এখন বড় ব্যবসা হলো কোম্পানি করে শেয়ার বিক্রি by আবু আহমেদ
আমাদের শেয়ারবাজারটাকে আমরা বড় করতে চেয়েছি। এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই বাজারে শেয়ার বিক্রি করছে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে। গত ১০ বছরে কোম্পানির স্পন্সররা, বিশেষ করে ব্যাংক ও বীমা খাতের যে পরিমাণ অর্থ শেয়ার বেচে নিজেদের জন্য আয় করে নিয়েছে, তা রীতিমতো চোখ ধাঁধার বিষয়। ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ব্যাংকের স্পন্সর বা উদ্যোক্তা হয়ে মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় শুধু শেয়ার বিক্রি করেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এর কয়েক গুণ টাকা। আর বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে স্পন্সরদের প্রাথমিক অর্থ ছিল আরও কম, কিন্তু লাভ হয়েছে অনেক বেশি।
ব্যাংকের মূলধনকে বাড়াতে হবে—বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নিয়ম মানতে গিয়ে প্রতিষ্ঠাতা ব্যাংক মালিকেরা বোনাসের পর বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছেন এবং ওই সব শেয়ারকে চড়া মূল্যে বাজারে বিক্রয় করে দিয়ে বেশ ভালো মুনাফা ঘরে তুলে নিয়েছেন। এই বিষয়টি সত্য হয়েছে বীমা ও লিজিং কোম্পানির ক্ষেত্রেও। এই দুই ক্ষেত্রে পুঁজি বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা না থাকলেও শুধু অতিরিক্ত অর্থ আয়ের জন্য এসব কোম্পানির পরিচালকেরা বোনাস শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভুল করে হোক, শুদ্ধ করে হোক শুধু বোনাস শেয়ার পাবেন—এই আশায় বাজার থেকে উদ্যোক্তাদের শেয়ারগুলোকে বেশ উঁচু মূল্যেই কিনে নিয়েছেন। বিগত কয়েক বছর শেয়ারের উঁচু মূল্যের পেছনে কাজ করেছে শেয়ারের জোগান-স্বল্পতাও। যে শেয়ারের যে মূল্য হওয়া উচিত ছিল, শুধু জোগানের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গিয়ে ওই সব শেয়ার দ্বিগুণ, তিন গুণে বিক্রয় হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ব্যাংকের মূলধন-ভিত্তি বিস্তৃত হয়েছে, সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর নগদ মুনাফা দেওয়ার ক্ষমতাও কমেছে। এই সত্যটা বুঝতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেক সময় লেগেছে।
ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রদানের প্রকৃত ক্ষমতা কতটুকু, তা আগামী কয়েক বছরে বোঝা যাবে। বীমা কোম্পানির নতুন আইন ও তদারকি কর্তৃপক্ষ হবে বলে বাজারে অনেকে উত্ফুল্ল। কিন্তু তাদের ওই উত্ফুল্লতার পরিমাণকে বাট্টাকরণকৃত করা উচিত এই ভেবে যে নতুন আইনে নতুন তদারকি কর্তৃপক্ষ হলে ওই সব কোম্পানির জন্য সহজে ব্যবসাকরণের সুবিধাগুলোও তিরোহিত হয়ে যেতে পারে। তখন বীমা কোম্পানির শেয়ার মূল্যও ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার মূল্যের মতো কমতে পারে।
যা-ই হোক, গত এক যুগের পর্যবেক্ষণ থেকে এটা বুঝেছি যে কাউকে সরকার খাতির করতে চাইলে তাকে একটা ব্যাংক বা কমপক্ষে একটা বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দিয়ে তা করতে পারে। কারণ, এসব কোম্পানিতে মূলধন খাটানোর তুলনায় লাভ অনেক বেশি। একটি ছোট দোকানের মালিক ছিল বা পিতার বেকার ছেলে ছিল সেও সুযোগ করে দেওয়া ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির পরিচালক হয়ে এখন অনেক অর্থের মালিক। তাদের লাভ অন্যভাবেও এসেছে। ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে বসে ভাতাদি তো নিয়েছেনই, অন্যদিকে কেউ কেউ পরোক্ষভাবে হলেও ওই সব আর্থিক কোম্পানির সঙ্গে বা তাদের সহায়তা নিয়ে ব্যবসা করেছেন। সমাজে তাদের একটা পরিচিতিও হয়েছে।
প্রথম দিকে সরকার একটু শক্ত ছিল যে কেউ ব্যাংকের পরিচালক বা উদ্যোক্তা থাকলে অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা উদ্যোক্তা হতে পারবে না। অর্থবিত্তের লোকদের চাপের মুখে সেই বাধা আজ অপসারিত।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বিধি জারি করেছে যে ব্যাংকের সর্বোচ্চ পরিচালক সংখ্যা হবে ১৩ জন এবং কেউ ছয় বছরের বেশি একটানা ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না। এই বিধিকে প্রথমে ব্যাংক মালিকেরা কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কোর্টে হেরে যাওয়ার পর যেভাবে বোর্ডগুলো গঠন করা হলো তাতে দেখা গেল, যে উদ্দেশ্যে ওই বিধিটা জারি করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্যটাই অর্জিত হলো না। উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসতে পারলেন না ঠিকই, কিন্তু তদস্থলে তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বসতে শুরু করলেন। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে আরও ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবুও শত শত দরখাস্ত বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের কাছে পড়ে আছে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি চেয়ে। কেন? সেটা তো বুঝতেই পারছেন!
শেয়ারবাজার হলো টাকার বাজার। তবে সবার জন্য নয়; সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য তো নয়ই। এটা ভালো বাজার হলো কিছু অতি চালাক লোকের জন্য, যাঁরা রেগুলেশনের ফাঁককে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে ধনী হতে চেয়েছেন। অনেক সময় তাত্ত্বিক অর্থে এঁরা আইন ও বিধি পালন করেন সত্য, কিন্তু এঁদের কাজ অবশ্যই আইনি চেতনার বিরুদ্ধে যায়।
এত দিন আমরা জানতাম, মিউচ্যুয়াল ফান্ড হলো বাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য অন্যতম ভালো আর্থিক হাতিয়ার। কিন্তু এখন এগুলো হয়ে পড়েছে অস্থিতিশীলতার ভালো অস্ত্র। এত দিন আমরা জানতাম, মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠন করার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা যে পুঁজি জোগান দিয়েছেন সে পুঁজি কোথায়, কীভাবে খেটেছে, তা আগে দেখাতে হবে, এখন আর সেই শর্তের বালাই নেই। এখন অতি উদারভাবে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বাজারে আসতে দেওয়া হচ্ছে এবং যেহেতু তা গঠন করে বাজারজাত করতে পারলেই কয়েক গুণ বেশি মূল্যে ওই ফান্ডকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রয় করা যায়, সে জন্য অনেকে এখন প্রচুর টাকার মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে বাজারে আসছে। এ ক্ষেত্রে স্পন্সরদের বেলায় এবং কথিত প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রেও কোনো রকম সময়গত বাধানিষেধ বা বিক্রির ওপর লক-ইন বলতে কিছু নেই। বড় আকারের মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠন করে ওই ফান্ডের অধিকাংশ ইউনিটকে যদি প্লেসমেন্ট বা বাজারে আসার আগেই পছন্দমতো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া যায়, তাহলে একদিকে যেমন অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো, অন্যদিকে ওই অর্থের জন্য সুদও দিতে হলো না। প্লেসমেন্টে বিক্রয় করার বিষয়টি এসেছে যাতে উদ্যোক্তারা পুরো ফান্ডকে বাজারে বেচতে না পারে সেই ভাবনা থেকে। কিন্তু আমাদের বাজারে শেয়ার এবং সেই সঙ্গে মিউচ্যুয়াল ফান্ডেরও এত চাহিদা যে প্লেসমেন্ট বা আগে বিক্রির প্রয়োজনই পড়ে না।
তবুও রেগুলেটর ঘুমিয়ে আছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগকারীরা যেমন ভুল বুঝেছে, তেমনি এর উপস্থাপনও ভুলভাবে হচ্ছে। কে বলেছে মিউচ্যুয়াল ফান্ড শেয়ার সরবরাহ বাড়ায়? যেটা বাড়ে সেটা হলো অর্থ। ফলে ছোট্ট এই বাজারে রেগুলেশনের ফাঁককে নিজ পক্ষে ব্যবহার করতে গিয়ে যাঁরা বড় বড় ফান্ড ম্যানেজার সাজছেন, লাভ আপাতত তাঁদেরই হতে পারে মাত্র, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অবশেষে শুধুই ঠকবে। একপর্যায়ে মিউচ্যুয়াল ফান্ড হয়ে পড়বে কেলেঙ্কারির হাতিয়ার এবং সবশেষে পরিত্যাজ্য ফান্ড।
তাই অনুরোধ করব, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে রেগুলেশনকে কড়াকড়ি করার জন্য, বিশেষ করে আমাদের এই বাজার, যে বাজারে বিনিয়োগকারীরা এটাকেও একটা শেয়ার ভেবে নেটওয়ার্থের কয়েক গুণ বেশি মূল্যে খরিদ করছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডে এত বেশি মূলধনী প্রাপ্যতা ঘটে শুধু আমাদের মতো বাজারেই। প্রায় ২১ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে যে সবাই বুঝে-শুনে শেয়ার কিনছে, এমন নয়। অনেকেই শেয়ার কেনার খাতিরে শেয়ার কেনে। অনেকটা লটারির মতো। এতে বড় খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে তারা জিতবে না। এদেরকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অল্প কিছু চালাক লোক শত কোটি টাকা তাদের পকেটে তুলে নিচ্ছে। ব্যবসা নেই, আয় নেই অথচ কোম্পানি বোনাস শেয়ার দিচ্ছে। এটা রেগুলেটর কীভাবে অনুমোদন দিচ্ছে। শুধু শেয়ার বেচে বড়লোক হওয়ার এই সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তা সমানে বোনাস-রাইট শেয়ার দিয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন পর এরা নোটিশ ছাড়ে, এদের বোনাস শেয়ারগুলো বাজারমূল্যে বেচা হবে। এর থেকে বড় ব্যবসা বাংলাদেশ অর্থনীতিতে আর কোথায় আছে?
* আবু আহমেদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ব্যাংকের মূলধনকে বাড়াতে হবে—বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নিয়ম মানতে গিয়ে প্রতিষ্ঠাতা ব্যাংক মালিকেরা বোনাসের পর বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছেন এবং ওই সব শেয়ারকে চড়া মূল্যে বাজারে বিক্রয় করে দিয়ে বেশ ভালো মুনাফা ঘরে তুলে নিয়েছেন। এই বিষয়টি সত্য হয়েছে বীমা ও লিজিং কোম্পানির ক্ষেত্রেও। এই দুই ক্ষেত্রে পুঁজি বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা না থাকলেও শুধু অতিরিক্ত অর্থ আয়ের জন্য এসব কোম্পানির পরিচালকেরা বোনাস শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভুল করে হোক, শুদ্ধ করে হোক শুধু বোনাস শেয়ার পাবেন—এই আশায় বাজার থেকে উদ্যোক্তাদের শেয়ারগুলোকে বেশ উঁচু মূল্যেই কিনে নিয়েছেন। বিগত কয়েক বছর শেয়ারের উঁচু মূল্যের পেছনে কাজ করেছে শেয়ারের জোগান-স্বল্পতাও। যে শেয়ারের যে মূল্য হওয়া উচিত ছিল, শুধু জোগানের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গিয়ে ওই সব শেয়ার দ্বিগুণ, তিন গুণে বিক্রয় হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ব্যাংকের মূলধন-ভিত্তি বিস্তৃত হয়েছে, সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর নগদ মুনাফা দেওয়ার ক্ষমতাও কমেছে। এই সত্যটা বুঝতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেক সময় লেগেছে।
ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রদানের প্রকৃত ক্ষমতা কতটুকু, তা আগামী কয়েক বছরে বোঝা যাবে। বীমা কোম্পানির নতুন আইন ও তদারকি কর্তৃপক্ষ হবে বলে বাজারে অনেকে উত্ফুল্ল। কিন্তু তাদের ওই উত্ফুল্লতার পরিমাণকে বাট্টাকরণকৃত করা উচিত এই ভেবে যে নতুন আইনে নতুন তদারকি কর্তৃপক্ষ হলে ওই সব কোম্পানির জন্য সহজে ব্যবসাকরণের সুবিধাগুলোও তিরোহিত হয়ে যেতে পারে। তখন বীমা কোম্পানির শেয়ার মূল্যও ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার মূল্যের মতো কমতে পারে।
যা-ই হোক, গত এক যুগের পর্যবেক্ষণ থেকে এটা বুঝেছি যে কাউকে সরকার খাতির করতে চাইলে তাকে একটা ব্যাংক বা কমপক্ষে একটা বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দিয়ে তা করতে পারে। কারণ, এসব কোম্পানিতে মূলধন খাটানোর তুলনায় লাভ অনেক বেশি। একটি ছোট দোকানের মালিক ছিল বা পিতার বেকার ছেলে ছিল সেও সুযোগ করে দেওয়া ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির পরিচালক হয়ে এখন অনেক অর্থের মালিক। তাদের লাভ অন্যভাবেও এসেছে। ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে বসে ভাতাদি তো নিয়েছেনই, অন্যদিকে কেউ কেউ পরোক্ষভাবে হলেও ওই সব আর্থিক কোম্পানির সঙ্গে বা তাদের সহায়তা নিয়ে ব্যবসা করেছেন। সমাজে তাদের একটা পরিচিতিও হয়েছে।
প্রথম দিকে সরকার একটু শক্ত ছিল যে কেউ ব্যাংকের পরিচালক বা উদ্যোক্তা থাকলে অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা উদ্যোক্তা হতে পারবে না। অর্থবিত্তের লোকদের চাপের মুখে সেই বাধা আজ অপসারিত।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বিধি জারি করেছে যে ব্যাংকের সর্বোচ্চ পরিচালক সংখ্যা হবে ১৩ জন এবং কেউ ছয় বছরের বেশি একটানা ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না। এই বিধিকে প্রথমে ব্যাংক মালিকেরা কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কোর্টে হেরে যাওয়ার পর যেভাবে বোর্ডগুলো গঠন করা হলো তাতে দেখা গেল, যে উদ্দেশ্যে ওই বিধিটা জারি করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্যটাই অর্জিত হলো না। উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসতে পারলেন না ঠিকই, কিন্তু তদস্থলে তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বসতে শুরু করলেন। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে আরও ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবুও শত শত দরখাস্ত বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের কাছে পড়ে আছে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি চেয়ে। কেন? সেটা তো বুঝতেই পারছেন!
শেয়ারবাজার হলো টাকার বাজার। তবে সবার জন্য নয়; সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য তো নয়ই। এটা ভালো বাজার হলো কিছু অতি চালাক লোকের জন্য, যাঁরা রেগুলেশনের ফাঁককে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে ধনী হতে চেয়েছেন। অনেক সময় তাত্ত্বিক অর্থে এঁরা আইন ও বিধি পালন করেন সত্য, কিন্তু এঁদের কাজ অবশ্যই আইনি চেতনার বিরুদ্ধে যায়।
এত দিন আমরা জানতাম, মিউচ্যুয়াল ফান্ড হলো বাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য অন্যতম ভালো আর্থিক হাতিয়ার। কিন্তু এখন এগুলো হয়ে পড়েছে অস্থিতিশীলতার ভালো অস্ত্র। এত দিন আমরা জানতাম, মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠন করার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা যে পুঁজি জোগান দিয়েছেন সে পুঁজি কোথায়, কীভাবে খেটেছে, তা আগে দেখাতে হবে, এখন আর সেই শর্তের বালাই নেই। এখন অতি উদারভাবে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বাজারে আসতে দেওয়া হচ্ছে এবং যেহেতু তা গঠন করে বাজারজাত করতে পারলেই কয়েক গুণ বেশি মূল্যে ওই ফান্ডকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রয় করা যায়, সে জন্য অনেকে এখন প্রচুর টাকার মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে বাজারে আসছে। এ ক্ষেত্রে স্পন্সরদের বেলায় এবং কথিত প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রেও কোনো রকম সময়গত বাধানিষেধ বা বিক্রির ওপর লক-ইন বলতে কিছু নেই। বড় আকারের মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠন করে ওই ফান্ডের অধিকাংশ ইউনিটকে যদি প্লেসমেন্ট বা বাজারে আসার আগেই পছন্দমতো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া যায়, তাহলে একদিকে যেমন অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো, অন্যদিকে ওই অর্থের জন্য সুদও দিতে হলো না। প্লেসমেন্টে বিক্রয় করার বিষয়টি এসেছে যাতে উদ্যোক্তারা পুরো ফান্ডকে বাজারে বেচতে না পারে সেই ভাবনা থেকে। কিন্তু আমাদের বাজারে শেয়ার এবং সেই সঙ্গে মিউচ্যুয়াল ফান্ডেরও এত চাহিদা যে প্লেসমেন্ট বা আগে বিক্রির প্রয়োজনই পড়ে না।
তবুও রেগুলেটর ঘুমিয়ে আছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগকারীরা যেমন ভুল বুঝেছে, তেমনি এর উপস্থাপনও ভুলভাবে হচ্ছে। কে বলেছে মিউচ্যুয়াল ফান্ড শেয়ার সরবরাহ বাড়ায়? যেটা বাড়ে সেটা হলো অর্থ। ফলে ছোট্ট এই বাজারে রেগুলেশনের ফাঁককে নিজ পক্ষে ব্যবহার করতে গিয়ে যাঁরা বড় বড় ফান্ড ম্যানেজার সাজছেন, লাভ আপাতত তাঁদেরই হতে পারে মাত্র, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অবশেষে শুধুই ঠকবে। একপর্যায়ে মিউচ্যুয়াল ফান্ড হয়ে পড়বে কেলেঙ্কারির হাতিয়ার এবং সবশেষে পরিত্যাজ্য ফান্ড।
তাই অনুরোধ করব, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে রেগুলেশনকে কড়াকড়ি করার জন্য, বিশেষ করে আমাদের এই বাজার, যে বাজারে বিনিয়োগকারীরা এটাকেও একটা শেয়ার ভেবে নেটওয়ার্থের কয়েক গুণ বেশি মূল্যে খরিদ করছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডে এত বেশি মূলধনী প্রাপ্যতা ঘটে শুধু আমাদের মতো বাজারেই। প্রায় ২১ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে যে সবাই বুঝে-শুনে শেয়ার কিনছে, এমন নয়। অনেকেই শেয়ার কেনার খাতিরে শেয়ার কেনে। অনেকটা লটারির মতো। এতে বড় খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে তারা জিতবে না। এদেরকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অল্প কিছু চালাক লোক শত কোটি টাকা তাদের পকেটে তুলে নিচ্ছে। ব্যবসা নেই, আয় নেই অথচ কোম্পানি বোনাস শেয়ার দিচ্ছে। এটা রেগুলেটর কীভাবে অনুমোদন দিচ্ছে। শুধু শেয়ার বেচে বড়লোক হওয়ার এই সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তা সমানে বোনাস-রাইট শেয়ার দিয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন পর এরা নোটিশ ছাড়ে, এদের বোনাস শেয়ারগুলো বাজারমূল্যে বেচা হবে। এর থেকে বড় ব্যবসা বাংলাদেশ অর্থনীতিতে আর কোথায় আছে?
* আবু আহমেদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments