‘বাংলাদেশ আর ওডিশার ভেতরে বহুত মিল’
অচ্যুত সামন্তর জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ জানুয়ারি, ওডিশায়। ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবার অকালমৃত্যুর পর চরম অর্থাভাবে পড়ে তাঁদের পরিবার। তিনি টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ চালিয়ে ওডিশার উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি নেন রসায়নে। ১৯৯২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি (কেআইআইটি বা কিট)। সেটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৩ সালে অচ্যুত সামন্ত প্রতিষ্ঠা করেন কলিঙ্গ ইনস্টিটিউড অব সোশ্যাল সায়েন্স (কেআইআইএস বা কিস)। ওডিশার আদিবাসী দরিদ্র শিশুরা ‘কেজি টু পিজি’ বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়া আর পড়ালেখার সুযোগ পায় এই প্রতিষ্ঠানে। ২০১২ সালে পেয়েছেন জওহরলাল নেহরু অ্যাওয়ার্ড। সমাজসেবায় অবদানের জন্য তিনি ভারত ছাড়াও স্বীকৃতি পেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, চেক রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। গত ৬ মার্চ চতুর্থ সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি দিয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
প্রথম আলো বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
অচ্যুত সামন্ত বহুত ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ আমাকে এতই বিমোহিত করেছে যে সেটা বলবার নয়। যে আতিথেয়তা আমি এখানে পেয়েছি, সেটাও বহুদিন মনে থাকবে। আমার ভাষা নেই বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবার। আমি বাংলা বুঝতে পারি। বলতেও পারি অনেকটা। এ জন্য আমার বাংলাদেশ আরও বেশি ভালো লাগছে। এর আগে দুবার বাংলাদেশে আসা হয়েছে। সেটা ছিল একরকম ট্রানজিট। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এটাই বাংলাদেশে আমার প্রথম সফর।
প্রথম আলো বাংলাদেশ আর ওডিশার মধ্যে কী মিল আপনি দেখতে পান?
অচ্যুত সামন্ত বাংলাদেশ আর ওডিশার ভেতরে বহুত মিল আছে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা একসময় একটা রাজ্য বা অঞ্চল ছিল। দুই জায়গার মানুষের চলন-বলতে খুব বেশি তফাত তো দেখছি না। সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও মিল অনেক। ওডিশাতে অনেক বড়লোক আছে। গরিব আছে। বাংলাদেশেও অনেক গরিব লোক আছে। বড়লোকও আছে। বাংলাদেশে এখানে রাস্তাঘাট অনেক ভালো দেখছি। এখানে অনেক গ্রিনারি (সবুজ) আছে, যেমনটি ওডিশাতে আছে। এ রকম বহুত মিল।
প্রথম আলো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বাংলাদেশি ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
অচ্যুত সামন্ত কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজিতে বাংলাদেশের বহুত ছেলেমেয়ে আছে। তারা অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড। কাল আমি ঢাকায় কিটের প্রাক্তন বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের একটা নৈশভোজে গিয়েছিলাম। কিটের ছাত্রদের আমি আদর করে ‘কিটিয়ানস’ বলে ডাকি। আপনিও ওখানে ছিলেন। আপনি দেখেছেন ছেলেমেয়েরা কত খুশি। বাংলাদেশে যেসব ছেলেমেয়ে কিট থেকে পাস করেছে, তারা অনেক ভালো জায়গায় চাকরি করছে। এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার। আমি মনে করি, বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা বহুতই ভালো।
প্রথম আলো আপনার শুরুর সময়টা খুব কঠিন ছিল। একটা সময় আপনি এমনকি আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন। অচ্যুত সামন্ত হ্যাঁ, অসুবিধা তো অনেকই ছিল। শুরুতে অনেক কঠিন সময় গেছে। পাঁচ হাজার টাকায় একটা ভাড়াবাড়িতে কিট শুরু করেছিলাম। লোকে আমাকে বলেছিল, এ পাগল। এসব করে কিছু হবে না। সে সময় পাঁচ হাজার টাকাই আমার জন্য জোগাড় করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ, আত্মহত্যার কথাও ভাবতে হয়েছে আমার। লোন হয়ে গিয়েছিল অনেক। হয়েছিল কি, কিটের জন্য সবার কাছ থেকে ১০ হাজার ২০ হাজার, এমনি করে ‘হাত উধারি’ করেছিলাম। এভাবে উধার করতে করতে ১৯৯৬ সালে আমার ধার হয়ে গিয়েছিল ১৫ কি ১৬ লাখ। সে সময় ওই অর্থে আমার ইনস্টিটিউটের কোনো আয় ছিল না। যারা লোন দিয়েছিল, তারা বারবার তাদের পয়সা ফেরত চাইছিল। আমি ওদের বোঝাতে পারছিলাম না। তখন দেখলাম, এই উধার শোধ করবার কোনো রাস্তা খোলা নেই। মনে হলো যে আমাকে সুইসাইড করতে হবে। পরে, একটা ন্যাশনাল ব্যাংক আমাকে সহায়তায় করল। ওরা আমাদের ৩০ লাখ রুপি লোন দেয়। এভাবে আমি সংকটটা কাটিয়ে উঠি।
প্রথম আলো ‘মূলি আর মূল কখনো পুড়বে না’ কথাটি আপনি সব সময় বলেন। কথাটি একটু ব্যাখ্যা করবেন।
অচ্যুত সামন্ত এই কথাটা আমার মা বলেন। এর মানে হচ্ছে যে লোকটি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে থাকবে, তার মূল কখনো ডুবে যাবে না। একদিন না একদিন সে তার ভালো কাজের ফল পাবেই।
প্রথম আলো কিটের পাশাপাশি দরিদ্র আদিবাসী শিশুদের জন্য কিস (কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স) গঠনের চিন্তা কীভাবে মাথায় এল?
অচ্যুত সামন্ত দেখুন, আমি নিজে খুব দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছি। দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে না পারলে তাদের ভবিষ্যৎ কী রকম অন্ধকার হয়, সেটা খুব ভালোভাবে জানতাম। কারণ, দারিদ্র্য আমি নিজে সহ্য করেছি। সব সময় ভেবেছি, যদি জীবনে কিছু করতে পারি, তো দরিদ্রদের সবার আগে পড়ালেখার সুযোগ করে দেব। আমি নিজে যদি আজ কিছু করতে পারি, সেটা পেরেছি শিক্ষার কারণে। শিক্ষা হচ্ছে একটা স্থায়ী সমাধান। আর সবটা সাময়িক। এটা আমি হূদয়ঙ্গম করেছিলাম। ওডিশাতে ২৫ শতাংশ আদিবাসী। আর তারা এত কষ্টের মধ্যে থাকে, সেটা বলবার নয়। তাদের কষ্ট কেউ না দেখলে অনুভব করতে পারবে না। যারা সবচেয়ে বেশি গরিব, তাদেরই আমি তুলে আনার চেষ্টা করলাম। কিস এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আবাসিক আদিবাসী শিশুদের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যারাই এটা দেখে, মুগ্ধ হয়ে যায়।
প্রথম আলো ভারতে ওডিশার বাইরেও কিসের বেশ কিছু শাখা আছে। বাংলাদেশেও এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান চালু হতে যাচ্ছে...
অচ্যুত সামন্ত ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সবুর খানজি আমাদের কিট ও কিস দেখতে গিয়েছিলেন গত ডিসেম্বর মাসে। দেখার পরে আমার মন হলো, ওনারও অনেক বড় হূদয়। পৃথিবীর বহু জায়গা তিনি দেখেছেন। তো কিট দেখে তিনি অবাক হলেন। কিস তাঁকে আরও বেশি মুগ্ধ করল। আমাদের বন্ধুত্ব হলো। দেখলাম, আমাদের বন্ধুত্বকে দৃঢ় করতে হলে একসঙ্গে কিছু কাজ করা দরকার। তাঁকে বললাম, আপনি এত বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয় চালান, আপনিও দরিদ্র শিশুদের জন্য একটা কিছু করলে খুব ভালো হয়। তিনি রাজি হয়েছেন। সবুর খানজি দুই একর জায়গা দিতে রাজি হয়েছেন আশুলিয়ায়। আমরা একসঙ্গে এটাকে এগিয়ে নেব। আমার কিটের ১০০ জন অ্যালামনাই চেষ্টা করবে দুজন-তিনজন করে ছেলেমেয়েকে স্পনসর করার। এভাবে আমাদের ইচ্ছে এক হাজার ২০০ ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটা শুরু করার। এটি হবে পুরোপুরি ফ্রি এবং আবাসিক। ওয়ান থেকে টুয়েলভ পড়ার সুযোগ থাকবে এখানে। প্রতিটা ক্লাসে ১০০ জনের মতো দরিদ্র ছেলেমেয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশে কিটের সাবেক ছাত্ররা এর সঙ্গে থাকবে বলে কথা দিয়েছে। আমি আশা করছি, ঢাকার এই ‘কিস’ অনেক বেশি সফল হবে।
প্রথম আলো আপনি কাকে আপনার আইডল মনে করেন?
