সবাইকে বলতে দিন, লিখতে দিন by আসিফ নজরুল
২১ মে বাম মোর্চার সমাবেশটি ছিল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য। বাম মোর্চা ক্ষমতার রাজনীতি করে না, তাদের সকল কর্মসূচি প্রগতিশীলতার পক্ষে বা মেহনতি মানুষের অধিকার রক্ষার্থে। বাম মোর্চা নাশকতা করেছে কখনো এই অভিযোগও শোনা যায়নি। কিন্তু তবু তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হয়েছে, নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকার বলছে আইনশৃঙ্ঘলা রক্ষার স্বার্থে কোনো সভা-সমাবেশের অনুমতি তারা দিচ্ছে না আগামী এক মাস। কিন্তু বাম মোর্চাসহ আরও কিছু সংগঠনকে গত কয়েক দিনে এমন কর্মসূচিও পালন করতে দেওয়া হয়নি (এমনকি বিএনপিকে একটি দোয়া মাহফিল করতে দেওয়া হয়নি), যার মধ্যে সহিংসতার কোনো আশঙ্কা ছিল না।
কোন আইন বা ক্ষমতাবলে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, সরকার তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। অজুহাত হিসেবে ঢালাওভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এই ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে, এই আশঙ্কায় আমরা সড়কপথে চলাচল বন্ধ করতে পারি না। পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে, এই অজুহাতে পুলিশ বাহিনীকে আমরা নিষিদ্ধ করতে পারি না। ঠিক তেমনি আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে পারে, এই যুক্তিতে সভা-সমাবেশের ওপর ঢালাও নিষেধাজ্ঞাও আমরা মেনে নিতে পারি না। এই ঢালাও নিষেধাজ্ঞার মানে হচ্ছে, আগামী এক মাসে ভারতের সঙ্গে রামপাল চুক্তি, আমেরিকার সঙ্গে টিকফা চুক্তি, রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনা, হেফাজতের সমাবেশে পুলিশি অভিযানসহ এমন বহু বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ-সমাবেশ করা যাবে না, যা এখনই করাটা জরুরি হয়তো।
সভা-সমাবেশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা কোনো বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপও নয়। আমরা সরকারকে একই সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহে আরও বহু পদক্ষেপ নিতে দেখেছি, যা একটি কর্তৃত্ববাদী ও অসহিষ্ণু শাসকগোষ্ঠীর পরিচায়ক। সরকার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ছাড়া দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। অবৈধভাবে আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা তালাবদ্ধ রেখে কার্যত পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর সম্পাদককে প্রায় এক মাস ধরে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে, রিমান্ডে তাঁকে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের ওপর চলছে অব্যাহত দমন ও নির্যাতন। আদালতের জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা রীতিমতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি সরকার ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, সরকার যেন সবার মুখ বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠছে। কোনো সরকার গণবিরোধী হয়ে উঠলে বা এ ধরনের কোনো চিন্তা থাকলে জনগণের প্রতিবাদ করার অধিকারকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এই ভীতি থেকে তাদের মুখ নানাভাবে বন্ধ করার অপচেষ্টা চলে। বর্তমানে বিভিন্ন ঘটনায় আমরা যেন তা-ই লক্ষ করছি
কোন আইন বা ক্ষমতাবলে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, সরকার তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। অজুহাত হিসেবে ঢালাওভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এই ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে, এই আশঙ্কায় আমরা সড়কপথে চলাচল বন্ধ করতে পারি না। পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে, এই অজুহাতে পুলিশ বাহিনীকে আমরা নিষিদ্ধ করতে পারি না। ঠিক তেমনি আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে পারে, এই যুক্তিতে সভা-সমাবেশের ওপর ঢালাও নিষেধাজ্ঞাও আমরা মেনে নিতে পারি না। এই ঢালাও নিষেধাজ্ঞার মানে হচ্ছে, আগামী এক মাসে ভারতের সঙ্গে রামপাল চুক্তি, আমেরিকার সঙ্গে টিকফা চুক্তি, রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনা, হেফাজতের সমাবেশে পুলিশি অভিযানসহ এমন বহু বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ-সমাবেশ করা যাবে না, যা এখনই করাটা জরুরি হয়তো।
সভা-সমাবেশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা কোনো বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপও নয়। আমরা সরকারকে একই সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহে আরও বহু পদক্ষেপ নিতে দেখেছি, যা একটি কর্তৃত্ববাদী ও অসহিষ্ণু শাসকগোষ্ঠীর পরিচায়ক। সরকার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ছাড়া দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। অবৈধভাবে আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা তালাবদ্ধ রেখে কার্যত পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর সম্পাদককে প্রায় এক মাস ধরে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে, রিমান্ডে তাঁকে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের ওপর চলছে অব্যাহত দমন ও নির্যাতন। আদালতের জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা রীতিমতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি সরকার ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, সরকার যেন সবার মুখ বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠছে। কোনো সরকার গণবিরোধী হয়ে উঠলে বা এ ধরনের কোনো চিন্তা থাকলে জনগণের প্রতিবাদ করার অধিকারকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এই ভীতি থেকে তাদের মুখ নানাভাবে বন্ধ করার অপচেষ্টা চলে। বর্তমানে বিভিন্ন ঘটনায় আমরা যেন তা-ই লক্ষ করছি
দুই
আমাদের সংবিধান অনুসারে, সভা-সমাবেশ, বাক্স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—এসব অধিকারকে সীমিত করা যায় কেবল সুনির্দিষ্ট আইনে। এসব অধিকারকে সীমিত করতে হলে সেই সীমিতকরণ যুক্তিসংগত হতে হবে, তা আইনের বিধান অনুসারে করতে হবে, সেই আইনটি সংবিধানে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট কারণে (যেমন জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি) প্রণীত হতে হবে। সভা-সমাবেশ বন্ধ করার জন্য আমাদের সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বিধান আছে, ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ রেগুলেশনসহ নানা আইনেও এমন কিছু বিধান রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এসব আইন ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণীত বলে বাংলাদেশে কখনো এসবের প্রয়োগকে ভালো চোখে দেখা হয়নি। সরকার সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে গিয়ে এমনকি এসব আইনের আশ্রয় পর্যন্ত নেয়নি। সভা-সমাবেশ বন্ধ করা হয়েছে আরও অগণতান্ত্রিকভাবে অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর) মৌখিক নির্দেশে।
দুটো টিভি চ্যানেল এবং একটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রেও আমরা এ ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে দেখি। আমাদের তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করা হয়েছে ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে তা উসকানিমূলকভাবে সম্প্রচার করার জন্য। তিনি জানিয়েছেন, টিভি দুটির প্রতি প্রদত্ত কারণ দর্শাও নোটিশের উত্তর সন্তোষজনক হলে তারা আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে। তাঁর এই বক্তব্য অস্বচ্ছ ও স্ববিরোধিতাপূর্ণ। প্রশ্ন আসে, কোনো সম্প্রচার উসকানিমূলক কি না, তা পরীক্ষা করার কী মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয়ের রয়েছে? মন্ত্রণালয়ের কারা, কোন আইনসম্মত কর্তৃত্বে সম্প্রচার উসকানিমূলক বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? কারণ দর্শাও নোটিশের উত্তর সন্তোষজনক হলে টিভি দুটো আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে বলা হচ্ছে। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনাই যদি থাকে, তাহলে উত্তর পাওয়ার আগে বা টিভি দুটির কোনো বক্তব্য না শুনেই সম্প্রচার কেন বন্ধ করা হলো?
বর্তমান সরকার আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করেছে স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে। সার্চ ওয়ারেন্টের নামে ছাপাখানায় অনির্দিষ্টকালের জন্য তালা দেওয়া এবং অন্য ছাপাখানা থেকে আমার দেশ বের করতে হলে সরকারের পূর্ব-অনুমতি লাগবে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। মাহমুদুর রহমানকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তারও যে কতটা অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক, তার প্রামাণ্য বিবরণ আমরা মিজানুর রহমান খানের একটি লেখায় (প্রথম আলো, ৫ মে) আগে দেখেছি। এ নিয়ে আর বিশদ আলোচনার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু বলব, যাঁরা মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে সরকারের খড়্গহস্তকে সমর্থন করছেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত যে দেশব্যাপী সংঘাতের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির অনেক আগেই সরকার আমার দেশ ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নিয়েছিল শুধু সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হওয়ার কারণেই।
মাহমুদুর রহমান সর্বশেষ গ্রেপ্তার হয়েছেন স্কাইপ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায়। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়নি। ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিচার যাঁরা চাইছেন, তাঁদের উচিত হবে শুধু ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে এটি না চাওয়া। মাহমুদুর রহমানের বিচার অবশ্যই চাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আরও প্রত্যক্ষ অপরাধীদের (যাঁরা নিজেরা ব্লগে চরম ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক লেখা লিখেছেন) বিচারও একই সঙ্গে চাওয়া উচিত হবে। তা না হলে সংবাদপত্র ও স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী সরকারের প্রতি এটি তাঁদের অন্ধ সমর্থন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমন সমর্থন সরকারগুলোকে আরও কর্তৃত্ববাদী হতে উৎসাহিত করবে।
আমাদের সংবিধান অনুসারে, সভা-সমাবেশ, বাক্স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—এসব অধিকারকে সীমিত করা যায় কেবল সুনির্দিষ্ট আইনে। এসব অধিকারকে সীমিত করতে হলে সেই সীমিতকরণ যুক্তিসংগত হতে হবে, তা আইনের বিধান অনুসারে করতে হবে, সেই আইনটি সংবিধানে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট কারণে (যেমন জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি) প্রণীত হতে হবে। সভা-সমাবেশ বন্ধ করার জন্য আমাদের সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বিধান আছে, ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ রেগুলেশনসহ নানা আইনেও এমন কিছু বিধান রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এসব আইন ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণীত বলে বাংলাদেশে কখনো এসবের প্রয়োগকে ভালো চোখে দেখা হয়নি। সরকার সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে গিয়ে এমনকি এসব আইনের আশ্রয় পর্যন্ত নেয়নি। সভা-সমাবেশ বন্ধ করা হয়েছে আরও অগণতান্ত্রিকভাবে অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর) মৌখিক নির্দেশে।
দুটো টিভি চ্যানেল এবং একটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রেও আমরা এ ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে দেখি। আমাদের তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করা হয়েছে ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে তা উসকানিমূলকভাবে সম্প্রচার করার জন্য। তিনি জানিয়েছেন, টিভি দুটির প্রতি প্রদত্ত কারণ দর্শাও নোটিশের উত্তর সন্তোষজনক হলে তারা আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে। তাঁর এই বক্তব্য অস্বচ্ছ ও স্ববিরোধিতাপূর্ণ। প্রশ্ন আসে, কোনো সম্প্রচার উসকানিমূলক কি না, তা পরীক্ষা করার কী মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয়ের রয়েছে? মন্ত্রণালয়ের কারা, কোন আইনসম্মত কর্তৃত্বে সম্প্রচার উসকানিমূলক বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? কারণ দর্শাও নোটিশের উত্তর সন্তোষজনক হলে টিভি দুটো আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে বলা হচ্ছে। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনাই যদি থাকে, তাহলে উত্তর পাওয়ার আগে বা টিভি দুটির কোনো বক্তব্য না শুনেই সম্প্রচার কেন বন্ধ করা হলো?
বর্তমান সরকার আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করেছে স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে। সার্চ ওয়ারেন্টের নামে ছাপাখানায় অনির্দিষ্টকালের জন্য তালা দেওয়া এবং অন্য ছাপাখানা থেকে আমার দেশ বের করতে হলে সরকারের পূর্ব-অনুমতি লাগবে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। মাহমুদুর রহমানকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তারও যে কতটা অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক, তার প্রামাণ্য বিবরণ আমরা মিজানুর রহমান খানের একটি লেখায় (প্রথম আলো, ৫ মে) আগে দেখেছি। এ নিয়ে আর বিশদ আলোচনার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু বলব, যাঁরা মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে সরকারের খড়্গহস্তকে সমর্থন করছেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত যে দেশব্যাপী সংঘাতের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির অনেক আগেই সরকার আমার দেশ ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নিয়েছিল শুধু সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হওয়ার কারণেই।
মাহমুদুর রহমান সর্বশেষ গ্রেপ্তার হয়েছেন স্কাইপ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায়। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়নি। ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিচার যাঁরা চাইছেন, তাঁদের উচিত হবে শুধু ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে এটি না চাওয়া। মাহমুদুর রহমানের বিচার অবশ্যই চাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আরও প্রত্যক্ষ অপরাধীদের (যাঁরা নিজেরা ব্লগে চরম ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক লেখা লিখেছেন) বিচারও একই সঙ্গে চাওয়া উচিত হবে। তা না হলে সংবাদপত্র ও স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী সরকারের প্রতি এটি তাঁদের অন্ধ সমর্থন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমন সমর্থন সরকারগুলোকে আরও কর্তৃত্ববাদী হতে উৎসাহিত করবে।
তিন
মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তাকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় সবচেয়ে বড় অবদানও রেখেছে এই অধিকারের প্রয়োগ। স্যামুয়েল হান্টিংটন আধুনিক গণতন্ত্রের তিনটি স্রোত বা উন্মেষকালকে চিহ্নিত করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম উন্মেষকালে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সর্বজনীন ভোটাধিকারের, পরের দুটো পর্বে বড় ভূমিকা ছিল মানুষের স্বাধীনতাবোধের। বিশেষ করে সত্তর দশক থেকে সূচিত তৃতীয় পর্বে এশিয়া, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকায় বহু গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল মানুষের বাক্স্বাধীনতার নির্ভীক প্রয়োগ থেকে। এক/এগারোর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডামাডোলে এই স্বাধীনতাকে নানাভাবে দুর্বল করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের আরব বসন্তের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থনের পর বাক্স্বাধীনতা তথা ভিন্নমতের স্বাধীনতার গুরুত্ব সারা পৃথিবীতে নতুনভাবে স্বীকৃত হচ্ছে।
গত এক দশকের একডেমিক ডিসকোর্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় যে তিনটি অধিকারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তা হচ্ছে বাক্স্বাধীনতা এবং সংগঠন ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা। এই তিনটি স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার (রাইট টু প্রটেস্ট) প্রয়োগ অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ করার অধিকার না থাকলে নির্বাচিত শাসকের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ইউরোপ বা আমেরিকায় জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: পার্লামেন্টারি কমিটি, উচ্চ আদালত ও বিভিন্ন সাংবিধানিক ও আইনগত কমিশন) স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে বলে সেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ করার অধিকার সব সময় প্রয়োগ করতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো নামেমাত্র গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে এসব দেশে নাগরিক সংগঠন ও বিরোধী দলগুলোর জন্য প্রতিবাদ করার অধিকারের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এই অধিকার সংকোচন করার পরিকল্পিত (সিস্টেম্যাটিক) চেষ্টা তাই ভয়াবহ রকমের উদ্বেগজনক।
আমরা বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পরবর্তী সামরিক আমলগুলো এবং সর্বশেষ এক/এগারোর সরকারের সময় এ ধরনের চেষ্টার কারণে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে নানাভাবে হোঁচট খেতে দেখেছি। নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া আশির দশক থেকে নানাভাবে এর শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের দুজনের উত্থান হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তির মুখে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রয়োগে সোচ্চার থাকার মাধ্যমেই। তাঁদের শাসনামলে প্রতিবাদ করার অধিকার সংকোচনের চেষ্টা তাই কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তার পরও দুই নেত্রীর আমলে আমরা এসব চেষ্টার অব্যাহত সম্প্রসারণ লক্ষ করছি।
মত, পথ ও বিশ্বাসের পার্থক্য ভুলে আমাদের নাগরিক সমাজকে সম্মিলিতভাবে বাক্স্বাধীনতার অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ কখনো প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারবে না।
সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির অনেক মানুষ আছে। তাঁদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, মানুষকে মুক্তভাবে কথা বলতে দিন, লিখতে দিন। সরকারের কিছু অযৌক্তিক সমালোচনা হয়তো হচ্ছে, আরও হবে। কিন্তু বিপজ্জনক স্তুতিবাক্য বা নীরব ষড়যন্ত্রের চেয়ে সমালোচনা অনেক শ্রেয়।
l আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তাকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় সবচেয়ে বড় অবদানও রেখেছে এই অধিকারের প্রয়োগ। স্যামুয়েল হান্টিংটন আধুনিক গণতন্ত্রের তিনটি স্রোত বা উন্মেষকালকে চিহ্নিত করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম উন্মেষকালে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সর্বজনীন ভোটাধিকারের, পরের দুটো পর্বে বড় ভূমিকা ছিল মানুষের স্বাধীনতাবোধের। বিশেষ করে সত্তর দশক থেকে সূচিত তৃতীয় পর্বে এশিয়া, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকায় বহু গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল মানুষের বাক্স্বাধীনতার নির্ভীক প্রয়োগ থেকে। এক/এগারোর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডামাডোলে এই স্বাধীনতাকে নানাভাবে দুর্বল করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের আরব বসন্তের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থনের পর বাক্স্বাধীনতা তথা ভিন্নমতের স্বাধীনতার গুরুত্ব সারা পৃথিবীতে নতুনভাবে স্বীকৃত হচ্ছে।
গত এক দশকের একডেমিক ডিসকোর্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় যে তিনটি অধিকারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তা হচ্ছে বাক্স্বাধীনতা এবং সংগঠন ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা। এই তিনটি স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার (রাইট টু প্রটেস্ট) প্রয়োগ অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ করার অধিকার না থাকলে নির্বাচিত শাসকের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ইউরোপ বা আমেরিকায় জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: পার্লামেন্টারি কমিটি, উচ্চ আদালত ও বিভিন্ন সাংবিধানিক ও আইনগত কমিশন) স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে বলে সেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ করার অধিকার সব সময় প্রয়োগ করতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো নামেমাত্র গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করে। ফলে এসব দেশে নাগরিক সংগঠন ও বিরোধী দলগুলোর জন্য প্রতিবাদ করার অধিকারের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এই অধিকার সংকোচন করার পরিকল্পিত (সিস্টেম্যাটিক) চেষ্টা তাই ভয়াবহ রকমের উদ্বেগজনক।
আমরা বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পরবর্তী সামরিক আমলগুলো এবং সর্বশেষ এক/এগারোর সরকারের সময় এ ধরনের চেষ্টার কারণে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে নানাভাবে হোঁচট খেতে দেখেছি। নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া আশির দশক থেকে নানাভাবে এর শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের দুজনের উত্থান হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তির মুখে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রয়োগে সোচ্চার থাকার মাধ্যমেই। তাঁদের শাসনামলে প্রতিবাদ করার অধিকার সংকোচনের চেষ্টা তাই কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তার পরও দুই নেত্রীর আমলে আমরা এসব চেষ্টার অব্যাহত সম্প্রসারণ লক্ষ করছি।
মত, পথ ও বিশ্বাসের পার্থক্য ভুলে আমাদের নাগরিক সমাজকে সম্মিলিতভাবে বাক্স্বাধীনতার অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ কখনো প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারবে না।
সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির অনেক মানুষ আছে। তাঁদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, মানুষকে মুক্তভাবে কথা বলতে দিন, লিখতে দিন। সরকারের কিছু অযৌক্তিক সমালোচনা হয়তো হচ্ছে, আরও হবে। কিন্তু বিপজ্জনক স্তুতিবাক্য বা নীরব ষড়যন্ত্রের চেয়ে সমালোচনা অনেক শ্রেয়।
l আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
No comments