পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী, আপনার জন্য by আনিসুল হক
আমি অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। এবং আমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয় খুবই প্রখর। আমি পেছনে না তাকিয়ে শুধু বাতাসে শ্বাস নিয়ে বলতে পারি, এক শ হাত পেছনে একটি অত্যন্ত রূপবতী তরুণী অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের নতুন প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি বুঝে ফেললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারীটি পুরোনো প্ল্যাটফর্মে এইমাত্র পা রাখল। আমি ঘ্রাণ নিলাম। বাতাস আমাকে জানিয়ে দিল। হ্যাঁ, এসেছে একজন। আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। মেয়েটি পরেছে ঘিয়ে রঙের একটা ফতুয়া, গ্যাবাডিনের একটা ট্রাউজার। তার চুল খোলা। মেয়েটির নাকে একটা নাকফুল। মেয়েটি ঈষৎ শ্যাম বর্ণ। আমার চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিল। মেয়েটিকে দেখতে হবে। কোনো মেয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয় না। কিন্তু তার মুখখানা আরেকটু কাছে থেকে না দেখলে আমি মারাই যাব। আমি নতুন প্ল্যাটফর্ম থেকে পুরোনো প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা হলাম।
আমার পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক। আমি অফিসের কাজে চট্টগ্রামে এসেছিলাম। কাজ সেরে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। মাত্র আটাশ বছর বয়সের কোমরেই ব্যথা এসে বাসা বেঁধেছে, ভারী জিনিস টানা আমার বারণ। কিন্তু ব্যাকপ্যাক পিঠে নিতে মানা নেই। আমার সামনের দিকে ঝোঁকা বারণ, পেছনের দিকে নয়। ঘিয়ে জামার কাছাকাছি গেলাম। একটু আগে বলছিলাম, কোনো মেয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকাতে হয় না। কিন্তু আমি তার কাছে গিয়ে হাঁ হয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে মাছি ঢুকে যেতে পারে। আমার জীবনে এত রূপবতী নারী আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। সে দেখতে নন্দিতা দাসের মতো—সংক্ষেপে শুধু এতটুকুন বলতে পারি। ভারতীয় অল্টারনেটিভ মুভির এই নায়িকার মতোই রংটা চাপা, সুন্দর নাক, খানিকটা খাড়া, খানিকটা গোল, তাতে নাকফুলটা—ইশ্, একটা নাকফুল নারীকে এই রকম অপরূপা করে তুলতে পারে! তার চোখ টানা–টানা, ভাসা-ভাসা। এবং ফাজিল মেয়েটা ট্রাউজার আর ফতুয়া পরেছে, কিন্তু চোখে পরেছে কাজল। দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই, আমি তো পুরুষ।
আমার তার দিকে আরও খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে বটে, কিন্তু তাতে আমার ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমার মন পড়ে রইল পুরোনো প্ল্যাটফর্মে, আর আমার অনিচ্ছুক শরীরটাকে পা দুটো কোনো রকমে টেনেটুনে আনল নতুন প্ল্যাটফর্মে।
টিকিট কাটাই ছিল। ফার্স্ট ক্লাস, এসি চেয়ার।
নম্বর মিলিয়ে আমি সিটে বসলাম।
সিটটাও পেয়েছি, বলার মতো। সামনে একটা টেবিল। চা খাওয়ার জন্য বোধ হয়। উল্টোদিকের সারিটা আমাদের সারির মুখোমুখি।
মেয়েটি কি একই ট্রেনে উঠবে?
একই ট্রেনে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাব?
উঠবে পুরোনো প্ল্যাটফরম থেকে?
তাহলে কি সে যাচ্ছে এসি বাথে। শুয়ে যাবে? তার সঙ্গে কি আর কেউ আছে?
আমরা দুজন একটি ট্রেনে যাই
এই আমাদের একটি মাত্র সুখ,
তাহার বগি টানছে যে ইঞ্জিন,
আমার বগিও টানছে সে উজবুক।
ভাবছি। কবিতার ছন্দ মেলাচ্ছি।
একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দেবে। একজন-দুজন করে যাত্রী আসছেন। কারও-বা বড় বোঝা, কুলি টেনে আনল। কারও-বা বোঝা কম। নানা বয়সের যাত্রীরা আসছেন, বসছেন। কে সেসবের দিকে তাকায়। আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো প্ল্যাটফর্মে। এখন বোধ হয় কোনো একটা কামরায় উঠে পড়েছে।
তবে নিয়তির পরিহাস সব সময় নির্মম হয় না। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় হঠাৎ সাড়া দিয়ে উঠল, তিনি এই কামরাতেই উঠছেন, ওই যে, ওই দরজা দিয়ে। এবং তিনি এই দিকেই আসছেন। ও খোদা। তিনি আমার সামনের আসনে এসে বসলেন!
আমরা দুজন এখন মুখোমুখি আসনে। মধ্যখানে একটা ইস্পাতের নিষ্ঠুর টেবিল।
এখন কী করা যায়?
আমার আইফোন সিক্সটা বের করলাম। সামনের টেবিলে রাখলাম।
তিনি একটা অর্ধচন্দ্র মার্কা কুশন বের করলেন। কাঁধের পেছনে দিলেন। এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।
যাহ্। আমার আইফোন-দুরভিসন্ধি মাঠে মারা গেল। ট্রেন চলছে। এত কাছে তিনি যে আমি তার দিকে পূর্ণ চোখে তাকাতেও পারছি না। কিন্তু তাকে দেখে আমার দেখার সাধ মিটছে না। আমি উঠলাম। বাথরুমের দিকে গেলাম। আবার এলাম। দূর থেকে তাকে প্রাণভরে দেখছি। নারী আর ঘুমন্ত নারী এক নয়। বিকেলের হলদেটে আলো জানালার কাচ গলে এসে পড়েছে তার মুখে। আমি জানি আলোরও অভিসন্ধি থাকে। এই রোদটুকুন কেন এসেছে, আমি জানি। ট্রেন চলছে। ট্রেনের চলার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আছে। ট্রেনের টেলিভিশনে চলতে থাকা মিউজিক ভিডিও দেখার জন্য আমি ঐকান্তিকভাবে প্রয়াস পেলাম। বেশ হাস্যকর হয়েছে মিউজিক ভিডিওটা। রাত হয়ে এসেছে। ট্রেনের ভেতরে বাতি জ্বলছে। যাত্রীরা সবাই ক্লান্ত। দূরে দুই ভদ্রলোক বেশ চিৎকার করে গল্পও করছেন। মাঝেমধ্যে ট্রেনের খাবারের কামরা থেকে নানা ধরনের খাবার এনে সামনে ধরে দ্রুত কেটে পড়ছে লোকগুলো। কাটলেট। চা। এরপর চিপস। দেবীর ঘুম ভাঙল। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তার সঙ্গে একটা ট্রলি। সেটা খুললেন। একটা ফার্স্ট এইড বক্স বের করলেন। তারপর নিজের পা বের করলেন কালো রঙের জুতা থেকে। তার দুটো পা থেকে পারিজাত ফুলের শোভা যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ কি এই দুটো পা দেখে লিখেছিলেন, ‘দুটো অতুল পদতল রাতুল শতদল, জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল।’ তিনি তার পায়ের পেছনের দিকে, গোড়ালির একটু ওপরে একটা ব্যান্ড এইড বাঁধলেন। মানে আঠাওয়ালা ব্যান্ডেজ। বোধ হয় জুতা লেগে তার পায়ের পেছনটা খানিক জখম হয়েছে। তারপর ফার্স্ট এইড বক্স ট্রলির ভেতরে রেখে ট্রলি সুটকেসটা বন্ধ করে রেখে দিলেন সিটের নিচে।
রাত দশটায় পৌঁছে যাব ঢাকায়, বিমানবন্দর স্টেশনে। আমাকে নেমে যেতে হবে।
বিমানবন্দর স্টেশনে কি সে-ও নামবে?
না। যারা যারা বিমানবন্দর স্টেশনে নামবে, টঙ্গী থেকেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার দেবীর মধ্যে সে রকমের কোনো চাঞ্চল্য নেই। তাহলে আমিও নামব না। আমি তার সঙ্গে কমলাপুর চলে যাব। যেতেই হবে।
বিমানবন্দরে পুরো কামরা ফাঁকা হয়ে গেল প্রায়। পৃথিবীর সব লোক এখন উত্তরা থাকে নাকি?
শুধু ওই দূরে দুজন মুরব্বি গোছের মানুষ বসে আছেন।
আমরা দুজন এইখানে মুখোমুখি আসনে।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে।
কমলাপুর পৌঁছাতে লাগবে আরও এক ঘণ্টা।
একটা ঘণ্টা তো আমি তার সামনে বেশি থাকতে পারব।
এইবার বোধ হয় আমার কথা বলা উচিত।
আমি বললাম, ‘আপনি কোথায় নামবেন?’
