দেয়াল-বিতর্ক- সংসদ ভবন ও ইতিহাসকে মুক্তি দিন by আদনান মোর্শেদ
জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণকাজ শুরুর ৫০ বছর
পূর্তির বছরে আমরা জানলাম একটি দুঃসংবাদ। ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর তখনকার
পূর্ব পাকিস্তানে স্থপতি লুই কানের হাতে জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু
হয়। যখন এই বিশ্বনন্দিত স্থাপত্যের অর্ধশতাব্দী পূর্তি উদ্যাপন করার কথা,
তখন নিরাপত্তার নামে একে ঘিরে ফেলার সরকারি সিদ্ধান্ত খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
নিরাপত্তার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা গণতন্ত্রের দম বন্ধ করে ফেলতে পারে না। আমরা ভুলতে পারি না যে ডেমোক্রেসির ডেমো মানে গণ আর ক্রাতোস মানে শক্তি। গণতন্ত্র হলো জনগণের ক্ষমতা। দুনিয়াজুড়েই সরকারি ভবনের গণতান্ত্রিক মহিমা রক্ষায় সেখানে জনগণের প্রবেশাধিকার রাখা হয়। শারীরিকভাবে সম্ভব না হলেও সেসব ভবন মানুষের দৃষ্টির গোচরে রাখা হয়। সংসদ ভবনের চারপাশে আট ফুট উঁচু ধাতব বেড়া দেওয়া তাই গণতন্ত্রের ধারণার বরখেলাপ, নিরাপত্তাভীতির বিকার এবং তর্কসাপেক্ষভাবে আইনের লঙ্ঘন।
সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার দায়িত্ব পাওয়ার পর লুই কান ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এর পাঁচ বছর আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেন। ১৯৬০ সালে সামরিক শাসনের মধ্যেই সেই সেনানায়ক পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে ‘নির্বাচিত’ হন। ১৯৬২ সালে প্রণীত পাকিস্তানের নতুন সংবিধান নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে ১৯৬৫ সালে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে আইয়ুব সজাগ ছিলেন। নিজেকে পুনর্নির্বাচিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে আইয়ুব খান বাঙালিদের বঞ্চনার অনুভূতিকে ধাপ্পা দিতে নতুন কৌশল নেন। ইতিমধ্যে ভাষা আন্দোলনের দ্বারা জাগরিত বাঙালিরা পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্যের দাবি করে আসছিল। এ অবস্থায় তাদের সামনে তিনি দেন দ্বিতীয় রাজধানীর টোপ। অর্থাৎ ইসলামাবাদ হবে প্রধান রাজধানী, তারপরে জায়গা হবে ঢাকার। এই সামরিক শাসক ধারণা করেছিলেন ঢাকায় এক অতিকায় ভবন তৈরি করা হলে তা বাঙালিদের মধ্যে ক্ষমতার অনুভূতি জাগাবে এবং বিনিময়ে আসন্ন নির্বাচনে তিনি তাদের ভোট পাবেন। এটা যে আইয়ুব খানের নিছক একটা রাজনৈতিক ধাপ্পা ছিল, তাতে কোনো সন্দেহই থাকে না যখন দেখি তিনি তাঁর আত্মজীবনী ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স (১৯৬৭) বইয়ে এর কোনো উল্লেখই করেন না।
এর পরের রাজনৈতিক নাটক নিজেই ব্যাখ্যা করে কীভাবে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ‘ঘুষ’ হয়ে না থেকে এই ভবন দিনে দিনে বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ের নির্মাণপ্রযুক্তি নিয়ে, পাটের রশিতে বাঁধা বাঁশের মাচার ওপর লুঙ্গি-শাড়ি পরা নির্মাণশ্রমিকেরা যেভাবে এই অতিকায় ভবন গড়ে তুলেছিলেন, ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে তাঁরা আসলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে জাতির সংকল্পশক্তিকে প্রদর্শন করছিলেন।
এর মধ্যে লুই কানকে ইসলামাবাদে নতুন একটি পার্লামেন্ট ভবন কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানকার সরকারি আমলাতন্ত্র কানের কাছে দাবি করেছিল তিনি যাতে সেই ভবনকে সুস্পষ্টভাবে ‘ইসলামি’ দৃশ্যরূপ দেন। এ ধরনের অন্যায় হস্তক্ষেপে হতাশ হয়ে কান কাজ ছেড়ে দেন (ঘটনাক্রমে আরেকজন মার্কিন স্থপতি ডারেল স্টোন তুলনায় অনাকর্ষণীয় সেই পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণ করেন)।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রাজনৈতিক ইসলামের ভূমিকা ছিল না। এ জন্যই কানের কাছে সংসদ ভবনের নির্মাণশৈলীতে ইসলামি স্থাপত্যকলার বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত গম্বুজ ও খিলান অন্তর্ভুক্তির দাবি আসেনি। লুই কান বঙ্গীয় বদ্বীপ, এর নদী, এর বিস্তৃত সবুজ, এর প্রসারিত সমভূমি, এর উঁচু ভিটায় তৈরি ঘরবাড়ি এবং এর ভূমি-জলে মেশানো ভূপ্রকৃতি থেকে সংসদ ভবনের নকশার প্রেরণা খুঁজছিলেন।
ঢাকায় আসার অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ান এবং এই মৌসুমি জলবায়ুর দেশের জীবন বুঝতে নদীতীরের দৃশ্যাবলির রেখাচিত্র (স্কেচ) তৈরি করেন। ১৯৫০-এর দশকে তাঁর অধীত চিরায়ত গ্রিক-রোমান ও মিসরীয় স্থাপত্যকলার বিদ্যার সঙ্গে বাংলার স্থানীয় ছাপের মিশ্রণ ঘটাতে তাঁর কোনো অসুবিধাই হয়নি।
কান সে ধরনের স্থপতি নন, যিনি তাঁর নকশা করা সরকারি ভবনে দেশীয় বা জাতিগত পরিচয়কে হেয় করবেন। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর নকশা থেকে ধীরে ধীরে একটি অবয়ব দৃশ্যমান হতে থাকল এবং মাথা তুলল কংক্রিটের দেয়াল (কোনো কোনো সূত্রের মতে গড়ে দৈনিক পাঁচ ফুট করে)। যতই কানের নির্মিত প্রাসাদ মাথা তুলতে থাকল, ততই জাগ্রত বাঙালিরা তার মধ্যে জাতি হিসেবে গঠিত হওয়ার জন্য অনস্বীকার্য জাতীয় মিথের অস্তিত্ব অনুভব করতে লাগল। শহীদ মিনার যেভাবে ১৯৫০-এর দশকের ভাষা আন্দোলনের চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, সংসদ ভবন তেমনি ষাটের দশকের স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মানসিকতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তড়িঘড়ি করে পূর্ব পাকিস্তানে কানের দপ্তর বন্ধ করা হলো এবং নির্মাণকাজও স্থগিত হয়ে গেল। সেখানে কেবল দাঁড়িয়ে ছিল একটি অর্ধসমাপ্ত রহস্যময় ভবন। তার পরও তা হয়ে ছিল বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের অদম্য প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা পরিহাসময় গল্প চালু ছিল, পাকিস্তানি পাইলটরা ভবনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মনে করে এর ওপর আর বোমা ফেলেনি!
১৯৮০-এর দশকে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে দেখা গেল সেই ধ্বংসপ্রতীকই দেশটির অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। হাজার টাকার নোটের গায়ে, ডাকটিকিটে, রিকশার অলংকরণে, বিজ্ঞাপনে, সরকারি পুস্তিকায় এবং কতভাবে তার ছবি ব্যবহূত হতে থাকল! গোটা দুনিয়ার স্থাপত্যশিক্ষায় সংসদ ভবনের নকশা কেবল অধ্যয়নই করা হয় না, এর ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু নিয়েই গবেষণা হয়। বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরও অনেক ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবন আছে। কিন্তু বিশ্ব স্তরে এটাই হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচয়সূচক প্রতীকী ভবন।
দুনিয়ার সব মহাদেশ থেকেই পর্যটকেরা এটি দেখতে আসেন। কয়েক বছর আগে আমি ৪০ জন আমেরিকান স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও বিনিয়োগকারীর একটি দল নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম। তাঁদের সবারই উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদ ভবন দেখা। তাঁদের একজন ছিলেন জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরিতে নিয়োজিত একটি নকশাবিদ দলের সদস্য। তিনি আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় বসে লুই কানের কাজের সহযোগী হয়েছিলেন। সংসদ ভবনে প্রবেশ করে তিনি অভিভূত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেই প্রথম তিনি এমন একটি ভবনের জাদুকরি সৌন্দর্য অনুভব করতে পারলেন, দুনিয়ার অপর প্রান্তে বসে যিনি নিজেও এর নকশা তৈরিতে জড়িত ছিলেন। তাঁর কাছে এটা তীর্থ ভ্রমণের চেয়ে কম কিছু ছিল না।
বোঝা মুশকিল, সরকার কেন বুঝতে চাইবে না কীভাবে এই ভবন বাংলাদেশের অতীত ও ভবিষ্যতের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। জাতীয় ঐতিহ্যের একটি ভবন যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে কেন সেটাকে সংরক্ষণ করবে না? সংসদ ভবনের চারপাশে দেয়াল তোলা মানে ইতিহাসকে বাক্সবন্দী করা, তাকে গুদামঘরে ঠেলে ঢোকানো, প্রতিদিনের ব্যবহার থেকে সরিয়ে ফেলা। গণতন্ত্রের আকুতি জাগিয়ে রাখা দেশের প্রতীক হয়ে থাকতে পারে না এ রকম দেয়ালবন্দী ভবন। বাংলাদেশের বয়স যখন ৫০ হবে, বাংলাদেশ যখন একটি আত্মবিশ্বাসী, আলোকিত এবং মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেই দেশের প্রতীক হতে পারে না এ ধরনের একটি দেওয়ালবন্দী ভবন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আদনান মোর্শেদ: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, স্কুল অব আর্কিটেকচার অ্যান্ড প্ল্যানিং, ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন ডিসি।
No comments