জাকিরের স্ত্রী-স্বজনদের সম্পদের পাহাড়

সাবেক গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনদের রয়েছে সম্পদের পাহাড়। গত ৫ বছর আগেও ঋণের দায়ে যারা পালিয়ে বেড়াতো আজ তাদের এত সম্পদ জনমনে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। জাকিরের মন্ত্রিত্ব থাকাকালে তার ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান রবিন ছিলেন এলাকার সঘোষিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার কথায় চলতো থানা ও উপজেলার সকল অফিস আদালত। রবিনের ছোট ভাই মাসুম ছিলেন ব্রহ্মপুত্র থেকে বালু উত্তোলনের হোতা। রৌমারীর ডিসি সড়কসহ সকল স্থাপনায় তিনি ব্রহ্মপুত্রের পাড় কেটে কোটি কোটি ফুট বালু সরবরাহ করতেন। ফলে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। আরেক ছোট ভাই রাশেদ ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস। তিনি প্রাইমারি সেকশনের সকল বদলি বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করতেন। কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মন্ত্রীর স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা ছিলেন উপজেলা মহিলা লীগের সভানেত্রী। সে সুবাদে সব বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন। যার মাধ্যমে তিনি অপকর্মগুলো করতেন তার নাম আকতার আহসান বাবু। তিনি প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই। এই বাবুও কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কাবিখা, কাবিটাসহ এমন প্রকল্পগুলো দেখতেন প্রতিমন্ত্রীর আরেক চাচাতো ভাই মশিউর ওরফে ফশিউর। ৫ বছর আগে যাকে বাকিতে খরচ দিতো না দোকানদার আজ তার রয়েছে বহুতল ভবন, গাড়ি ও কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স। প্রতিমন্ত্রীর এক চাচার নাম সুজাউল ইসলাম সুজা। জাকির হোসেন প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সুজা রৌমারী প্রেস ক্লাব দখল করে সকল সাংবাদিককে তাড়িয়ে দেন। প্রেস ক্লাবের সদস্য বানিয়ে নেন প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের। শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। বিভিন্ন রাস্তার কাজ না করেই প্রভাব খাটিয়ে বিল তুলে নেন। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয় এলাকার সাধারণ মানুষকে। এছাড়াও পুত্র সাফায়াত বিন জাকির ওরফে সৌরভ, মেয়ে সঞ্চয়ীর নামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স ও ব্যবসার শেয়ার। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর থেকে তারাও লাপাত্তা রয়েছেন।

জাকির হোসেনের স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা রৌমারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের এফডব্লিউভি (ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার ভিজিটর) হিসেবে দাঁতভাঙ্গা কমিউনিটি সেন্টারে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি উপজেলা কার্যালয়ে রয়েছেন। ২০০৮ সালে জাকির এমপি হওয়ার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে তিনি কর্মস্থলে হাজির হননি। এমপি’র প্রভাব খাটিয়ে হাজিরা খাতা আপডেট রেখে প্রতিমাসের বেতন উত্তোলন করেছেন তিনি। তার নামে রয়েছে লন্ডন, ঢাকা, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রৌমারীতে একাধিক বাড়ি। রয়েছে অঢেল অর্থ-সম্পদ ও বিলাসবহুল একাধিক গাড়ি।

জাকিরের চাচাতো ভাই রবিন উপজেলার সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন। সে সময় বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি, টিআর, কাবিখা, কাবিটা, যত্ন প্রকল্প, কার্ডের নাম, রাজস্ব উন্নয়ন, ঠিকাদারিতে সিন্ডিকেট, এডিপিসহ যাবতীয় প্রকল্পের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন। প্রভাব খাটিয়ে করতেন ঠিকাদারি ব্যবসাও। এতে বাড়ি, গাড়ি  ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। বর্তমানে উপজেলা মডেল মসজিদ ও কয়েকটি ব্রিজের কাজ অসমাপ্ত রেখেই লাপাত্তা হয়েছেন।
রবিনের ছোট ভাই রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। পরে জাকির প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর রাশেদকে এপিএস হিসেবে যোগদান করান। এরপর থেকে প্রতিমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অনুদান বরাদ্দ নিয়ে কাজ না করেই কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। প্রাইমারি সেক্টরে সকল বদলিবাণিজ্য তিনি পরিচালনা করেন। ঢাকার মিরপুরে তার রয়েছে ২টি ফ্ল্যাট, কোটি টাকার ব্যবসা ও ঠিদাকারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ব্রিজের কাজ না করেই লাপাত্তা রয়েছেন তিনি।

রবিনের আরেক ভাইয়ের নাম মোয়াজ্জেম হোসেন মাসুম। প্রতিমন্ত্রীর ভাই এ দাপটে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে কোটি কোটি ফুট বালু উত্তোলন করে ৫ বছর প্রায় সকল ঠিকাদারি স্থাপনায় বিক্রি করেন তিনি। ঢাকা-রৌমারী ২ লেনের রাস্তার কাজে মূল ঠিকাদারের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ইট, পাথর, বালু ও সিমেন্ট দেয়ার ঠিকাদারি নিয়ে সেখানেও ১ নম্বর ইটের স্থলে দেয়া হতো ২/৩ নম্বর ইট। কালো ও মূল্যমান পাথরের স্থলে দেয়া হতো সাদা কালো মিশ্রিত পাথর। ১ নম্বর মোটা বালুর স্থলে দেয়া হতো ভিটি বালু। যা কাজের জন্য অযোগ্য। এমনিভাবে নয়/ছয় করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়েছেন মাসুম।  

আকতার আহসান বাবু প্রতিমন্ত্রীর আরেক চাচাতো ভাই। জাকিরের স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানার পরিচয়ে শিক্ষক নিয়োগ, সরকারি ঘরের নাম, টিনের নাম, ভিজিডি’র কার্ড, যত্ন প্রকপ্লের শিশু বাচ্চাদের নামের কার্ড, সোলার সুবিধা, বয়স্ক বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ধোঁকা দিয়ে অসহায় মানুষজনকে সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে সুবিধাভোগীরা জেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এমনকি আদালতে মামলাও করেছেন। কিন্তু পাওনা টাকা আদায় করতে পারেননি। নিজ বাড়ির পাশে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল খুলে ১৩জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রায় ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কাস্টমস অফিসে গরু নিলাম ও দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করায় এক সাংবাদিককে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় শ্বশুরের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে চাকরি দেয়ার নামেও প্রায় সোয়া কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নিজ গ্রাম মণ্ডলপাড়ায় বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে বিলাসবহুল বাড়ি  ও অঢেল অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এই বাবু।

মশিউর ওরফে ফশিউর জাকিরের আরেক জ্যাঠাতো ভাই। গত ৩ বছর আগেও তার বাড়ি বলতে একটি ভাঙা টিনের ঘর ছাড়া কিছুই ছিল না। এখন তিনি ৩তলা ভবনের মালিক। জাকির প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তার কপাল খুলে যায়। টিআর, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্পের বরাদ্দ বণ্টনের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। প্রকল্প সভাপতিকে প্রকল্প তৈরি করে দেয়া ও ২০% পার্সেনটেজ কেটে নিয়ে অর্থ দেয়াসহ অফিস থেকে নিজে বিল করে নিয়ে এ অর্থ ছাড় দিতেন মশিউর। এছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে খাজনা খারিজ, বন্দোবস্তসহ নানা বিষয়ের উপর তহশিলদার ও উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, নাজিরের সঙ্গে সখ্য রেখে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। এভাবেই বহুতল ভবন ও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। প্রতিমন্ত্রী জাকির ধরা খাওয়ার পর তিনিও পালিয়ে রয়েছেন।

জাকিরের এক চাচার নাম সুজাউল ইসলাম সুজা। ইউপি মেম্বার থেকে তিনি বনে যান সাংবাদিক। জাকির প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর যেন তারও কপাল খুলে যায়। প্রথমে তিনি রৌমারী প্রেস ক্লাব দখল করে সকল সাংবাদিককে তাড়িয়ে দেন। পরে প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের সেখানকার সদস্য বানিয়ে শুরু করেন দুর্নীতি। অফিস-আদালতে চাঁদাবাজি, দুর্নীতিবাজ ও চোরাকারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়, মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে বাণিজ্য, বিচার সালিশের নামে অর্থ আদায়সহ হেন কোনো অনিয়ম নেই তিনি করেননি। পরে শেয়ারে শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। সেখানেও শেয়ার পার্টনারকে ঠকিয়ে মেরে দেন লাখ লাখ টাকা। কয়েকটি রাস্তার কাজ না করেই তুলে নেন বিল। তিনিও এখন কোটিপতি। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর প্রতিমন্ত্রীর গোটা পরিবার ও তার অনুসারীরাও গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের ব্যবহৃত মুঠো ফোন নম্বর বন্ধ। একাধিকবার তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.