গোপন বলেই সে এত মধুর!
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে ভাঙিয়া
মিলিয়া যায় দুইটি অধরে। প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আদরে অধরেতে থরে থরে
চুম্বনের লেখা। (রবিঠাকুর) গোপন বলেই সে এত মধুর।
চিরকালের,
চিরদিনের ধন। গোপন বলেই তাকে ঘিরে এত ভাললাগা, সমস্ত সুখ-দু্ঃখের মধ্যযামে
দাঁড়িয়ে ভালবাসা। যদি সে হয় তার একটি ভুবনমোহিনী তিল, তবে সেই চিরচেনা
চিবুকের তিল-ই হয়ে যায় রোমাঞ্চ-স্পর্শ পিপাসায়, আদর-আঘ্রাণে পরম সত্য!
যদি সে হয় রাসবিহারী ব্যস্ত ট্রাফিক পার হতে হতে তার সটান গ্রীবা ভঙ্গিমা,
তবে চুলের আড়ালে সে গ্রীবায় রেণু রেণু জমে ওঠা ঘাম হয়ে ওঠে ভরতি
দুপুরেও ‘থরে থরে চুম্বনের লেখা’!
৫৬, যতীন দাস রোডের ক্যাফেলা যাবার পথে চাট্টিখানি কাব্য করছিলাম। ফকিরের যেমন স্বভাব, ট্যাক্সির ব্যাকসিটে বসে অপ্রস্তুত রঞ্জাকে ভাঙতে ভাঙতে কাব্য করা। শান্তিনিকেতন থেকে এনে দেওয়া রূপদস্তার নুপূর পড়েছে আজ ও। রিনরিনে সুরে বাজা সন্ধির নুপূর! বোল-চালে চেতনার গহনে যেন নিয়ত বেজে চলেছে সুধা নিক্কন! থেকে থেকে কবিরুলদার লাইনগুলো মনে পড়ছে। ট্যাক্সিওয়ালার সতর্ক কান বাঁচিয়ে ওর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,
- আজ সেই নুপুরই দুপুর, আহা, দুপুর/ কত কী যে ভাঙ্গতে গড়তে/ গড়তে ভাঙ্গতে/ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গড়া/ শোনো/ সেই নুপুরই বাজে/ বাজে, বাজে ভরতি দুপুর দূরে…’!
- কী করে এত মনে রাখো কবিতার কারুশালা?
রঞ্জার কথা শুনে শিথিল হাতে ওর কোমর ছুঁয়ে বললাম,
- এ তো তোমার জন্য ফকিরের নিজস্ব নিখিল রঞ্জা। তুমি জেনে খুশি হবে, ক্যাফেলা তেমন এক কবিতা-গান আর প্রাণখোলা আড্ডার ভুবন। যেখানে এই শহরের রাখালরা তাদের রঞ্জাকে যদি প্রেম জানাতে চায়, সাদরে জানাতে পারে যে কোনও বৃষ্টি-মুখর সন্ধেয়। দাপুটে দুপুর অথবা সাহসী সকালে!
- সে তো বুঝলাম। সেদিন বাঙালি উদ্যোগ বললে, সে কি বারিস্তা কিংবা সিসিডির অক্ষম অনুকরণ? নাকি কফি হাউসের কলরব মিলবে এখানে? মানে তোমার মিউজিক ক্যাফেতে?
- এর কোনওটাই নয়! এ এক ষোল আনা বাঙালি-রক-কালচারের জায়গা!
রঞ্জার সঙ্গে কথা আর উপকথনের ভিতর কখন ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছে যুগলসের সামনে। একটু এগিয়ে প্রথম বাঁ-দিকে ঘুরতেই নজরে এল ক্যাফেলা। কাচের দরজা ঠেলতেই ওপারে হিমেল স্পর্শ! এর আগে টেলিফোনে কথা হয়েছিল। সেই সুবাদে পরিচয় দিতেই কাউন্টার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সুভদ্র আতিথেয়তায় মুহূর্তে নিজের করে নিলেন দুই কর্ণধার, সঞ্জয় সোম ও দ্বৈপায়ন রায়। মনে হল যেন নিজের-ই কোটরে ফিরলাম দগ্ধ শহরের বহু পথ ঘুরে! সঞ্জয়বাবু বলছিলেন,
- নিশিঠেকে বহু জন পড়েছে শুনলাম। অনেকে টেক্সট করেও জানিয়েছে।
- সে সব পরে শুনব। চলুন আগে ঘুরে ফিরে দেখি। বাকি পর্ব তো লিখতে হবে, নাকি?
দ্বৈপায়নবাবু এগিয়ে এসে, হাসতে হাসতে বললেন,
- নিশ্চয়! চলুন চলুন। তিনটে ফ্লোর ঘুরিয়ে দেখাই। তবে নিশি লেখার আগে এখনই বলে রাখি, এখন থেকে নিশিঠেকের নিয়মিত ঠেকবাজ কিন্তু আমরাও! মানে ক্যাফেলাও!
কথার মাঝে চোখ গেল রঞ্জার দিকে। রিসেপশনের চারদিকের দেওয়ালজুড়ে সাজানো লোক-সম্ভারে। সাধ্যের দামে রয়েছে সেরামিকের টি-পট থেকে নানান পেনডেন্ট, কানের দুল, চিরুনি, ছাইদান, বুকমার্ক, নিজস্ব ‘রোদচশমা ব্রান্ডে’-এর টি-শার্ট। রঞ্জা হাতের দুলটা রেখে বলল,
- একটু অন্যরকম মোটিফ! বেশ লাগল সিলভার জুয়েলারি কালেকশন।
দরজা ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ক্যাফেলা শুরুর গল্প বলছিলেন দ্বৈপায়নবাবু। সিঁড়ির দু’পাশে টাঙানো বিক্রির জন্য ফ্রেমিং করা ফটো ও পেন্টিং দেখতে গিয়ে দেরি হচ্ছিল আমাদের। সেই কারণে, মাঝে মাঝে-ই থামতে হচ্ছিল ওঁকে। উনি বলছিলেন,
- হায়দরাবাদে ইঞ্জিনিয়র ছিলাম। কলকাতায় বদলি হয়ে এসে, ঠিক তাল মেলাতে পারলাম না জানেন, এখানকার কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে। একদিন সঞ্জয়দার সঙ্গে সিসিডিতে বসে কথা বলতে বলতে মনে হল, এমন কেন হবে? কফি হাউসের না হয় চরিত্র বদলে গেছে। তাই বলে বাঙালি চা-কফি খাবে ফিসফিস করে কথা বলে? কোনও রকবাজি থাকবে না সেই আড্ডায়?
দ্বৈপায়নবাবুকে সমর্থন জানিয়ে বললাম,
- ঠিক! কফিশালায় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে উপচে পড়বে না তর্কের তুফান? গান-কবিতা-সিনেমা নিয়ে তুলকালাম হবে না? তাহলে কীসের ক্যাফেটোরিয়া?
উপরের ফ্লোরে পা রেখে, একটু থেমে রঞ্জা বলল,
- সেখান থেকেই কি রক-কালচারে মশগুল বাঙালির একটা মিউজিক ক্যাফে, এই ক্যাফেলার জন্ম?
- বলতে পারেন ম্যাডাম, সেই সূত্রপাত এই বিপ্লবের। রঞ্জন ঘোষাল নিজের মামা হন। একসময় টেলিভিশনে ‘আড্ডাচক্র’ বলে একটা অপেরা করেছিলেন উনি। তাছাড়া মহীনের গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। কোথাও একটা এসব করার ভাবনা হয়তো ছিল। সেই ভাবনাকে শিল্পের নানা আঙ্গিকে সাজানোর জন্য আরেক জনের কথা বলব। তিনি কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিনীত বয়নে বলে চলা ক্যাফের জন্মকথা শুনতে শুনতে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। উঠেই প্রথম ফ্লোরে চারজনের ছোট্ট বসার জায়গাটি বেশ সুন্দর। পাশে-ই দুটো ঘর সাজানো দারুণ সব শাড়ি এবং ক্যানভাসে! রঞ্জা মেতে উঠল শাড়ির সংসারে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওকে খুব নিবিড় করে দেখলাম। ফকির যেমন দেখে!
গহন কালো হালকা-পুলকা লং-স্কার্ট পড়েছে রঞ্জা। যেন মৌসুমি হাওয়ার সমুদ্রে ভেসে থাকতে চায় ওর স্কার্টের খোল। একটা দিক একটু বেশি-ই গোটানো, কোমরের কাছে। সেই জন্য কোমরের দোলনমায়ায় যেন ও মেয়ে অভিসারিকা। ওপরে ফেড, বেশ ঘরোয়া আমন্ত্রণের ঘোষণায় বুঝি ফিচেল, ওর স্লিভলেস ফতুয়া! কানে চাম্বা লাম্বার রুপোর দুলের একফালি কারুকাজে, চাঁদভাসি স্নিগ্ধতা। নিজের পাড়া বলে, রঞ্জার এই সাজ খসাবার এলোমেলো সাজ! ওর চুলেও সেই এলোমেলো হাওয়ার বিশৃঙ্খলা। ঠোঁটের ফিকে হয়ে হয়ে আসা গ্লসি রং এখন বেশ ফিকে! একটা বাংলাদেশের টাঙাইল শাড়ির আঁচল দেখছিল, খুব কাছে গিয়ে কানের পাশে মুখ নামিয়ে বললাম,
- এই শোনো, ইচ্ছে করছে… মানে, চুমু খাবি?
- ইশশশশশ!
কথা ফুরোবার আগেই ছটফটিয়ে নাগালের বাইরে সরে গেল উড়ুক মেয়ে। সলাজ চোখে এখন তিরতির ত্রাস! ওর চোখের হরিণ যে ফকিরের চেনা। বললাম,
- চলো, এবার কফি হল্টে যাই। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়ে গেছে বেশ!
দ্বৈপায়নবাবু শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। উপরতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন,
- চলুন, এবার সোজা কফি হল্টে। খুব ছোট্ট, মাত্র তিনশো স্কোয়ার ফিটের জায়গা। সাকুল্যে ত্রিশজনের বসার জায়গা। শনি-রবি লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে সিঁড়িতে।
একটু অবাক হয়ে রঞ্জা বলল,
- সেদিন কি স্পেশ্যাল কিছু থাকে আপনাদের?
- সেই অর্থে প্রতিটা দিন-ই ক্যাফেলার কাছে স্পেশ্যাল। আসলে শনি-রবিগুলোতে এখানে নানা কিছু হয়। ধরুন, আপনার কবিতার বই বা সিডি লঞ্চ করতে চান। এখানে ভিড় জমাতে পারেন। এখানে গিটার আছে, ইচ্ছেমতো গান-বাজনা করতে পারেন এসে। নানা বিষয়ের বই-ও রয়েছে। এসে কফি খেতে খেতে পড়াশুনোও করতে পারেন! রইল বাকি প্রেম!
কথা কেড়ে নিয়ে রঞ্জার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললাম,
- ভিতর-বাহির, সে তো আছে সবখানে।
কফি হল্টে পা দিতেই মনে হল, মিথ্যে বলা নয়, দুই কর্ণধারের উদ্দেশ্য। একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের এক মিউজিক-ক্যাফে করে ফেলেছেন ওঁরা! কী নেই, স্মোকিং জোন থেকে স্পেনের কেতায় দেওয়াল লিখন। মেনুতে ব্রিটিশ ফিশ অ্যান্ড চিপস ইন বিয়ার বাটার থেকে ঠান্ডি আইস টি অথবা কোল্ড কফি! সেরামিকের টেবিলের রঙ বিন্যাস থেকে সিলিং মুখর গিটারে সুর-সারিন্দা- সর্বত্র নতুন ভাবনার ছোঁওয়াচ! চারপাশের টেবিলে বসা ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের রকমসকম দেখে অন্তত সেটাই মনে হল। কফিতে চুমুক দিয়ে কথার ফাঁকে রঞ্জা দেওয়াল লিখনগুলো পড়ছিল। একসময় এক জায়গায় ওর চোখ থামল! যেখানে বেপরোয়া আঁচড়ে তুলিতে লেখা, ‘কোনও কোনও কলমে রক্তও থাকে’! রঞ্জা বলল,
- বাঙালির রক-বিপ্লব-ই বটে!
ওর কথায় হাসতে হাসতে মেনু উলটে বললাম,
- যাই বলো, এখানে কোনও উঠিয়ে দেবার তাড়া নেই। বিন্দাস বসে ঝিঙ্কু প্রেম করা যায়। ঘর ভর্তি লোকের সামনে চোখে চোখে যেটা এখন করবে ফকির!
খেয়াল হল, রঞ্জার সেই রেণু রেণু জমে ওঠা ঘাম মিলিয়ে গিয়েছে কখন, কফি হল্টের হিমেল হাওয়ায়। দুষ্টুমির খেয়ালে, ওকে সে কথা স্মরণ করিয়ে বললাম,
- এই জয়দেব মনে পড়ছে জানো?
- মোটেই না! জয়দেব কখনও শ্রীরাধিকার ঘাম নিয়ে লিখতে পারেন না!
- লিখতে পারেন না নয়, লিখেছেন! তবে সে ঘাম, রাধার হার থেকে ঝরে পড়া রতিশ্রমের ঘাম!
রঞ্জা তুমুল লজ্জা পেয়ে, দু’ হাতে রাঙা গাল ঢেকে, জিভ কেটে বলল,
- ইশশশশ! তুমি পারো ফকির!
চুপি চুপি ওর লালি কানের কাছে মুখ নিয়ে যেতে, ও করতলে কান ঢেকে না শোনার ভান করল! নাছোড় হয়ে ফকিরও জয়দেব বলল,
- শ্রমজলকণভরসুভগশরীরা।/ পরিপতিতোরশি রতিরণধীরা!
৫৬, যতীন দাস রোডের ক্যাফেলা যাবার পথে চাট্টিখানি কাব্য করছিলাম। ফকিরের যেমন স্বভাব, ট্যাক্সির ব্যাকসিটে বসে অপ্রস্তুত রঞ্জাকে ভাঙতে ভাঙতে কাব্য করা। শান্তিনিকেতন থেকে এনে দেওয়া রূপদস্তার নুপূর পড়েছে আজ ও। রিনরিনে সুরে বাজা সন্ধির নুপূর! বোল-চালে চেতনার গহনে যেন নিয়ত বেজে চলেছে সুধা নিক্কন! থেকে থেকে কবিরুলদার লাইনগুলো মনে পড়ছে। ট্যাক্সিওয়ালার সতর্ক কান বাঁচিয়ে ওর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,
- আজ সেই নুপুরই দুপুর, আহা, দুপুর/ কত কী যে ভাঙ্গতে গড়তে/ গড়তে ভাঙ্গতে/ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গড়া/ শোনো/ সেই নুপুরই বাজে/ বাজে, বাজে ভরতি দুপুর দূরে…’!
- কী করে এত মনে রাখো কবিতার কারুশালা?
রঞ্জার কথা শুনে শিথিল হাতে ওর কোমর ছুঁয়ে বললাম,
- এ তো তোমার জন্য ফকিরের নিজস্ব নিখিল রঞ্জা। তুমি জেনে খুশি হবে, ক্যাফেলা তেমন এক কবিতা-গান আর প্রাণখোলা আড্ডার ভুবন। যেখানে এই শহরের রাখালরা তাদের রঞ্জাকে যদি প্রেম জানাতে চায়, সাদরে জানাতে পারে যে কোনও বৃষ্টি-মুখর সন্ধেয়। দাপুটে দুপুর অথবা সাহসী সকালে!
- সে তো বুঝলাম। সেদিন বাঙালি উদ্যোগ বললে, সে কি বারিস্তা কিংবা সিসিডির অক্ষম অনুকরণ? নাকি কফি হাউসের কলরব মিলবে এখানে? মানে তোমার মিউজিক ক্যাফেতে?
- এর কোনওটাই নয়! এ এক ষোল আনা বাঙালি-রক-কালচারের জায়গা!
রঞ্জার সঙ্গে কথা আর উপকথনের ভিতর কখন ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছে যুগলসের সামনে। একটু এগিয়ে প্রথম বাঁ-দিকে ঘুরতেই নজরে এল ক্যাফেলা। কাচের দরজা ঠেলতেই ওপারে হিমেল স্পর্শ! এর আগে টেলিফোনে কথা হয়েছিল। সেই সুবাদে পরিচয় দিতেই কাউন্টার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সুভদ্র আতিথেয়তায় মুহূর্তে নিজের করে নিলেন দুই কর্ণধার, সঞ্জয় সোম ও দ্বৈপায়ন রায়। মনে হল যেন নিজের-ই কোটরে ফিরলাম দগ্ধ শহরের বহু পথ ঘুরে! সঞ্জয়বাবু বলছিলেন,
- নিশিঠেকে বহু জন পড়েছে শুনলাম। অনেকে টেক্সট করেও জানিয়েছে।
- সে সব পরে শুনব। চলুন আগে ঘুরে ফিরে দেখি। বাকি পর্ব তো লিখতে হবে, নাকি?
দ্বৈপায়নবাবু এগিয়ে এসে, হাসতে হাসতে বললেন,
- নিশ্চয়! চলুন চলুন। তিনটে ফ্লোর ঘুরিয়ে দেখাই। তবে নিশি লেখার আগে এখনই বলে রাখি, এখন থেকে নিশিঠেকের নিয়মিত ঠেকবাজ কিন্তু আমরাও! মানে ক্যাফেলাও!
কথার মাঝে চোখ গেল রঞ্জার দিকে। রিসেপশনের চারদিকের দেওয়ালজুড়ে সাজানো লোক-সম্ভারে। সাধ্যের দামে রয়েছে সেরামিকের টি-পট থেকে নানান পেনডেন্ট, কানের দুল, চিরুনি, ছাইদান, বুকমার্ক, নিজস্ব ‘রোদচশমা ব্রান্ডে’-এর টি-শার্ট। রঞ্জা হাতের দুলটা রেখে বলল,
- একটু অন্যরকম মোটিফ! বেশ লাগল সিলভার জুয়েলারি কালেকশন।
দরজা ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ক্যাফেলা শুরুর গল্প বলছিলেন দ্বৈপায়নবাবু। সিঁড়ির দু’পাশে টাঙানো বিক্রির জন্য ফ্রেমিং করা ফটো ও পেন্টিং দেখতে গিয়ে দেরি হচ্ছিল আমাদের। সেই কারণে, মাঝে মাঝে-ই থামতে হচ্ছিল ওঁকে। উনি বলছিলেন,
- হায়দরাবাদে ইঞ্জিনিয়র ছিলাম। কলকাতায় বদলি হয়ে এসে, ঠিক তাল মেলাতে পারলাম না জানেন, এখানকার কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে। একদিন সঞ্জয়দার সঙ্গে সিসিডিতে বসে কথা বলতে বলতে মনে হল, এমন কেন হবে? কফি হাউসের না হয় চরিত্র বদলে গেছে। তাই বলে বাঙালি চা-কফি খাবে ফিসফিস করে কথা বলে? কোনও রকবাজি থাকবে না সেই আড্ডায়?
দ্বৈপায়নবাবুকে সমর্থন জানিয়ে বললাম,
- ঠিক! কফিশালায় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে উপচে পড়বে না তর্কের তুফান? গান-কবিতা-সিনেমা নিয়ে তুলকালাম হবে না? তাহলে কীসের ক্যাফেটোরিয়া?
উপরের ফ্লোরে পা রেখে, একটু থেমে রঞ্জা বলল,
- সেখান থেকেই কি রক-কালচারে মশগুল বাঙালির একটা মিউজিক ক্যাফে, এই ক্যাফেলার জন্ম?
- বলতে পারেন ম্যাডাম, সেই সূত্রপাত এই বিপ্লবের। রঞ্জন ঘোষাল নিজের মামা হন। একসময় টেলিভিশনে ‘আড্ডাচক্র’ বলে একটা অপেরা করেছিলেন উনি। তাছাড়া মহীনের গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। কোথাও একটা এসব করার ভাবনা হয়তো ছিল। সেই ভাবনাকে শিল্পের নানা আঙ্গিকে সাজানোর জন্য আরেক জনের কথা বলব। তিনি কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিনীত বয়নে বলে চলা ক্যাফের জন্মকথা শুনতে শুনতে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। উঠেই প্রথম ফ্লোরে চারজনের ছোট্ট বসার জায়গাটি বেশ সুন্দর। পাশে-ই দুটো ঘর সাজানো দারুণ সব শাড়ি এবং ক্যানভাসে! রঞ্জা মেতে উঠল শাড়ির সংসারে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওকে খুব নিবিড় করে দেখলাম। ফকির যেমন দেখে!
গহন কালো হালকা-পুলকা লং-স্কার্ট পড়েছে রঞ্জা। যেন মৌসুমি হাওয়ার সমুদ্রে ভেসে থাকতে চায় ওর স্কার্টের খোল। একটা দিক একটু বেশি-ই গোটানো, কোমরের কাছে। সেই জন্য কোমরের দোলনমায়ায় যেন ও মেয়ে অভিসারিকা। ওপরে ফেড, বেশ ঘরোয়া আমন্ত্রণের ঘোষণায় বুঝি ফিচেল, ওর স্লিভলেস ফতুয়া! কানে চাম্বা লাম্বার রুপোর দুলের একফালি কারুকাজে, চাঁদভাসি স্নিগ্ধতা। নিজের পাড়া বলে, রঞ্জার এই সাজ খসাবার এলোমেলো সাজ! ওর চুলেও সেই এলোমেলো হাওয়ার বিশৃঙ্খলা। ঠোঁটের ফিকে হয়ে হয়ে আসা গ্লসি রং এখন বেশ ফিকে! একটা বাংলাদেশের টাঙাইল শাড়ির আঁচল দেখছিল, খুব কাছে গিয়ে কানের পাশে মুখ নামিয়ে বললাম,
- এই শোনো, ইচ্ছে করছে… মানে, চুমু খাবি?
- ইশশশশশ!
কথা ফুরোবার আগেই ছটফটিয়ে নাগালের বাইরে সরে গেল উড়ুক মেয়ে। সলাজ চোখে এখন তিরতির ত্রাস! ওর চোখের হরিণ যে ফকিরের চেনা। বললাম,
- চলো, এবার কফি হল্টে যাই। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়ে গেছে বেশ!
