সংস্কৃতি এবং পরিবেশ সৃষ্টির যে চেষ্টা তিনি করছেন, তার বার্তাটা কিন্তু সাদরে গৃহীত হয়েছে। এটা কিন্তু তাঁর ওই দর্শনেরই একটি সম্প্রসারণ। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র্য জলাভূমি।
প্রথম আলো : এখানেই...
এম জে আকবর : না। আমাকে বলতে দিন। এটা বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র্য ডোবা। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, আমরা সংঘাতে থাকলে কোনো সমস্যার সুরাহা করতে পারব না। প্রথমত, একমাত্র সহযোগিতা হলেই পারব। দ্বিতীয় কথা হলো, কোনো জাতিই কিন্তু বিগ ব্রাদার নয়। প্রত্যেকেই সমান। সবাই সমান। আয়তন দিয়ে বড় ভাই বা ছোট ভাই হওয়া যায় না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যতই সমস্যা থাকুক সেটা সমাধোনের বাইরে নয়। ভাইদের মধ্যেও টেনশন থাকে। কিন্তু আপনি হয়তো অবাক হয়ে যাবেন, নেপালে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ১৭ বছর যাননি। সেখানে গিয়ে উনি বললেন, দিজ ইজ নো বিগ ব্রাদার স্টেট। আমি খুবই আশাবাদী। সব সমস্যার সমাধান তো সম্ভব নয়। কিন্তু সংস্কৃতি এবং পরিবেশ সৃষ্টির যে চেষ্টা করছেন, তার বার্তাটা কিন্তু উষ্ণতার সঙ্গে সাদরে গৃহীত হয়েছে।
প্রথম আলো : মোদি সরকার বাংলাদেশে কংগ্রেসের চেয়ে ভারতীয় সহায়তা হ্রাস করেছে। তাঁর নিকট প্রতিবেশীদের থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম। তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন কি?
এম জে আকবর : আমি এর বিস্তারিত জানি না।
প্রথম আলো : ভারতে সরকার পরিবর্তনের পরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন কেমন?
এম জে আকবর : বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র। একটি জাতি। মর্যাদার সঙ্গে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। আমি বেশি বলতে চাই না। কারণ, এর একটি প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র। তার সঙ্গে সম্মান ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়তে হবে। আপনাকে অবশ্যই অর্থনৈতিক সহযোগিতা খুঁজে বের করতে হবে। আপনাকে বিনিয়োগ খুঁজতে হবে। আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করতেন, ভারতীয় বাণিজ্যের মধ্যে বিনিয়োগ এখানে কতটা এসেছে বা আসছে, সেটা আমি অধিকতর নিজের বলে গ্রহণ করতাম। কারণ, বিনিয়োগ আপনাকে কবুল করতে হবে। বিনিয়োগেই দুই দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত। কারণ, এটা একটা যৌথ সহযোগিতামূলক বিষয়। মোদি সাহায্যের জন্য জাপান সফরে যাননি।
প্রথম আলো : আপনার কথায় ওই সফর একটা রূপান্তরকরণ।
এম জে আকবর : নিশ্চয়ই। ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে তাদের শর্তে। আমাদের দেশে ৫০টি বড় শহর আছে। আমরা জাপানকে বলব তোমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আছে। আমি ভারতীয় সরকারের নই। আমি মনে করি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিহিত আমরা কতখানি প্রকৃত অভিন্ন সম্পদ সৃষ্টি করতে পারি তার ওপর। দক্ষিণ এশিয়ায় এটা কতটা পারি তার ওপর। সমৃদ্ধি এখানে অংশীদারিমূলক সমৃদ্ধি। আমাদের বিনিয়োগ পরিণত হচ্ছে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও মানবসম্পদ বিনিয়োগে।
প্রথম আলো : এতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইচ্ছা আছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে সমস্যা ছিল, সেটা এখন আর খুব বড় বাধা নয় বলে মনে করেন?
এম জে আকবর : না, এখন আর কোনো বাধা মনে হয় না।
প্রথম আলো : পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একটা পরিবর্তন এসে গেছে? একটা সময়ই তো সাম্প্রদায়িকতাকেই প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেটা আজ উল্টে গেছে?
