তালেবান কি ফিরে আসছে? by মশিউল আলম
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান ও ন্যাটো সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সময় যত এগিয়ে
আসছে, তালেবানের সহিংস তৎপরতায় ততই বাড়তি উদ্যম লক্ষ করা যাচ্ছে। গত
দুই-আড়াই মাসে অল্প সময়ের ব্যবধানে তারা বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে
অনেক মানুষকে হত্যা ও জখম করেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে কাবুলের
অন্যতম বিলাসবহুল হোটেল সেরেনায় চার কিশোর তালেবান যোদ্ধা ঢুকে পড়ে দুই
শিশুসহ নয় ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে, গুরুতর জখম করেছে ছয়জনকে।
নিহতদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশিসহ চারজন বিদেশি নাগরিক। শুক্রবার সকালে
দক্ষিণ কান্দাহারে আরেক সন্ত্রাসী হামলায় তালেবানরা হত্যা করেছে তিনজনকে।
কাবুলের সেরেনা হোটেলে নয় ব্যক্তিকে হত্যা করার দিনই জালালাবাদ শহরের কেন্দ্রে এক থানায় তালেবানরা ট্রাকবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হত্যা করেছে পুলিশের ১০ সদস্যসহ মোট ১৮ জনকে। ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন পুলিশের ১৪ জন। নিহতদের মধ্যে জেলার পুলিশ-প্রধানও আছেন। গভর্নরের বাসভবনের কাছে ওই থানায় তালেবান যোদ্ধারা আফগান পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে তিন ঘণ্টা ধরে। তার এক দিন আগে ১৮ মার্চ উত্তর আফগানিস্তানের ফারিয়াব প্রদেশের রাজধানী মায়মানা শহরের এক বাজারের কাছে পুলিশ ঘাঁটিতে রিকশায় করে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে এক আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী তালেবান যোদ্ধা। কিন্তু পুলিশ ঘাঁটিতে ঢুকতে পারার আগেই বাজারের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটালে সে নিজেসহ ১৩ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, আহত হয় ২৩ জন। ফারিয়াব প্রদেশে তালেবানের তৎপরতা অপেক্ষাকৃত কম; আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের মতো তালেবানের শক্ত ঘাঁটি সেখানে নেই। সেখানে তারা সরকারি ও ন্যাটো বাহিনীগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে না; কিন্তু প্রচুর আত্মঘাতী হামলা চালায়। ২০১২ সালের অক্টোবরে মাত্র একজন আত্মঘাতী তালেবান যোদ্ধা ফারিয়াবের মায়মানারে এক মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে ৪১ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কুনার প্রদেশে গাজি আবাদ এলাকায় এক সেনাচৌকির ওপর হামলা চালায় শত শত তালেবান যোদ্ধা। আফগান সরকারি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ চলে চার ঘণ্টা ধরে। সেই যুদ্ধে তালেবানদের হাতে নিহত হন ২১ জন সরকারি সেনাসদস্য। গোলাগুলির পর থেকে সাতজন সেনাসদস্য নিখোঁজ আছেন। বলা হচ্ছে, তাঁদের কয়েকজনকে তালেবান যোদ্ধারা ধরে নিয়ে গেছে আর বাকিরা পালিয়ে গেছেন।
এ বছর শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত। বলা হচ্ছে, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও সামরিক বাহিনী নিজেরাই এখন দেশটির শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম। বিদেশিদের আর প্রয়োজন নেই। গত ১৫ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের পার্লামেন্টে চূড়ান্তভাবে বলে দিয়েছেন, এ বছরের শেষ নাগাদ আমেরিকা তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে; কারণ আফগান সেনাবাহিনী এখনই দেশটির ৯৩ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বছরের শেষ নাগাদ পুরো দেশের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আফগান সামরিক বাহিনীর বর্তমান সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এ বছরের শেষ নাগাদ তা আরও ৬০ হাজার বাড়ার কথা। অন্যদিকে, ধারণা করা হয় যে আফগানিস্তানে তালেবান যোদ্ধার মোট সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার। আড়াই লাখের বেশি প্রশিক্ষিত সরকারি সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে মাত্র ১৫ হাজার তালেবান যোদ্ধা আদৌ পেরে উঠবে না—এ রকম ধারণাই প্রবল, এমনকি আফগান জনগণের মধ্যেও। তাই বিদেশি সেনাদের চলে যাওয়ার পক্ষেই আফগানিস্তানে জনমত প্রবল।
তালেবান এটা ভালো করে জানে। তাই তারা যত বড় নয়, যত শক্তিশালী নয়, তার থেকে অনেক বেশি বড় ও শক্তিশালীরূপে নিজেদের তুলে ধরতে চায়। সম্ভবত সে কারণেই তারা তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। বিদেশি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর আফগান সরকারের জন্য তারা কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, তার কিছু লক্ষণ যদি এখন থেকেই দেখাতে পারে, তাহলে সরকারের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে দর-কষাকষির সুবিধা হবে বলে তারা হয়তো ভাবছে। সে জন্য তারা সরকারি সশস্ত্র বাহিনী, বিদেশি সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার নাগরিক এবং আফগান সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তারা ৮৪ জন সরকারি সেনাসদস্যকে হত্যা করেছে। আর যদিও তারা দাবি করে যে বেসামরিক লোকজনের ওপর তারা আক্রমণ চালায় না, কিন্তু তাদের আত্মঘাতী হামলায় এবং সরকারি ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে বিপুলসংখ্যক নিরীহ বেসামরিক আফগান হতাহত হয়েছে। জাতিসংঘের এক হিসাবে ২০১৩ সালে তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছে প্রায় তিন হাজার বেসামরিক আফগান নাগরিক, আহত হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি। জাতিসংঘ বলছে, তালেবানদের হাতে বেসামরিক লোকজনের এই হতাহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।
কিন্তু তালেবানের এই কৌশলের ফল তো তাদের জন্য খারাপও হতে পারে। তারা যদি একের পর এক হামলা চালিয়ে আফগানিস্তানজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, তাহলে তো আমেরিকান ও ন্যাটোর সেনাবাহিনীর সে দেশে থেকে যাওয়ার পক্ষে যুক্তিই জোরালো হবে। কারণ তালেবানের সহিংস তৎপরতা যতই বাড়বে, আফগান সরকারি বাহিনীগুলোর দুর্বলতাও ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আফগানিস্তানের জনগণেরও মনে হতে পারে, বিদেশি সেনারা চলে গেলে তাদের নিরাপত্তা বাড়বে না, বরং বিপন্ন হবে। বস্তুত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৪ সালের পরও কিছু আমেরিকান সৈন্য আফগানিস্তানে রেখে দিতে চান এই যুক্তিতেই। নভেম্বরে ন্যাটো বাহিনী চলে গেলে আফগানিস্তানের সঙ্গে তিনি একটা দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি করতে চান, যার ভিত্তিতে কিছু আমেরিকান সৈন্য আফগানিস্তানে থেকে যাবে। তালেবান ও আল-কায়েদার সম্ভাব্য বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে ওই মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীগুলোকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাবে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই রাজি না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ওবামা গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পেন্টাগনকে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু ওবামা প্রশাসনের এই অবস্থানই যে চূড়ান্ত, কিংবা এই দৃশ্যমান অবস্থানের আড়ালে আফগানিস্তানে কিছু ‘অবশিষ্ট’ মার্কিন বা ন্যাটো সৈন্য রেখে দেওয়ার তৎপরতা যে চলছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। গত ১২ মার্চ মার্কিন সিনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সভায় আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জোসেফ ডানফোর্ড বলেছেন, ন্যাটো বাহিনী ১৩ বছর ধরে আফগানিস্তানে যা অর্জন করেছে, সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেই অর্জন আবার দ্রুতই হারিয়ে যেতে পারে। তাঁর মতে, আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বা আমেরিকান সব সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলে শুধু তালেবানের নয়, আল-কায়েদারও হাত শক্তিশালী হবে। সে জন্য তিনি মনে করেন, ২০১৪ সালের পর আফগানিস্তানে আট থেকে ১২ হাজার ন্যাটোর সৈন্য থেকে যাওয়া উচিত, যাঁদের অধিকাংশই হবেন আমেরিকান। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী মিশনের অংশ হিসেবে কিছু আমেরিকান স্পেশাল অপারেশন্স ফোর্সও রাখা প্রয়োজন। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন—সিনেট কমিটির ওই সভায় এক সিনেটর এমন মন্তব্য করলে জেনারেল ডানফোর্ড তাঁকে বলেন, আমরা যদি আফগানদের হাতেই সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে আসি, তাহলে ভবিষ্যতে সেখানে আমাদের আরও বড় যুদ্ধের জন্য যেতে হবে।
জেনারেল ডানফোর্ডের এই অবস্থানের সঙ্গে আফগান তালেবানের সাম্প্রতিক নতুন উদ্যমের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা বলা কঠিন। তবে আফগান সরকারকে এড়িয়ে তালেবানের সঙ্গে মার্কিনিদের সংলাপের যে উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল, এই সুবাদে সে কথা স্মরণে আসে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments