ওদের কি দেশে ফেরা হবে না?
গত ডিসেম্বর মাসেই তঁার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের এক বন্ধুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একজন অধ্যাপক বাংলাদেশ থেকে কিছু ছাত্রছাত্রীকে তঁার গবেষণাগারে চাকরি দেবেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে যৌথ গবেষণার উদ্যোগ নেবেন—এই আশায়। কিন্তু গোলাগুলি আর মৃত্যুর মিছিল দেখে তঁার আর যাওয়া হলো না। একটা বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। তার আগের মাসেই এক অস্ট্রেলিয়ান শিল্পোদ্যোক্তা তঁার বিশাল শোরুমে বাংলাদেশের পণ্যকে স্থান দেওয়ার জন্য যাচাই করতে যেতে চেয়েছিলেন আমাদের আরেক পরিচিত বাঙালির সঙ্গে। পত্রপত্রিকা আর সংবাদমাধ্যমে দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখে ভদ্রলোক আর গেলেন না। ভেস্তে গেল কোটি টাকার ব্যবসার সম্ভাবনা। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডের একজন উদ্যোক্তার দেশে যাওয়ার কথা ছিল নতুন বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা দেখতে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অপহরণের ভয়ংকর আর মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে তিনি বাতিল করেছেন দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। এভাবেই কি একের পর এক সুযোগ হারানোর মিছিল তৈরি হবে বাংলাদেশে? অবাক হয়ে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে একই বৃত্তে ঘুরতে থাকার দৃশ্যপট?
আমরা সবাই দেশের বাইরে থাকি। কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ যুক্তরাষ্ট্র, কেউ যুক্তরাজ্য আবার কেউ জাপানে। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তায় জুড়ে আছে বাংলাদেশ। অদ্ভুতভাবে আমরা লক্ষ করলাম, অনেক অনেক দিন ধরে বাইরে থাকা এমনকি উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশিরা এখনো ভুলতে পারেননি নিজেদের শিকড়কে, এখনো তঁাদের আলোচনায় সবার আগে বাংলাদেশ, বিতর্কের ঝড় ওঠে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। সিডনির রাস্তায় ট্যাক্সি চালানো বাংলাদেশের বুয়েটের ছেলেটি কিংবা নিউইয়র্কে সুপারশপে কাজ করা চট্টগ্রাম মেডিকেলের চিকিৎসক মেয়েটি নিজের পেশা বিসর্জন দিয়ে এই সহস্র মাইল দূরে বসে আছে বাংলাদেশে চাকরিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় প্রমোশন না পাওয়ার কষ্টে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে বিশেষ কোনো সময়ে উপেক্ষার শিকার হয়ে, ক্ষমতাধর মামা না থাকায় নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী পছন্দের চাকরি না পাওয়ার কারণে। আর কত দিন এভাবে যোগ্যতার অবমূল্যায়ন চলতে থাকবে আর আমরা হারাতে থাকব সবচেয়ে মেধাবী সন্তানগুলোকে?
