বাকস্বাধীনতা ও কণ্ঠরোধের চেষ্টা! by মিজানুর রহমান খান

দীর্ঘকাল উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্তকেই প্রধান হুমকি হিসেবে দেখা গেছে। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাকস্বাধীনতার প্রতি হুমকি। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে টিআইবি নিয়ে যা ঘটল তা উপমহাদেশীয় উদ্বেগজনক প্রবণতা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। আবার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার পরিসর সংকুচিত হওয়ার ঘটনা ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনজনিত দুর্বিপাক থেকেও বিচ্ছিন্ন নয়।

ভারতের দৈনিক হিন্দুর শীর্ষ সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে সিদ্ধার্থ ভারাদারাজনকে। পত্রিকার মালিক চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির আলোকচিত্র প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপাতে হবে। সম্পাদক রাজি হননি। এরপর সিদ্ধার্থের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে ‘চার দুর্বৃত্ত’ পেটায়। তাঁর অধ্যাপক স্ত্রীকে হুমকি দেওয়া হয়।
থিরু বিরুপ্পনের তামিলভাষী জনপ্রিয় টক শো ১৭ বছর চলার পর গত ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ তিনি বলেছিলেন, মোদিকে ভোট দেওয়ার আগে ভাবুন। ১৭ মার্চে আল-জাজিরার একটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘ভারত এখনো মুক্তকথার দেশ নয়’। নির্বাচন সামনে রেখে বাধানিষেধের বেড়াজাল বাড়ছে। ওপেন ম্যাগাজিনের সাংবাদিক হরতোষ সিং মোদি ও রাহুল গান্ধীকে সমালোচনা করে নিবন্ধ লেখেন। তিনি চাকরি হারান। কারণ, মালিকপক্ষ ‘রাজনৈতিক শত্রু’ সৃষ্টি করতে চায়নি।
ভারতের বিখ্যাত লেখক অনন্য বাজপাই আল-জাজিরাকে বলেন, কংগ্রেস, শরিক সরকার, বিজেপি, কি বাম—কারও অবস্থানই পরিষ্কার নয়। বাকস্বাধীনতায় তাদের অসহিষ্ণুতা ও অবিশ্বাস সাধারণ ঘটনা। বাজপাই ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ক (সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি) ও ২৯৫ক (ধর্মবিশ্বাস) এর সংস্কার চান। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক ও শৈল্পিক লেখালেখিকে সুরক্ষা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিদ্বেষপ্রসূত ও ভুয়া মামলা থেকে সুরক্ষা দরকার। ১১ মার্চে তিনি তবু চার হাজার ৬০টি সইসহ আবেদনটির ইতি টানেন। ওই দুটো ধারা আমাদের দণ্ডবিধিতেও অবিকল আছে। বাজপাই জানেন ক্ষমতায় যিনিই আসুন, এই আইন কেউ বদলাবে না। ওখানে তবু সংস্কারের দাবি উঠেছে। এখানে তাও নেই। গলাটেপা রোগের বিষয়ে হালকাচালে নিন্দামন্দ করে সবাই চুপ থাকব। অস্ত্রোপচার করব না। বিষবৃক্ষের শিকড় ওপড়াব না।
বাংলাদেশ সংবিধানে বাকস্বাধীনতা যেভাবে আছে সেটা বুঝতে ভারত ও মার্কিন সংবিধানকে বুঝতে হবে। ভারতে ১৯৮৬ সালে একটি মামলা উঠল সুপ্রিম কোর্টে। স্কুলের তিনটি বাচ্চা জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকৃতি জানাল। কারণ, ওরা জেহভা ধর্মাবলম্বী। জাতীয় সংগীতে বর্ণিত ঈশ্বরে ওদের বিশ্বাস নেই। ওদের বহিষ্কার করা হলো। কেরালা হাইকোর্টে ওরা বিচার পেল না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বললেন, যুক্তিসংগত বাধানিষেধ দিয়ে নির্দিষ্ট আইন থাকতে হবে। ওরা আইন মান্যকারী। গান না গাইলেও ওরা গানের সময় দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানায়। আর ধর্মীয় স্বাধীনতার জায়গা থেকে জাতীয় সংগীত না গাওয়ার অধিকার তাদের আছে। হাইকোর্টের রায় নাকচ হলো। ওরা জিতল। কোর্ট বললেন, ধর্মীয় বিশ্বাসে গান না গাওয়া কোনো আইনে বারণ ছিল না। তাই বহিষ্কারাদেশ অবৈধ। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ওই যুক্তি আমাদের জন্যও প্রযোজ্য।
এটা বললাম এ কারণে যে দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা টিআইবি, সুজন এবং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছেন। নাগরিক সমাজের ভিন্নমত কীভাবে আইনবিরুদ্ধ, তা মন্ত্রীরা বলেননি। কোথায়, কীভাবে তাঁরা ‘যুক্তিসংগত বাধা’ অতিক্রম করেছেন, তা নির্দিষ্ট করুন। সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হোক। ১৫৩ জন বিনা ভোটে কী করে জিতলেন, তা উচ্চ আদালতে বিচার্য। এই রিটের শুনানি শুরু হচ্ছে। তাই আমরা কী বলব না খোদ সংসদের বৈধতা এখনো অমীমাংসিত।
টিআইবির ওপর আক্রমণ নতুন নয়। তাদের সূচকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের খেতাব দুই বড় দল পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। সংসদে প্রকৃত বিরোধী দল নেই। এ বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামানের যুক্তি সত্য। কিন্তু আগের সংসদেও কি ‘প্রকৃত বিরোধী দল’ ছিল? ৭০ অনুচ্ছেদ রেখে বৈধ বিরোধী দল দূরে থাক, সংসদীয়ব্যবস্থা চলতে পারে কি না, তা নিয়ে আমরা সংশয়গ্রস্ত। সব অবস্থায় কার্যকর দলের অস্তিত্ব একটারই থাকে, তার নাম ক্ষমতাসীন দল।
গণতন্ত্রে বহুমত থাকবেই এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতেই হবে। টিআইবির মন্তব্য যুক্তিনির্ভর। ডেপুটি স্পিকার যদিও টিআইবির অভিমতকে খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলেছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলার অধিকার তাঁর আছে। নাগরিক সমাজের আয়ের উৎস বের করতে তদন্তের প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। কিন্তু টিআইবির সঙ্গে কথিত মতে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক থাকা এবং খালেদা জিয়ার সঙ্গে টিআইবির পার্থক্য খুঁজে না পাওয়া কার্যত বিদ্বেষপ্রসূত। ‘নির্বাচন শুধু জনগণের জন্য, সন্ত্রাসীদের জন্য নয়’ এই মন্তব্য আমাদের যারপরনাই বিচলিত করে।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হাতে গোনা কয়েকজনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হলেও অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েক শ বা কয়েক হাজার।’ এ জন্য তাঁকে নিন্দা করা, তাঁকে নীরব করে দেওয়া উত্তর নয়। এর উত্তর হলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দেবেন। সেখানে আমরা দেখব, সংখ্যাটা ‘হাতে গোনা’ কি না? ‘অজ্ঞাতনামারা’ কয়েক শ, নাকি কয়েক সহস্র। এজাহার তো অত্যন্ত বাসি খবর। অবিলম্বে আমরা ওসব মামলার অগ্রগতি জানতে চাই। দাখিল করা অভিযোগপত্রে উল্লিখিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা জানতে চাই। বিচারের হাল কী জানতে চাই।
একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী করে মিজানুর রহমানের কাছে ‘হামলাকারীদের নাম’ জানতে চান। এ কাজ তো তাঁর নয়। তাই বিস্ময় প্রহসনমূলক হয়ে ওঠে যখন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেন তিনি নাম বললেন না? কারণ এরা হলো সেই শক্তির বংশদলীয় ও তাদের ধারক। এরা তাদের খরচ জোগায়।’ এই বক্তব্য সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদকে অন্তত তিন শর্তে লঙ্ঘন করেছে। মন্ত্রীর ওই মন্তব্য প্ররোচনামূলক বটে।
ক্ষমতাসীন দলের আরেকজন প্রবীণ নেতা অপ্রিয় বাস্তবতা উচ্চারণ করেছেন। ‘এই সমাজে দুই জাতের বুদ্ধিজীবী আছে।’ তাঁর কথায়, ‘আমাদের (আওয়ামী) বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য রয়েছে। তাঁরা স্পষ্ট করে কথা বলেন না। যেটা প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই যায়।’ এটা বুদ্ধিবৃত্তিক বাংলাদেশকে ভাগ করার স্বীকৃতি। একে জোড়া লাগাতে হবে। আমাদের বুদ্ধিজীবী। আমাদের সাংবাদিক। আমাদের কবি। আমাদের পেশাজীবী। সবই ঠিক থাকবে। কেবল ‘আমাদের’ শব্দটি আওয়ামী ও বিএনপি তরিকামুক্ত করে নৈতিক বাংলাদেশনির্ভর করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, আপাতত এই ‘আমাদের’ কিংবা ‘ওদের’ ছাড়া এই রাষ্ট্রে তাঁরা আর কাউকে থাকতে দেবে কি না। মিজানুর রহমান ইচ্ছা-অনিচ্ছায় একটি নাজুক সংস্থার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। ক্ষমতাসীনরা সেটুকুও সইতে পারছেন না।
সরকারি ও তাদের মিত্র ‘বিরোধী দলের’ দায়িত্বশীল নেতাদের অসংযত মন্তব্য আমাদের উদ্বিগ্ন করে। তাঁরাও ভাবেন মুক্তকথাই এখন একমাত্র হুমকি। তাই আঘাত হানো। শাসকদের বুঝতে হবে এই রাষ্ট্রে বাকস্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা কোনো নির্বাচন বা সরকারের বৈধতার ওপর নির্ভর করে না। এটা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ থেকে এসেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ একটি বদ্ধ সমাজে পরিণত হতে চলেছে। ভিন্নমতের ওপর আক্রমণ চলছে। একটি একতরফা নির্বাচনের পরে বাকস্বাধীনতাকে এভাবে রুদ্ধ করার প্রবণতা শুভ নয়। সরকারকে এখন কেবল সহনশীল হলেই চলবে না, তার উচিত সমালোচনাকে আহ্বান জানানো।
প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সংসদের সমালোচনা করা নাগরিকের বাকস্বাধীনতার সীমার মধ্যে পড়ে কি না। পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ টিআইবিকে ‘সহিংসতা উসকে’ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু সেটা কীভাবে তা নির্দিষ্ট করেননি। তাদের বক্তব্য কি আশু হুমকি বয়ে এনেছে? এটা প্রমাণ করা যাবে না। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের উক্তি তাই দায়িত্বহীন। সরকার অন্যায্য নির্বাচন করেছে। এখন তার বায়না হচ্ছে তাকে বৈধতার সনদ দিতে হবে নবম সংসদের মতো।
ভিন্নমতের বিরুদ্ধে যে প্রবণতা ক্রমে তীব্র হচ্ছে, যে অভিযোগ তাঁরা মুখে বলছেন, সেটা প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহ বটে। যুক্তরাষ্ট্র ১৭৯১ সালে প্রথম সংশোধনী পাস করে বলেছিল কংগ্রেস বাকস্বাধীনতাকে খর্ব করে কোনো আইন করবে না। ১৭৯৮ সালের মার্কিন রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটা তাই টিকল না। ভারত রাষ্ট্রদ্রোহ-সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক ১২৪ক রেখে দিলেও জওহরলাল নেহরু থেকে অমর্ত্য সেন তাকে ‘সেকেলে ও উদ্ভট’ মনে করেন। বাংলাদেশের শাসককুল ভুলেও এটা স্বীকার করে না। সত্য বটে ভারতের অর্থলোভী রাজনীতিকেরাও এ থেকে বেরোতে চান না। আসলে ভিন্নমত দলনে, ভয় পাইয়ে দিতে একে বর্ম হিসেবে ব্যবহারের লোভ সামলানো কঠিন। অরুন্ধতী রায় ও ড. বিনায়ক সেনদের শায়েস্তা করার অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে গেলে চলবে কি করে?
ভারতীয় কার্টুনিস্ট অসীম ত্রিবেদিকে দুই বছর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি তাঁর কার্টুনে ভারতের সংসদ নিয়ে টয়লেট, নর্দমা এঁকেছেন। লন্ডনের গার্ডিয়ান তাঁর কার্টুন ছেপেছে, পাকিস্তানি সন্ত্রাসী আজমল ভারতীয় সংবিধানের ওপর প্রস্রাব করছে। রাষ্ট্রদ্রোহ ও সংসদকে ঠাট্টার দায়ে অসীম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সংসদে জ্বালাময়ী বক্তৃতাও হলো। কিন্তু তা প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নয়। ভারতের প্রেস কাউন্সিলের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি মারকান্ডেকাজু। তিনি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। তিনি বললেন, ‘এটা তাঁর বাকস্বাধীনতার অংশ। অসীম অবৈধ কিছুই করেননি।’ ২০ মার্চ লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস-এ পড়লাম। কয়েক দশক ধরে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, নাগরিক অধিকারকর্মীদের সুরক্ষা দিতে প্রথম সংশোধনী ছিল লিবারেলদের রক্ষাকবচ। এখন রক্ষণশীলরা একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
আমাদের সংশোধনীর কমতি নেই। দুর্ভাগ্য আমাদের বাকস্বাধীনতা সংরক্ষণ করে, তেমন সংশোধনী নেই। রক্ষাকবচ নেই। টিআইবি, সুজন ও মিজানুর রহমানকে যা নিয়ে সমালোচনা, তা দুর্ভাগ্যজনক। সংসদ ও সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ রেখে এখন কণ্ঠরোধের এতখানি চেষ্টা, পরিহাসমূলকই মনে হয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.