অচ্যুত সামন্ত আমি কাউকে সেভাবে আইডল মনে করি না। আমার মা আমার আইডল। তাঁর ৮৬ বছর বয়স। আমি দেখেছি, আমার বেশির ভাগ জিনিস নিজের চেষ্টায় হয়। আমি যেটা বলি, মন থেকে বলি। আজকালকার কলিযুগে যেটা হচ্ছে, মানুষ বলছে একটা, করছে আরেকটা। এভাবে চললে কেউ আপনার কথা মানবে না। সবাই জানে, আমি যা বলি সেটাই করার চেষ্টা করি।
প্রথম আলো ওডিশায় আপনি সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু জাতপাতের ভেদাভেদ ভারতে এখনো একটা বড় সমস্যা।
অচ্যুত সামন্ত ভারতের অন্য জায়গায় থাকতে পারে। কিন্তু ওডিশাতে কোনো জাতপাতের ভেদাভেদ নেই। জাত এখানে মাত্র দুটো। একদল ধনী, আরেক দল গরিব। ধনীদের জন্য অনেক কিছু সহজ। গরিবদের জন্য সেটা নয়। ওডিশার সম্পদ আছে। কিন্তু সেটা খুব অল্প কিছু মানুষের হাতে।
প্রথম আলো আপনি প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী। টাইম ম্যাগাজিন আপনার সম্পর্কে লিখেছে ‘সিমিং টু একম্পলিশ এভরিথিং, বাই ডুয়িং নাথিং’। এটা কীভাবে সম্ভব?
অচ্যুত সামন্ত আমি আজ পর্যন্ত কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি না। এই কিছুদিন হলো ই-মেইল চেক করা শিখেছি।
এই দুটো মোবাইলে (হাতের আর পকেটের দুটো মোবাইল ফোন দেখিয়ে) আমি পুরো বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এই মোবাইলের বয়সও ১৫ বছর প্রায় হয়ে গেল। পুরোনোটার নতুন মডেল খুঁজছি, মিলছে না। আমার তিনজন ব্যক্তিগত সহকারী আছে। তারা যাবতীয় কাজ করে। আমি পুরো প্রতিষ্ঠানকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দিয়েছি। সবার হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই ভালোভাবে নিজেদের কাজ করছে। আমি শুধু প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আছি। এমনকি আমি নিজে চেকও সই করি না।
প্রথম আলো ৫০ পূর্ণ করার আগেই আপনি দেশ-বিদেশ থেকে অজস্র সম্মাননা পেয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে আপনার লক্ষ্য কী?
অচ্যুত সামন্ত যে পড়ালেখা করবে না, সে দেশের জন্য বোঝা হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী হবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা করবে। আর যে পড়ালেখা করবে, সে সমাজকে অনেক কিছু দেবে। সে কোনো না কোনোভাবে সমাজের উন্নতিতে লাগবে। এটা আমি বুঝি। দেখবেন, যারা গরিব আছে, তাদের গরিব থাকার কারণ শিক্ষার অভাব। তবে শিক্ষা অবশ্যই কাজে লাগে এমন শিক্ষা হতে হবে। শুধু নাম সই করতে পারাটাকে আমি শিক্ষা বলতে চাই না। শিক্ষার মাধ্যমে আমি সমাজের গরিব লোকদের উন্নতির জন্য কাজ করছি। সেটাই করে যেতে চাই।
প্রথম আলো ‘আর্ট অব গিভিং’ নামে নিজস্ব একটি দর্শনের কথা আপনি বলেছেন। একটু খোলাসা করে বলবেন।
অচ্যুত সামন্ত: এটি আমার নিজের একটি চিন্তা। সবাই মনে করে, শুধু ধনীরাই অন্যদের জন্য কাজ করতে পারে। আমি মনে করি, অন্যের জন্য কিছু করা বা দেওয়া মানে সব সময় অর্থসহায়তা নয়। যে গরিব, সেও অন্যদের জন্য অনেক কিছু করতে পারে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
অচ্যুত সামন্ত ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
প্রথম আলো বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
অচ্যুত সামন্ত বহুত ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ আমাকে এতই বিমোহিত করেছে যে সেটা বলবার নয়। যে আতিথেয়তা আমি এখানে পেয়েছি, সেটাও বহুদিন মনে থাকবে। আমার ভাষা নেই বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবার। আমি বাংলা বুঝতে পারি। বলতেও পারি অনেকটা। এ জন্য আমার বাংলাদেশ আরও বেশি ভালো লাগছে। এর আগে দুবার বাংলাদেশে আসা হয়েছে। সেটা ছিল একরকম ট্রানজিট। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এটাই বাংলাদেশে আমার প্রথম সফর।
প্রথম আলো বাংলাদেশ আর ওডিশার মধ্যে কী মিল আপনি দেখতে পান?
অচ্যুত সামন্ত বাংলাদেশ আর ওডিশার ভেতরে বহুত মিল আছে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা একসময় একটা রাজ্য বা অঞ্চল ছিল। দুই জায়গার মানুষের চলন-বলতে খুব বেশি তফাত তো দেখছি না। সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও মিল অনেক। ওডিশাতে অনেক বড়লোক আছে। গরিব আছে। বাংলাদেশেও অনেক গরিব লোক আছে। বড়লোকও আছে। বাংলাদেশে এখানে রাস্তাঘাট অনেক ভালো দেখছি। এখানে অনেক গ্রিনারি (সবুজ) আছে, যেমনটি ওডিশাতে আছে। এ রকম বহুত মিল।
প্রথম আলো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বাংলাদেশি ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
অচ্যুত সামন্ত কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজিতে বাংলাদেশের বহুত ছেলেমেয়ে আছে। তারা অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড। কাল আমি ঢাকায় কিটের প্রাক্তন বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের একটা নৈশভোজে গিয়েছিলাম। কিটের ছাত্রদের আমি আদর করে ‘কিটিয়ানস’ বলে ডাকি। আপনিও ওখানে ছিলেন। আপনি দেখেছেন ছেলেমেয়েরা কত খুশি। বাংলাদেশে যেসব ছেলেমেয়ে কিট থেকে পাস করেছে, তারা অনেক ভালো জায়গায় চাকরি করছে। এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার। আমি মনে করি, বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা বহুতই ভালো।
প্রথম আলো আপনার শুরুর সময়টা খুব কঠিন ছিল। একটা সময় আপনি এমনকি আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন। অচ্যুত সামন্ত হ্যাঁ, অসুবিধা তো অনেকই ছিল। শুরুতে অনেক কঠিন সময় গেছে। পাঁচ হাজার টাকায় একটা ভাড়াবাড়িতে কিট শুরু করেছিলাম। লোকে আমাকে বলেছিল, এ পাগল। এসব করে কিছু হবে না। সে সময় পাঁচ হাজার টাকাই আমার জন্য জোগাড় করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ, আত্মহত্যার কথাও ভাবতে হয়েছে আমার। লোন হয়ে গিয়েছিল অনেক। হয়েছিল কি, কিটের জন্য সবার কাছ থেকে ১০ হাজার ২০ হাজার, এমনি করে ‘হাত উধারি’ করেছিলাম। এভাবে উধার করতে করতে ১৯৯৬ সালে আমার ধার হয়ে গিয়েছিল ১৫ কি ১৬ লাখ। সে সময় ওই অর্থে আমার ইনস্টিটিউটের কোনো আয় ছিল না। যারা লোন দিয়েছিল, তারা বারবার তাদের পয়সা ফেরত চাইছিল। আমি ওদের বোঝাতে পারছিলাম না। তখন দেখলাম, এই উধার শোধ করবার কোনো রাস্তা খোলা নেই। মনে হলো যে আমাকে সুইসাইড করতে হবে। পরে, একটা ন্যাশনাল ব্যাংক আমাকে সহায়তায় করল। ওরা আমাদের ৩০ লাখ রুপি লোন দেয়। এভাবে আমি সংকটটা কাটিয়ে উঠি।
প্রথম আলো ‘মূলি আর মূল কখনো পুড়বে না’ কথাটি আপনি সব সময় বলেন। কথাটি একটু ব্যাখ্যা করবেন।
অচ্যুত সামন্ত এই কথাটা আমার মা বলেন। এর মানে হচ্ছে যে লোকটি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে থাকবে, তার মূল কখনো ডুবে যাবে না। একদিন না একদিন সে তার ভালো কাজের ফল পাবেই।
প্রথম আলো কিটের পাশাপাশি দরিদ্র আদিবাসী শিশুদের জন্য কিস (কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স) গঠনের চিন্তা কীভাবে মাথায় এল?
অচ্যুত সামন্ত দেখুন, আমি নিজে খুব দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছি। দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে না পারলে তাদের ভবিষ্যৎ কী রকম অন্ধকার হয়, সেটা খুব ভালোভাবে জানতাম। কারণ, দারিদ্র্য আমি নিজে সহ্য করেছি। সব সময় ভেবেছি, যদি জীবনে কিছু করতে পারি, তো দরিদ্রদের সবার আগে পড়ালেখার সুযোগ করে দেব। আমি নিজে যদি আজ কিছু করতে পারি, সেটা পেরেছি শিক্ষার কারণে। শিক্ষা হচ্ছে একটা স্থায়ী সমাধান। আর সবটা সাময়িক। এটা আমি হূদয়ঙ্গম করেছিলাম। ওডিশাতে ২৫ শতাংশ আদিবাসী। আর তারা এত কষ্টের মধ্যে থাকে, সেটা বলবার নয়। তাদের কষ্ট কেউ না দেখলে অনুভব করতে পারবে না। যারা সবচেয়ে বেশি গরিব, তাদেরই আমি তুলে আনার চেষ্টা করলাম। কিস এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আবাসিক আদিবাসী শিশুদের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যারাই এটা দেখে, মুগ্ধ হয়ে যায়।
প্রথম আলো ভারতে ওডিশার বাইরেও কিসের বেশ কিছু শাখা আছে। বাংলাদেশেও এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান চালু হতে যাচ্ছে...
অচ্যুত সামন্ত ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সবুর খানজি আমাদের কিট ও কিস দেখতে গিয়েছিলেন গত ডিসেম্বর মাসে। দেখার পরে আমার মন হলো, ওনারও অনেক বড় হূদয়। পৃথিবীর বহু জায়গা তিনি দেখেছেন। তো কিট দেখে তিনি অবাক হলেন। কিস তাঁকে আরও বেশি মুগ্ধ করল। আমাদের বন্ধুত্ব হলো। দেখলাম, আমাদের বন্ধুত্বকে দৃঢ় করতে হলে একসঙ্গে কিছু কাজ করা দরকার। তাঁকে বললাম, আপনি এত বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয় চালান, আপনিও দরিদ্র শিশুদের জন্য একটা কিছু করলে খুব ভালো হয়। তিনি রাজি হয়েছেন। সবুর খানজি দুই একর জায়গা দিতে রাজি হয়েছেন আশুলিয়ায়। আমরা একসঙ্গে এটাকে এগিয়ে নেব। আমার কিটের ১০০ জন অ্যালামনাই চেষ্টা করবে দুজন-তিনজন করে ছেলেমেয়েকে স্পনসর করার। এভাবে আমাদের ইচ্ছে এক হাজার ২০০ ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটা শুরু করার। এটি হবে পুরোপুরি ফ্রি এবং আবাসিক। ওয়ান থেকে টুয়েলভ পড়ার সুযোগ থাকবে এখানে। প্রতিটা ক্লাসে ১০০ জনের মতো দরিদ্র ছেলেমেয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশে কিটের সাবেক ছাত্ররা এর সঙ্গে থাকবে বলে কথা দিয়েছে। আমি আশা করছি, ঢাকার এই ‘কিস’ অনেক বেশি সফল হবে।
প্রথম আলো আপনি কাকে আপনার আইডল মনে করেন?
অচ্যুত সামন্ত আমি কাউকে সেভাবে আইডল মনে করি না। আমার মা আমার আইডল। তাঁর ৮৬ বছর বয়স। আমি দেখেছি, আমার বেশির ভাগ জিনিস নিজের চেষ্টায় হয়। আমি যেটা বলি, মন থেকে বলি। আজকালকার কলিযুগে যেটা হচ্ছে, মানুষ বলছে একটা, করছে আরেকটা। এভাবে চললে কেউ আপনার কথা মানবে না। সবাই জানে, আমি যা বলি সেটাই করার চেষ্টা করি।
প্রথম আলো ওডিশায় আপনি সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু জাতপাতের ভেদাভেদ ভারতে এখনো একটা বড় সমস্যা।
অচ্যুত সামন্ত ভারতের অন্য জায়গায় থাকতে পারে। কিন্তু ওডিশাতে কোনো জাতপাতের ভেদাভেদ নেই। জাত এখানে মাত্র দুটো। একদল ধনী, আরেক দল গরিব। ধনীদের জন্য অনেক কিছু সহজ। গরিবদের জন্য সেটা নয়। ওডিশার সম্পদ আছে। কিন্তু সেটা খুব অল্প কিছু মানুষের হাতে।
প্রথম আলো আপনি প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী। টাইম ম্যাগাজিন আপনার সম্পর্কে লিখেছে ‘সিমিং টু একম্পলিশ এভরিথিং, বাই ডুয়িং নাথিং’। এটা কীভাবে সম্ভব?
অচ্যুত সামন্ত আমি আজ পর্যন্ত কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি না। এই কিছুদিন হলো ই-মেইল চেক করা শিখেছি।
এই দুটো মোবাইলে (হাতের আর পকেটের দুটো মোবাইল ফোন দেখিয়ে) আমি পুরো বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এই মোবাইলের বয়সও ১৫ বছর প্রায় হয়ে গেল। পুরোনোটার নতুন মডেল খুঁজছি, মিলছে না। আমার তিনজন ব্যক্তিগত সহকারী আছে। তারা যাবতীয় কাজ করে। আমি পুরো প্রতিষ্ঠানকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দিয়েছি। সবার হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই ভালোভাবে নিজেদের কাজ করছে। আমি শুধু প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আছি। এমনকি আমি নিজে চেকও সই করি না।
প্রথম আলো ৫০ পূর্ণ করার আগেই আপনি দেশ-বিদেশ থেকে অজস্র সম্মাননা পেয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে আপনার লক্ষ্য কী?
অচ্যুত সামন্ত যে পড়ালেখা করবে না, সে দেশের জন্য বোঝা হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী হবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা করবে। আর যে পড়ালেখা করবে, সে সমাজকে অনেক কিছু দেবে। সে কোনো না কোনোভাবে সমাজের উন্নতিতে লাগবে। এটা আমি বুঝি। দেখবেন, যারা গরিব আছে, তাদের গরিব থাকার কারণ শিক্ষার অভাব। তবে শিক্ষা অবশ্যই কাজে লাগে এমন শিক্ষা হতে হবে। শুধু নাম সই করতে পারাটাকে আমি শিক্ষা বলতে চাই না। শিক্ষার মাধ্যমে আমি সমাজের গরিব লোকদের উন্নতির জন্য কাজ করছি। সেটাই করে যেতে চাই।
প্রথম আলো ‘আর্ট অব গিভিং’ নামে নিজস্ব একটি দর্শনের কথা আপনি বলেছেন। একটু খোলাসা করে বলবেন।
অচ্যুত সামন্ত: এটি আমার নিজের একটি চিন্তা। সবাই মনে করে, শুধু ধনীরাই অন্যদের জন্য কাজ করতে পারে। আমি মনে করি, অন্যের জন্য কিছু করা বা দেওয়া মানে সব সময় অর্থসহায়তা নয়। যে গরিব, সেও অন্যদের জন্য অনেক কিছু করতে পারে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
অচ্যুত সামন্ত ধন্যবাদ।
No comments