গাজীপুরের টিএন্ডজেড অ্যাপারেলস: শতকোটি টাকা পড়েছিল ব্যাংকে তিন মাসের বেতন বকেয়া by ইকবাল আহমদ সরকার

গাজীপুরের বহুল আলোচিত রপ্তানিকারক পোশাক কারখানা টিএন্ডজেড অ্যাপারেলস গ্রিন কারখানা। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত কারখানা। তাদের শত কোটি টাকা বছরের পর বছর পড়েছিল ব্যাংকে। সেই টাকার কোন সুদ নেননি মালিকপক্ষ। কিন্তু এখন সেই কোম্পানি টানা তিন মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, বকেয়া বিলের কারণে কারখানার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ওই কারখানার শ্রমিকরা এ কারণে সাম্প্রতিককালের রেকর্ড ভেঙে টানা তিনদিন অবরোধ করে অচল করে মহাসড়ক। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে সরকারিভাবে ঋণ নিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে। এরপরও ঠিক কবে নাগাদ কারখানাটি খোলা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও মালিকপক্ষ বলছেন দু’একদিনের মধ্যেই খোলার আশা করা হচ্ছে।

কি কারণে এমন অবস্থার তৈরি হলো? এ নিয়ে টিএন্ডজেড গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. হেদায়েতুল হকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।  হেদায়েতুল হক জানান, তাদের কারখানায় আগে সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছিল। এখন রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তাদের কারখানাটি ইকো ফ্রেন্ডলি কারখানা। গ্রিন প্রজেক্ট। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত কোম্পানি। খুব ভালো চলছিলো।

কোম্পানির একশ’ পঞ্চাশ কোটি টাকা তিন বছর পড়েছিল ব্যাংকে। কোম্পানির আগের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন শামীম অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন বিধায় ব্যাংক থেকে কোনো ইন্টারেস্ট নেননি। অথচ আমাদের ক্রাইসিস পিরিয়ডের ব্যাংক কোনো কারণে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বন্ধ করে দিলো। গত জুলাই মাস থেকে সংকট চরমে উঠেছে। তখন থেকেই এত বড় প্রতিষ্ঠানটি পড়ে গেল। এ ছাড়াও ওনার কিছু আত্মীয়স্বজন কারখানা ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। কারখানার মালিক শাহাদাত হোসেনের বাবা মারা যাওয়ার পর এবং তার ছেলে অপহরণ হওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে মদিনায় শিফট করেন। সেখানেই বসবাস করছেন। তবে সেখানে থেকেই আবার দেশে এসে মাসের পর মাস থেকে তিনি কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগ সামলাচ্ছেন। তিনি বিদেশে থাকার সময়ে কারখানার ম্যানেজমেন্ট মূলত দেখাশোনা করেছেন তার কতিপয় আত্মীয়স্বজন।

কারখানা ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা অসাধু প্রকৃতির ওইসব আত্মীয়স্বজন মাসে যেখানে ১০ কোটি টাকা শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ হওয়ার কথা, সেখানে কৌশলে ১৫-২০ কোটি টাকা বেতন পরিশোধ দেখিয়ে ক্ষতির দিকে নিয়ে গেছে। ওনার ছেলেকে যখন অপহরণ করা হয়েছিল, তখন বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি তার ছেলেকে উদ্ধার করেন। এ কারণে মূলত দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে গিয়ে বসবাস করছেন। হয়তো আবার শিগগিরই ফিরে আসবেন। মার্কেটিংসহ কারখানার নানা কাজের হাল ধরবেন তিনি। কারখানার বর্তমান এমডি শাহাদাত হোসেন শামীম কারখানাটি ভালোবাসতেন বলেই কারখানার ভেতরেই উনার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন ও মায়ের কবর দিয়েছেন। কারখানা এলাকায় নিজেদের অর্থে বিশাল আয়তনের মসজিদ ও মাদ্রাসা করেছেন। স্থানীয় লোকজনও কারখানা মালিকের মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, এখানে মা-বাবার কবর দেয়ার এবং আগে ভালোভাবে কারখানা চলেছে বলে জানান।

কারখানার চেয়ারম্যান আরও জানান, ২০০৭ সালে কোম্পানিটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এ প্রজেক্টটির আনুমানিক মূল্য ১৪শ’ কোটি টাকা। এই কারখানাটির ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩.৩৯ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনা পরিস্থিতি, ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধ ও দেশীয় নানা কারণসহ ব্যাংকের একটি চক্রান্তের শিকার হয়ে কারখানাটি বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। গত জুলাই মাস থেকে সংকট চরম আকারে দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট পাওয়া যায় নি। কারখানার রিস্ক ফান্ড ছিল ২০ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে সেটাও পাওয়া যায় নি। ৬৫ কোটি টাকার বাড়ির দলিল দিয়েও লোন পাননি। এখানে কোনো চক্রান্ত হয়েছে। যেসব কারণে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যায়ে শ্রম সচিবসহ সরকারের আন্তরিকতায় বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করে কারখানাটি আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি জানান, বিল বকেয়া পড়ায় এই মুহূর্তে কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। আশা করছি, দু-একদিনের মধ্যেই হয়তো গ্যাস বিদ্যুৎ সংযোগ হবে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। আশা করা যাচ্ছে, দু-একদিনের মধ্যে কারখানা চালু করা সম্ভব হবে। টিএন্ডজেড গ্রুপের মালিক দু’জন। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাসিন্দা বর্তমানে সৌদি আরবে বসবাসরত শাহাদাত হোসেন শামীম ও ঢাকার বাসিন্দা মো. হেদায়েতুল হক। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.