‘চাচার বই নিয়ে এসেছি’
নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেয়া শুরু
করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সাফাই
সাক্ষ্যের আগে, পরে, মাঝে কখনও কখনও প্রসিকিউশনের বিভিন্ন আপত্তিরও জবাব
দিয়েছেন তিনি।
বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ট্রাইব্যুনালে
ডকুমেন্ট হিসেবে জমা দিলে কি কবিরা গুনাহ হবে? ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের কারণে
উপমহাদেশে সামপ্রদায়িক সংঘাত হয়েছে’- প্রসিকিউশনের আনা এমন অভিযোগের তীব্র
সমালোচনা করেছেন তিনি। বলেছেন, এ বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর জন্য অবমাননাকর। তার
বিরুদ্ধে মামলাকে ‘ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন,
উত্তরাধিকার সূত্রে আমি এ মামলার আসামি হয়েছি। আজ চাচার (বঙ্গবন্ধু) বই
নিয়ে এসেছি। আমার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তার কি সম্পর্ক ছিল? আমি
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কে তা তো এখানে বলতেই হবে। ইংরেজিতে দেয়া সাক্ষ্যে
নিজের বিস্তারিত পরিচয় উপস্থাপন করেন তিনি। তিন ঘণ্টা ট্রাইব্যুনালের
এজলাসে অবস্থানকালে এই পার্লামেন্টেরিয়ান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও
হাস্যোজ্জ্বল আবার কখনও উত্তেজিত কণ্ঠে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বলেন,
আমি শুধু নিজের জীবন রক্ষার জন্যই এখানে লড়াই করছি না আমি আমার মর্যাদা
রক্ষার জন্যও এখানে লড়াই করছি। ৩৩ বছর ধরে সংসদে আছি। ছয় বার জনগণের কাছে
পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে। সাফাই সাক্ষ্যের শুরুতে তিনি বলেন, আমার নাম
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। জন্ম ১৩ই মার্চ ১৯৪৯। এরপর তিনি তার বিস্তারিত
বংশ পরিচয় উত্থাপন করেন। একপর্যায়ে বলেন, আমার কাজিনদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক
প্রধান বিচারপতি মাঈনুর রেজা চৌধুরী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর
মোদাচ্ছির হোসেন, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ফজলে
করিম চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ. রহমান প্রমুখ। গতকাল সকাল ১০টা ৪০
মিনিটের দিকে বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের
কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই সাক্ষীর
সংখ্যা ৫ থেকে বাড়ানোর জন্য করা আবেদনের ওপর শুনানি করেন তার আইনজীবী
ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম। একই সঙ্গে তার সঙ্গে ৪ জন আইনজীবীর দেখা করার
অনুমতি চেয়েও আবেদন করা হয়। পরে আদালত তার সঙ্গে দেখা করার জন্য দুই জন
আইনজীবীকে অনুমতি দেয়। তারা মঙ্গলবার এক ঘণ্টা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর
সঙ্গে মামলা নিয়ে কথা বলতে পারবেন। শুনানিকালে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে
সালাউদ্দিন কাদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি বাংলাদেশে ছিলাম না। আমি
কোথায় ছিলাম না তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- আমি কোথায় ছিলাম।
আমি কোথায় ছিলাম তা প্রমাণের জন্য বিদেশ থেকে সাক্ষী আনা প্রয়োজন। তারা যেন
ভিসা পান এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা প্রয়োজন। কারণ দেশের
সার্বিক পরিবেশ এখন ভাল নয়। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আপনার মূলত
দু’টি বক্তব্য। একটি হচ্ছে আপনি বলেছেন, আপনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে
ছিলেন না, পাকিস্তানে ছিলেন। অন্যটি হচ্ছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আপনাকে এ
মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের
দায়িত্ব প্রসিকিউশনের। পরে সালাউদ্দিন কাদেরকে আসামির কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর
কাঠগড়ায় নেয়া হয়। এ সময় তিনি তার সামনে মনিটর রাখার আবেদন জানান। যেন নিজের
দেয়া জবানবন্দি পড়তে পারেন। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম এতে আপত্তি জানান।
তবে ট্রাইব্যুনাল মনিটর রাখার অনুমতি দেয়। শুরুতে সাক্ষী হিসেবে শপথ নিলেও
প্রসিকিউশনের আপত্তিতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তিনি তা প্রত্যাহার করে
নেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা সালাউদ্দিন কাদের নিজের বিতার্কিক জীবনের
