এই কালসাপের জন্মদাতা কারা? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
লন্ডনের একটি আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। যদিও আলোচনাটি একাডেমিক, কিন্তু আলোচ্য বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক। আলোচক ছিলেন অনেকেই। তাতে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজে অধ্যয়ন ও গবেষণা কাজে রত কয়েকজন ভারতীয় এবং পাকিস্তানিও ছিলেন। আলোচনা হচ্ছিল অনেক বিষয় নিয়েই। শেষ পর্যন্ত তা গড়াল পাকিস্তানে। প্রশ্ন হল, জঙ্গি মৌলবাদের কব্জা থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারবে কিনা। নাকি গৃহযুদ্ধে ইরাকের মতো বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকার মুখে পড়বে? যদি তা হয় এবং পাকিস্তান তার বর্তমান অস্তিত্ব হারায়, তাহলে উপমহাদেশে শান্তি ফিরবে কি? ভারত অস্ত্রসজ্জা বন্ধ করে জনগণের দারিদ্র্য মোচনকে অগ্রাধিকার দেবে কি এবং উপমহাদেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কি নিরাপদ হবে?
এই আলোচনাটি হয়তো একেবারে পাকিস্তানকেন্দ্রিক হয়ে পড়ত না যদি সভায় এক আলোচক আমেরিকার সাবেক ফার্স্টলেডি ও বিদেশমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনী লিভিং হিস্ট্রি বইটি সঙ্গে নিয়ে না আসতেন এবং পাকিস্তান সম্পর্কে হিলারির একটি মন্তব্য তার আলোচনায় তুলে না ধরতেন। সম্প্রতি এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, নিজের ঘরে কালসাপ পুষছে পাকিস্তান। সেই বিষাক্ত সাপ একদিন ফণা তুলে পাকিস্তানকেই ছোবল মারবে। বিষাক্ত ছোবলের আঘাত থেকে রক্ষা পাবে না পাকিস্তান এবং তার আশপাশের দেশও।
এই বিষাক্ত সাপটির পরিচয় হিলারি তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, আল কায়দা ও তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানা কোথায় সেটা পাকিস্তান জানে না এমন নয়, কিন্তু জেনেশুনেও তারা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এর পরিণতি ভালো নয়। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে পাকিস্তানকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে।
লন্ডনের আলোচনা সভায় অনেকেই হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাদের যুক্তিতর্ক শুনতে শুনতে আমার মনে হল, ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন যিনি, সেই হিলারি তার বক্তব্যে আমেরিকার বর্তমান এশীয় নীতির উদ্দেশ্যটাই প্রকারান্তরে বলে ফেলেছেন। অর্থাৎ তাদের নতুন এশীয় নীতিতে পাকিস্তানকে আর ততটা তাদের দরকার নেই।
কারণ, ভারতকে তারা পক্ষপুটে পাবেন মনে করছেন। এজন্যই পাকিস্তানে ক্রমাগত ড্রোন হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে আমেরিকার দ্বিধা নেই। একদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকায় এই একতরফা হামলা, অন্যদিকে ভারতকেও হুশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে যে, পাকিস্তানের জঙ্গিরা ভারতের জন্যও বিপদের কারণ হবে।
আগে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে কাছে টানতে চেয়েছিল; এখন ভারতকে পাকিস্তান জুজুর ভয় দেখিয়ে কোলে টানতে চাইছে। অর্থাৎ উপমহাদেশে আমেরিকার সেই পুরনো বিভেদ নীতির খেলা। হিলারি ক্লিনটন উপমহাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য এখন পাকিস্তানের কাঁধে সব দোষ চাপিয়ে সেই পুরনো খেলা খেলতে চাইছেন। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতের নতুন মোদি সরকার সেই খেলার ফাঁদে পা দেবে কিনা সেটা এখনও দেখার রয়েছে।
লন্ডনের আলোচনা সভায় একজন ভারতীয় ছাত্র যথার্থই বলেছেন, একসময় ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টি যেমন ছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের খেলা; আজও তেমনি তাদের চীনবিরোধী স্ট্র্যাটেজিতে ভারতকে কোলে টানার জন্য পাকিস্তানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করা মার্কিন নীতির লক্ষ্য। বর্তমানে পাকিস্তান ধ্বংস হলে বা আরও বিভক্ত হলে ভারতের কোনো লাভ নেই। বরং পাকিস্তানে আশ্রিত জঙ্গিরা উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে এবং ভারতকে দৃশ্যমান শত্র“র বদলে এক অদৃশ্য শত্র“র সন্ধানে এবং তাকে দমনে দিশেহারা হয়ে ঘুরতে হবে।
এই বক্তা তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব ছিল, ততদিন আমেরিকার একটি দৃশ্যমান শত্র“ ছিল এবং তাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থান ছিল। এই দৃশ্যমান শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমেরিকার পক্ষে সহজ ছিল এবং সেই যুদ্ধ চালিয়ে সে জয়ীও হয়েছে। কিন্তু আজ ইসলামী সন্ত্রাসীরা কোনো দৃশ্যমান শত্র“ নয় এবং তাদের কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় অবস্থানও নেই। এই শত্র“ দমনের জন্য আমেরিকাকে এখন কানা দৈত্যের মতো যেখানে সেখানে যুদ্ধ করতে হচ্ছে কিন্তু জয়ী হতে পারছে না। আমেরিকার জনগণ এখন যুদ্ধক্লান্ত, তারা আর যুদ্ধ চায় না। তাদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। প্রেসিডেন্ট ওবামার জনপ্রিয়তা এখন ফুটো বেলুনের মতো।
এই বক্তার মতে, মোদির ভারতও দূরদর্শী হলে পাকিস্তানের ধ্বংস কামনা করে আমেরিকার মতো অদৃশ্য শত্র“র বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধের ফাঁদে পা দেবে না। মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাবেন, দারিদ্র্য মোচন করবেন এটাই সবাই আশা করে। আর তা যদি করতে হয়, তাহলে মোদি সরকারকে যুদ্ধ খাতে নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতে অধিক অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং উন্নয়নের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, আঞ্চলিক মৈত্রী ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
এই প্রয়োজন ক্ষমতায় থাকার শেষ দিকে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী উপলব্ধি করেছিলেন। সেজন্যই তিনি তৎকালীন দুই সুপার পাওয়ারেরই প্রভাবমুক্ত ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় জোন অব পিস গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি তার দেশকে একটি দারিদ্র্যমুক্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতমুক্ত একটি জোন অব পিস (শান্তির এলাকা) গড়ে তোলার ওপরই তাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আলোচনা সভায় ভারতীয় বক্তা এই বলে তার বক্তব্য শেষ করেছিলেন যে, ভারতের গণতন্ত্রকে যদি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সহযোগিতাও ভারতের প্রয়োজন হবে। এজন্যই সন্ত্রাস দমনের জন্য পাকিস্তানকে ধ্বংস করা নয়, পাকিস্তান যাতে জঙ্গিবাদ ও সেনা-নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাতে সহযোগিতা দান ভারতের অবশ্য কর্তব্য। একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়েই উপমহাদেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সফল সংগ্রাম করা সম্ভব। পাকিস্তানকে ধ্বংস করে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না; বরং সন্ত্রাস সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
আলোচনা সভা শেষে বাসায় ফিরে হিলারি ক্লিনটনের আত্মজীবনীমূলক বই লিভিং হিস্ট্রি কেনার জন্য অর্ডার দিয়েছি। এই আমেরিকান নেত্রী নিজেকে লিভিং হিস্ট্রি বা জীবন্ত ইতিহাস বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তার বইটির যেটুকু অংশ (সংবাদপত্রে প্রকাশিত) পড়েছি, তাতে মনে হয় বইটি সত্যের অপলাপ ও তত্ত্বের বিকৃতিতে ভর্তি। এটা তিনি স্বজ্ঞানে ও সচেতনভাবে করেছেন কিনা আমি জানি না।
হিলারি অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান তার ঘরে জঙ্গি কালসাপ পুষছে এবং দেশটির উচিত সেনাবাহিনীর কবলমুক্ত হওয়া। হিলারি যে টিভি সাক্ষাৎকারে একথাগুলো বলেছেন, সেই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কোনো সাংবাদিক তাকে দুটি প্রশ্ন কেন করেননি তা ভেবে বিস্মিত হই। প্রথম প্রশ্নটি হল, জঙ্গিবাদের যে কালসাপ পাকিস্তান পুষছে, তার সৃষ্টিকর্তা কে এবং কারা সেই কালসাপ পাকিস্তানের গলায় জোর করে পরিয়ে দিয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশটিতে গণতন্ত্র ধ্বংস করে সামরিক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল কারা? আমেরিকা কি একই কাজ আলেন্দের চিলিতেও করেনি?
একথা তো আজ ইতিহাসের সত্য, পাকিস্তানের নাজিমউদ্দীন সরকার আমেরিকার সামরিক চুক্তি- বাগদাদ জোটে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় আমেরিকাই দেশটির সেনাপতি আইয়ুব খানকে কব্জা করে তার সাহায্যে আধাসামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নাজিমউদ্দীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে এনে অবৈধভাবে শাসন ক্ষমতায় বসায়। তারপর একে একে সিভিল গভর্নমেন্টগুলোকে বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনীকে (১৯৫৮ অক্টোবর সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার সমর্থনে ও সাহায্যে) ক্ষমতায় এনে বসানো হয়। শুরু হয় পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উচ্ছেদ ও ফৌজি শাসন।
প্রতিবেশী পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উচ্ছেদে তখন সঙ্গতভাবেই শংকিত হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহেরু। তিনি পাকিস্তানে সামরিক শাসনকে বাধাদানের উদ্দেশ্যে এই শাসনকে আখ্যা দিয়েছিলেন Naked military dictatorship বা নগ্ন সামরিক স্বেচ্ছাতন্ত্র। ভারত তখন এই নগ্ন ফৌজি শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিলে পাকিস্তানে ওই শাসন স্থায়ী হতে পারত না। কিন্তু নেহেরুর মনোভাব টের পেয়েই দিল্লিতে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার কাছে ছুটে যান এবং আশ্বাস দেন, পাকিস্তানে একটি মিলিটারি সরকারের সঙ্গেই ভারত তার নিজের শর্তে কাশ্মীর বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে পারবে। নেহেরু এই প্রতারণার ফাঁদে পা দেন এবং পরদিনই নিজের বক্তব্য পাল্টে সামরিক অভ্যুত্থানকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আখ্যা দেন এবং পরে কাশ্মীর সমস্যা মীমাংসার জন্য পাকিস্তানের মারীতে ফৌজি নায়ক আইয়ুবের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতে রাজি হন। নেহেরুর এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এখনও ভারত করছে।
কথায় বলে সাপ হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো। পাকিস্তান সম্পর্কে আমেরিকায় হিলারিদের আজ এই ভূমিকা। গণতন্ত্র ধ্বংস করে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের অভিশাপ চাপিয়ে দিয়ে তাকে বেশুমার অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে মনস্টারে পরিণত করার পর হিলারি ক্লিনটন নির্লজ্জ ভাষায় পাকিস্তানের জনগণকে হিতোপদেশ দিচ্ছেন, তাদের উচিত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া। ক্লিনটন-দম্পতির নৈতিক চরিত্রের কোনো বালাই নেই। তাদের মুখেই এই ধরনের কথা সাজে।
এখানে আরও একটি প্রশ্ন, আজ যে আফগানিস্তান, ইরাকসহ পাকিস্তানে আল কায়দা ও তালেবান জঙ্গি গোষ্ঠীর এত উৎপাত তার জন্য দায়ী কারা? এই কালসাপের জন্মদাতা কি আমেরিকা নয়? কাবুলে একটি সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের জন্যই কি মার্কিন অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে আল কায়দা ও তালেবানের জন্ম নয়? পাকিস্তানে এই তালেবানদের ঘাঁটি গাড়তে দিতে পাকিস্তানকে কারা বাধ্য করেছিল? সে কি আমেরিকা নয়? এই জঙ্গি কালসাপ লালন ও পোষণের জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে কারা দায়িত্ব দিয়ে তথাকথিত আফগান মুজাহিদে পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলগুলো ভরে ফেলেছিল? সে কি আমেরিকা নয়? এখন সেই জঙ্গিদের দমনের নামে বর্বর ড্রোন হামলায় শয়ে শয়ে নিরীহ পাকিস্তানি নর-নারী, শিশু নির্বিচার হত্যা করে চলেছে কারা? সেও কি আমেরিকা নয়?
আসলে যে বিষধর কালসাপ আজ পাকিস্তানের গলায়, তার জন্মদাতা এবং বহুদিনের প্রতিপালক আমেরিকা। এই কালসাপের দংশনে আজ শুধু পাকিস্তান নয়, আমেরিকাও জর্জরিত। আমেরিকা তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু করেছে মাত্র।
লন্ডন ৬ জুলাই রোববার, ২০১৪
এই আলোচনাটি হয়তো একেবারে পাকিস্তানকেন্দ্রিক হয়ে পড়ত না যদি সভায় এক আলোচক আমেরিকার সাবেক ফার্স্টলেডি ও বিদেশমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনী লিভিং হিস্ট্রি বইটি সঙ্গে নিয়ে না আসতেন এবং পাকিস্তান সম্পর্কে হিলারির একটি মন্তব্য তার আলোচনায় তুলে না ধরতেন। সম্প্রতি এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, নিজের ঘরে কালসাপ পুষছে পাকিস্তান। সেই বিষাক্ত সাপ একদিন ফণা তুলে পাকিস্তানকেই ছোবল মারবে। বিষাক্ত ছোবলের আঘাত থেকে রক্ষা পাবে না পাকিস্তান এবং তার আশপাশের দেশও।
এই বিষাক্ত সাপটির পরিচয় হিলারি তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, আল কায়দা ও তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানা কোথায় সেটা পাকিস্তান জানে না এমন নয়, কিন্তু জেনেশুনেও তারা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এর পরিণতি ভালো নয়। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে পাকিস্তানকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে।
লন্ডনের আলোচনা সভায় অনেকেই হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাদের যুক্তিতর্ক শুনতে শুনতে আমার মনে হল, ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন যিনি, সেই হিলারি তার বক্তব্যে আমেরিকার বর্তমান এশীয় নীতির উদ্দেশ্যটাই প্রকারান্তরে বলে ফেলেছেন। অর্থাৎ তাদের নতুন এশীয় নীতিতে পাকিস্তানকে আর ততটা তাদের দরকার নেই।
কারণ, ভারতকে তারা পক্ষপুটে পাবেন মনে করছেন। এজন্যই পাকিস্তানে ক্রমাগত ড্রোন হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে আমেরিকার দ্বিধা নেই। একদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকায় এই একতরফা হামলা, অন্যদিকে ভারতকেও হুশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে যে, পাকিস্তানের জঙ্গিরা ভারতের জন্যও বিপদের কারণ হবে।
আগে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে কাছে টানতে চেয়েছিল; এখন ভারতকে পাকিস্তান জুজুর ভয় দেখিয়ে কোলে টানতে চাইছে। অর্থাৎ উপমহাদেশে আমেরিকার সেই পুরনো বিভেদ নীতির খেলা। হিলারি ক্লিনটন উপমহাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য এখন পাকিস্তানের কাঁধে সব দোষ চাপিয়ে সেই পুরনো খেলা খেলতে চাইছেন। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতের নতুন মোদি সরকার সেই খেলার ফাঁদে পা দেবে কিনা সেটা এখনও দেখার রয়েছে।
লন্ডনের আলোচনা সভায় একজন ভারতীয় ছাত্র যথার্থই বলেছেন, একসময় ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টি যেমন ছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের খেলা; আজও তেমনি তাদের চীনবিরোধী স্ট্র্যাটেজিতে ভারতকে কোলে টানার জন্য পাকিস্তানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করা মার্কিন নীতির লক্ষ্য। বর্তমানে পাকিস্তান ধ্বংস হলে বা আরও বিভক্ত হলে ভারতের কোনো লাভ নেই। বরং পাকিস্তানে আশ্রিত জঙ্গিরা উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে এবং ভারতকে দৃশ্যমান শত্র“র বদলে এক অদৃশ্য শত্র“র সন্ধানে এবং তাকে দমনে দিশেহারা হয়ে ঘুরতে হবে।
এই বক্তা তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব ছিল, ততদিন আমেরিকার একটি দৃশ্যমান শত্র“ ছিল এবং তাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থান ছিল। এই দৃশ্যমান শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমেরিকার পক্ষে সহজ ছিল এবং সেই যুদ্ধ চালিয়ে সে জয়ীও হয়েছে। কিন্তু আজ ইসলামী সন্ত্রাসীরা কোনো দৃশ্যমান শত্র“ নয় এবং তাদের কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় অবস্থানও নেই। এই শত্র“ দমনের জন্য আমেরিকাকে এখন কানা দৈত্যের মতো যেখানে সেখানে যুদ্ধ করতে হচ্ছে কিন্তু জয়ী হতে পারছে না। আমেরিকার জনগণ এখন যুদ্ধক্লান্ত, তারা আর যুদ্ধ চায় না। তাদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। প্রেসিডেন্ট ওবামার জনপ্রিয়তা এখন ফুটো বেলুনের মতো।
এই বক্তার মতে, মোদির ভারতও দূরদর্শী হলে পাকিস্তানের ধ্বংস কামনা করে আমেরিকার মতো অদৃশ্য শত্র“র বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধের ফাঁদে পা দেবে না। মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাবেন, দারিদ্র্য মোচন করবেন এটাই সবাই আশা করে। আর তা যদি করতে হয়, তাহলে মোদি সরকারকে যুদ্ধ খাতে নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতে অধিক অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং উন্নয়নের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, আঞ্চলিক মৈত্রী ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
এই প্রয়োজন ক্ষমতায় থাকার শেষ দিকে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী উপলব্ধি করেছিলেন। সেজন্যই তিনি তৎকালীন দুই সুপার পাওয়ারেরই প্রভাবমুক্ত ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় জোন অব পিস গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি তার দেশকে একটি দারিদ্র্যমুক্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতমুক্ত একটি জোন অব পিস (শান্তির এলাকা) গড়ে তোলার ওপরই তাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আলোচনা সভায় ভারতীয় বক্তা এই বলে তার বক্তব্য শেষ করেছিলেন যে, ভারতের গণতন্ত্রকে যদি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সহযোগিতাও ভারতের প্রয়োজন হবে। এজন্যই সন্ত্রাস দমনের জন্য পাকিস্তানকে ধ্বংস করা নয়, পাকিস্তান যাতে জঙ্গিবাদ ও সেনা-নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাতে সহযোগিতা দান ভারতের অবশ্য কর্তব্য। একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়েই উপমহাদেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সফল সংগ্রাম করা সম্ভব। পাকিস্তানকে ধ্বংস করে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না; বরং সন্ত্রাস সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
আলোচনা সভা শেষে বাসায় ফিরে হিলারি ক্লিনটনের আত্মজীবনীমূলক বই লিভিং হিস্ট্রি কেনার জন্য অর্ডার দিয়েছি। এই আমেরিকান নেত্রী নিজেকে লিভিং হিস্ট্রি বা জীবন্ত ইতিহাস বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তার বইটির যেটুকু অংশ (সংবাদপত্রে প্রকাশিত) পড়েছি, তাতে মনে হয় বইটি সত্যের অপলাপ ও তত্ত্বের বিকৃতিতে ভর্তি। এটা তিনি স্বজ্ঞানে ও সচেতনভাবে করেছেন কিনা আমি জানি না।
হিলারি অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান তার ঘরে জঙ্গি কালসাপ পুষছে এবং দেশটির উচিত সেনাবাহিনীর কবলমুক্ত হওয়া। হিলারি যে টিভি সাক্ষাৎকারে একথাগুলো বলেছেন, সেই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কোনো সাংবাদিক তাকে দুটি প্রশ্ন কেন করেননি তা ভেবে বিস্মিত হই। প্রথম প্রশ্নটি হল, জঙ্গিবাদের যে কালসাপ পাকিস্তান পুষছে, তার সৃষ্টিকর্তা কে এবং কারা সেই কালসাপ পাকিস্তানের গলায় জোর করে পরিয়ে দিয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশটিতে গণতন্ত্র ধ্বংস করে সামরিক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল কারা? আমেরিকা কি একই কাজ আলেন্দের চিলিতেও করেনি?
একথা তো আজ ইতিহাসের সত্য, পাকিস্তানের নাজিমউদ্দীন সরকার আমেরিকার সামরিক চুক্তি- বাগদাদ জোটে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় আমেরিকাই দেশটির সেনাপতি আইয়ুব খানকে কব্জা করে তার সাহায্যে আধাসামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নাজিমউদ্দীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে এনে অবৈধভাবে শাসন ক্ষমতায় বসায়। তারপর একে একে সিভিল গভর্নমেন্টগুলোকে বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনীকে (১৯৫৮ অক্টোবর সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার সমর্থনে ও সাহায্যে) ক্ষমতায় এনে বসানো হয়। শুরু হয় পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উচ্ছেদ ও ফৌজি শাসন।
প্রতিবেশী পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উচ্ছেদে তখন সঙ্গতভাবেই শংকিত হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহেরু। তিনি পাকিস্তানে সামরিক শাসনকে বাধাদানের উদ্দেশ্যে এই শাসনকে আখ্যা দিয়েছিলেন Naked military dictatorship বা নগ্ন সামরিক স্বেচ্ছাতন্ত্র। ভারত তখন এই নগ্ন ফৌজি শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিলে পাকিস্তানে ওই শাসন স্থায়ী হতে পারত না। কিন্তু নেহেরুর মনোভাব টের পেয়েই দিল্লিতে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার কাছে ছুটে যান এবং আশ্বাস দেন, পাকিস্তানে একটি মিলিটারি সরকারের সঙ্গেই ভারত তার নিজের শর্তে কাশ্মীর বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে পারবে। নেহেরু এই প্রতারণার ফাঁদে পা দেন এবং পরদিনই নিজের বক্তব্য পাল্টে সামরিক অভ্যুত্থানকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আখ্যা দেন এবং পরে কাশ্মীর সমস্যা মীমাংসার জন্য পাকিস্তানের মারীতে ফৌজি নায়ক আইয়ুবের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতে রাজি হন। নেহেরুর এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এখনও ভারত করছে।
কথায় বলে সাপ হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো। পাকিস্তান সম্পর্কে আমেরিকায় হিলারিদের আজ এই ভূমিকা। গণতন্ত্র ধ্বংস করে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের অভিশাপ চাপিয়ে দিয়ে তাকে বেশুমার অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে মনস্টারে পরিণত করার পর হিলারি ক্লিনটন নির্লজ্জ ভাষায় পাকিস্তানের জনগণকে হিতোপদেশ দিচ্ছেন, তাদের উচিত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া। ক্লিনটন-দম্পতির নৈতিক চরিত্রের কোনো বালাই নেই। তাদের মুখেই এই ধরনের কথা সাজে।
এখানে আরও একটি প্রশ্ন, আজ যে আফগানিস্তান, ইরাকসহ পাকিস্তানে আল কায়দা ও তালেবান জঙ্গি গোষ্ঠীর এত উৎপাত তার জন্য দায়ী কারা? এই কালসাপের জন্মদাতা কি আমেরিকা নয়? কাবুলে একটি সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের জন্যই কি মার্কিন অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে আল কায়দা ও তালেবানের জন্ম নয়? পাকিস্তানে এই তালেবানদের ঘাঁটি গাড়তে দিতে পাকিস্তানকে কারা বাধ্য করেছিল? সে কি আমেরিকা নয়? এই জঙ্গি কালসাপ লালন ও পোষণের জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে কারা দায়িত্ব দিয়ে তথাকথিত আফগান মুজাহিদে পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলগুলো ভরে ফেলেছিল? সে কি আমেরিকা নয়? এখন সেই জঙ্গিদের দমনের নামে বর্বর ড্রোন হামলায় শয়ে শয়ে নিরীহ পাকিস্তানি নর-নারী, শিশু নির্বিচার হত্যা করে চলেছে কারা? সেও কি আমেরিকা নয়?
আসলে যে বিষধর কালসাপ আজ পাকিস্তানের গলায়, তার জন্মদাতা এবং বহুদিনের প্রতিপালক আমেরিকা। এই কালসাপের দংশনে আজ শুধু পাকিস্তান নয়, আমেরিকাও জর্জরিত। আমেরিকা তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু করেছে মাত্র।
লন্ডন ৬ জুলাই রোববার, ২০১৪
No comments