এবিএম মূসার ৬০ বছরের সাংবাদিকতার বর্ণিল অধ্যায়
দেশবরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসা জীবনের ৬০
বছরই কেটেছে সাংবাদিকতায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করে
খ্যাতি কুড়িয়েছেন। দক্ষতা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। শাসক শ্রেণীর
রক্ষচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাংবাদিকতার নীতি ও আদর্শ উচ্চকিত রেখেছেন
কর্মজীবনে। তার হাত ধরে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সাংবাদিকতায়। সাংবাদিক
সমাজের অভিভাবক ও জাতীয় এই মুরব্বি শেষ জীবনেও সত্য কথা বলে অপরিসীম
সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।
১৯৩১
সালের এই দিনে ফেনীর পরশুরাম থানার ধর্মপুর গ্রামে নানাবাড়িতে তিনি
জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আশরাফ আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। পিতার চাকরির
সুবাদে শৈশবের সাত বছর কেটেছে চট্টগ্রামে। তার শিক্ষাজীবন কেটেছে
চট্টগ্রামের গভ. মোসলেম হাইস্কুল, নোয়াখালী জিলা স্কুল, ফেনী কলেজ,
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। বিএ প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েছেন চৌমুহনী কলেজ
থেকে। কলেজে পড়াকালে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি চৌমুহনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক
‘কৈফিয়ত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। এ সময়ই জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতিতে।
নিয়মিত লিখতেন সাপ্তাহিক সংগ্রাম ও পাকিস্তান অবজারভারে। ১৯৫০ সালে
লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় এসে যোগ দেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকার সহ-সম্পাদক
হিসেবে। একই বছরে মালিকের সঙ্গে বিরোধের কারণে ইনসাফ ছেড়ে একই পদে
শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন পাকিস্তান অবজারভারে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের
সংবাদ প্রকাশের অপরাধে পাকিস্তান অবজারভার বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তিনি
চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। বছর তিনেকের পর এখানেই
বার্তা সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পান এবিএম মূসা। ১৯৬১ সালে কমনওয়েলথ প্রেস
ইনস্টিটিউটের বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে যান। সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেন
অক্সফোর্ডের কুইন এলিজাবেথ হাউসে। অবজারভারে বার্তা সম্পাদক থাকা অবস্থায়ই
তিনি পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের একাধিকবার
প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে তাসখন্দে
ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনা চলাকালে গভীর রাতে মারা যান ভারতের
প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। এ খবর উপমহাদেশের অন্য কোন সংবাদপত্র
দিতে পারেনি অবজারভার ছাড়া। তিনি তখন অবজারভারের বার্তা সম্পাদক। এ কাজের
পুরস্কার হিসেবে তিনি পান জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট
(আইপিআই) পুরস্কার। বাংলাদেশের পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি তিনি বিবিসি,
লন্ডন সানডে টাইমস, দি ইকোনমিস্ট টাইমসসহ বিভিন্ন বিদেশী গণমাধ্যমের
বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়
রণাঙ্গনের অনেক খবর বিদেশী গণমাধ্যমে পাঠাতেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে
এলে এবিএম মূসাকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিটিভি’র মহাপরিচালক হিসেবে। যোগদানের
কয়েক মাস পর ওই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মর্নিং নিউজ পত্রিকাকে নতুন করে বের
করলেন। তিনি ১৯৭৩-এর সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নির্বাচন করে সংসদ
সদস্য হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে চলে যান
লন্ডনে। সেখানে যোগ দেন সানডে টাইমসের রিসার্চ ফেলো হিসেবে। ১৯৭৬ সালে
দেশে ফিরে এসে দৈনিক নিউ নেশনে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে
যোগ দেন জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচিতে। এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমানের অনুরোধে মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রেস
ইনস্টিটিউটে। এখানে চার বছর কাজ করার পরে যোগ দেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায়।
এখান থেকে এরশাদ সরকারের চাপে অবসর নেন ১৯৮৮ সালে। ফের ১৯৯১ সালে নিউজ ডে
নামক একটি দৈনিকের সম্পাদক হিসেবে বছরখানেক কাজ করেন। ১৯৯৪ সালে ভোরের
কাগজে প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলামের প্রতিবাদ লেখার মধ্য দিয়ে শুরু
করেন কলাম লেখা। ২০০৪ সালে অগত্য নিত্যদিন নামক পত্রিকা প্রকাশে সরকার
আপত্তি করলে তিনি প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেন। পরে তার পক্ষে রায় দেয়া হলেও
তিনি আর পত্রিকা বের করেননি। ১৯৫৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এবিএম মূসা বিয়ে
করেন। পারিবারিক জীবনে এবিএম মূসা তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক ছিলেন। স্ত্রী
সেতারা মূসা এদেশের নারী সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। সাংবাদিকতায়
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এবিএম মূসা বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর
মধ্যে রয়েছে একুশে পদক (১৯৯৯), জেফারসন ফেলোশিপ (১৯৭০), কমনওয়েলথ প্রেস
ইউনিয়ন ফেলোশিপ (১৯৬১) ইত্যাদি।
No comments