কথা উল্লেখ করে বলেন, ১৯৬৮ সালে আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম
হয়েছিলাম। ৪০ বছর ধরে বিতর্ক করে আসছি। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনি যে
একজন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান তা আমরা জানি। সালাউদ্দিন কাদের নিজের পিতা,
চাচা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানদের বিস্তারিত পরিচয় উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন,
আমার বাবার নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার সূত্রেই আমি এ মামলার আসামি হয়েছি।
তাই তার ব্যাপারে তো বিস্তারিত বলতেই হবে। এখানে একজন প্রফেসর সাক্ষ্য
দিয়ে গেছেন যিনি ৪০ বছর ধরে নিজের জন্মস্থান নিয়ে মিথ্যা বলছেন। তিনি বলেন,
ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৯১৯ সালের ২৬শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি
নোয়াখালী জিলা স্কুল, বরিশাল বিএম কলেজ এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে
শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে তিনি থাকতেন
কারমাইকেল হোস্টেলে। মেধাবী এবং এলিট পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে হোস্টেলে
থাকতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী দুইবার ওই হোস্টেলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন।
সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ফর্মাল চার্জে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন
করা হয়েছে তার প্রতিটি লাইনের জবাব আমি দেবো। তারা নবাব সিরাজউদ্দোলা থেকে
শুরু করেছেন আমি এটা নিশ্চিত করতে পারি আমি সিরাজউদ্দৌলার আগে যাবো না।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ফর্মাল চার্জে বলা হয়েছে, দ্বিজাতি
তত্ত্বের কারণে উপমহাদেশে সামপ্রদায়িক সংঘাত হয়েছে। এ বক্তব্য বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অবমাননাকর। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথা উল্লেখ করেন তিনি। এ সময় সালাউদ্দিন
কাদেরের কাছে বইটি ছিল। তিনি বলেন, এই গ্রন্থে দ্বিজাতি তত্ত্বকেই
প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ত্যাগ, বাধা-বিপত্তি ও
উত্থান-পতনের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এ ফর্মাল চার্জের মাধ্যমে
দ্বিজাতি তত্ত্ব উঠিয়ে দিয়ে এক জাতি প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে,
যা এদেশের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। আমি বিশ্বাস করি না যে এ ধরনের প্রস্তাব
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও আদর্শের স্বাক্ষর বহন করে; বরং এটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা
শেখ হাসিনার এবং তার রাজনৈতিক প্রশাসনের রাজনীতি। প্রসিকিউশন যে প্রস্তাব
দিয়েছে তা বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব। এটা খুবই প্রলুব্ধকর।
বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে অন্য কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে এক হয়ে
যাওয়ার জন্য এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ
ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভক্তি হয়েছিল সে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানাই সংবিধান
অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা। আর বাংলাদেশের বিচারপতিদের সংবিধান
রক্ষার শপথ নিতে হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্যে
করে বলেন, ফাঁসি তো দেবেন-ই। তবুও আমি আমার কথা বলতে চাই। এ সময়
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমরা আপনাকে সব সময়ই বলার সুযোগ দিয়েছি। কোন আদালত এ
ধরনের সুযোগ দেয় না। তখন সালাউদ্দিন কাদের বলেন, দুইটি ট্রাইব্যুনাল এ
পর্যন্ত যে সব রায় দিয়েছে তা আমি দেখেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
প্রশংসা করে তিনি বলেন, দেশে ফেরার তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মিত্র
বাহিনীর সদস্যদের দেশ ত্যাগ করিয়েছিলেন। এটা তার জীবনের মহত্তম এক ঘটনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও জাপান যা করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু তা
করেছিলেন। পরে আজ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়েছে।
No comments