তিনি জবাব দিলেন না।
মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল।
জবাব দিল না কেন মেয়েটা। খুবই নিরীহ প্রশ্ন। জবাব দিলে কী হতো?
আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি এভাবে অপমানিত হলাম! এর কি কোনো শোধ নেই?
ফ্যানটা তার দিকে ঘোরানো। তিনি উঠে ফ্যানটা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন।
পারলেন না।
আমি ভাবলাম, এবার আমার চেষ্টা করা উচিত। না হয় সে খারাপ ব্যবহার করেইছে। তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হইব না কেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যানটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম।
ভুলক্রমেই, আপনাদের এ কথা আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে পারব, ইচ্ছা করে কাজটা আমি করিনি, আমার তর্জনী ঢুকে গেল ফ্যানের খাঁচার ভেতরে, আর ঘুরন্ত পাখা লেগে বেশ খানিকটা গেল কেটে। আমি দ্রুতই হাতটা সরিয়ে নিলাম, একটা অব্যয়ধ্বনি বেরিয়ে এল, আহা...
টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। এবার দেবীর দয়া হলো। তিনি আমার আঙুল চেপে ধরলেন তার চাপাকলির মতো আঙুল দিয়ে। তারপর নিজের সুটকেসটা খুললেন। ফার্স্ট এইড বক্সটা বের করলেন। তাতে ডেটল ছিল। একটা তুলায় ডেটল মেখে, আহা, তিনি আমার আঙুলের রক্ত মুছে দিলেন। তারপর আরেকটু তুলা চেপে ধরে আমার আঙুলের ডগায় একটা ব্যান্ড এইড বেঁধে দিলেন।
আমার জীবন চিরদিনের জন্য ধন্য হয়ে গেল।
তারপর এসে গেল কমলাপুর।
আমি বললাম, ‘আসি।’
তিনি হাসলেন। কোনো কথাই বললেন না।
আমি বললাম, ‘আপনার সুটকেসটা আমি নামিয়ে দেব?’
তিনি হাসলেন। কথা বললেন না।
কমলাপুর এসে গেল।
আমি নেমে পড়লাম।
তিনিও নামলেন।
তাকে নিতে এসেছে এক যুবক।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম, দুজনে কথা বলছে, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে, সাংকেতিক ভাষায়, হাত নেড়ে নেড়ে।
একে অন্যকে একবার আলতো করে হাগ করল।
তারপর যুবকটি মেয়েটির ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে মিশে গেল কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিড়ে।
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করছি নিজের কাছ থেকেই।
তারপর তাকে হারিয়ে ফেললাম।
এই গল্পটা লিখছি কম্পিউটারে। ডান হাতে এখনো তার দেওয়া ব্যান্ডেজটা আছে।
তর্জনী ব্যবহার করতে পারছি না।
দেবী, যদি তুমি এই লেখাটা পড়ো, তোমার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ো। স্যরি, মোবাইল নম্বর নিয়ে আমি কী করব? তুমি কি বাংলা পড়তে পারো? আমি আশা করি, তুমি পারো এবং এই লেখাটা তুমি পড়ছ। তাহলে আমাকে ই-মেইল কোরো। এই লেখার সঙ্গে আমি আমার ই-মেইল এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। ওটা দিয়ে সার্চ দিলে তুমি আমাকে ফেসবুকেও পেতে পারো।
আমার তার দিকে আরও খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে বটে, কিন্তু তাতে আমার ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমার মন পড়ে রইল পুরোনো প্ল্যাটফর্মে, আর আমার অনিচ্ছুক শরীরটাকে পা দুটো কোনো রকমে টেনেটুনে আনল নতুন প্ল্যাটফর্মে।
টিকিট কাটাই ছিল। ফার্স্ট ক্লাস, এসি চেয়ার।
নম্বর মিলিয়ে আমি সিটে বসলাম।
সিটটাও পেয়েছি, বলার মতো। সামনে একটা টেবিল। চা খাওয়ার জন্য বোধ হয়। উল্টোদিকের সারিটা আমাদের সারির মুখোমুখি।
মেয়েটি কি একই ট্রেনে উঠবে?
একই ট্রেনে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাব?
উঠবে পুরোনো প্ল্যাটফরম থেকে?
তাহলে কি সে যাচ্ছে এসি বাথে। শুয়ে যাবে? তার সঙ্গে কি আর কেউ আছে?
আমরা দুজন একটি ট্রেনে যাই
এই আমাদের একটি মাত্র সুখ,
তাহার বগি টানছে যে ইঞ্জিন,
আমার বগিও টানছে সে উজবুক।
ভাবছি। কবিতার ছন্দ মেলাচ্ছি।
একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দেবে। একজন-দুজন করে যাত্রী আসছেন। কারও-বা বড় বোঝা, কুলি টেনে আনল। কারও-বা বোঝা কম। নানা বয়সের যাত্রীরা আসছেন, বসছেন। কে সেসবের দিকে তাকায়। আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো প্ল্যাটফর্মে। এখন বোধ হয় কোনো একটা কামরায় উঠে পড়েছে।
তবে নিয়তির পরিহাস সব সময় নির্মম হয় না। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় হঠাৎ সাড়া দিয়ে উঠল, তিনি এই কামরাতেই উঠছেন, ওই যে, ওই দরজা দিয়ে। এবং তিনি এই দিকেই আসছেন। ও খোদা। তিনি আমার সামনের আসনে এসে বসলেন!
আমরা দুজন এখন মুখোমুখি আসনে। মধ্যখানে একটা ইস্পাতের নিষ্ঠুর টেবিল।
এখন কী করা যায়?
আমার আইফোন সিক্সটা বের করলাম। সামনের টেবিলে রাখলাম।
তিনি একটা অর্ধচন্দ্র মার্কা কুশন বের করলেন। কাঁধের পেছনে দিলেন। এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।
যাহ্। আমার আইফোন-দুরভিসন্ধি মাঠে মারা গেল। ট্রেন চলছে। এত কাছে তিনি যে আমি তার দিকে পূর্ণ চোখে তাকাতেও পারছি না। কিন্তু তাকে দেখে আমার দেখার সাধ মিটছে না। আমি উঠলাম। বাথরুমের দিকে গেলাম। আবার এলাম। দূর থেকে তাকে প্রাণভরে দেখছি। নারী আর ঘুমন্ত নারী এক নয়। বিকেলের হলদেটে আলো জানালার কাচ গলে এসে পড়েছে তার মুখে। আমি জানি আলোরও অভিসন্ধি থাকে। এই রোদটুকুন কেন এসেছে, আমি জানি। ট্রেন চলছে। ট্রেনের চলার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আছে। ট্রেনের টেলিভিশনে চলতে থাকা মিউজিক ভিডিও দেখার জন্য আমি ঐকান্তিকভাবে প্রয়াস পেলাম। বেশ হাস্যকর হয়েছে মিউজিক ভিডিওটা। রাত হয়ে এসেছে। ট্রেনের ভেতরে বাতি জ্বলছে। যাত্রীরা সবাই ক্লান্ত। দূরে দুই ভদ্রলোক বেশ চিৎকার করে গল্পও করছেন। মাঝেমধ্যে ট্রেনের খাবারের কামরা থেকে নানা ধরনের খাবার এনে সামনে ধরে দ্রুত কেটে পড়ছে লোকগুলো। কাটলেট। চা। এরপর চিপস। দেবীর ঘুম ভাঙল। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তার সঙ্গে একটা ট্রলি। সেটা খুললেন। একটা ফার্স্ট এইড বক্স বের করলেন। তারপর নিজের পা বের করলেন কালো রঙের জুতা থেকে। তার দুটো পা থেকে পারিজাত ফুলের শোভা যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ কি এই দুটো পা দেখে লিখেছিলেন, ‘দুটো অতুল পদতল রাতুল শতদল, জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল।’ তিনি তার পায়ের পেছনের দিকে, গোড়ালির একটু ওপরে একটা ব্যান্ড এইড বাঁধলেন। মানে আঠাওয়ালা ব্যান্ডেজ। বোধ হয় জুতা লেগে তার পায়ের পেছনটা খানিক জখম হয়েছে। তারপর ফার্স্ট এইড বক্স ট্রলির ভেতরে রেখে ট্রলি সুটকেসটা বন্ধ করে রেখে দিলেন সিটের নিচে।
রাত দশটায় পৌঁছে যাব ঢাকায়, বিমানবন্দর স্টেশনে। আমাকে নেমে যেতে হবে।
বিমানবন্দর স্টেশনে কি সে-ও নামবে?
না। যারা যারা বিমানবন্দর স্টেশনে নামবে, টঙ্গী থেকেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার দেবীর মধ্যে সে রকমের কোনো চাঞ্চল্য নেই। তাহলে আমিও নামব না। আমি তার সঙ্গে কমলাপুর চলে যাব। যেতেই হবে।
বিমানবন্দরে পুরো কামরা ফাঁকা হয়ে গেল প্রায়। পৃথিবীর সব লোক এখন উত্তরা থাকে নাকি?
শুধু ওই দূরে দুজন মুরব্বি গোছের মানুষ বসে আছেন।
আমরা দুজন এইখানে মুখোমুখি আসনে।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে।
কমলাপুর পৌঁছাতে লাগবে আরও এক ঘণ্টা।
একটা ঘণ্টা তো আমি তার সামনে বেশি থাকতে পারব।
এইবার বোধ হয় আমার কথা বলা উচিত।
আমি বললাম, ‘আপনি কোথায় নামবেন?’
তিনি জবাব দিলেন না।
মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল।
জবাব দিল না কেন মেয়েটা। খুবই নিরীহ প্রশ্ন। জবাব দিলে কী হতো?
আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি এভাবে অপমানিত হলাম! এর কি কোনো শোধ নেই?
ফ্যানটা তার দিকে ঘোরানো। তিনি উঠে ফ্যানটা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন।
পারলেন না।
আমি ভাবলাম, এবার আমার চেষ্টা করা উচিত। না হয় সে খারাপ ব্যবহার করেইছে। তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হইব না কেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যানটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম।
ভুলক্রমেই, আপনাদের এ কথা আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে পারব, ইচ্ছা করে কাজটা আমি করিনি, আমার তর্জনী ঢুকে গেল ফ্যানের খাঁচার ভেতরে, আর ঘুরন্ত পাখা লেগে বেশ খানিকটা গেল কেটে। আমি দ্রুতই হাতটা সরিয়ে নিলাম, একটা অব্যয়ধ্বনি বেরিয়ে এল, আহা...
টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। এবার দেবীর দয়া হলো। তিনি আমার আঙুল চেপে ধরলেন তার চাপাকলির মতো আঙুল দিয়ে। তারপর নিজের সুটকেসটা খুললেন। ফার্স্ট এইড বক্সটা বের করলেন। তাতে ডেটল ছিল। একটা তুলায় ডেটল মেখে, আহা, তিনি আমার আঙুলের রক্ত মুছে দিলেন। তারপর আরেকটু তুলা চেপে ধরে আমার আঙুলের ডগায় একটা ব্যান্ড এইড বেঁধে দিলেন।
আমার জীবন চিরদিনের জন্য ধন্য হয়ে গেল।
তারপর এসে গেল কমলাপুর।
আমি বললাম, ‘আসি।’
তিনি হাসলেন। কোনো কথাই বললেন না।
আমি বললাম, ‘আপনার সুটকেসটা আমি নামিয়ে দেব?’
তিনি হাসলেন। কথা বললেন না।
কমলাপুর এসে গেল।
আমি নেমে পড়লাম।
তিনিও নামলেন।
তাকে নিতে এসেছে এক যুবক।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম, দুজনে কথা বলছে, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে, সাংকেতিক ভাষায়, হাত নেড়ে নেড়ে।
একে অন্যকে একবার আলতো করে হাগ করল।
তারপর যুবকটি মেয়েটির ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে মিশে গেল কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিড়ে।
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করছি নিজের কাছ থেকেই।
তারপর তাকে হারিয়ে ফেললাম।
এই গল্পটা লিখছি কম্পিউটারে। ডান হাতে এখনো তার দেওয়া ব্যান্ডেজটা আছে।
তর্জনী ব্যবহার করতে পারছি না।
দেবী, যদি তুমি এই লেখাটা পড়ো, তোমার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ো। স্যরি, মোবাইল নম্বর নিয়ে আমি কী করব? তুমি কি বাংলা পড়তে পারো? আমি আশা করি, তুমি পারো এবং এই লেখাটা তুমি পড়ছ। তাহলে আমাকে ই-মেইল কোরো। এই লেখার সঙ্গে আমি আমার ই-মেইল এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। ওটা দিয়ে সার্চ দিলে তুমি আমাকে ফেসবুকেও পেতে পারো।
No comments