সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় অটোমেশন by ড. মোঃ আবদুর রউফ
কর সংস্কৃতি হল যথাযথভাবে কর প্রদানের জন্য জনগণের প্রবণতা। কর হল জনগণের কাছে সরকারের প্রাপ্য অর্থ। জনগণ কর্তৃক পণ্য ও সেবার সরবরাহ, জনগণের আয়, জনগণের সম্পদ ইত্যাদির ওপর কর আদায় করা হয়। অর্থাৎ জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত সরবরাহ, জনগণের আয়, জনগণের সম্পদ ইত্যাদির একটা অংশ জনগণের নিজস্ব নয়, তা হল সরকারের। সরবরাহ, আয়, সম্পদ ইত্যাদি থেকে সরকারের প্রাপ্য কর সঠিকভাবে পরিশোধ করার প্রবণতাকে সুস্থ কর সংস্কৃতি বলে। আমাদের দেশে সুস্থ কর সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এখানে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। তাই আমাদের দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশ কম, যা বর্তমানে ১২.২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও এ কর-জিডিপি হার কম, উন্নত দেশের তুলনায় কম তো বটেই। সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা ছাড়া কর-জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে সুস্থ কর সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল, কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ এবং ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পেলে অনেকেই সে সুযোগ গ্রহণ করে। কর ব্যবস্থাপনায় বর্তমানের ম্যানুয়্যাল পদ্ধতির হিসাব সংরক্ষণের কারণে যেহেতু কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থেকে যায়, সেহেতু অনেকেই সে সুযোগ গ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেয়ার পর অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। অর্থাৎ বর্তমান ব্যবস্থায় নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা নেই। শাস্তির এ অনিশ্চয়তাও অনেককে কর ফাঁকি প্রদানে উৎসাহিত করে। তাই কর ফাঁকি প্রদানের সুযোগ বন্ধ করা সম্ভব হলে এবং ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে, ফাঁকি প্রদান নিরুৎসাহিত হবে, মানুষের মধ্যে সুস্থ কর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
অটোমেশন কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ বহুলাংশে বন্ধ করে দেয়। ম্যানুয়্যাল পদ্ধতিতে করযোগ্য সব কর্মকাণ্ড থেকে কর আদায় করা সহজসাধ্য হয় না। কিন্তু অটোমেটেড পদ্ধতিতে তা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। কারণ অটোমেটেড পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ সহজ হয়। বহু তথ্য একত্রে এবং অল্প সময়ের মধ্যে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। যেহেতু করদাতাদের তথ্য কর কর্মকর্তাদের হাতের নাগালে থাকে, তাই তাদের মধ্যে তথ্য গোপন করার প্রবণতা থাকে না। অটোমেশন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেয় ব্যাপকতা এবং গতি। কর ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা করতে অটোমেশন অনেকটাই সক্ষম। অটোমেটেড ব্যবস্থায় প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা যায়। বিভিন্ন উৎসের সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত প্রতিপরীক্ষা (Cross check) করা যায়। কর ফাঁকি সহজে শনাক্ত করা যায়। তাই কর ফাঁকি প্রদানকারীকে সদা শাস্তির ভয় তাড়া করে ফিরে। তাই অটোমেটেড কর ব্যবস্থা সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
অটোমেশনের দিক থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেশ পিছিয়ে ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা বাদ দিয়ে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে তুলনা করলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশনের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১১ সালে ডিজিটাল এনবিআর গড়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালের বাজেটের সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আধুনিকায়ন পরিকল্পনা সরকার অনুমোদন করে। এ পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ডিজিটাইজড করা। এজন্য একটি ডিজিটাল কোর কমিটি গঠন করা হয়। ডিজিটাল কোর কমিটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামগ্রিক অটোমেশনের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে। নানা কারণে টেন্ডারটি বাতিল হয়ে যায়। অতঃপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুবিভাগগুলো পৃথকভাবে অটোমেশন কার্যক্রম শুরু করে। কার্যত শুল্ক বিভাগের অটোমেশন শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই। প্রথমত ১৯৯৪ সালে ঢাকা কাস্টম হাউস এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ASYCUDA ২.৭ চালু করা হয়। অতঃপর ২০০২ সালে ওই সিস্টেমের উন্নত সংস্করণ ASYCUDA++ ঢাকা কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, আইসিডি কমলাপুর এবং বেনাপোল কাস্টম হাউসে চালু করা হয়। ওই সিস্টেমে ট্যারিফ ম্যানেজমেন্টের জন্য ইউনিফর্ম ফাইল চালু করা হয়।
বর্তমানে ASYCUDA WORLD প্রচলনের কাজ চলছে। এ সিস্টেম হল ইন্টারনেট বেজড। ঢাকা, চট্টগ্রাম, আইসিডি এবং বেনাপোল কাস্টম হাউসসহ ১০টি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনে ASYCUDA WORLD সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। এই সিস্টেমে ম্যানিফেস্ট এবং বিল-অব-এন্ট্রির সংযোগ তৈরি করা হচ্ছে। তাছাড়া ম্যানিফেস্ট, এক্সিট নোট, ডেসপাস নোট, পেমেন্ট, এলসি, ইএক্সপি ইত্যাদি অন-লাইন করা হচ্ছে। ব্যাংক, বিএসটিআই, ইপিবি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দফতরের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পণ্য শুল্কায়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার অধিকাংশই এখন অটোমেটেড। আমরা এখন উন্নত দেশের বন্দর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনার স্বপ্ন দেখছি। সেটা এমন ব্যবস্থা, যেখানে রফতানি বন্দরে পণ্য জাহাজে বোঝাই হওয়ার সময়ই আমাদের আমদানি বন্দরে আমরা সব তথ্য পেয়ে যাব এবং অগ্রিম শুল্কায়ন সম্পন্ন করা যাবে। পণ্য আগমনের পর অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না। দ্রুত পণ্য খালাস হয়ে যাবে। পণ্যের কায়িক পরীক্ষা (physical examination) করা হবে খুব কম। প্রয়োজনে পণ্যের খালাসোত্তর নিরীক্ষার (post-clearance audit) মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি শনাক্ত করা হবে।
আয়কর অনুবিভাগও অটোমেশনে বেশ এগিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ই-টিআইএন ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। Tax Payers Idendtification Number (TIN)-এর ক্ষেত্রে ১০ ডিজিটের ডাটাবেইজে ভুল-ভ্রান্তি ছিল। তা এখন প্রায় সমাধানের পথে। টিআইএন ডাটাবেইজ পরিষ্কার করা হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেইজের সঙ্গে টিআইএন ডাটাবেইজ সংযুক্ত করা হয়েছে। ই-পেমেন্টের মাধ্যমে আয়কর পরিশোধ করার ব্যবস্থাও ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একই নম্বরে একাধিক টিআইএন ইস্যুর ফলে টিআইএন ডাটাবেইজের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। নতুন ব্যবস্থায় ই-টিআইএন ইস্যু করা হচ্ছে। ই-টিআইএন ইস্যু সম্পন্ন হলে করদাতার সংখ্যা ৫০ (পঞ্চাশ) লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মূসক অনুবিভাগও পিছিয়ে নেই। মূসক ব্যবস্থায় সংস্কারের অংশ হিসেবে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় সামগ্রিক মূসক ব্যবস্থাপনার অটোমেশন করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ অটোমেডেট ভ্যাট ব্যবস্থা কার্যকর হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অটোমেডেট ভ্যাট ব্যবস্থায় ভ্যাটের আওতায় রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট পরিশোধ, দাখিলপত্র পেশ, অডিট ইত্যাদি সব কাজ অটোমেডেট পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হবে। ভ্যাটদাতা এবং ভ্যাট কর্মকর্তাদের কায়িক আন্তঃক্রিয়া (physical interaction) হবে কম। ওয়েববেইজড সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রায় সব কাজ সম্পন্ন করা হবে।
পরিপূর্ণ অটোমেডেট পরিবেশে সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ হ্রাস পেলে এবং কর ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে শাস্তির নিশ্চয়তা থাকলে সুস্থ কর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে অবশ্যই। তাই, কার্যকর অটোমেশনের ওপর জোর দেয়া খুবই জরুরি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অটোমেশন এবং সুস্থ কর সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক বলা যায়। সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা ছাড়া কর-জিডিপি অনুপাতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। অটোমেশন এখন যুগের দাবি। অটোমেশনের মাধ্যমে বর্তমানে নানা ধরনের সেবার মান বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের লেনদেন এখন আমরা আমাদের ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারি। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখনও আমাদের করদাতাদের ই-মেইল বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাঠাতে পারেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আর পিছিয়ে থাকার অবকাশ নেই। আশা করা যায় বর্তমান কার্যক্রমগুলো অব্যাহত থকলে আর দু-এক বছরের মধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, দেশে আধুনিক ও আদর্শ কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা হবে রাজস্ববান্ধব (revenue-friendly) এবং ব্যবসা-বান্ধব (business-friendly)।
ড. মোঃ আবদুর রউফ : পরিচালক, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড roufcus@yahoo.com
আমাদের দেশে সুস্থ কর সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল, কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ এবং ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পেলে অনেকেই সে সুযোগ গ্রহণ করে। কর ব্যবস্থাপনায় বর্তমানের ম্যানুয়্যাল পদ্ধতির হিসাব সংরক্ষণের কারণে যেহেতু কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থেকে যায়, সেহেতু অনেকেই সে সুযোগ গ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেয়ার পর অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। অর্থাৎ বর্তমান ব্যবস্থায় নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা নেই। শাস্তির এ অনিশ্চয়তাও অনেককে কর ফাঁকি প্রদানে উৎসাহিত করে। তাই কর ফাঁকি প্রদানের সুযোগ বন্ধ করা সম্ভব হলে এবং ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে, ফাঁকি প্রদান নিরুৎসাহিত হবে, মানুষের মধ্যে সুস্থ কর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
অটোমেশন কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ বহুলাংশে বন্ধ করে দেয়। ম্যানুয়্যাল পদ্ধতিতে করযোগ্য সব কর্মকাণ্ড থেকে কর আদায় করা সহজসাধ্য হয় না। কিন্তু অটোমেটেড পদ্ধতিতে তা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। কারণ অটোমেটেড পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ সহজ হয়। বহু তথ্য একত্রে এবং অল্প সময়ের মধ্যে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। যেহেতু করদাতাদের তথ্য কর কর্মকর্তাদের হাতের নাগালে থাকে, তাই তাদের মধ্যে তথ্য গোপন করার প্রবণতা থাকে না। অটোমেশন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেয় ব্যাপকতা এবং গতি। কর ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা করতে অটোমেশন অনেকটাই সক্ষম। অটোমেটেড ব্যবস্থায় প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা যায়। বিভিন্ন উৎসের সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত প্রতিপরীক্ষা (Cross check) করা যায়। কর ফাঁকি সহজে শনাক্ত করা যায়। তাই কর ফাঁকি প্রদানকারীকে সদা শাস্তির ভয় তাড়া করে ফিরে। তাই অটোমেটেড কর ব্যবস্থা সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
অটোমেশনের দিক থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেশ পিছিয়ে ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা বাদ দিয়ে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে তুলনা করলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশনের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১১ সালে ডিজিটাল এনবিআর গড়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালের বাজেটের সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আধুনিকায়ন পরিকল্পনা সরকার অনুমোদন করে। এ পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ডিজিটাইজড করা। এজন্য একটি ডিজিটাল কোর কমিটি গঠন করা হয়। ডিজিটাল কোর কমিটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামগ্রিক অটোমেশনের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে। নানা কারণে টেন্ডারটি বাতিল হয়ে যায়। অতঃপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুবিভাগগুলো পৃথকভাবে অটোমেশন কার্যক্রম শুরু করে। কার্যত শুল্ক বিভাগের অটোমেশন শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই। প্রথমত ১৯৯৪ সালে ঢাকা কাস্টম হাউস এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ASYCUDA ২.৭ চালু করা হয়। অতঃপর ২০০২ সালে ওই সিস্টেমের উন্নত সংস্করণ ASYCUDA++ ঢাকা কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, আইসিডি কমলাপুর এবং বেনাপোল কাস্টম হাউসে চালু করা হয়। ওই সিস্টেমে ট্যারিফ ম্যানেজমেন্টের জন্য ইউনিফর্ম ফাইল চালু করা হয়।
বর্তমানে ASYCUDA WORLD প্রচলনের কাজ চলছে। এ সিস্টেম হল ইন্টারনেট বেজড। ঢাকা, চট্টগ্রাম, আইসিডি এবং বেনাপোল কাস্টম হাউসসহ ১০টি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনে ASYCUDA WORLD সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। এই সিস্টেমে ম্যানিফেস্ট এবং বিল-অব-এন্ট্রির সংযোগ তৈরি করা হচ্ছে। তাছাড়া ম্যানিফেস্ট, এক্সিট নোট, ডেসপাস নোট, পেমেন্ট, এলসি, ইএক্সপি ইত্যাদি অন-লাইন করা হচ্ছে। ব্যাংক, বিএসটিআই, ইপিবি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দফতরের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পণ্য শুল্কায়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার অধিকাংশই এখন অটোমেটেড। আমরা এখন উন্নত দেশের বন্দর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনার স্বপ্ন দেখছি। সেটা এমন ব্যবস্থা, যেখানে রফতানি বন্দরে পণ্য জাহাজে বোঝাই হওয়ার সময়ই আমাদের আমদানি বন্দরে আমরা সব তথ্য পেয়ে যাব এবং অগ্রিম শুল্কায়ন সম্পন্ন করা যাবে। পণ্য আগমনের পর অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না। দ্রুত পণ্য খালাস হয়ে যাবে। পণ্যের কায়িক পরীক্ষা (physical examination) করা হবে খুব কম। প্রয়োজনে পণ্যের খালাসোত্তর নিরীক্ষার (post-clearance audit) মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি শনাক্ত করা হবে।
আয়কর অনুবিভাগও অটোমেশনে বেশ এগিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ই-টিআইএন ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। Tax Payers Idendtification Number (TIN)-এর ক্ষেত্রে ১০ ডিজিটের ডাটাবেইজে ভুল-ভ্রান্তি ছিল। তা এখন প্রায় সমাধানের পথে। টিআইএন ডাটাবেইজ পরিষ্কার করা হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেইজের সঙ্গে টিআইএন ডাটাবেইজ সংযুক্ত করা হয়েছে। ই-পেমেন্টের মাধ্যমে আয়কর পরিশোধ করার ব্যবস্থাও ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একই নম্বরে একাধিক টিআইএন ইস্যুর ফলে টিআইএন ডাটাবেইজের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। নতুন ব্যবস্থায় ই-টিআইএন ইস্যু করা হচ্ছে। ই-টিআইএন ইস্যু সম্পন্ন হলে করদাতার সংখ্যা ৫০ (পঞ্চাশ) লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মূসক অনুবিভাগও পিছিয়ে নেই। মূসক ব্যবস্থায় সংস্কারের অংশ হিসেবে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় সামগ্রিক মূসক ব্যবস্থাপনার অটোমেশন করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ অটোমেডেট ভ্যাট ব্যবস্থা কার্যকর হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অটোমেডেট ভ্যাট ব্যবস্থায় ভ্যাটের আওতায় রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট পরিশোধ, দাখিলপত্র পেশ, অডিট ইত্যাদি সব কাজ অটোমেডেট পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হবে। ভ্যাটদাতা এবং ভ্যাট কর্মকর্তাদের কায়িক আন্তঃক্রিয়া (physical interaction) হবে কম। ওয়েববেইজড সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রায় সব কাজ সম্পন্ন করা হবে।
পরিপূর্ণ অটোমেডেট পরিবেশে সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ হ্রাস পেলে এবং কর ফাঁকি প্রদান পরবর্তী সময়ে শাস্তির নিশ্চয়তা থাকলে সুস্থ কর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে অবশ্যই। তাই, কার্যকর অটোমেশনের ওপর জোর দেয়া খুবই জরুরি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অটোমেশন এবং সুস্থ কর সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক বলা যায়। সুস্থ কর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা ছাড়া কর-জিডিপি অনুপাতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। অটোমেশন এখন যুগের দাবি। অটোমেশনের মাধ্যমে বর্তমানে নানা ধরনের সেবার মান বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের লেনদেন এখন আমরা আমাদের ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারি। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখনও আমাদের করদাতাদের ই-মেইল বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাঠাতে পারেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আর পিছিয়ে থাকার অবকাশ নেই। আশা করা যায় বর্তমান কার্যক্রমগুলো অব্যাহত থকলে আর দু-এক বছরের মধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, দেশে আধুনিক ও আদর্শ কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা হবে রাজস্ববান্ধব (revenue-friendly) এবং ব্যবসা-বান্ধব (business-friendly)।
ড. মোঃ আবদুর রউফ : পরিচালক, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড roufcus@yahoo.com
No comments