পাকিস্তান- তালেবানের আরেকটি ফাঁদ? by নাজাম শেঠি
তালেবানের ঘাঁটি ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি
সৈন্যের সতর্ক অবস্থানখুনে তালেবানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো ভালো
হবে, না খারাপ হবে—এ নিয়ে মাসের পর মাস পাকিস্তানের সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো
ও সংবাদমাধ্যম যখন দোদুল্যমানতায় ভুগেছে, তখন তালেবান গোষ্ঠীগুলোর মোর্চা
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (সংক্ষেপে পাকিস্তানি তালেবান) সরকারের সঙ্গে
আলোচনায় বসার আগে অস্ত্রবিরতির ধারণাটি সোজাসাপটা নাকচ করে দিয়েছিল।
তারা বরং আলোচনার ব্যাপারে কতগুলো অসম্ভব পূর্বশর্ত আরোপ করেছিল। অবশ্য মাওলানা ফজল উর রহমান ও ইমরান খানের মতো রাজনীতিকেরা সংঘর্ষ বন্ধ করে আলোচনায় বসার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য অল পার্টিজ কনফারেন্সের প্রতি যতই আহ্বান জানাচ্ছিলেন, পাকিস্তানি তালেবান ততই পাকিস্তানজুড়ে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা বাড়িয়ে চলছিল। গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যখন তালেবানকে শান্তি প্রস্তাব দেওয়ার জন্য অল পার্টিজ কনফারেন্স আহ্বান করেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত তালেবানের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ও ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণে পাঁচ শতাধিক লোক নিহত হয়েছে, আহত হয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। বস্তুত, তালেবানের সঙ্গে আলোচনার জন্য নওয়াজ শরিফের সরকার গত ২৮ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করার পর থেকে একটার পর একটা সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে।
প্রতিটি হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে কোনো না কোনো তালেবান গ্রুপ। এসব হামলায় হতাহত হয়েছে দেড় শতাধিক লোক। সামরিক বাহিনীর ধৈর্যের বাঁধ একদম ভেঙে পড়ে, যখন তালেবান ফ্রন্টিয়ার কোরের ১৯ জন সেনার শিরশ্ছেদ করে, যাঁদের তারা কয়েক বছর ধরে জিম্মি করে রেখেছিল। এ ঘটনার পর সামরিক বাহিনী উত্তর ওয়াজিরিস্তানে তালেবানের ঘাঁটিগুলোর ওপর প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা চালায়। গত মাসে সামরিক বাহিনী তালেবানের ওপর দ্বিতীয় দফা বিমান হামলা চালালে তালেবান বেগতিক দেখে অবশেষে অস্ত্রবিরতির ডাক দেয়। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে তালেবানকে আলোচনায় বসতে রাজি করাতে হলে তাদের প্রতি মখমলের দস্তানা পরে করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালে কাজ হবে না, বরং তাদের বজ্রমুষ্টি দেখাতে হবে।
এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে পাকিস্তানি তালেবানের এক মাসের অস্ত্রবিরতি তাদের একটা ফাঁদ মাত্র। এই ফাঁদ তারা পেতেছে আমাদের সামরিক নেতৃত্বের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং নতুন কোনো বিমান হামলা থেকে তাদের বিরত রাখার মতলবে। এই সময়ের মধ্যে শীতকাল পেরিয়ে যাবে, তালেবান জঙ্গি গ্রুপগুলো নিজেদের আবার সংহত করে নেবে এবং সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য নতুন হামলাগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হবে।
পাকিস্তানি তালেবান যে আল-কায়েদা ও আফগান তালেবানের সহযোগিতায় পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে নিজেদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেটা হবে পাকিস্তানের ভেতরে একটা তালেবান রাষ্ট্র। তারা যে ওয়াজিরিস্তান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এসেছে, এটা তাদের সেই খায়েশেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইমরান খানের মতো রাজনৈতিক নেতারা, জামায়াত-ই-ইসলামি ও জমিয়ত-ই-উলেমা এবং পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ পাকিস্তান তালেবানের এই ভাবাদর্শ ও কৌশলটি বুঝতে পারে না। এটাও ভেবে দেখার মতো একটা বিষয়।
আফগান তালেবান আমেরিকা ও কারজাই সরকারের সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে দীর্ঘ সময় ধরে টালবাহানা করে এসেছে, কিন্তু তারা কখনো সংলাপে বসেনি; আমেরিকা বা কারজাইয়ের কোনো কথায় রাজিও হয়নি। কারণ, আফগান তালেবান জানে, আমেরিকানরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারজাই সরকারের পতন ঘটবে। তাই তারা মনে করে, আপাতত ঘাপটি মেরে থাকাই ভালো; লড়াইটা হবে পরে।