এম জে আকবর : আমি এখানে এসেছি গত চার দিন হলো। আমি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের চোখ দেখেছি। দেখলাম, তারা সব ধরনের ‘হ্যাংওভার অব বিটারনেস’ বা তিক্ততার রেশ ধরে থাকতে আগ্রহী নয়। তারা নিজেদের জন্য উন্নত জীবন চায়। চাকরি চায়। চাকরি না দিলে মর্যাদা কোথা থেকে আসবে? চাকরি না দিলে আত্মমর্যাদা কোথা থেকে আসবে? উত্তর প্রদেশে পরাজয়ের একটা বড় কারণ হলো ১০ বছরে ওরা মাত্র দেড় কোটি চাকরি সৃষ্টি করেছে। ভেবে দেখো, আমার বয়স ২০। আমার ৩০ হয়ে গেল কিন্তু চাকরি পাইনি। সেখানে কি আর কোনো আশা থাকে? পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ওপর বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে একটি ধ্বংসকর তত্ত্ব (পরনিশাস থিওরি) আরোপ করা হয়েছে। সেটা হলো ট্রিকল ডাউন। আমি বিশ্বব্যাংককে বললাম, তোমরা কি জানো তোমরা কী বলছ? ট্রিকল ডাউন মানে যার সুইমিংপুল আছে, তাকে তুমি ঝরনা দেবে। আর যে পিয়াসে মরে যাচ্ছে, তাকে তুমি নালকার দুটি-তিনটি ফোঁটা দেবে। বিশ্বব্যাংকের এই নীতি ভারতের জন ধান কর্মসূচি উল্টে দিচ্ছে। আর সেটাই হলো ট্রিকলআপ।
প্রথম আলো : বাংলাদেশে অনেকেই এটা জানতে আগ্রহী হবেন যে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান কতগুলো সমস্যা, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি এবং স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের ব্যাপারে কত দূর কী হলো?
এম জে আকবর : এই প্রশ্ন করা আপনার অধিকার। আমি এতটুকুই জানি, সরকার কী করবে বা করবে না, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আমার নিয়তটা কী সেটা তো আমি বলতে পারি?
প্রথম আলো : জি, সেটাই বলুন।
এম জে আকবর : নিয়তটা হচ্ছে, কোনো সমস্যা যত তাড়াতাড়ি সমাধান করা যায়, তা-ই করো। সমস্যাকে জিইয়ে রেখো না। সেটা করলে তা সম্পর্কের ওপর বোঝা সৃষ্টি করবে। এবং ‘ডোন্ট ট্রিট বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল।’ মানে হলো, আচ্ছা ঠিক আছে, একটা আলোচনা হয়ে গেল। মেক অ্যান এফর্ট।
প্রথম আলো : এর আগে আমরা ধারণা পেলাম যে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার রাজি ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজি না হওয়ায় তা আটকে গেল। আপনাদের সংবিধান কী বলে? আইন কী বলে? প্রতিবেশীকে পানির হিস্যা দেওয়া কি রাজ্যের বিষয়? তারা কখনো না চাইলে কেন্দ্রীয় সরকারের কি কিছুই করার নেই? তিস্তা নয়, আপনি সাধারণভাবেই বলুন।
এম জে আকবর :এটা আপনার বৈধ প্রশ্ন। আমাদের ফেডারেল সরকার। সুতরাং তার ফেডারেল সম্পর্ক তো আছেই। রাজ্যের ক্ষমতা কোনো দিন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। আমাদের ফেডারেল পদ্ধতির একটা অনন্য চরিত্র আছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনো জিওগ্রাফির ওপর কোনো হুকুমত করে না। অল দ্য জিওগ্রাফি ইজ রুলড বাই স্টেট গভর্নমেন্ট।
প্রথম আলো : পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস আছে। মমতাকে হটিয়ে পরের নির্বাচনে বিজেপি সেখানে আসতে পারে বলে তারা আশাবাদী। তাহলে কি তিস্তার জন্য আমাদের ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে?
এম জে আকবর : এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর আমাদের বিদেশমন্ত্রী জানবেন। কিন্তু আমার যে জবাবটা, সেটা জেনে আপনারা হয়তো অবাক হবেন যে আমরা চেষ্টা করব, এটাকে সমাধানের জন্য। নিশ্চিতভাবেই। কারণ, আমি আপনাকে এটা বলতে পারি, বিজেপি সরকার সম্পর্ক উন্নততর করতে আগ্রহী। কেবল বাংলাদেশের সঙ্গেই নয়, সরকার জনগণের সঙ্গে উন্নততর সম্পর্ক করতে চায়।
প্রথম আলো : মানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে—
এম জে আকবর : জনগণের সঙ্গে। কারণ, আমরা প্রতিবেশী।
প্রথম আলো : আপনি সম্ভবত বলতে চাইছেন যে এই জনগণের কোনো সীমান্ত নেই।
এম জে আকবর : জনগণ। সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রাখা জনগণের সঙ্গে। এবং অবশ্যই আমরা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। নির্বাচিত সরকার যেই হোক, আমরা তার সঙ্গেই উত্তম সম্পর্ক রাখব।
প্রথম আলো : এই জনগণ প্রসঙ্গে একটা ধারণা সামনে আসে। আপনি একটু আগেই বলছিলেন যে সাম্প্রদায়িকতা চলে গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরই কেবল তারা পুনর্বাসন দেবে। চাকরি দেবে। অন্ধ্রে শুরুও করেছে। এই লাইনে চলতে মমতাকে বিজেপি চাপ দিচ্ছে। একে আপনি কীভাবে দেখছেন? যদিও আমরা চাই না, কিন্তু ধর্মের জায়গা থেকে এটা তো দেখা হচ্ছে।
এম জে আকবর : আমিও সেটা মনে করি। আমাদের সমস্যাটা কী? সমস্যা হলো তো অবৈধ অভিবাসন?
প্রথম আলো :হ্যাঁ। এবং সেটা যে ধর্মেরই হোক।
এম জে আকবর : যখন অবৈধ, তখন অবৈধ। ঠিক আছে? আমাদের ইতিহাসও তো আছে। আমাদেরকে আমাদের অ্যাটিচুডের মধ্যে ইতিহাসকে ধারণ করতে হবে। কিন্তু আমি সত্যি বলছি এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলছি যে এসব ইস্যু মিটে যাবে। এটা সাধারণভাবে (ব্রডলি) বলছি, সামগ্রিকভাবে (হোললি) নয়। সাধারণভাবে ইতিহাসে দেখা যায়, অভিবাসন হলো অর্থনৈতিক ঘটনাবলির পরিণাম।
প্রথম আলো : এখানেও তা-ই ঘটছে।
এম জে আকবর : তাহলে আপনি সেটা মানছেন? এখন যদি বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে শুরু করে তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অভিবাসন কমবে। আমি চারপাশে দেখেছি, তারা গ্রিসে যাচ্ছে, তারা ইতালি যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে?
প্রথম আলো : বাংলাদেশের একজন বন্ধু হিসেবে বলুন, আমাদের এখানে ১৫৩ আসনে ভোট না করে নির্বাচন নিয়ে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ বিষয়ে ভারত মনে করছে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে অস্থিতিশীলতা বাড়লেও তাতে ভারতের স্বার্থের ক্ষতি নেই। এটা আপনি কীভাবে দেখেন?
এম জে আকবর : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের কোনো আগ্রহ নেই।
প্রথম আলো : সেটা এখানে যে ধরনের সরকারই হোক না কেন?
এম জে আকবর : সেটা আপনাদের ব্যাপার, ভারতের ব্যাপার নয়। আমি আপনার বন্ধু, সেটা বাংলাদেশে নয়। আপনার সরকার গ্রহণ করবে এদিক থেকে, ওদিক থেকে, সেটা আপনার ব্যাপার। আমাদের মতে কী এসে-যায়?
প্রথম আলো : কিন্তু গণতন্ত্রের উন্নয়নে—
এম জে আকবর : সেটা আপনার দায়িত্ব। আপনারা যা মনে করেন। এটা আপনার সমস্যা, আমাদের নয়। যিনিই বৈধ (লেজিটিমেট) সরকার হবেন। শেখ হাসিনা আছেন, বেশ ভালো। সেটা আপনারা যেমন চান, পাঁচ বছরের পরে নির্বাচন করতে চান, করুন। আগে করতে চাইলে সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। আমাদের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই।
প্রথম আলো :ইউরোপীয় সংসদে, ব্রিটেনে যখন রেজুলেশন হয়েছে, ভারতকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক মেশিন—
এম জে আকবর : আমি আপনাকে এক্ষুনি বললাম, আমরা প্রত্যেকে সমান। আমরা শক্তিশালী নই। আমি আপনাকে পুনর্বার বলছি, আমরা উভয়ে সমমর্যাদাসম্পন্ন জাতি।
প্রথম আলো : একটি ধারণাগত জায়গা থেকে—
এম জে আকবর : আমি কোনো ধারণার ব্যাপারে আগ্রহী নই। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, আমরা উভয়ে সমমর্যাদাসম্পন্ন জাতি। আপনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আপনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আমাদের অভ্যন্তরীণ। ঠিক আছে? এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছুই বলার নেই।
প্রথম আলো : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিজেপি আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
এম জে আকবর : সব রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের অংশ। আপনার সঙ্গে আমি কথা বলছি। যদি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আমার সাক্ষাৎকার নিতে চায়, তাহলে আমি না বলে দেব?
প্রথম আলো : তাহলে কি এটা রুটিনের বাইরে নয়?
এম জে আকবর :এটা তো সাধারণ প্রক্রিয়া। আমি জানি না এখানে কী ঘটে, আমাদের দেশে কোনো ভিআইপি এলে সর্বদাই তিনি বা তাঁরা বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকলে সোনিয়া বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। সবাই যেতেন। এটা তো সরকারি সফরসূচির অংশ। আর সেটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। হারলেও তো আপনি বাংলাদেশে কিছু জনমতের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমি চার দিন আছি। অনেকেই সাক্ষাৎ করেছেন। আমার কী এসে-যায়? তবে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ রাজনীতি বাংলাদেশের ব্যাপার। আমরা প্রত্যেক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন জাতির সঙ্গে উষ্ণতম সম্পর্ক চাই।
প্রথম আলো : মোদি প্রথম ভুটান গিয়ে তাঁর প্রতিবেশী নীতি যে শক্তিশালী, সেটা বুঝিয়েছেন।
এম জে আকবর : ওটাই তাঁর মুখ্যনীতি।
প্রথম আলো : ভুটানে, নেপালে গেলেন। বাংলাদেশে তাঁর সফর কি নিকট ভবিষ্যতে আসন্ন?
এম জে আকবর : এটা বলতে আমার কোনোই দ্বিধা নেই যে কিছু হচ্ছে, তা আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। প্রধানমন্ত্রীর সফর জটিল বিষয়। এটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুরাহা হওয়া উচিত। শপথ অনুষ্ঠানে যখন আর সবাই এল, শেখ হাসিনা আসতে পারেননি।
প্রথম আলো : সেটা তো তাঁর জাপান সফরের কারণে।
এম জে আকবর : স্বাভাবিক। ওনার একটা অ্যারেঞ্জড ভিজিট আছে, সেখানে মনে করার তো কিছু নেই। সেটা দেশ শাসনের একটা বাধ্যবাধকতা। তাই উভয় দিক থেকে দিনপঞ্জি, সময় সব দেখেটেখে নিয়ে পরস্পরের জন্য সুবিধাজনক সময়ে সম্ভবত একটি তারিখ স্থির হবে।
প্রথম আলো : শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকায় ভারতীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তাড়া দিয়েছেন। এটা আগে দেখা যায়নি। ট্রানজিটসহ অনেক কিছুর সুরাহায় ভারত সন্তুষ্ট। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একটা হতাশা আসতে পারে। কারণ, শেখ হাসিনা নতুন করে শুরুর পরেও লম্বা সময় কেটে গেল। তিস্তা ও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ঝুলেই রইল। বলেছেন দ্রুত হবে, নির্দিষ্ট করে বলা যায় কি?
এম জে আকবর : না। আমার পক্ষে বলা যায় না। আমি তো সরকারে নই।
প্রথম আলো : আপনি তো বিজেপিতে।
এম জে আকবর : বলছি তো, আমাদের হৃদয়ে উন্নত সম্পর্ক। আর উন্নত সম্পর্ক মানে দ্রুততার সঙ্গে পারস্পরিক সমস্যার সমাধান করা। সেটাই হওয়া উচিত উভয় জাতির অবজেকটিভস। সমস্যার সমাধান করা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির অংশ হওয়া উচিত।
প্রথম আলো : ভুটান, নেপাল বা অন্যদের সঙ্গে মোদি যেভাবে সম্পর্কের উন্নতিসাধন করছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করে কি কিছু বলা যায়?
এম জে আকবর : এগুলো আসলে ভাষার অর্থঘটিত। (হাসি) আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু কে? দ্বিতীয় বন্ধু কে, তৃতীয় বন্ধু কে, পররাষ্ট্রনীতি আসলে এভাবে ব্যাংকিং পদ্ধতিতে চলে না। আমরা সবাই বন্ধু, সেটাই বড় লক্ষ্য। এর অর্থ হলো নিজেদের ভেতর বিরোধাত্মক ইস্যুসমূহ দূর করে ফেলা। এবং এটা খুবই স্পষ্ট যে সেটা অর্জন করাই হলো দিল্লির লক্ষ্য।
প্রথম আলো : গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে এসে আপনি কী দেখলেন, কী অনুভব করলেন? নাড়ির স্পন্দন কি টের পেলেন?
এম জে আকবর: আমি এখানে শুনতে এসেছি।
প্রথম আলো : আপনার এ সফর কি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ধরনের।
এম জে আকবর : আমি শুনতে এসেছি। অনেক দিন আসিনি।
প্রথম আলো : আপনি কী শুনতে পেলেন? যদি সংক্ষেপে বলেন।
এম জে আকবর : (হাসি) সবচেয়ে যেটা খুব ভালো লাগছে, আপনার হাসি আমি শুনতে পাচ্ছি। আপনার ক্রোধ শুনছি না।
প্রথম আলো : আপনি একটি পার্থক্য এনেছিলেন। যখন সাংবাদিকতা করবেন তখন রাজনীতি নয়। আর রাজনীতি করলে সাংবাদিকতা নয়। আপনার কি মনে হয় এটা একটা আন্তর্জাতিক রীতি হতে পারে। এর কি একটা সমালোচনা করা যায় না যে এখানে একটা সুবিধাবাদ রয়েছে।
এম জে আকবর : সুবিধাবাদ কেন হবে?
প্রথম আলো : এটা কি খুব নীতিনিষ্ঠ বলবেন?
এম জে আকবর : আমার তো মনে হয় এটা নীতির ওপর। কেননা অনেকেই দুটো করেন। আমি যখন সম্পাদক হব, তখন নিরপেক্ষ থাকব, সেটা আমার ধর্ম। আমি দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারি না। যখন আমি দলে আছি, তখন আমি প্রকৃতপক্ষেই দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তা আমি সম্পাদক কী করে হব। সে জন্য যোগদান করার আগে আমি যত সম্পাদকীয় পদে ছিলাম, সব থেকে পদত্যাগ করেছি। এখন আমার কোনো শেয়ার নেই। শেয়ার আগেই বিক্রি করে দিয়েছিলাম। কারণ, কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে মিডিয়া ও রাজনীতিতে অনুগত থাকতে পারে না।
প্রথম আলো : এই মুহূর্তে মিডিয়ায় আপনার কোনো বিনিয়োগ নেই। আর সেটা রাজনীতিতে আসবেন বলে সুচিন্তিতভাবে করেছেন, যাতে সাংবাদিক হিসেবে আপনার সততা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে?
এম জে আকবর : একদম সঠিক। আমরা কেউ ফেরেশতা নই। এখন যত দূর সম্ভব সম্পাদক ও রাজনীতিক হিসেবে ইন্টেগ্রিটি রাখতে পারি, জীবনে যদি এটা করে যাই, সেটাই হবে আমার জন্য মোর দ্যান এনাফ।
প্রথম আলো : ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবেশ করছে। এতে কি তার প্রতিবেশীদের নিয়ে চলার লক্ষ্য রয়েছে? যদি থাকে তাহলে তার বহিঃপ্রকাশ কী?
এম জে আকবর : অবশ্যই রয়েছে। দেখুন আমরা উঠলে, যত দিন আমরা সবাই না উঠি, একা ওঠা মুশকিল হবে।
প্রথম আলো : এটা ভারতের উপলব্ধির মধ্যে আছে?
এম জে আকবর : অ্যাবসলিউটলি। আর সবাই উঠলে দেখবেন মহলটা কী রকম হয়ে যায়। সেটা হবে ট্রান্সফরমেশনাল মহল। অলমোস্ট রেভ্যুলেশনারি মহল।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
এম জে আকবর : ধন্যবাদ।
No comments