টরন্টোর ২০ তলা উঁচু অ্যাপার্টমেন্টে বসে বাংলাদেশের ছেলেটি আধুনিক কক্ষের উষ্ণতা অনুভব করছে ঠিকই, কিন্তু আজন্ম গ্রামে বেড়ে ওঠা ছেলেটি এখনো ভুলতে পারে না পূর্ণিমা রাতে ঘরের উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকায় মধুর স্মৃতি। প্রতিদিন সকালে অফিসে এসেই সবার আগে প্রবাসীদের কম্পিউটারের স্ক্রিনে বিবিসি কিংবা সিএনএন ভাসে না, দেখা যায় প্রথম আলো কিংবা বাংলাদেশের কোনো অনলাইন পত্রিকা। যত বড় গবেষণাগারেই পাশ্চাত্যের সমস্যা নিয়ে কাজ করি না কেন, সবার চিন্তায় বাংলাদেশ। আমাদের এক বন্ধু তাজ গবেষণা করছে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সোয়ান নদীতে ভাঙনের সম্ভাব্যতা প্রতিরোধ নিয়ে; কিন্তু তার উদাহরণে বর্ণনায় সব সময়ই চলে আসে সন্দ্বীপের নদীভাঙনের দুঃখ। দিন শেষে নীড়ে ফেরার প্রতীক্ষা সবার কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মানুষগুলোর বেশির ভাগেরই দেশে ফেরার উপায় নেই। ন্যানো টেকনোলজি কিংবা জৈবপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করা ছেলেটা দেশে ফিরতে পারবে না। কারণ, দেশে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না।
আমরা বিদেশে পিএইচডি করছি, গবেষণা করছি। আমরা সবাই দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এখানে আমাদের সুপারভাইজাররা যখন বলেন, আসলেই কি এই উন্নত কাজগুলো তোমার দেশে করতে পারার সুযোগ ও অর্থায়ন পাবে? আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। চাইলে হয়তো আমরা অনেকেই এসব দেশে নাগরিকত্ব পেয়ে যাব। কিন্তু আমরা বাঙালি পরিচয়ে থাকতে চাই, অন্য কোনো দেশের নাগরিক নয়। তার পরও দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দেখি শিক্ষক এই পরিচয়ের চেয়ে আমি কোন দল সমর্থন করি, এটাই অনেক ক্ষেত্রে বড় পরিচয়, তখন হতাশ হতে হয়৷ শিকড় ছড়িয়ে থাকা এই কষ্ট ও অনিশ্চয়তাগুলো মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্নের উদয় ঘটায়—আমাদেরও কি তবে দেশে ফেরা হবে না? লেখার শেষে পার্থের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামসুল আরেফিন আনামের একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কিছুদিনের মধ্যেই সে পাবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব কিন্তু তবু বাংলাদেশকে নিয়ে তার অনেক ভাবনা ও উৎকণ্ঠা। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কিছুদিনের মধ্যেই যেখানে অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা উন্নত দেশের নিরাপদ নাগরিক হতে যাচ্ছ, বাংলাদেশকে নিয়ে এত চিন্তা কেন তোমার? উত্তরে সে বলেছিল, ‘পৃথিবীর যেই প্রান্তেই যাই না কেন, যেখানেই থাকি না কেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভালো আছে—এটা দূর থেকে দেখেও শান্তি পাব, ভীষণ ভালো লাগবে।’ মাননীয় সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা, দোহাই লাগে আপনাদের। আমাদের দেশে ফিরতে দিন, ফেরার পরিস্থিতি তৈরি করুন৷
লেখকবৃন্দ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত এবং চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউএসটিসির তরুণ শিক্ষক৷
আমরা সবাই দেশের বাইরে থাকি। কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ যুক্তরাষ্ট্র, কেউ যুক্তরাজ্য আবার কেউ জাপানে। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তায় জুড়ে আছে বাংলাদেশ। অদ্ভুতভাবে আমরা লক্ষ করলাম, অনেক অনেক দিন ধরে বাইরে থাকা এমনকি উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশিরা এখনো ভুলতে পারেননি নিজেদের শিকড়কে, এখনো তঁাদের আলোচনায় সবার আগে বাংলাদেশ, বিতর্কের ঝড় ওঠে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। সিডনির রাস্তায় ট্যাক্সি চালানো বাংলাদেশের বুয়েটের ছেলেটি কিংবা নিউইয়র্কে সুপারশপে কাজ করা চট্টগ্রাম মেডিকেলের চিকিৎসক মেয়েটি নিজের পেশা বিসর্জন দিয়ে এই সহস্র মাইল দূরে বসে আছে বাংলাদেশে চাকরিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় প্রমোশন না পাওয়ার কষ্টে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে বিশেষ কোনো সময়ে উপেক্ষার শিকার হয়ে, ক্ষমতাধর মামা না থাকায় নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী পছন্দের চাকরি না পাওয়ার কারণে। আর কত দিন এভাবে যোগ্যতার অবমূল্যায়ন চলতে থাকবে আর আমরা হারাতে থাকব সবচেয়ে মেধাবী সন্তানগুলোকে?
টরন্টোর ২০ তলা উঁচু অ্যাপার্টমেন্টে বসে বাংলাদেশের ছেলেটি আধুনিক কক্ষের উষ্ণতা অনুভব করছে ঠিকই, কিন্তু আজন্ম গ্রামে বেড়ে ওঠা ছেলেটি এখনো ভুলতে পারে না পূর্ণিমা রাতে ঘরের উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকায় মধুর স্মৃতি। প্রতিদিন সকালে অফিসে এসেই সবার আগে প্রবাসীদের কম্পিউটারের স্ক্রিনে বিবিসি কিংবা সিএনএন ভাসে না, দেখা যায় প্রথম আলো কিংবা বাংলাদেশের কোনো অনলাইন পত্রিকা। যত বড় গবেষণাগারেই পাশ্চাত্যের সমস্যা নিয়ে কাজ করি না কেন, সবার চিন্তায় বাংলাদেশ। আমাদের এক বন্ধু তাজ গবেষণা করছে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সোয়ান নদীতে ভাঙনের সম্ভাব্যতা প্রতিরোধ নিয়ে; কিন্তু তার উদাহরণে বর্ণনায় সব সময়ই চলে আসে সন্দ্বীপের নদীভাঙনের দুঃখ। দিন শেষে নীড়ে ফেরার প্রতীক্ষা সবার কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মানুষগুলোর বেশির ভাগেরই দেশে ফেরার উপায় নেই। ন্যানো টেকনোলজি কিংবা জৈবপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করা ছেলেটা দেশে ফিরতে পারবে না। কারণ, দেশে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না।
আমরা বিদেশে পিএইচডি করছি, গবেষণা করছি। আমরা সবাই দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এখানে আমাদের সুপারভাইজাররা যখন বলেন, আসলেই কি এই উন্নত কাজগুলো তোমার দেশে করতে পারার সুযোগ ও অর্থায়ন পাবে? আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। চাইলে হয়তো আমরা অনেকেই এসব দেশে নাগরিকত্ব পেয়ে যাব। কিন্তু আমরা বাঙালি পরিচয়ে থাকতে চাই, অন্য কোনো দেশের নাগরিক নয়। তার পরও দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দেখি শিক্ষক এই পরিচয়ের চেয়ে আমি কোন দল সমর্থন করি, এটাই অনেক ক্ষেত্রে বড় পরিচয়, তখন হতাশ হতে হয়৷ শিকড় ছড়িয়ে থাকা এই কষ্ট ও অনিশ্চয়তাগুলো মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্নের উদয় ঘটায়—আমাদেরও কি তবে দেশে ফেরা হবে না? লেখার শেষে পার্থের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামসুল আরেফিন আনামের একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কিছুদিনের মধ্যেই সে পাবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব কিন্তু তবু বাংলাদেশকে নিয়ে তার অনেক ভাবনা ও উৎকণ্ঠা। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কিছুদিনের মধ্যেই যেখানে অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা উন্নত দেশের নিরাপদ নাগরিক হতে যাচ্ছ, বাংলাদেশকে নিয়ে এত চিন্তা কেন তোমার? উত্তরে সে বলেছিল, ‘পৃথিবীর যেই প্রান্তেই যাই না কেন, যেখানেই থাকি না কেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভালো আছে—এটা দূর থেকে দেখেও শান্তি পাব, ভীষণ ভালো লাগবে।’ মাননীয় সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা, দোহাই লাগে আপনাদের। আমাদের দেশে ফিরতে দিন, ফেরার পরিস্থিতি তৈরি করুন৷
লেখকবৃন্দ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত এবং চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউএসটিসির তরুণ শিক্ষক৷
No comments