গদ্যকার্টুন- কৌতুকের বিষয় নয় by আনিসুল হক
প্রেসিডেন্ট বুশ গেছেন একটা স্কুলে।
বাচ্চাদের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন। বক্তৃতার পরে প্রশ্নোত্তর। একটা ছেলে
দাঁড়াল। সে বলল, আমার দুইটা প্রশ্ন আছে। এক. আপনি কম ভোট পেয়েও কীভাবে
দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, ইরাকে কোনো
ডব্লুএমডি বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও কেন ইরাকের ওপরে আক্রমণ
করা হলো। এই সময় ঘণ্টা বাজল।
বুশ বললেন, এখন বিরতি। বিরতির
পরে আবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। বিরতির পরে প্রশ্নোত্তর পর্ব আবার
শুরু হলো। এবার আরেকটা ছেলে দাঁড়াল। সে বলল, আমার তিনটা প্রশ্ন আছে। এক.
আপনি কম ভোট পেয়েও কীভাবে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। দ্বিতীয়
প্রশ্ন হলো, ইরাকে কোনো ডব্লুএমডি বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও
কেন ইরাকের ওপরে আক্রমণ করা হলো। তিন নম্বর প্রশ্ন হলো, একটু আগে আমার যে
বন্ধুটি আপনাকে দুটো প্রশ্ন করেছিল, সে কোথায়? কেন তাকে আর খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে না?
ওপরেরটা নিতান্তই কৌতুক। কিন্তু আমাদের সংবাদমাধ্যমে খবর আসছে, মানুষজন হারিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
বিরোধী দল অভিযোগ করছে, বিশেষ করে বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও সাহায্যদাতা দেশগুলোর কাছে এই অভিযোগ বেশ শক্তপোক্তভাবে পেশ করা হচ্ছে যে, সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ‘ক্রসফায়ার’ করছে, কিংবা তারা স্রেফ হারিয়ে যাচ্ছে। এই অভিযোগ গুরুতর। এর আগে অবশ্য বিএনপির একটা তালিকা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলব, একজনও যদি বিনা বিচারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা নিহত বা নিগৃহীত হয়ে থাকে, তাহলে তা অনেক বড় অভিযোগ। সেই অভিযোগের তদন্ত করতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তা সরকারকে জানাতে হবে। তা জানার অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের আছে।
আজ আমি অরণ্যে রোদন লিখছি না। আজ আমি গদ্যকার্টুন লিখতে বসেছি। তাই আমার রসিকতা করার চেষ্টা করা উচিত। আমার বলা উচিত: ভাই, ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যুর পরে আপনারা যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন, তা গৎবাঁধা, পুরোনো। তাতে কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতার বড়ই অভাব। একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী ধরা পড়ে। তারপর তাকে নিয়ে যান অস্ত্র উদ্ধারে। পথে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে। তখন গোলাগুলি হয়। সেই গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ধরা পড়া সন্ত্রাসীটাই মারা যায়। আপনারা এই এক কাহিনি কেন প্রচার করেন।
আপনারা বলতে পারেন:
১. বজ্রপাতে সন্ত্রাসী নিহত। সন্ত্রাসীকে ধরে এক জেল থেকে আরেক জেলে নেওয়া হচ্ছিল। পথে ফেরি পারাপারের সময় তাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়। এই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে সে মারা যায়। লাশ ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে।
২. পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সন্ত্রাসীর আত্মহত্যা। এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে জেলখানার বাগানে কাজের জন্য নেওয়া হলে সে পুলিশের রিভলবার কেড়ে নিয়ে নিজের মাথায় নিজেই গুলি করে। কর্তব্যে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশকে ক্লোজড করা হয়েছে।
৩. গলায় পায়জামা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা। কুখ্যাত সন্ত্রাসী নিজের কৃতকর্মের কারণে মানসিক অস্থিরতায় ভুগে আত্মহত্যা করেছে। সে পায়জামা গলায় পেঁচিয়ে জানালার পাল্লার সঙ্গে বিশেষ কায়দায় বেঁধে আত্মহত্যা করে।
কিন্তু এই রকম একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে আমরা রসিকতা করতে পারি না। মানবাধিকার কমিশন অন্তত একটা ক্ষেত্রে তদন্ত করেছে। এবং বলেছে, এটা ক্রসফায়ার নয়। এটা হত্যাকাণ্ড।
৬ মার্চ ২০১৪-এর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবর: ‘“বন্দুকযুদ্ধে” দিনমজুর নিহত চুয়াডাঙ্গায়। পরিবারের দাবি “সাজানো নাটক”’।
আইনের বাইরে কোনো কাজ কেউ করতে পারে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরাও না। কেউ কোনো অপরাধ করলে বিচার হবে, বিচারে আদালত শাস্তি দিলে আইন মেনে সেই শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমি নিজে সারা পৃথিবী থেকেই মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোথাও কেউ নেই নাটকে আমরা দেখেছি, খুন না করা সত্ত্বেও বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়। এ রকমের বহু সত্য ঘটনা সারা পৃথিবীতে আছে। একজনের অপরাধে কোনো একজন নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনেক পরে বোঝা গেছে, বিচারে ভুল হয়ে গেছে।
আলেকজান্ডার একবার ডায়োজেনিস নামের এক দার্শনিকের সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই জ্ঞানী ব্যক্তি তখন রোদের মধ্যে শুয়ে ছিলেন একটা চৌবাচ্চায়। আলেকজান্ডার এমনভাবে দাঁড়ান, তাতে তাঁর ছায়া পড়ে ডায়োজেনিসের গায়ে। আলেকজান্ডার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি। দার্শনিক উত্তর দেন, আপনি আমার রোদ আটকে রেখেছেন। দয়া করে সরে যান। আমাকে রোদ পোহাতে দিন। যা আপনি আমাকে দিতে পারেন না, তা আপনি আমার কাছ থেকে কেড়েও নিতে পারেন না।
আমরা কারও জীবন দান করতে পারি না। তাই কারও জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের কারও নেই। বিনা বিচারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হোক, এটা আমরা চাই না।
আমাদের দেশে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। পৃথিবীর অনেক দেশে আছে। আমেরিকারও অনেক রাজ্যে আছে। আমেরিকানরা ওসামা বিন লাদেনকে যেভাবে হত্যা করেছে, যেভাবে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে ভূমিকা রেখেছে, তাতে তাদের কাছ থেকে এই বিষয়ে সদুপদেশ অনেকটাই পরিহাসের মতো শোনাবে।
কিন্তু আমরা আমাদের সংবিধান, আইনের শাসন ও সভ্যতার প্রতি অঙ্গীকারের স্বার্থে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে চাই।
আমার আকুল আবেদন হলো, দরকার হলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করুন। এক মাসের মধ্যে বিচার করে অপরাধ প্রমাণ করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিন। কিন্তু ক্রসফায়ার বন্ধ করুন।
সন্ত্রাসীরা যখন মানবাধিকার হরণ করে, মানুষ হত্যা করে, দেশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করে, তখন কোথায় থাকে মানবাধিকারের প্রবক্তারা? এই কথা আমরা শুনি। ওরা মানুষের অধিকার হরণ করে বলেই ওদের বিচার চাই। ওরা মানবাধিকারের শত্রু, মানুষের শত্রু। কেউই ওদের প্রশংসা করে না। কিন্তু রাষ্ট্র নিজে তা করতে পারে না। এমনকি অপরাধীদের বেলায়ও তা করতে পারে না।
আমার একটা আশঙ্কা হচ্ছে; বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণগুলো এই সরকারের জন্য একিলিসের গোড়ালি হতে যাচ্ছে। যেহেতু এই সরকার সংবিধানমোতাবেক একটা নির্বাচন করে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে, অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও শক্তি আইনত এর বিরোধিতা করতে পারছে না।
এই সরকারের বিরোধিতা করার জন্য তারা ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। সরকার যদি নিজের ভালো বোঝে, তাহলেও তাদের এসব বন্ধ করা উচিত।
মানুষ মাত্রই ভুল হয়। লিমনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, অপরাধী শনাক্ত করতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। এই রকম একাধিক ভুল অন্যান্য সরকারের আমলেও ঘটেছে বলে আমরা খবরের কাগজে পড়েছি। কুখ্যাত সন্ত্রাসীর বদলে অন্য কাউকে ভুলক্রমে ধরা হয়েছে এবং তাকে ক্রসফায়ারে নেওয়ার পরে টের
পাওয়া গেছে যে ভুল হয়ে গেছে। যা-ই হোক, ভুল লোক হোক বা ঠিক লোক হোক, আইনানুগভাবে বিচার না করে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments