স্বাস্থ্যনীতির সংস্কারমূলক কিছু প্রস্তাব -স্বাস্থ্যসেবা by মো. আহাদ আলী
মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া জনগণের একটি অন্যতম সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত ব্যাপক স্বাস্থ্য অবকাঠামো তৈরি এবং জনবল নিয়োগ হলেও আজ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা জনগণের কাছে সহজলভ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অপ্রতুলতা, দুর্নীতির পাশাপাশি এর ব্যবস্থাপনার ব্যাপক ত্রুটির জন্যই মূলত জনগণ কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে অতীতের চেয়ে এখন বেশি বঞ্চিত হচ্ছে। অতীতে ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবই ছিল তা সমাধানের প্রধান অন্তরায়।
বর্তমান সরকার নতুন করে স্বাস্থ্যনীতির প্রস্তাবনা জাতির কাছে উপস্থাপন করেছে। এ বিষয়ে মতামত সংগ্রহ করছে। অতীতেও এমন স্বাস্থ্যনীতির প্রস্তাবনা কম হয়নি। কিন্তু নীতি কখনো খারাপ হয়নি। সমস্যা হয়েছে নীতি বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নিয়ে।
এ অবস্থার অবসানের লক্ষ্যে চিকিত্সাসেবায় নিয়োজিত চিকিত্সকসহ সবার আজ ভাবার অবকাশ নিশ্চয়ই আছে। আট হাজার চিকিত্সকের এ সর্ববৃহত্ ক্যাডার সার্ভিস দিয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে বহুমুখী স্বাস্থ্যসেবা (চিকিত্সাশিক্ষা, হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্যসেবা) একসঙ্গে অব্যাহত রাখা সম্ভব কি? সম্ভব নয় বলেই দেশের বিজ্ঞজন, দাতাগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন মহল থেকে অহরহ দাবি উঠছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংস্কার আবশ্যক। গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে তিনটি অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালনা করা প্রয়োজন।
১. চিকিত্সাশিক্ষা অধিদপ্তর
বাংলাদেশে শিক্ষা আর সেবা একীভূত অবস্থায় অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে না থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মেডিকেল এডুকেশন, হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একীভূত অবস্থায় পরিচালনার কারণে কোনোটারই মানের উন্নতি হয়নি এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির অভাবে দিন দিন সেবার মান নিম্নগামী। সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও কৃষিশিক্ষার মতো মেডিকেল শিক্ষাকে পৃথক অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালনা করা আজ অত্যন্ত জরুরি। পৃথক অধিদপ্তর করলে কোনো একাডেমিক অধ্যাপক গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিকর্তা হয়ে পদে পদে হোঁচট খাবেন না। যোগ্যতা, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা সচিব হতে পারবেন। মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তরের অধীনে সব গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ও আন্ডার গ্রাজুয়েট (NTC, MATS, MTI) চিকিত্সাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট টিচিং হাসপাতাল (সব মেডিকেল কলেজ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হাসপাতাল) নিয়ন্ত্রিত হবে। অন্যান্য শিক্ষা ক্যাডারের মতো একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার ও বিষয়ভিত্তিক সাব-ক্যাডার থাকবে। যেখানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পরিকল্পনা ও গবেষণা, ক্রয়, সরবরাহসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তরের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে জনগণের চাহিদা অনুসারে দক্ষ ও কার্যক্ষম মেডিকেল জনবল তৈরি করা। মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে ক্যাডার সার্ভিসের পরিবর্তে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া মেডিকেল শিক্ষার মান সুষম ও উন্নত করতে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে কারিকুলাম ও পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করা উচিত।
২. হাসপাতাল সেবা অধিদপ্তর
