হুমকির মুখে মার্কিন আধিপত্য by নোম চমস্কি
ইউক্রেনের চলমান সংকট খুব গুরুতর,
বিশ্বশান্তির জন্য তা হুমকিস্বরূপ। সংকটের মাত্রা এতই গুরুতর যে অনেকে
এটাকে ১৯৬২ সালের কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সঙ্গে তুলনা করছেন। দ্য
বোস্টন গ্লোব-এ কলাম লেখক থ্যানাসিস ক্যামবানিস মূল বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে
ধরেছেন এভাবে: ঠান্ডাযুদ্ধের পরের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা
নিজেদের মতো একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, পুতিন যে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার
অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন, এর ফলে সেই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল। এই ব্যবস্থায়
পরাশক্তিগুলো আন্তর্জাতিক সমর্থন পেলেই সামরিক হস্তক্ষেপ করত। অথবা সেটা
সম্ভব না হলে তারা বিরোধী পক্ষের স্বার্থের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সেটা করত। ফলে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ইরাক আগ্রাসন এই কথিত বিশ্বব্যবস্থায়
কোনো ছেদ ঘটায়নি। সে সময় তারা রাশিয়া বা চীনের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটায়নি।
এর বিপরীতে, পুতিনের এই ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও ইউক্রেনে তাঁর যে স্বার্থ আছে, তা মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী। সে কারণে, ‘ওবামা রাশিয়ার সঙ্গে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টা করছেন। রাশিয়ার আশপাশের এলাকায় তাঁর সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে রাশিয়াকে একটি সমাজচ্যুত রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছেন ওবামা।’ পিটার বেকার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে এ কথা বলেছেন।
সংক্ষেপে বললে, রাশিয়ার সীমানায় মার্কিন স্বার্থ নিহিত আছে। সে কারণে, রাশিয়ার ‘আশপাশের এলাকায়’ তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিশ্বব্যবস্থায় ব্যত্যয় ঘটানোর মাধ্যমে সংকটের সৃষ্টি করেছে। ব্যাপারটা সাধাসিধে। অন্য দেশগুলোর তাদের সীমানায় নিজ স্বার্থ থাকতে পারে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ থাকতে পারে। কিন্তু ইরাক ও ইরানের ক্ষেত্রে তা হতে পারে না। ইরানে তো সব সময় মার্কিন হামলার হুমকি অব্যাহতই আছে। এসব হুমকি সব সময় শুধু জাতিসংঘ সনদেরই লঙ্ঘন নয়, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবেরও লঙ্ঘন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে সবে সই করেছে, সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাবে রাশিয়ার ওপর দোষারোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘হুমকি ও বল প্রয়োগ’-এ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত জাতিসংঘ সনদের ওপর গুরুত্বারোপ করে এই প্রস্তাব শুরু হয়েছে।
কিউবার মিসাইল সংকটের সময়ও পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের বিষয়টি খালি চোখে ধরা পড়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী খ্রুশ্চভের প্রস্তাব খারিজ করে দিলে সারা দুনিয়ায় পারমাণবিক যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। খ্রুশ্চভ প্রস্তাব করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিলে রাশিয়াও একইভাবে কিউবা থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেবে। (মার্কিন মিসাইল তুলে নিয়ে তখন সেখানে আরও প্রাণঘাতী পোলারিস সাবমেরিন বসানোর বিষয়টি তখন প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল, রাশিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দানবীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, সেটার অংশ হিসেবে।)
এ ক্ষেত্রেও রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত ছিল। সব পক্ষই তা গ্রহণ করেছিল। ইন্দোচীনে মার্কিন আগ্রাসন কারও স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটায়নি, ঠিক ইরাকের মতো বা দুনিয়াজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য আগ্রাসনের ক্ষেত্রেও তা ঘটেনি।
মূল বিষয়টি আরেকবার বলি, প্রতিপক্ষের কখনো কখনো নিজের স্বার্থ থাকতে পারে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ আছে। যদি কোনো প্রতিপক্ষের তার ‘আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা থাকে’, যা মার্কিন স্বার্থকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ার সামনে গুরুতর সমস্যা। হার্ভার্ড-এমআইটি জার্নাল ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির চলতি সংখ্যায় অক্সফোর্ড বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউয়েন ফুং খং বলেছেন, ‘মার্কিন কৌশলগত পরিকল্পনায় একটি দীর্ঘ (দ্বি-দলীয়) ঐতিহ্য আছে: মার্কিন প্রশাসন বছরের পর বছর ধরে বলে আসছে, এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা, যাতে কোনো বিরোধীপক্ষ বিশ্বের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।’
এটা সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্রকে তার ‘আধিপত্য বজায় রাখতে হবে।’ কারণ, ‘মার্কিন আধিপত্য আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার জন্য জরুরি। মার্কিন আধিপত্যকে সহনীয়ভাবে উপস্থাপন করার শিল্প।
তবে সারা দুনিয়া এটা মনে করে না। দুনিয়া মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘সমাজচ্যুত রাষ্ট্র’ ও ‘বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।’ মেরুতেও এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। খংয়ের নিবন্ধটি এশিয়ার সংকট নিয়ে লেখা। এই সংকটের আঁতুড়ঘর হচ্ছে চীনের উত্থান। চীন ‘এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি’ হয়ে উঠছে এবং রাশিয়ার মতো তারও ‘আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা আছে।’ ফলে তারাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উঠছে। এই ‘দীর্ঘ (দ্বি-দলীয়) ঐতিহ্য’কে আরও জোরদার করার লক্ষ্যেই ওবামার এই সাম্প্রতিক এশিয়া সফর। কূটনীতির ভাষায়।
পুতিনের সমালোচনা প্রায় বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে। তিনি একটি তথাকথিত ‘আবেগী বক্তব্য’ দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তিক্ততাসহ অভিযোগ করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার সঙ্গে ‘বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাঁদের বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে ন্যাটোর সম্প্রসারণ হওয়ার পরে তাঁদের সেটা জানানো হয়েছে, আমাদের সীমান্তে সেনা মোতায়েন করার ক্ষেত্রেও তা করা হয়েছে। তারা সব সময় আমাদের বলেছে, “এটা তোমাদের বিষয় নয়।”’
পুতিনের সমালোচনার বস্তুগত ভিত্তি আছে। ন্যাটোর পরিকল্পনামাফিক গর্বাচভ জার্মানির একত্রীকরণ মেনে নিয়েছিলেন, এই ছাড় দেওয়াটার একটা বিনিময় মূল্য ছিল। ইতিহাসে এটা অনন্য। ওয়াশিংটন রাজি হয়েছিল, ন্যাটো আর ‘এক ইঞ্চিও পূর্ব দিকে যাবে না’, পূর্ব জার্মানির কথা মাথায় রেখে। এই প্রতিশ্রুতি কিছুদিনের মধ্যেই ভাঙা হয়। গর্বাচভের অভিযোগ, তাঁকে বলা হয়েছিল, এটা ছিল শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি। ক্লিনটন ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর আজ ন্যাটোকে সম্প্রসারণ করে ইউক্রেন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। রাশিয়ার ঐতিহাসিক ‘আশপাশ’-এর গহিন পর্যন্ত। কিন্তু এটা ‘রাশিয়ার বিষয় নয়’, কারণ ‘শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায়’ রাখার জন্য রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন স্বার্থ থাকা প্রয়োজন। রাশিয়ার ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তকরণ একটি বেআইনি কাজ। এটা আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিরও পরিপন্থী। এর সমতুল্য সমসাময়িক ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া ভার। ইরাক আগ্রাসনের চেয়েও বড় অপরাধ।
কিন্তু একটি সমতুল্য উদাহরণ মাথায় এসে গেল। সেটা হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব কিউবায় গুয়ানতানামো উপদ্বীপের ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ আরোপ। ১৯০৩ সালে বন্দুকের মুখে এই উপদ্বীপ কিউবার কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিউবা ১৯৫৯ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বারবার দাবি করলেও যুক্তরাষ্ট্র তার আরজিতে কর্ণপাত করেনি। নিঃসন্দেহে রাশিয়ার দাবি জোরালো। এই অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষে অভ্যন্তরীণ সমর্থন ছাড়াও ক্রিমিয়া তো আসলে ঐতিহাসিকভাবে রুশীয়। সেখানে রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ পানির বন্দর ও নৌবাহিনীর ঘাঁটি অবস্থিত। এর কৌশলগত তাৎপর্যও অনেক বেশি। গুয়ানতানামোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দাবি থাকতে পারে না, বল প্রয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতা ছাড়া।
কিউবাকে গুয়ানতানামো ফেরত দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বীকৃতি জানানোর একটি কারণ এমন হতে পারে: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকূল, এর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে কিউবার উন্নয়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ৫০ বছর ধরে এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতিগত লক্ষ্য, বড় আকারের সন্ত্রাস ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপসহ। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, কিউবায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। অথচ গুয়ানতানামোতে যুক্তরাষ্ট্র আরও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। কিন্তু এটা কারও স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। ‘শান্তি ও স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ রকম করতে হয়—সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে জঘন্য স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর কাজও!
চমস্কির ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
নোম চমস্কি: আমেরিকান বুদ্ধিজীবী ও লেখক।
এর বিপরীতে, পুতিনের এই ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও ইউক্রেনে তাঁর যে স্বার্থ আছে, তা মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী। সে কারণে, ‘ওবামা রাশিয়ার সঙ্গে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টা করছেন। রাশিয়ার আশপাশের এলাকায় তাঁর সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে রাশিয়াকে একটি সমাজচ্যুত রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছেন ওবামা।’ পিটার বেকার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে এ কথা বলেছেন।
সংক্ষেপে বললে, রাশিয়ার সীমানায় মার্কিন স্বার্থ নিহিত আছে। সে কারণে, রাশিয়ার ‘আশপাশের এলাকায়’ তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিশ্বব্যবস্থায় ব্যত্যয় ঘটানোর মাধ্যমে সংকটের সৃষ্টি করেছে। ব্যাপারটা সাধাসিধে। অন্য দেশগুলোর তাদের সীমানায় নিজ স্বার্থ থাকতে পারে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ থাকতে পারে। কিন্তু ইরাক ও ইরানের ক্ষেত্রে তা হতে পারে না। ইরানে তো সব সময় মার্কিন হামলার হুমকি অব্যাহতই আছে। এসব হুমকি সব সময় শুধু জাতিসংঘ সনদেরই লঙ্ঘন নয়, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবেরও লঙ্ঘন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে সবে সই করেছে, সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাবে রাশিয়ার ওপর দোষারোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘হুমকি ও বল প্রয়োগ’-এ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত জাতিসংঘ সনদের ওপর গুরুত্বারোপ করে এই প্রস্তাব শুরু হয়েছে।
কিউবার মিসাইল সংকটের সময়ও পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের বিষয়টি খালি চোখে ধরা পড়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী খ্রুশ্চভের প্রস্তাব খারিজ করে দিলে সারা দুনিয়ায় পারমাণবিক যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। খ্রুশ্চভ প্রস্তাব করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিলে রাশিয়াও একইভাবে কিউবা থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেবে। (মার্কিন মিসাইল তুলে নিয়ে তখন সেখানে আরও প্রাণঘাতী পোলারিস সাবমেরিন বসানোর বিষয়টি তখন প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল, রাশিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দানবীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, সেটার অংশ হিসেবে।)
এ ক্ষেত্রেও রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত ছিল। সব পক্ষই তা গ্রহণ করেছিল। ইন্দোচীনে মার্কিন আগ্রাসন কারও স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটায়নি, ঠিক ইরাকের মতো বা দুনিয়াজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য আগ্রাসনের ক্ষেত্রেও তা ঘটেনি।
মূল বিষয়টি আরেকবার বলি, প্রতিপক্ষের কখনো কখনো নিজের স্বার্থ থাকতে পারে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ আছে। যদি কোনো প্রতিপক্ষের তার ‘আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা থাকে’, যা মার্কিন স্বার্থকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ার সামনে গুরুতর সমস্যা। হার্ভার্ড-এমআইটি জার্নাল ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির চলতি সংখ্যায় অক্সফোর্ড বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউয়েন ফুং খং বলেছেন, ‘মার্কিন কৌশলগত পরিকল্পনায় একটি দীর্ঘ (দ্বি-দলীয়) ঐতিহ্য আছে: মার্কিন প্রশাসন বছরের পর বছর ধরে বলে আসছে, এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা, যাতে কোনো বিরোধীপক্ষ বিশ্বের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।’
এটা সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্রকে তার ‘আধিপত্য বজায় রাখতে হবে।’ কারণ, ‘মার্কিন আধিপত্য আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার জন্য জরুরি। মার্কিন আধিপত্যকে সহনীয়ভাবে উপস্থাপন করার শিল্প।
তবে সারা দুনিয়া এটা মনে করে না। দুনিয়া মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘সমাজচ্যুত রাষ্ট্র’ ও ‘বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।’ মেরুতেও এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। খংয়ের নিবন্ধটি এশিয়ার সংকট নিয়ে লেখা। এই সংকটের আঁতুড়ঘর হচ্ছে চীনের উত্থান। চীন ‘এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি’ হয়ে উঠছে এবং রাশিয়ার মতো তারও ‘আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা আছে।’ ফলে তারাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উঠছে। এই ‘দীর্ঘ (দ্বি-দলীয়) ঐতিহ্য’কে আরও জোরদার করার লক্ষ্যেই ওবামার এই সাম্প্রতিক এশিয়া সফর। কূটনীতির ভাষায়।
পুতিনের সমালোচনা প্রায় বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে। তিনি একটি তথাকথিত ‘আবেগী বক্তব্য’ দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তিক্ততাসহ অভিযোগ করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার সঙ্গে ‘বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাঁদের বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে ন্যাটোর সম্প্রসারণ হওয়ার পরে তাঁদের সেটা জানানো হয়েছে, আমাদের সীমান্তে সেনা মোতায়েন করার ক্ষেত্রেও তা করা হয়েছে। তারা সব সময় আমাদের বলেছে, “এটা তোমাদের বিষয় নয়।”’
পুতিনের সমালোচনার বস্তুগত ভিত্তি আছে। ন্যাটোর পরিকল্পনামাফিক গর্বাচভ জার্মানির একত্রীকরণ মেনে নিয়েছিলেন, এই ছাড় দেওয়াটার একটা বিনিময় মূল্য ছিল। ইতিহাসে এটা অনন্য। ওয়াশিংটন রাজি হয়েছিল, ন্যাটো আর ‘এক ইঞ্চিও পূর্ব দিকে যাবে না’, পূর্ব জার্মানির কথা মাথায় রেখে। এই প্রতিশ্রুতি কিছুদিনের মধ্যেই ভাঙা হয়। গর্বাচভের অভিযোগ, তাঁকে বলা হয়েছিল, এটা ছিল শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি। ক্লিনটন ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর আজ ন্যাটোকে সম্প্রসারণ করে ইউক্রেন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। রাশিয়ার ঐতিহাসিক ‘আশপাশ’-এর গহিন পর্যন্ত। কিন্তু এটা ‘রাশিয়ার বিষয় নয়’, কারণ ‘শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায়’ রাখার জন্য রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন স্বার্থ থাকা প্রয়োজন। রাশিয়ার ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তকরণ একটি বেআইনি কাজ। এটা আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিরও পরিপন্থী। এর সমতুল্য সমসাময়িক ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া ভার। ইরাক আগ্রাসনের চেয়েও বড় অপরাধ।
কিন্তু একটি সমতুল্য উদাহরণ মাথায় এসে গেল। সেটা হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব কিউবায় গুয়ানতানামো উপদ্বীপের ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ আরোপ। ১৯০৩ সালে বন্দুকের মুখে এই উপদ্বীপ কিউবার কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিউবা ১৯৫৯ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বারবার দাবি করলেও যুক্তরাষ্ট্র তার আরজিতে কর্ণপাত করেনি। নিঃসন্দেহে রাশিয়ার দাবি জোরালো। এই অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষে অভ্যন্তরীণ সমর্থন ছাড়াও ক্রিমিয়া তো আসলে ঐতিহাসিকভাবে রুশীয়। সেখানে রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ পানির বন্দর ও নৌবাহিনীর ঘাঁটি অবস্থিত। এর কৌশলগত তাৎপর্যও অনেক বেশি। গুয়ানতানামোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দাবি থাকতে পারে না, বল প্রয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতা ছাড়া।
কিউবাকে গুয়ানতানামো ফেরত দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বীকৃতি জানানোর একটি কারণ এমন হতে পারে: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকূল, এর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে কিউবার উন্নয়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ৫০ বছর ধরে এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতিগত লক্ষ্য, বড় আকারের সন্ত্রাস ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপসহ। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, কিউবায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। অথচ গুয়ানতানামোতে যুক্তরাষ্ট্র আরও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। কিন্তু এটা কারও স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। ‘শান্তি ও স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ রকম করতে হয়—সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে জঘন্য স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর কাজও!
চমস্কির ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
নোম চমস্কি: আমেরিকান বুদ্ধিজীবী ও লেখক।
No comments