সকালে ঢাকায় প্রাতরাশ, ইয়াঙ্গুনে দুপুরের খাবার by সোহরাব হাসান

৬ মার্চ আমরা বিমানের যে ফ্লাইটে ইয়াঙ্গুন যাই, তার বেশির ভাগ যাত্রীই ছিলেন ব্যবসায়ী। ফিরতি ফ্লাইটে এ আর দাশ নামে একজনের সঙ্গে আলাপ হলো। কিছুটা ঠাট্টার সুরে তিনি বললেন, ‘আপনাদের জন্য বাংলা নববর্ষের ইলিশ আনতে গিয়েছিলাম।’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আরও জানালেন, ‘আপনারা যে মাছ খান তার বড় একটা অংশ আসে মিয়ানমার থেকে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সেখানে মাছের ঘের আগাম কিনে রাখেন। আর ইলিশ আসে বর্মার সমুদ্র থেকে।’ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে তারই একটি চালানের টাকা জমা দিতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এই তরুণ ব্যবসায়ী। জাহাজযোগে মাছ আসবে আরও কদিন পর।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ কাঠও আনেন মিয়ানমার থেকে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে বার্মাটিকের কদর। বর্তমানে আস্ত গোল কাঠ আমদানি করা গেলেও ৩১ মার্চের পর আর সেটি সম্ভব হবে না, মিয়ানমার সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে। এই ফ্লাইটেই পারটেক্স গ্রুপের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হলো। ইয়াঙ্গুনে তাঁদের অফিস আছে। পারটেক্স আসবাবে ব্যবহূত কাঠও তাঁরা আনেন মিয়ানমার থেকে।
আমাদের ফ্লাইটে চট্টগ্রামের আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী ছিলেন, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে ব্যবসা করেন। মিয়ানমার সরকার শর্তসাপেক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দিয়েছে। ব্যবসার লাইসেন্স, ব্যাংক হিসাব সবই করতে হয় স্থানীয় নাগরিকের নামে। যাকে বলে স্লিপিং পার্টনার। তবে তাঁরা বিশ্বস্ত। সম্প্রতি মিয়ানমার পার্লামেন্টে পাস হওয়া আইনে বিদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাব খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ইদানীং মিয়ানমারে কাজ শুরু করেছে ব্র্যাক। তাদের অফিস ও কর্মী আছে। গ্রামীণ ব্যাংক মডেলের মাইক্রোক্রেডিট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্যাক্ট বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কয়েকজন বাংলাদেশি কাজ করছেন মিয়ানমারে।
সরকারি পর্যায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ মিয়ানমারে রপ্তানি করত ৩৪৬.১৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০১২-১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১০৯২.৫১ মিলিয়ন ডলারে। একই সময় আমদানি বেড়েছে যথাক্রমে ১৯৮৩.৬ মিলিয়ন থেকে ৬৭০৩ মিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ বাণিজ্য কমিশন (জেটিসি) বৈঠক হয় নেপিডোতে ১৪-১৫ জানুয়ারি। আলোচনা হয় সীমান্ত বাণিজ্য, কৃষি, পণ্য, মাছ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়ানো এবং নৌ, বিমান ও সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার। বিমান চালু হয়েছে। জুন নাগাদ জাহাজ চলাচল শুরু হবে।
২০১১ সালে মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর দেশটিতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বেড়েছে। আগে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিয়ানমার প্রতিবেশী চীন ও থাইল্যান্ডের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। সারা বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল—সব দেশই সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরা পিছিয়ে থাকব কেন? বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে মিয়ানমারে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে প্রচুর কৃষিশ্রমিকের কাজ মিলবে সেখানে।
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের যে দুটো সমস্যা ছিল তার একটির শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। এতে দুই দেশই খুশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন সমুদ্রে যৌথ বিনিয়োগও সম্ভব। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি এই সমুদ্রসীমা নির্ধারণকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, এর ফলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্ভাবনা আরও বাড়ল।
মিয়ানমার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ামনার সীমান্তে পাইকারি ও মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটির রয়েছে প্রচুর জমি, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ। আর আমাদের রয়েছে জ্বালানি ঘাটতি। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে আমরা সহজেই গ্যাস আমদানি করতে পারি। ভারত ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে গ্যাসলাইন স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে। প্রথম প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেই গ্যাসলাইন যাবে। ত্রিদেশীয় গ্যাসলাইন না হলেও মিয়ানমার থেকে আমাদের সরাসরি গ্যাস আনতে কোনো বাধা নেই।
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দ্বিতীয় যে সমস্যা রোহিঙ্গা শরণার্থী। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দেশের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে বৈঠককালে এর শান্তিপূর্ণ সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সম্পর্ক খুবই সোহার্দ্যপূর্ণ ছিল। দেশটির সঙ্গে আছে আমাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন। ব্রিটিশ আমলে অনেকে ভাগ্যের সন্ধানে ইয়াঙ্গুনে যেতেন, যার বর্ণনা আছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস শ্রীকান্ত-এ। শরৎচন্দ্র নিজেও ইয়াঙ্গুনে একসময় চাকরি করতেন। দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সবখানেই আছে। সমস্যা মিটিয়ে ফেলে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়াই উত্তম। কিন্তু সেটি সম্ভব না হলে সম্পর্ক তো থেমে থাকতে পারে না। ভারত-চীন সীমান্তবিরোধ বহুদিনের। তার পর দুটি দেশ ব্যবসা-যোগাযোগ বাড়িয়ে চলেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় আমাদের সেই নীতি অনুসরণ করা উচিত।
গত ৩-৪ মার্চ মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠিত হয় বহুমাত্রিক কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগের (বিমসটেক) তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে সাতটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান যোগ দেন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন। এর আগে তিনি ২০১১ সালেও একবার মিয়ানমার সফর করেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার না হলে আঞ্চলিক জোট যে কোনো কাজে আসে না, সার্ক তার প্রমাণ।
২০১৩ সালের ৭ জুন মিয়ানমার নৌবাহিনীর ইউএনএসএস মহর থি হাম থুহারাজ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফর করে। এর আগে দুই দেশের মধ্যে বিমান ও নৌ-যোগাযোগ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়; যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা-ইয়াঙ্গুন সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান সপ্তাহে দুই দিন ইয়াঙ্গুন যায়। মিয়ানমারের বিমানেরও শিগগিরই ঢাকায় ফ্লাইট চালু করার কথা আছে।
২০১২ সালের মে মাসে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং নয়াদিল্লি সফরকালে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডর গঠনের প্রস্তাব দিলে মনমোহন সিং তা স্বাগত জানান। এই প্রস্তাবে সম্মতি আছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারেরও। এরপর ঢাকা ও ইয়াঙ্গুন হয়ে কলকাতা-কুনমিং মোটর শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, কুনমিংয়ে আয়োজন করা হয় বাণিজ্য মেলার।
উল্লেখ্য, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে দক্ষিণ চীন থেকে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ ছিল। সেই যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করতে চীন সাউদার্ন সিল্ক রোড তৈরি প্রস্তাব দিয়েছে; যার রুট হবে কলকাতা থেকে ঢাকা ও মান্দালে হয়ে চীনের কুনমিং। এই সড়ক চালু হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বহুগুণ বেড়ে যাবে, সাশ্রয় হবে পরিবহন খরচ।
মিয়ানমারসহ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিনিয়োগ-বাণিজ্যের মহা আয়োজন চলছে। এর সক্রিয় অংশীদার হতে না পারলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। বিগত জোট সরকারের আমলে এশীয় মহাসড়ক ও ট্রান্স এশীয় রেলওয়ের রুট নিয়ে বিতর্কে অযথা সময় নষ্ট করা হয়েছে। আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী এখনো হীনম্মন্যতায় ভোগেন। সব ক্ষেত্রে তারা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব গেল গেল রব তোলেন। কিন্তু সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ় করার উপায় হলো অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো। আর সেটি সম্ভব আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমেই। তবে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য প্রতিবেশী বৃহৎ দেশগুলোরও উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তারা কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখলে ছোট দেশগুলোর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আঞ্চলিক যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করে একবার বলেছিলেন, ‘আমি সেই দিনের স্বপ্ন দেখি যেদিন একজন অমৃতসরে সকালের প্রাতরাশ সারবেন, লাহোরে দুপুরের খাবার খাবেন এবং রাতে কাবুলে গিয়ে নৈশভোজে অংশ নেবেন।’ আমরাও কি এ রকম স্বপ্ন দেখতে পারি না যে, সকালে ঢাকায় নাশতা খেয়ে (অবশ্যই সড়কপথে) ইয়াঙ্গুনে দুপুরের খাবারটি সারব আর রাতে কুনমিংয়ে নৈশভোজ সম্পন্ন করব?
আগামীকাল: সু চি কি পারবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.