মিডিয়া যখন মোদির চিয়ারলিডার by কাজী আলিম-উজ-জামান
যেকোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনে গণমাধ্যমের
একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল, ব্যক্তি গণমাধ্যমকে নিজেদের
মতো করে কাজে লাগাতে চায়। গণমাধ্যমকে তারা ব্যবহার করতে চায়, তাদের
প্রচারযন্ত্র হিসেবে। কিন্তু গণমাধ্যমের পক্ষে তো কারও প্রচারযন্ত্র হওয়া
সম্ভব না। প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের কাজও সেটি নয়। চূড়ান্তভাবে গণমাধ্যমের
কাজ নির্মোহভাবে ঘটনাকে তুলে ধরা।
অবশ্য এ নিয়েও বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, গণতন্ত্র, মানুষ ও সমাজের স্বার্থে গণমাধ্যম নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। আবার নিরপেক্ষতার নামে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন করা গণমাধ্যমের কাজ হতে পারে না।
ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচনটি বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ। কংগ্রেস দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে লড়তে যাচ্ছে। এপ্রিলে ও মে মাসে নয় দফায় ভোট গ্রহণ হবে। যদিও সাম্প্রতিক কিছু বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ফল হতাশাজনক। দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আছে।
অপরদিকে ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি আছে টপ গিয়ারে। এই দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি প্রতিদিনই কথার তুবড়ি ফুটিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকছেন। যে প্রবণতাটি লক্ষণীয়, তা হলো ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রভাবশালী অংশটি লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। হিন্দি, ইংরেজি ও অপরাপর আঞ্চলিক ভাষার বেশির ভাগ গণমাধ্যম কখনো প্রকাশ্যে, কখনো ইনিয়ে-বিনিয়ে বিজেপিকে সমর্থন করছে।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গণমাধ্যমের কাছে সমালোচিত, প্রায় নিষিদ্ধ এক চরিত্র। এক দশকের মধ্যে সেই ভাবমূর্তি গঙ্গার জলে ধুয়ে তিনি হয়েছেন মনোহরণ নেতা। যেখানে মোদি, সেখানেই বিপুল আড়ম্বরে মিডিয়ার উপস্থিতি। গণমাধ্যমের কাছে মোদি এখন মেরুকরণে অভিযুক্ত কোনো সাম্প্রদায়িক নেতা নন, বরং একজন দক্ষ শাসক, যিনি জনগণকে সুশাসন দিয়েছেন।
অপরদিকে নির্বাচন সামনে রেখে মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য বাড়তি কোনো চেষ্টা কংগ্রেসের নেই। দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী চুপ, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও স্বভাবসুলভ নীরব। রাহুল গান্ধী কোনো সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন না। সভা-সমাবেশ শেষে সাংবাদিকদের আলাদা কোনো প্রশ্নও নেন না। এই ২৪ ঘণ্টার সংবাদ প্রচারের যুগে নীরবতা অবশ্যই দুর্বলতার পরিচায়ক।
কেবল তা-ই নয়, বরং কংগ্রেসের কেউ কেউ ভারতীয় গণমাধ্যমকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে সাংবাদিক-সমাজকে খেপিয়ে তুলছেন। ‘পেড নিউজে’ সংবাদপত্রের পাতা ভরা থাকে, তাই সাংবাদিকদের উচিত ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতির দিকে আঙুল তোলার পাশাপাশি নিজেদের দুর্নীতিটা একটু পরখ করে নেওয়া। কপিল সিবাল, গুলাম নবী আজাদসহ অনেক নেতা চাঁচাছোলা ভাষায় এভাবে আক্রমণ করেছেন সংবাদমাধ্যমকে। কেউ কেউ এও বলছেন, মোদির আজকের এই জনপ্রিয়তা গণমাধ্যমেরই তৈরি।
২.
আরেকটি
প্রবণতা লক্ষণীয়, যেটি যথেষ্ট চমকপ্রদ। একে তো মূল ধারার গণমাধ্যমের বড়
একটি অংশ মোদির পক্ষে আছে, তার পরও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে, মিডিয়া
মোটের ওপর মোদির বিপক্ষে। গণমাধ্যম পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এটা বিজেপির
সমর্থকদের একটি কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরনের অভিযোগ তুলে গণমাধ্যমের
নিরপেক্ষতার ওপর চাপ সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য।
ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক গণমাধ্যমে মোদির ‘ফলোয়ার’ নাকি আছেন ১৫ লাখ। ইন্টারনেটে যাঁরা মোদির জন্য লড়ছেন, তাঁরা অভিহিত হচ্ছেন ‘ইন্টারনেট হিন্দু’ নামে। এই ইন্টারনেট হিন্দুরা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী হিন্দুদের সংগঠিত করছেন।
ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক গণমাধ্যমে মোদির ‘ফলোয়ার’ নাকি আছেন ১৫ লাখ। ইন্টারনেটে যাঁরা মোদির জন্য লড়ছেন, তাঁরা অভিহিত হচ্ছেন ‘ইন্টারনেট হিন্দু’ নামে। এই ইন্টারনেট হিন্দুরা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী হিন্দুদের সংগঠিত করছেন।
৩.
বিজেপির
পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, গণমাধ্যম কিছু হলেই কেবল ২০০২ সালে গুজরাটের
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ফিরে যায় এবং পুরো ঘটনার জন্য তাদের দায়ী করে। কিন্তু
এর আগেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৮৪ সালে শিখবিরোধী
দাঙ্গা, নব্বইয়ের আগের দাঙ্গা, সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে
সংবাদমাধ্যম। এই অভিযোগের কিছু হয়তো সত্যি। কারণ ওই সময় ভারতে ইলেকট্রনিক
মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত ছিল না। ছিল না ২৪ ঘণ্টার কোনো নিউজ চ্যানেল।
বিজেপি আরও অভিযোগ করে, গণমাধ্যম মোদির সবকিছুকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, এমনকি তাঁর উন্নয়নকাজও। তিনি কোনো সময় ন্যায্য আচরণ পান না। এই অভিযোগের মধ্যেও সত্যতা থাকতে পারে। কারণ কিছু সাংবাদিক মোদির প্রশংসা করে তাঁকে আকাশে তুলে দেন। আবার কিছু সাংবাদিক তাঁর কোনো ভালো দেখতে পান না। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতা কখনো জনসংযোগ নয়, আবার কারও চরিত্র হননও নয়। এখানে গণমাধ্যমের উচিত ছিল, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতা সঠিকভাবে তুলে ধরা।
বিজেপি আরও অভিযোগ করে, গণমাধ্যম মোদির সবকিছুকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, এমনকি তাঁর উন্নয়নকাজও। তিনি কোনো সময় ন্যায্য আচরণ পান না। এই অভিযোগের মধ্যেও সত্যতা থাকতে পারে। কারণ কিছু সাংবাদিক মোদির প্রশংসা করে তাঁকে আকাশে তুলে দেন। আবার কিছু সাংবাদিক তাঁর কোনো ভালো দেখতে পান না। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতা কখনো জনসংযোগ নয়, আবার কারও চরিত্র হননও নয়। এখানে গণমাধ্যমের উচিত ছিল, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সাফল্য-ব্যর্থতা সঠিকভাবে তুলে ধরা।
৪.
গণমাধ্যম
ভোটারদের কতটা প্রভাবিত করতে পারে, আদৌ পারে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে।
যেমন আমরা প্রায়ই দেখি, ভারতীয় গণমাধ্যমে লালু প্রসাদ যাদব ও মায়াবতীকে খুব
দৃষ্টিকটুভাবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু তাতে আরজেডি ও বিএসপি নেতার
জনপ্রিয়তা বা ভোটে কোনো হেরফের হয়েছে, তা কেউ বলতে পারবে না।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে মূল ধারার গণমাধ্যমের বড় অংশটি কেন বিজেপির পক্ষ নিচ্ছে, সেটা একটা ধাঁধা বটে। কেউ কেউ এটাকে গণমাধ্যমের বাজারমুখিনতা বলছেন।
আসলে সাংবাদিকদের কোনো রাজনীতিবিদের প্রতি সমর্থন বা বিদ্বেষ থাকা ঠিক নয়। সাংবাদিকেরা একটিভিস্টও নন, ন্যাশনালিস্টও নন। সাংবাদিকেরা কেবলই জার্নাালিস্ট।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
ইমেইল: alim_zaman@yahoo.com
এবারের লোকসভা নির্বাচনে মূল ধারার গণমাধ্যমের বড় অংশটি কেন বিজেপির পক্ষ নিচ্ছে, সেটা একটা ধাঁধা বটে। কেউ কেউ এটাকে গণমাধ্যমের বাজারমুখিনতা বলছেন।
আসলে সাংবাদিকদের কোনো রাজনীতিবিদের প্রতি সমর্থন বা বিদ্বেষ থাকা ঠিক নয়। সাংবাদিকেরা একটিভিস্টও নন, ন্যাশনালিস্টও নন। সাংবাদিকেরা কেবলই জার্নাালিস্ট।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
ইমেইল: alim_zaman@yahoo.com
No comments