শুধু সুন্নিদের নিয়ে জোট গঠন কেন? by রবার্ট ফিস্ক
সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক জোট গঠিত |
সৌদিরা
জোট করতে ভালোবাসে। ১৯৯১ সালে কুয়েত থেকে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীকে হটাতে
তাঁরা মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি ও বিভিন্ন তেল আমদানিকারকদের পাশে পেয়েছিল। এ
বছরই মাস কয়েক আগে সৌদি সামরিক বাহিনী তাদের রাজতন্ত্রের শত্রু শিয়া
হুতিদের ইয়েমেনে গিয়ে আক্রমণ করেছে, সেটা করতেও তারা জোট করেছিল। সামরিক
বাহিনীর জায়গায় বিশ্বের তরুণতম প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও উচ্চাভিলাষী সৌদি
উপপ্রধানমন্ত্রী মোহামেদ বিন সালমান আল সৌদ পড়ুন। এই জোটে শুধু সৌদি
যুদ্ধবিমানই ছিল না, কাতার, আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন, মিসর, জর্ডান, মরক্কো ও
সুদানও ছিল।
কিন্তু এখন নতুন হলিউডি নাটক মঞ্চস্থ করতে সৌদিরা বহুজাতিক সামরিক অভিযান শুরু করেছে, প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইসলামি ‘সন্ত্রাসের অসুখ’। এই জোটে মুসলিম ও মুসলিম তকমা-প্রত্যাশী বেশ অনেকগুলো রাষ্ট্র রয়েছে, মহানবী (সা.)–এর সময়ের পর এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্র আর কখনোই একত্র হতে পারেনি। ইয়েমেন অভিযানের মতো এবারও ৩১ বছর বয়সী যুবরাজ মোহামেদ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওদিকে সৌদি বিমান হামলায় ইয়েমেনে ইতিমধ্যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে অনেক বেসামরিক মানুষ মারা গেছে, বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে আমরা সে খবর পেয়েছি।
একদম গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে মোহামেদ ঘোষণা করেছেন, তাঁদের এই সর্বশেষ জোটের যুদ্ধ করতে হলে ‘খুবই শক্তিশালী পদক্ষেপ’ নিতে হবে। এই জোটের মধ্যে কারা আছে জানেন? রূপকথার মতো দেশ ‘ফিলিস্তিন’ থেকে শুরু করে আফগানিস্তানের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত, লেবাননের মতো নখর দন্তহীন, চাদের মতো দেউলিয়া ও রিপাবলিক অব করোমোসের মতো দেশকে সৌদি আরব নিয়েছে শুধু এটা নিশ্চিত করার জন্য যে এই জোটে যথেষ্টসংখ্যক দেশ আছে। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই এটা খেয়াল করেছে যে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া এই ৩৪টি দেশের শক্তিশালী জোটে নেই।
এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার, কারণ ২০০২ সালে বালি হামলায় ২০২ জন বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়ার পর ইন্দোনেশিয়ার ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ মধ্যে শত্রুর তালিকায় আল-কায়েদাও ঢুকে যায়। ইন্দোনেশিয়ায় ২০ কোটি সুন্নি মুসলমানের বসবাস, ফলে তারা নিজেদের সুন্নি মুসলমান ভাইদের সঙ্গে এই অভূতপূর্ব ‘জোটে’ যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। অথবা এমনটা হতে পারে যে সৌদি আরবে ৩০ জন ইন্দোনেশীয় পরিচারিকাকে অন্যায্য বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে সৌদি আরবের জোটে যোগ দেওয়ার আগে তারা চায়, এই অবিচারের অবসান হোক।
তবে এই জোটে পাকিস্তানের যোগ দেওয়াটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কারণ এর আগে তাদের যখন ইয়েমেনের বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের পক্ষে লড়াই করার জন্য বলা হয়েছিল, তখন ইসলামাবাদের সংসদ সৌদি আরবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ, তখন সৌদি আরব পীড়াপীড়ি করেছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুন্নি মুসলমানরাই শুধু যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে।
সার্বিকভাবে বেশ শক্তিশালী ‘জোট’ হয়েছে। এই দেশগুলোর অধিকাংশের ঘাড়েই বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা রয়েছে, তারা সব সময়ই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে আছে। ফলে এই অসাধারণ সামরিক জোট গঠনের পেছনের প্রকৃত বিবেচনা কিন্তু কত দেশ এই জোটে অংশ নিচ্ছে সেখানে নিহিত নয়, বরং সৌদি আরবকে এই ভ্রাতৃত্বসুলভ সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য দেশগুলো তাদের কাছ থেকে কত মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার পাবে, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
এখন একটি প্রশ্ন অবধারিতভাবেই এসে যায়: এই তরুণ যুবরাজ ‘সন্ত্রাস রোগের’ কোন তরিকা ধ্বংস করতে চান? আইএস তরিকা? যদিও এই সংগঠনটি ওয়াহাবি সুন্নি বিশুদ্ধতাবাদী মতবাদের ভিত্তিতে একরকম আধ্যাত্মিকভাবেই গড়ে উঠেছে। নাকি নুসরা তরিকা, যেটা সেই কাতার থেকেই সৃষ্ট, যে কাতার এখন এই রহস্যময় ‘জোটের’ অন্তর্ভুক্ত? অথবা ইয়েমেনের শিয়া হুতি তরিকা, যাদের ইয়েমেনের সুন্নি প্রেসিডেন্ট ইরানপন্থী সন্ত্রাসী মনে করেন, যেই সুন্নি প্রেসিডেন্টকে আবার সৌদি আরব সমর্থন করে। আর সৌদি যুবরাজ ইরানের সঙ্গে আবার কোন ধরনের সম্পর্কের কথা চিন্তা করছেন, যেখানে ইরানিরা ইরাক ও সিরিয়ায় সেই একই আইএস ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে লড়ছে, যাকে আমাদের প্রিয় সৌদি যুবরাজ ‘অসুখের’ অংশ বলে মনে করেন? শিয়া ইরান বা ইরাক—কেউই এই নতুন আন্তর্জাতিক মুসলিম সেনাবাহিনীর অংশ নয়, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাহলে আমরা জানি যে একটি ‘জোট’ হয়েছে। কিন্তু সে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আর সেখান থেকে কী ফল-ই বা পাওয়া যাবে? আর এটা কেন সুন্নি মুসলমানদের জোট, স্রেফ মুসলিম ‘জোট’ নয় কেন?
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
কিন্তু এখন নতুন হলিউডি নাটক মঞ্চস্থ করতে সৌদিরা বহুজাতিক সামরিক অভিযান শুরু করেছে, প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইসলামি ‘সন্ত্রাসের অসুখ’। এই জোটে মুসলিম ও মুসলিম তকমা-প্রত্যাশী বেশ অনেকগুলো রাষ্ট্র রয়েছে, মহানবী (সা.)–এর সময়ের পর এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্র আর কখনোই একত্র হতে পারেনি। ইয়েমেন অভিযানের মতো এবারও ৩১ বছর বয়সী যুবরাজ মোহামেদ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওদিকে সৌদি বিমান হামলায় ইয়েমেনে ইতিমধ্যে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে অনেক বেসামরিক মানুষ মারা গেছে, বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে আমরা সে খবর পেয়েছি।
একদম গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে মোহামেদ ঘোষণা করেছেন, তাঁদের এই সর্বশেষ জোটের যুদ্ধ করতে হলে ‘খুবই শক্তিশালী পদক্ষেপ’ নিতে হবে। এই জোটের মধ্যে কারা আছে জানেন? রূপকথার মতো দেশ ‘ফিলিস্তিন’ থেকে শুরু করে আফগানিস্তানের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত, লেবাননের মতো নখর দন্তহীন, চাদের মতো দেউলিয়া ও রিপাবলিক অব করোমোসের মতো দেশকে সৌদি আরব নিয়েছে শুধু এটা নিশ্চিত করার জন্য যে এই জোটে যথেষ্টসংখ্যক দেশ আছে। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই এটা খেয়াল করেছে যে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া এই ৩৪টি দেশের শক্তিশালী জোটে নেই।
এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার, কারণ ২০০২ সালে বালি হামলায় ২০২ জন বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়ার পর ইন্দোনেশিয়ার ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ মধ্যে শত্রুর তালিকায় আল-কায়েদাও ঢুকে যায়। ইন্দোনেশিয়ায় ২০ কোটি সুন্নি মুসলমানের বসবাস, ফলে তারা নিজেদের সুন্নি মুসলমান ভাইদের সঙ্গে এই অভূতপূর্ব ‘জোটে’ যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। অথবা এমনটা হতে পারে যে সৌদি আরবে ৩০ জন ইন্দোনেশীয় পরিচারিকাকে অন্যায্য বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে সৌদি আরবের জোটে যোগ দেওয়ার আগে তারা চায়, এই অবিচারের অবসান হোক।
তবে এই জোটে পাকিস্তানের যোগ দেওয়াটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কারণ এর আগে তাদের যখন ইয়েমেনের বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের পক্ষে লড়াই করার জন্য বলা হয়েছিল, তখন ইসলামাবাদের সংসদ সৌদি আরবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ, তখন সৌদি আরব পীড়াপীড়ি করেছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুন্নি মুসলমানরাই শুধু যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে।
সার্বিকভাবে বেশ শক্তিশালী ‘জোট’ হয়েছে। এই দেশগুলোর অধিকাংশের ঘাড়েই বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা রয়েছে, তারা সব সময়ই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে আছে। ফলে এই অসাধারণ সামরিক জোট গঠনের পেছনের প্রকৃত বিবেচনা কিন্তু কত দেশ এই জোটে অংশ নিচ্ছে সেখানে নিহিত নয়, বরং সৌদি আরবকে এই ভ্রাতৃত্বসুলভ সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য দেশগুলো তাদের কাছ থেকে কত মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার পাবে, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
এখন একটি প্রশ্ন অবধারিতভাবেই এসে যায়: এই তরুণ যুবরাজ ‘সন্ত্রাস রোগের’ কোন তরিকা ধ্বংস করতে চান? আইএস তরিকা? যদিও এই সংগঠনটি ওয়াহাবি সুন্নি বিশুদ্ধতাবাদী মতবাদের ভিত্তিতে একরকম আধ্যাত্মিকভাবেই গড়ে উঠেছে। নাকি নুসরা তরিকা, যেটা সেই কাতার থেকেই সৃষ্ট, যে কাতার এখন এই রহস্যময় ‘জোটের’ অন্তর্ভুক্ত? অথবা ইয়েমেনের শিয়া হুতি তরিকা, যাদের ইয়েমেনের সুন্নি প্রেসিডেন্ট ইরানপন্থী সন্ত্রাসী মনে করেন, যেই সুন্নি প্রেসিডেন্টকে আবার সৌদি আরব সমর্থন করে। আর সৌদি যুবরাজ ইরানের সঙ্গে আবার কোন ধরনের সম্পর্কের কথা চিন্তা করছেন, যেখানে ইরানিরা ইরাক ও সিরিয়ায় সেই একই আইএস ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে লড়ছে, যাকে আমাদের প্রিয় সৌদি যুবরাজ ‘অসুখের’ অংশ বলে মনে করেন? শিয়া ইরান বা ইরাক—কেউই এই নতুন আন্তর্জাতিক মুসলিম সেনাবাহিনীর অংশ নয়, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাহলে আমরা জানি যে একটি ‘জোট’ হয়েছে। কিন্তু সে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আর সেখান থেকে কী ফল-ই বা পাওয়া যাবে? আর এটা কেন সুন্নি মুসলমানদের জোট, স্রেফ মুসলিম ‘জোট’ নয় কেন?
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments