একটি ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী শক্তি অর্জন করল কীভাবে? by বদরুদ্দীন উমর
কোন
সব ইস্যু সামনে রেখে নির্বাচন হবে তার পরিবর্তে কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে
নির্বাচন হবে এটাই যেখানে নির্বাচনের মূল ইস্যু, সেখানে সমাজ এবং সামাজিক,
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা কত পিছিয়ে আছে এটা বোঝা কোনো কঠিন কাজ নয়।
বাংলাদেশে শাসকশ্রেণীর রাজনীতিবিদদের অর্ধশিক্ষিত ও অশ্লীল কথাবার্তা থেকে
নিয়ে তাদের সহযোগী বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিচর্চার একটা বিশেষত্ব এই যে, এরা
কোনো কোনো ঘটনা বা বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তোলপাড় করলেও এসব ঘটনা কেন ঘটছে এ
বিষয়ে চিন্তা করার কোনো ব্যাপার এদের নেই। সেটা যদি থাকত তাহলে এদেশের অনেক
সমস্যার সমাধান শাসকশ্রেণীর লোকদের দ্বারা সম্ভব হতো। কারণ যেখানে জানা
নেই এবং জানার চেষ্টা নেই, সেখানে কোনো সমস্যার সমাধানও যে সম্ভব নয় এটা এক
স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রধানত খিস্তিখেউড়।
শাসকশ্রেণীর প্রত্যেকটি দলই এ বিষয়ে পারদর্শী, তবে আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী
শেখ হাসিনা অন্যদের পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে। বস্তুতপক্ষে তারাই হলেন এই
রাজনৈতিক ভাষার প্রবর্তক।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল সমগ্র রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দূষিত করে দেশকে এক চরম সংকটজনক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এর একটি হল আওয়ামী লীগ এবং অন্যটি জামায়াতে ইসলামী। এই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই দেশে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তান আমলের থেকে অনেক শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হল- এ প্রশ্ন কি যথাযথভাবে এদেশে শাসকশ্রেণীর দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অথবা শাসকশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী মহল থেকে কেউ উত্থাপন করেছেন? এক্ষেত্রে তাদের উভয়েরই অচিন্তিত সিদ্ধান্ত হল, জিয়াউর রহমান এর জন্য দায়ী। তিনিই ক্ষমতায় বসে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে তারা এদেশে নতুনভাবে সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়েছে। এর থেকে স্থূল বক্তব্য আর কী হতে পারে?
সমাজে কোনো কিছুই হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে না। কোনো ঘটনা ঘটার শর্ত যদি আগে তৈরি না হয় তাহলে সে ঘটনা হঠাৎ করে ঘটতে পারে না। জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবন ও শক্তি সঞ্চয়ের ভিত্তি আসলে রচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলেই। শেখ মুজিব জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন ঠিক, কিন্তু আইনগতভাবে তাকে অসুবিধায় ফেললেও খুব কার্যকরভাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবনের শর্ত সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ১৯৭২ সালেই শুরু করে দ্রুত শেষ না করে তিনি বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধীকে কিছুকাল জেলে আটক রেখে পরে তাদের মুক্ত করেন। তিনি তাদের জন্য এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণের জন্য তিনি তাদের প্রতি আহ্বান জানান! এর অর্থ কী ছিল? এই আহ্বান কি তাদের নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান ছিল না? তিনি তো তাদের আওয়ামী লীগে যোগদান করে এ কাজে এগিয়ে আসতে বলেননি। অন্যদিকে সংগঠিত না হয়ে কি কেউ রাজনৈতিকভাবে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে পারে? কাজেই জামায়াতে ইসলামীর লোকদের দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার আহ্বানের অর্থই ছিল তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হওয়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান। তারা যাতে এ কাজ করতে পারে এ জন্য প্রয়োজন ছিল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। কিন্তু সে সুযোগ শেখ মুজিবের হয়নি। কারণ ১৯৭৪ সালেই তার সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক নির্যাতন এক চরম আকার ধারণ করেছিল এবং ওই বছরেরই শেষ দিকে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের গোড়াতেই তিনি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামে একটি নতুন সরকারি দল গঠন করেছিলেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা সম্ভব ছিল না। কাজেই তার অসমাপ্ত কাজ তার উত্তরসূরি জিয়াউর রহমানকেই করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবুর দ্বারা নিষিদ্ধ সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করেছিলেন। কাজেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার শুধু জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে ছিল না। এটা প্রযোজ্য ছিল অন্য দলের ক্ষেত্রেও।
একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল এ দেশে রাজনীতির ধর্মবিযুক্তির (secularisation) আন্দোলনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গঠিত হবে, এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবত দেখা গেল যে, মুখে ধর্মবিযুক্তির কথা বললেও নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিণত হল লুণ্ঠনজীবীদের অভয়ারণ্য এক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে। জনগণের জীবনে নেমে এলো চরম দুর্দশা ও নিরাপত্তাহীনতা। তাদের মধ্যে দেখা গেল এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের এ অবস্থায় সেই পর্যায়ে বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী, গণতন্ত্রী বলতে যাদের বোঝায়, তাদের কোনো কার্যকর সাংগঠনিক উপস্থিতি না থাকায় শাসকশ্রেণীর নির্যাতনের কবল থেকে মুক্তির কোনো আশু সম্ভাবনা না দেখে জনগণ ইহলোকে মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়ে পরলোকে শান্তির আশায় ধর্মমুখী হতে শুরু করল। শুরু হল রাজনীতির মধ্যে ধর্মীয় চিন্তার। এই পর্যায়ে আওয়ামী-বাকশালী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হল এবং সামরিক কর্তাব্যক্তি হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলেন। শেখ মুজিবের দ্বারা সব নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তিনি বাধ্য হলেন। জামায়াতে ইসলামীও একটি আইনসম্মত রাজনৈতিক দল হিসেবে আবার আত্মপ্রকাশ করল। এভাবে আত্মপ্রকাশের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ধর্মবিযুক্তিকে সম্পর্কিত করে শুরু হল রাজনীতিতে তাদের ধর্মের ব্যবহার। জিয়াউর রহমানের সময় মাদ্রাসা শিক্ষার তথাকথিত আধুনিকায়নের নামে সিলেবাসে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের কিছু বিষয় ঢোকানোর ফল হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের চিন্তার কোনো আধুনিকায়ন না হলেও সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত হল। এ সুযোগের ব্যবহারের জন্য জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্র সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখল ইসলামী ছাত্রশিবির। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নিজেদের সংগঠিত করল, বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ আমদানি করল, ছাত্র রাজনীতির অপরাধীকরণ শুরু হল। এই অপরাধীকরণ আওয়ামী লীগ-বিএনপির ছাত্র সংগঠনেও দ্রুত বিস্তার লাভ করল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজনৈতিকভাবে সব থেকে লাভবান হল জামায়াতে ইসলামী। তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি কোনো কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দল কর্তৃক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল! ছাত্রশিবিরকে সামনে রেখে তারা রাজনীতির মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে নামল। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, ধর্মীয় দল হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই তাদের সঙ্গে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় মৈত্রী স্থাপন করল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমঝোতা হল। তার ভিত্তিতে নির্বাচনের পর জামায়াতের সহায়তায় আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করল। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক জামায়াতপন্থী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো প্রশ্ন ছিল না। জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের মুখেই চুমু খেয়ে রাজনীতি করায় ২০০১ সালের নির্বাচনে তারা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করল। সরকারে মন্ত্রীর পদ লাভ করে তারা ক্ষমতাসীন হল! শুধু তাই নয়, এই ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা নিজেদের সংগঠন অনেক বেশি শক্তিশালী করল।
এসব ঐতিহাসিক বিষয় হিসাব করলে স্পষ্টই বোঝা যায়, বিএনপি-আওয়ামী লীগ নির্বিশেষে শাসকশ্রেণীর প্রধান দলগুলো জামায়াতে ইসলামীকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাহায্য-সহযোগিতা করে তাকে বর্তমান পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে গদিনসীন হয়ে সুবিধাবাদী কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলেও বিচারকে তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। বাস্তবত তারা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে গণজাগরণ মঞ্চের তৎপরতা। নিজেদের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সহায়তায় এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তারা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও সুদূরপ্রসারী জামায়াত নেতাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির চরিত্র গোপন রাখা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জামায়াতে ইসলামীর উত্থান ও শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব বিষয় ও ঘটনাবলীকে বিবেচনার বাইরে রেখে হিসাব করলে ফ্যাসিস্ট শক্তি হিসেবে তার বর্তমান অবস্থান কীভাবে তৈরি হল সেটা বোঝা যাবে না। এবং সেটা বোঝা না গেলে এই ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম কীভাবে সংগঠিত করতে হবে, কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এদের শক্তির মূলোচ্ছেদ করা সম্ভব তার হদিস পাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল সমগ্র রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দূষিত করে দেশকে এক চরম সংকটজনক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এর একটি হল আওয়ামী লীগ এবং অন্যটি জামায়াতে ইসলামী। এই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই দেশে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তান আমলের থেকে অনেক শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হল- এ প্রশ্ন কি যথাযথভাবে এদেশে শাসকশ্রেণীর দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অথবা শাসকশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী মহল থেকে কেউ উত্থাপন করেছেন? এক্ষেত্রে তাদের উভয়েরই অচিন্তিত সিদ্ধান্ত হল, জিয়াউর রহমান এর জন্য দায়ী। তিনিই ক্ষমতায় বসে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে তারা এদেশে নতুনভাবে সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়েছে। এর থেকে স্থূল বক্তব্য আর কী হতে পারে?
সমাজে কোনো কিছুই হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে না। কোনো ঘটনা ঘটার শর্ত যদি আগে তৈরি না হয় তাহলে সে ঘটনা হঠাৎ করে ঘটতে পারে না। জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবন ও শক্তি সঞ্চয়ের ভিত্তি আসলে রচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলেই। শেখ মুজিব জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন ঠিক, কিন্তু আইনগতভাবে তাকে অসুবিধায় ফেললেও খুব কার্যকরভাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবনের শর্ত সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ১৯৭২ সালেই শুরু করে দ্রুত শেষ না করে তিনি বেশ কিছু যুদ্ধাপরাধীকে কিছুকাল জেলে আটক রেখে পরে তাদের মুক্ত করেন। তিনি তাদের জন্য এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণের জন্য তিনি তাদের প্রতি আহ্বান জানান! এর অর্থ কী ছিল? এই আহ্বান কি তাদের নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান ছিল না? তিনি তো তাদের আওয়ামী লীগে যোগদান করে এ কাজে এগিয়ে আসতে বলেননি। অন্যদিকে সংগঠিত না হয়ে কি কেউ রাজনৈতিকভাবে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে পারে? কাজেই জামায়াতে ইসলামীর লোকদের দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার আহ্বানের অর্থই ছিল তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হওয়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান। তারা যাতে এ কাজ করতে পারে এ জন্য প্রয়োজন ছিল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। কিন্তু সে সুযোগ শেখ মুজিবের হয়নি। কারণ ১৯৭৪ সালেই তার সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক নির্যাতন এক চরম আকার ধারণ করেছিল এবং ওই বছরেরই শেষ দিকে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের গোড়াতেই তিনি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামে একটি নতুন সরকারি দল গঠন করেছিলেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা সম্ভব ছিল না। কাজেই তার অসমাপ্ত কাজ তার উত্তরসূরি জিয়াউর রহমানকেই করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবুর দ্বারা নিষিদ্ধ সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করেছিলেন। কাজেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার শুধু জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে ছিল না। এটা প্রযোজ্য ছিল অন্য দলের ক্ষেত্রেও।
একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল এ দেশে রাজনীতির ধর্মবিযুক্তির (secularisation) আন্দোলনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গঠিত হবে, এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবত দেখা গেল যে, মুখে ধর্মবিযুক্তির কথা বললেও নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিণত হল লুণ্ঠনজীবীদের অভয়ারণ্য এক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে। জনগণের জীবনে নেমে এলো চরম দুর্দশা ও নিরাপত্তাহীনতা। তাদের মধ্যে দেখা গেল এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের এ অবস্থায় সেই পর্যায়ে বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী, গণতন্ত্রী বলতে যাদের বোঝায়, তাদের কোনো কার্যকর সাংগঠনিক উপস্থিতি না থাকায় শাসকশ্রেণীর নির্যাতনের কবল থেকে মুক্তির কোনো আশু সম্ভাবনা না দেখে জনগণ ইহলোকে মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়ে পরলোকে শান্তির আশায় ধর্মমুখী হতে শুরু করল। শুরু হল রাজনীতির মধ্যে ধর্মীয় চিন্তার। এই পর্যায়ে আওয়ামী-বাকশালী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হল এবং সামরিক কর্তাব্যক্তি হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলেন। শেখ মুজিবের দ্বারা সব নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তিনি বাধ্য হলেন। জামায়াতে ইসলামীও একটি আইনসম্মত রাজনৈতিক দল হিসেবে আবার আত্মপ্রকাশ করল। এভাবে আত্মপ্রকাশের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ধর্মবিযুক্তিকে সম্পর্কিত করে শুরু হল রাজনীতিতে তাদের ধর্মের ব্যবহার। জিয়াউর রহমানের সময় মাদ্রাসা শিক্ষার তথাকথিত আধুনিকায়নের নামে সিলেবাসে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের কিছু বিষয় ঢোকানোর ফল হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের চিন্তার কোনো আধুনিকায়ন না হলেও সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত হল। এ সুযোগের ব্যবহারের জন্য জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্র সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখল ইসলামী ছাত্রশিবির। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নিজেদের সংগঠিত করল, বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ আমদানি করল, ছাত্র রাজনীতির অপরাধীকরণ শুরু হল। এই অপরাধীকরণ আওয়ামী লীগ-বিএনপির ছাত্র সংগঠনেও দ্রুত বিস্তার লাভ করল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজনৈতিকভাবে সব থেকে লাভবান হল জামায়াতে ইসলামী। তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি কোনো কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দল কর্তৃক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল! ছাত্রশিবিরকে সামনে রেখে তারা রাজনীতির মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে নামল। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, ধর্মীয় দল হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই তাদের সঙ্গে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় মৈত্রী স্থাপন করল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমঝোতা হল। তার ভিত্তিতে নির্বাচনের পর জামায়াতের সহায়তায় আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করল। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক জামায়াতপন্থী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো প্রশ্ন ছিল না। জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের মুখেই চুমু খেয়ে রাজনীতি করায় ২০০১ সালের নির্বাচনে তারা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করল। সরকারে মন্ত্রীর পদ লাভ করে তারা ক্ষমতাসীন হল! শুধু তাই নয়, এই ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা নিজেদের সংগঠন অনেক বেশি শক্তিশালী করল।
এসব ঐতিহাসিক বিষয় হিসাব করলে স্পষ্টই বোঝা যায়, বিএনপি-আওয়ামী লীগ নির্বিশেষে শাসকশ্রেণীর প্রধান দলগুলো জামায়াতে ইসলামীকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাহায্য-সহযোগিতা করে তাকে বর্তমান পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে গদিনসীন হয়ে সুবিধাবাদী কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলেও বিচারকে তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। বাস্তবত তারা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে গণজাগরণ মঞ্চের তৎপরতা। নিজেদের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সহায়তায় এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তারা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও সুদূরপ্রসারী জামায়াত নেতাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির চরিত্র গোপন রাখা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জামায়াতে ইসলামীর উত্থান ও শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব বিষয় ও ঘটনাবলীকে বিবেচনার বাইরে রেখে হিসাব করলে ফ্যাসিস্ট শক্তি হিসেবে তার বর্তমান অবস্থান কীভাবে তৈরি হল সেটা বোঝা যাবে না। এবং সেটা বোঝা না গেলে এই ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম কীভাবে সংগঠিত করতে হবে, কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এদের শক্তির মূলোচ্ছেদ করা সম্ভব তার হদিস পাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments