বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লেখা একদিকে অত্যন্ত সহজ, অন্যদিকে কঠিন। অনেকটা সমুদ্র ও আকাশকে নিয়ে লেখার মতো। সমুদ্রকে নিয়ে লিখতে গেলে কূলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখে তার বিরাটত্ব অনুভব করা যায়। কিন্তু সমুদ্রের গভীরে যে কত কী রয়েছে, তা আন্দাজ করা যায় না। কেবল ডুবুরিরাই তার কিছুটা বুঝতে পারে। সেখানে এক নতুন জগত্, উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক বিরাট সমাহার। একই কথা বলা যায় আকাশ সম্পর্কে।
আমরা খালি চোখে দিনে ও রাতে যে আকাশ দেখি, দেখে মুগ্ধ হই—মহাকাশচারীরা তাঁদের মহাকাশযান থেকে যা দেখেন, তা সে তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত। সেখানে কোটি কোটি গ্রহ, তারা, নক্ষত্রের খেলা, তাদের জন্ম-মৃত্যুর দৃশ্য তাঁরা দেখেন কাছে থেকে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে ওই একই কথা বলা চলে। উনি সারা জীবন জেল খেটে শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য সপরিবারে জীবন দান করে গেছেন। কী ছিল তাঁর অন্তরে, কোথা থেকে এল সেই দেশপ্রেম, তা ভাবতে গেলে আমরা সাধারণ মানুষ বিস্মিত হই। শুধু তাঁর কিছু সহযাত্রী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে এক রাজনীতি করেছেন, তাঁরাই বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।
আজ ৩৩ বছর হয়ে গেল তাঁর ও পরিবারের আর সবার মৃত্যুর। কিন্তু আজও সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হলো না। শাস্তি হলো না সেসব আত্মস্বীকৃত খুনির, যারা আট বছরের শিশুকেও নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ইদানীং খবরের কাগজে মার্কিন সরকারের পুরোনো দলিলপত্র প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যাচ্ছে যে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিনই মেনে নিতে পারেনি এ দেশের সেনাবাহিনীর একটি অংশ। দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই সেনাপতি জিয়াউর রহমান এবং তাঁর অধীনস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্নেল ফারুক রহমান, কর্নেল রশিদ—এঁরা বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকানোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ক্রয়ের সন্ধানে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। সেই কর্নেল ফারুক রহমান এখন জেলে, রশিদ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেনাপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যে শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, সেই পঞ্চম সংশোধনী সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেছে ২০০৫ সালে হাইকোর্টের একটি রায়। রাতের অন্ধকারে আদালত খুলিয়ে সেই রায় স্থগিত করেছিল সাবেক চারদলীয় জোট সরকার। বর্তমানে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার এখন পর্যন্ত সেই রায় বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ নেয়নি। দেখে-শুনে মানুষ ক্রমেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, বর্তমান সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানটি ফিরিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে, কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি আমরা বর্তমান সরকারের কাছে। যে সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, যে রাষ্ট্রের প্রধান এখন বঙ্গবন্ধুর একজন সহযোদ্ধা জিল্লুর রহমান।
এখন বোঝা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল দেশের স্বাধীনতার পর পরই। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিচিহ্ন সম্পূর্ণ মুছে ফেলারও এক যড়যন্ত্র হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নামের দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, আজও চেষ্টা চলছে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে ফেলার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর গ্রেনেড হামলা সে কথাই প্রমাণ করে। সেদিন সেই চেষ্টা সফল হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একমাত্র উপায় হবে হাইকোর্টের পঞ্চম সংশোধনী রায়টি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া যে সেনাপতি জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের শাসনকালটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক। তাঁরা সেদিন যে কাজটি করেছিলেন, তা ছিল সব ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী। ১৯৭২-এর সংবিধানটি ফিরিয়ে এনেও সে কাজটি করা সম্ভব। আরেক সেনাপতি এরশাদের প্রতিষ্ঠিত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাতিল করে দিয়ে দেশের কিছু মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে ফেলার চেষ্টা যত তাড়াতাড়ি নস্যাত্ করা সম্ভব, ততই দেশের মঙ্গল।
কিন্তু কেন এই বিদ্বেষ বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর হাতে গড়া আওয়ামী লীগের প্রতি? সেনাবাহিনীর যে সামান্যসংখ্যক কর্মকর্তা এই বিদ্বেষ পোষণ করেন, তাঁরাও তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামাতিদের সঙ্গে কীভাবে তাঁদের এই সখ্য গড়ে উঠল? অথচ এই জামাতিদের তৈরি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস একাত্তরে বাংলার মানুষকে ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাতে। তাদের হাতে দু-তিন লাখ নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন। সেই জামায়াতে ইসলামকে রাজনীতি করার অধিকার কী করে ফিরিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। তাদের সঙ্গে কী করে হাত মেলালেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করে বাংলাদেশের পতাকাওয়ালা গাড়িতে চড়ার সুযোগ করে দিলেন ওই সব বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীদের? এসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
একটা ধারণা এই যে সবকিছুর মূলেই রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এসব মুক্তিযোদ্ধা সম্ভবত ভেবেছিলেন, যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়ে একটি মুসলমান রাষ্ট্র হবে। সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্থান অবশ্যই হবে, তবে মুসলমানদের, বিশেষ করে সুন্নি মুসলমানদের, কিছুটা নিচে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের সংবিধানে যখন সে রকম কিছু হলো না, সবাই সমান হলো এবং কেউই বেশি সমান হওয়ার অবকাশ পেল না, তখনই তারা বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার মতলব আঁটতে লাগল। হয়তো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা তাদের ইচ্ছে ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের কয়েকজন যেমন শেখ মণি, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান ইত্যাদি কিছু মানুষকে সরিয়ে ফেলা তাদের পরিকল্পনায় স্থান পেয়ে গেল। পনেরোই আগস্ট কাজটি সম্পূর্ণ সমাপ্ত না করতে পেরে তারা সেই বছরেরই তেসরা নভেম্বর ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাদের অসমাপ্ত কাজটি শেষ করল।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ তাই মনে হচ্ছে, বাহাত্তরের ওই সংবিধানটি যদি ফিরিয়ে আনা যায় এবং জনগণের কাছে এ কথা প্রমাণ করা যায় যে জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক আসলে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাহলেই আবার ফিরে আসবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের জন্য একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করে। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের দাবি, ফিরিয়ে দিন আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ। আমরা আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে ওঠার সুযোগ পাই।
এ জেড এম আবদুল আলী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
আমরা খালি চোখে দিনে ও রাতে যে আকাশ দেখি, দেখে মুগ্ধ হই—মহাকাশচারীরা তাঁদের মহাকাশযান থেকে যা দেখেন, তা সে তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত। সেখানে কোটি কোটি গ্রহ, তারা, নক্ষত্রের খেলা, তাদের জন্ম-মৃত্যুর দৃশ্য তাঁরা দেখেন কাছে থেকে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে ওই একই কথা বলা চলে। উনি সারা জীবন জেল খেটে শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য সপরিবারে জীবন দান করে গেছেন। কী ছিল তাঁর অন্তরে, কোথা থেকে এল সেই দেশপ্রেম, তা ভাবতে গেলে আমরা সাধারণ মানুষ বিস্মিত হই। শুধু তাঁর কিছু সহযাত্রী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে এক রাজনীতি করেছেন, তাঁরাই বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।
আজ ৩৩ বছর হয়ে গেল তাঁর ও পরিবারের আর সবার মৃত্যুর। কিন্তু আজও সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হলো না। শাস্তি হলো না সেসব আত্মস্বীকৃত খুনির, যারা আট বছরের শিশুকেও নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ইদানীং খবরের কাগজে মার্কিন সরকারের পুরোনো দলিলপত্র প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যাচ্ছে যে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিনই মেনে নিতে পারেনি এ দেশের সেনাবাহিনীর একটি অংশ। দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই সেনাপতি জিয়াউর রহমান এবং তাঁর অধীনস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্নেল ফারুক রহমান, কর্নেল রশিদ—এঁরা বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকানোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ক্রয়ের সন্ধানে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। সেই কর্নেল ফারুক রহমান এখন জেলে, রশিদ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেনাপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যে শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, সেই পঞ্চম সংশোধনী সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেছে ২০০৫ সালে হাইকোর্টের একটি রায়। রাতের অন্ধকারে আদালত খুলিয়ে সেই রায় স্থগিত করেছিল সাবেক চারদলীয় জোট সরকার। বর্তমানে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার এখন পর্যন্ত সেই রায় বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ নেয়নি। দেখে-শুনে মানুষ ক্রমেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, বর্তমান সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানটি ফিরিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে, কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি আমরা বর্তমান সরকারের কাছে। যে সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, যে রাষ্ট্রের প্রধান এখন বঙ্গবন্ধুর একজন সহযোদ্ধা জিল্লুর রহমান।
এখন বোঝা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল দেশের স্বাধীনতার পর পরই। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিচিহ্ন সম্পূর্ণ মুছে ফেলারও এক যড়যন্ত্র হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল আওয়ামী লীগ নামের দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, আজও চেষ্টা চলছে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করে ফেলার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর গ্রেনেড হামলা সে কথাই প্রমাণ করে। সেদিন সেই চেষ্টা সফল হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একমাত্র উপায় হবে হাইকোর্টের পঞ্চম সংশোধনী রায়টি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া যে সেনাপতি জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের শাসনকালটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক। তাঁরা সেদিন যে কাজটি করেছিলেন, তা ছিল সব ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী। ১৯৭২-এর সংবিধানটি ফিরিয়ে এনেও সে কাজটি করা সম্ভব। আরেক সেনাপতি এরশাদের প্রতিষ্ঠিত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাতিল করে দিয়ে দেশের কিছু মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে ফেলার চেষ্টা যত তাড়াতাড়ি নস্যাত্ করা সম্ভব, ততই দেশের মঙ্গল।
কিন্তু কেন এই বিদ্বেষ বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর হাতে গড়া আওয়ামী লীগের প্রতি? সেনাবাহিনীর যে সামান্যসংখ্যক কর্মকর্তা এই বিদ্বেষ পোষণ করেন, তাঁরাও তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামাতিদের সঙ্গে কীভাবে তাঁদের এই সখ্য গড়ে উঠল? অথচ এই জামাতিদের তৈরি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস একাত্তরে বাংলার মানুষকে ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাতে। তাদের হাতে দু-তিন লাখ নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন। সেই জামায়াতে ইসলামকে রাজনীতি করার অধিকার কী করে ফিরিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। তাদের সঙ্গে কী করে হাত মেলালেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক মোর্চা গঠন করে বাংলাদেশের পতাকাওয়ালা গাড়িতে চড়ার সুযোগ করে দিলেন ওই সব বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীদের? এসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
একটা ধারণা এই যে সবকিছুর মূলেই রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এসব মুক্তিযোদ্ধা সম্ভবত ভেবেছিলেন, যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়ে একটি মুসলমান রাষ্ট্র হবে। সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্থান অবশ্যই হবে, তবে মুসলমানদের, বিশেষ করে সুন্নি মুসলমানদের, কিছুটা নিচে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের সংবিধানে যখন সে রকম কিছু হলো না, সবাই সমান হলো এবং কেউই বেশি সমান হওয়ার অবকাশ পেল না, তখনই তারা বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার মতলব আঁটতে লাগল। হয়তো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা তাদের ইচ্ছে ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের কয়েকজন যেমন শেখ মণি, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান ইত্যাদি কিছু মানুষকে সরিয়ে ফেলা তাদের পরিকল্পনায় স্থান পেয়ে গেল। পনেরোই আগস্ট কাজটি সম্পূর্ণ সমাপ্ত না করতে পেরে তারা সেই বছরেরই তেসরা নভেম্বর ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাদের অসমাপ্ত কাজটি শেষ করল।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ তাই মনে হচ্ছে, বাহাত্তরের ওই সংবিধানটি যদি ফিরিয়ে আনা যায় এবং জনগণের কাছে এ কথা প্রমাণ করা যায় যে জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক আসলে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাহলেই আবার ফিরে আসবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের জন্য একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করে। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের দাবি, ফিরিয়ে দিন আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ। আমরা আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে ওঠার সুযোগ পাই।
এ জেড এম আবদুল আলী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
No comments