একইভাবে পাকিস্তানি তালেবানও জানে, আমেরিকানরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আফগান তালেবানের বিপদ ও ব্যস্ততা কমে যাবে। তখন পাকিস্তানি তালেবানও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরও জোরেশোরে লড়তে পারবে। কারণ, আফগান তালেবান ডুরান্ড লাইন মুছে ফেলতে পাকিস্তানি তালেবানকে সহযোগিতা করবে। হাজার হাজার আফগান তালেবান ইতিমধ্যে ওয়াজিরিস্তানকে নিজেদের দ্বিতীয় স্থায়ী আবাস বানিয়ে ফেলেছে; বিনা লড়াইয়ে তারা সেখান থেকে চলে যেতে মোটেই রাজি নয়।
তালেবানের সঙ্গে সংলাপ, না যুদ্ধ—এ নিয়ে পাকিস্তানে যে বিতর্ক চলছে, তাতে আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় বলতে গেলে অনুপস্থিত। আফগানিস্তানে তালেবানের দাঁড়ানোর একটা জায়গা আছে, সে দেশে তাদের অস্তিত্বের কারণও আছে। আর তারা যুদ্ধ করে তাদের হারানো রাষ্ট্র ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে, যে রাষ্ট্র তারা হারিয়েছে এক বিদেশি আগ্রাসী শক্তির কারণে। তাই আফগানিস্তান থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে যে আমেরিকা এবং তার ফলে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে যে পুতুল কারজাই সরকারের, তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করে একধরনের ক্ষমতা ভাগাভাগির কোনো ফরমুলা বের করার চেষ্টা তারা করতেই পারে। একইভাবে আফগান তালেবানও কাবুল ছাড়া অন্য কোনো কিছুর বিনিময়ে সমঝোতায় যাবে না—এই কৌশল নিতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা ও দর-কষাকষি করবে? একটা নতুন তালেবান রাষ্ট্রের জন্য পাকিস্তানের একখণ্ড ভূমি নিয়ে? একটা নতুন ইসলামি সংবিধান নিয়ে? ইসলামাবাদে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে?
পাকিস্তানি তালেবানের অস্ত্রবিরতি প্রস্তাবের জবাবে নওয়াজ শরিফের সরকার আলোচনা প্রক্রিয়ার ‘প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের’ কথা বলেছে। এর অর্থ হলো, তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ বা শান্তি যেটাই হোক না কেন, তার কর্তৃত্ব সামরিক বাহিনীর ওপর অর্পণের দায়িত্বটা সরকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খানকে দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার কথা খাইবার পাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী ও গভর্নরের। এটা একটা চালাকিপূর্ণ পদক্ষেপ; যারা তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায় (জেনারেল রাহিল শরিফের অধীনস্থ সামরিক বাহিনী), আর যারা তালেবানের সঙ্গে সংলাপে বসতে বা তাদের মন জয় করতে চায় (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ ও জামায়াত-ই-সলামির নেতৃত্বাধীন খাইবার পাখতুনখাওয়া সরকার), তাদের একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করাই এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য।
বছর দুই আগে ঠিক এমনটিই করেছিলেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। তিনি তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল আশফাক কায়ানির অধীনস্থ সামরিক বাহিনী ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) নেতৃত্বাধীন খাইবার পাখতুনখাওয়া সরকারকে একসঙ্গে বসিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সে সময় সামরিক বাহিনী তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়নি, কিন্তু খাইবার পাখতুনখাওয়া সরকার যুদ্ধই চেয়েছিল। ওই পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী নিজের রাস্তা খুঁজে পেয়েছিল, আর এএনপিকে তার মাশুল গুনতে হয়েছে। এখন অন্য কিছু না ঘটলে আবার অনেকটা সে রকমই ঘটতে যাচ্ছে। এবার বরং বিভ্রান্তি ও অস্বস্তি-উদ্বেগ আগেরবারের থেকে বেশি।
পাকিস্তানে এ ধরনের রাজনীতির ফলে গত তিন দশকে রাষ্ট্র-সমাজকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। রাজনীতির খেলা বন্ধ করে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজাম শেঠি: পাকিস্তানি সাংবাদিক। লাহোরের ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমস-এর সম্পাদক।
No comments