হাসপাতালের সেবার মান ভালো নয়, সেটা সবাই জানে এবং চিকিত্সকেরাও দ্বিমত করেন না। কিন্তু এর জন্য শুধু চিকিত্সকদেরই দায়ী করা হয়ে থাকে। বিদ্যমান কাঠামোর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল পরিচালকের পক্ষে সারা দেশের সব হাসপাতাল পরিচালনা করা একটি দুঃসাধ্য কাজ। আর তার ক্ষমতাই বা কতটুকু হাসপাতাল সেবার মান উন্নয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। থানা পর্যায়ের ৩১ বা ৫০ শয্যার সব হাসপাতাল, জেলা পর্যায়ের ৫০, ১০০, ২০০ বা ২৫০ শয্যার সব হাসপাতাল (টিচিং হাসপাতাল ছাড়া) একটি অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালনা করা উচিত। এ অধিদপ্তরের অধীনে একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার এবং বিষয়ভিত্তিক সাব-ক্যাডার (যেমনটি রেল, পিডব্লিউডি ইত্যাদিতে আছে) থাকবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পরিকল্পনা ও গবেষণা, দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, উচ্চতর ডিগ্রি, ক্রয় ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় কাজ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। টিচিং হাসপাতাল ছাড়া শয্যাবিশিষ্ট দেশের সব হাসপাতালের পদগুলোকে সাব-ক্যাডারে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। সাব-ক্যাডারের শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এবং সাব-ক্যাডারে নিয়োগকৃত চিকিত্সকদের মেধাতালিকামোতাবেক উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ থাকবে। এ অধিদপ্তরের পদোন্নতির ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি একই কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের কর্ম-অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩. জনস্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিভাগের কর্মসূচির মুখ্য উদ্দেশ্য অর্জনের একটি কর্মকৌশল হচ্ছে গ্রামপর্যায়ে অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজ ইএসপি বাস্তবায়ন করা। মূলত, ইএসপি বাস্তবায়নে প্রধান যে বাধা এসেছে তা হলো স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগকে একীভূত করতে গিয়ে যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। একটি ব্যয়-সাশ্রয়ী, জনমুখী ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা গ্রামপর্যায়ে নিশ্চিত করতে ইএসপি সার্ভিসকে কেন্দ্র করে জনস্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার অধীন একজন চিকিত্সা কর্মকর্তা (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও MO (R&CH) কাজ করবেন। উপজেলায় ৩১ বা ৫০ শয্যার হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বা নিয়ন্ত্রণ UH&FPO করবেন না। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের জনবল আরএমও বা কনসালট্যান্ট বা সহকারী পরিচালক (হা. সেবা) সে দায়িত্ব পালন করবেন। অনুরূপভাবে জেলার সিভিল সার্জন সদর হাসপাতালসহ উপজেলা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবেন। তিনি বর্তমান ইএসপি সেবার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও প্রশাসন পরিচালনা করবেন। জেলাপর্যায়ে সিভিল সার্জন বা জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা (পরিবর্তিত নাম) সব উপজেলার কাজকর্মের জন্য দায়ী থাকবেন। তাঁর অধীন তিনজন অতিরিক্ত সিভিল সার্জন বা অতিরিক্ত জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা (পদ সৃষ্টিসাপেক্ষে) দায়িত্ব পালন করবেন। এ অধিদপ্তরের অধীন একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার থাকবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পরিকল্পনা ও গবেষণা-উপকরণ সরবরাহ, ক্রয়সহ যাবতীয় কাজ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য-উপকেন্দ্রগুলোকে একটিতে একীভূত করে সেখানে একটি করে মোট চার হাজার ৫০০ নতুন চিকিত্সা কর্মকর্তা ইএসপির ক্যাডার পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিত্সা কর্মকর্তা (ডিজিজ কন্ট্রোল) এবং চিকিত্সা কর্মকর্তা (R&CH) পদ দুটি উচ্চতর পদে (১১ হাজার টাকা স্কেলে) উন্নীত করতে হবে। মেধার ভিত্তিতে এ অধিদপ্তরের নিয়োগকৃত চিকিত্সকেরা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পাবেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপরিউক্ত তিন অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা এক অধিদপ্তর থেকে অন্য অধিদপ্তরে বদলি হতে পারবেন না। পেশাভিত্তিক দেশ-বিদেশের প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গ্রহণ করবেন। তাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের অপচয় হবে না—যেমনটা এখন হচ্ছে। হাসপাতাল সেবা অধিদপ্তরের অধীনে বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালক (হা. সেবা), জেলায় উপপরিচালক (হা. সেবা), উপজেলায় সহকারী পরিচালক (হা. সেবা), আবাসিক চিকিত্সা কর্মকর্তা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন। অনুরূপভাবে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে বিভাগে পরিচালক (জনস্বাস্থ্য), জেলায় সিভিল সার্জন বা জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং উপজেলায় UH&FPO-এর পদকে ডেপুটি সিভিল সার্জন পদে পরিবর্তন করা যেতে পারে।
এ প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
* ডা. মো. আহাদ আলী: বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক।
বর্তমান সরকার নতুন করে স্বাস্থ্যনীতির প্রস্তাবনা জাতির কাছে উপস্থাপন করেছে। এ বিষয়ে মতামত সংগ্রহ করছে। অতীতেও এমন স্বাস্থ্যনীতির প্রস্তাবনা কম হয়নি। কিন্তু নীতি কখনো খারাপ হয়নি। সমস্যা হয়েছে নীতি বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নিয়ে।
এ অবস্থার অবসানের লক্ষ্যে চিকিত্সাসেবায় নিয়োজিত চিকিত্সকসহ সবার আজ ভাবার অবকাশ নিশ্চয়ই আছে। আট হাজার চিকিত্সকের এ সর্ববৃহত্ ক্যাডার সার্ভিস দিয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে বহুমুখী স্বাস্থ্যসেবা (চিকিত্সাশিক্ষা, হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্যসেবা) একসঙ্গে অব্যাহত রাখা সম্ভব কি? সম্ভব নয় বলেই দেশের বিজ্ঞজন, দাতাগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন মহল থেকে অহরহ দাবি উঠছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংস্কার আবশ্যক। গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে তিনটি অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালনা করা প্রয়োজন।
১. চিকিত্সাশিক্ষা অধিদপ্তর
বাংলাদেশে শিক্ষা আর সেবা একীভূত অবস্থায় অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে না থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মেডিকেল এডুকেশন, হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একীভূত অবস্থায় পরিচালনার কারণে কোনোটারই মানের উন্নতি হয়নি এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির অভাবে দিন দিন সেবার মান নিম্নগামী। সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও কৃষিশিক্ষার মতো মেডিকেল শিক্ষাকে পৃথক অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালনা করা আজ অত্যন্ত জরুরি। পৃথক অধিদপ্তর করলে কোনো একাডেমিক অধ্যাপক গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিকর্তা হয়ে পদে পদে হোঁচট খাবেন না। যোগ্যতা, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা সচিব হতে পারবেন। মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তরের অধীনে সব গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ও আন্ডার গ্রাজুয়েট (NTC, MATS, MTI) চিকিত্সাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট টিচিং হাসপাতাল (সব মেডিকেল কলেজ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হাসপাতাল) নিয়ন্ত্রিত হবে। অন্যান্য শিক্ষা ক্যাডারের মতো একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার ও বিষয়ভিত্তিক সাব-ক্যাডার থাকবে। যেখানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পরিকল্পনা ও গবেষণা, ক্রয়, সরবরাহসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। মেডিকেল এডুকেশন অধিদপ্তরের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে জনগণের চাহিদা অনুসারে দক্ষ ও কার্যক্ষম মেডিকেল জনবল তৈরি করা। মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে ক্যাডার সার্ভিসের পরিবর্তে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া মেডিকেল শিক্ষার মান সুষম ও উন্নত করতে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে কারিকুলাম ও পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করা উচিত।
২. হাসপাতাল সেবা অধিদপ্তর
হাসপাতালের সেবার মান ভালো নয়, সেটা সবাই জানে এবং চিকিত্সকেরাও দ্বিমত করেন না। কিন্তু এর জন্য শুধু চিকিত্সকদেরই দায়ী করা হয়ে থাকে। বিদ্যমান কাঠামোর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল পরিচালকের পক্ষে সারা দেশের সব হাসপাতাল পরিচালনা করা একটি দুঃসাধ্য কাজ। আর তার ক্ষমতাই বা কতটুকু হাসপাতাল সেবার মান উন্নয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। থানা পর্যায়ের ৩১ বা ৫০ শয্যার সব হাসপাতাল, জেলা পর্যায়ের ৫০, ১০০, ২০০ বা ২৫০ শয্যার সব হাসপাতাল (টিচিং হাসপাতাল ছাড়া) একটি অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালনা করা উচিত। এ অধিদপ্তরের অধীনে একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার এবং বিষয়ভিত্তিক সাব-ক্যাডার (যেমনটি রেল, পিডব্লিউডি ইত্যাদিতে আছে) থাকবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পরিকল্পনা ও গবেষণা, দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, উচ্চতর ডিগ্রি, ক্রয় ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় কাজ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। টিচিং হাসপাতাল ছাড়া শয্যাবিশিষ্ট দেশের সব হাসপাতালের পদগুলোকে সাব-ক্যাডারে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। সাব-ক্যাডারের শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এবং সাব-ক্যাডারে নিয়োগকৃত চিকিত্সকদের মেধাতালিকামোতাবেক উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ থাকবে। এ অধিদপ্তরের পদোন্নতির ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি একই কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের কর্ম-অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩. জনস্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিভাগের কর্মসূচির মুখ্য উদ্দেশ্য অর্জনের একটি কর্মকৌশল হচ্ছে গ্রামপর্যায়ে অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজ ইএসপি বাস্তবায়ন করা। মূলত, ইএসপি বাস্তবায়নে প্রধান যে বাধা এসেছে তা হলো স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগকে একীভূত করতে গিয়ে যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। একটি ব্যয়-সাশ্রয়ী, জনমুখী ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা গ্রামপর্যায়ে নিশ্চিত করতে ইএসপি সার্ভিসকে কেন্দ্র করে জনস্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার অধীন একজন চিকিত্সা কর্মকর্তা (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও MO (R&CH) কাজ করবেন। উপজেলায় ৩১ বা ৫০ শয্যার হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বা নিয়ন্ত্রণ UH&FPO করবেন না। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের জনবল আরএমও বা কনসালট্যান্ট বা সহকারী পরিচালক (হা. সেবা) সে দায়িত্ব পালন করবেন। অনুরূপভাবে জেলার সিভিল সার্জন সদর হাসপাতালসহ উপজেলা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবেন। তিনি বর্তমান ইএসপি সেবার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও প্রশাসন পরিচালনা করবেন। জেলাপর্যায়ে সিভিল সার্জন বা জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা (পরিবর্তিত নাম) সব উপজেলার কাজকর্মের জন্য দায়ী থাকবেন। তাঁর অধীন তিনজন অতিরিক্ত সিভিল সার্জন বা অতিরিক্ত জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা (পদ সৃষ্টিসাপেক্ষে) দায়িত্ব পালন করবেন। এ অধিদপ্তরের অধীন একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার থাকবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পরিকল্পনা ও গবেষণা-উপকরণ সরবরাহ, ক্রয়সহ যাবতীয় কাজ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য-উপকেন্দ্রগুলোকে একটিতে একীভূত করে সেখানে একটি করে মোট চার হাজার ৫০০ নতুন চিকিত্সা কর্মকর্তা ইএসপির ক্যাডার পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিত্সা কর্মকর্তা (ডিজিজ কন্ট্রোল) এবং চিকিত্সা কর্মকর্তা (R&CH) পদ দুটি উচ্চতর পদে (১১ হাজার টাকা স্কেলে) উন্নীত করতে হবে। মেধার ভিত্তিতে এ অধিদপ্তরের নিয়োগকৃত চিকিত্সকেরা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পাবেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপরিউক্ত তিন অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা এক অধিদপ্তর থেকে অন্য অধিদপ্তরে বদলি হতে পারবেন না। পেশাভিত্তিক দেশ-বিদেশের প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গ্রহণ করবেন। তাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের অপচয় হবে না—যেমনটা এখন হচ্ছে। হাসপাতাল সেবা অধিদপ্তরের অধীনে বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালক (হা. সেবা), জেলায় উপপরিচালক (হা. সেবা), উপজেলায় সহকারী পরিচালক (হা. সেবা), আবাসিক চিকিত্সা কর্মকর্তা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন। অনুরূপভাবে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে বিভাগে পরিচালক (জনস্বাস্থ্য), জেলায় সিভিল সার্জন বা জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং উপজেলায় UH&FPO-এর পদকে ডেপুটি সিভিল সার্জন পদে পরিবর্তন করা যেতে পারে।
এ প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
* ডা. মো. আহাদ আলী: বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক।
No comments