দ্বৈপায়নবাবু শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। উপরতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন,
- চলুন, এবার সোজা কফি হল্টে। খুব ছোট্ট, মাত্র তিনশো স্কোয়ার ফিটের জায়গা। সাকুল্যে ত্রিশজনের বসার জায়গা। শনি-রবি লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে সিঁড়িতে।
একটু অবাক হয়ে রঞ্জা বলল,
- সেদিন কি স্পেশ্যাল কিছু থাকে আপনাদের?
- সেই অর্থে প্রতিটা দিন-ই ক্যাফেলার কাছে স্পেশ্যাল। আসলে শনি-রবিগুলোতে এখানে নানা কিছু হয়। ধরুন, আপনার কবিতার বই বা সিডি লঞ্চ করতে চান। এখানে ভিড় জমাতে পারেন। এখানে গিটার আছে, ইচ্ছেমতো গান-বাজনা করতে পারেন এসে। নানা বিষয়ের বই-ও রয়েছে। এসে কফি খেতে খেতে পড়াশুনোও করতে পারেন! রইল বাকি প্রেম!
কথা কেড়ে নিয়ে রঞ্জার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললাম,
- ভিতর-বাহির, সে তো আছে সবখানে।
কফি হল্টে পা দিতেই মনে হল, মিথ্যে বলা নয়, দুই কর্ণধারের উদ্দেশ্য। একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের এক মিউজিক-ক্যাফে করে ফেলেছেন ওঁরা! কী নেই, স্মোকিং জোন থেকে স্পেনের কেতায় দেওয়াল লিখন। মেনুতে ব্রিটিশ ফিশ অ্যান্ড চিপস ইন বিয়ার বাটার থেকে ঠান্ডি আইস টি অথবা কোল্ড কফি! সেরামিকের টেবিলের রঙ বিন্যাস থেকে সিলিং মুখর গিটারে সুর-সারিন্দা- সর্বত্র নতুন ভাবনার ছোঁওয়াচ! চারপাশের টেবিলে বসা ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের রকমসকম দেখে অন্তত সেটাই মনে হল। কফিতে চুমুক দিয়ে কথার ফাঁকে রঞ্জা দেওয়াল লিখনগুলো পড়ছিল। একসময় এক জায়গায় ওর চোখ থামল! যেখানে বেপরোয়া আঁচড়ে তুলিতে লেখা, ‘কোনও কোনও কলমে রক্তও থাকে’! রঞ্জা বলল,
- বাঙালির রক-বিপ্লব-ই বটে!
ওর কথায় হাসতে হাসতে মেনু উলটে বললাম,
- যাই বলো, এখানে কোনও উঠিয়ে দেবার তাড়া নেই। বিন্দাস বসে ঝিঙ্কু প্রেম করা যায়। ঘর ভর্তি লোকের সামনে চোখে চোখে যেটা এখন করবে ফকির!
খেয়াল হল, রঞ্জার সেই রেণু রেণু জমে ওঠা ঘাম মিলিয়ে গিয়েছে কখন, কফি হল্টের হিমেল হাওয়ায়। দুষ্টুমির খেয়ালে, ওকে সে কথা স্মরণ করিয়ে বললাম,
- এই জয়দেব মনে পড়ছে জানো?
- মোটেই না! জয়দেব কখনও শ্রীরাধিকার ঘাম নিয়ে লিখতে পারেন না!
- লিখতে পারেন না নয়, লিখেছেন! তবে সে ঘাম, রাধার হার থেকে ঝরে পড়া রতিশ্রমের ঘাম!
রঞ্জা তুমুল লজ্জা পেয়ে, দু’ হাতে রাঙা গাল ঢেকে, জিভ কেটে বলল,
- ইশশশশ! তুমি পারো ফকির!
চুপি চুপি ওর লালি কানের কাছে মুখ নিয়ে যেতে, ও করতলে কান ঢেকে না শোনার ভান করল! নাছোড় হয়ে ফকিরও জয়দেব বলল,
- শ্রমজলকণভরসুভগশরীরা।/ পরিপতিতোরশি রতিরণধীরা!
No comments