মাদকের অপপ্রয়োগ রোধে চাই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস by ইকতেদার আহমেদ
একটি
দেশ ও সমাজের ওপর মাদকদ্রব্যের প্রলয়ংকরী প্রভাবের জন্য এর নিয়ন্ত্রণ
অপরিহার্য। মাদকদ্রব্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশের ভবিষ্যৎ
অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যুবসমাজের ভেতর মাদকদ্রব্য সেবন বা গ্রহণের প্রবণতা বেশি
লক্ষ্য করা যায়। পরিবেশ, শিথিল পারিবারিক বন্ধন, অতিরিক্ত স্নেহ, কঠোর
শাসন, হতাশা প্রভৃতি একজন কিশোর বা যুবককে মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়।
হতাশার ক্ষেত্রে দু’ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর একটি হল সব প্রাপ্তি
নিঃশেষিত হওয়ার পর অন্য কোনো প্রাপ্তি না থাকার হতাশা আর অপরটি হল
অপ্রাপ্তির হতাশা। আমাদের সমাজে আগে যৌথ পরিবারের কারণে শিশুরা অধিক হারে
দাদি-নানির সান্নিধ্য পেত। এটি শিশুর নৈতিক মানোন্নয়নে সহায়ক ছিল। বর্তমানে
এককেন্দ্রিক পরিবার এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে চাকরিজীবী হওয়ায় শিশুরা
পর্যাপ্ত সময় মা-বাবার সান্নিধ্য পায় না। বর্তমানে অগ্রসরমান প্রযুুক্তির
যুগে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে একটি শিশু অনায়াসে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের
বদৌলতে নাচ-গানে ভরপুর অশ্লীল দৃশ্যের হিন্দি ছায়াছবি এবং আপত্তিকর দৃশ্যের
ছবি দেখার সুযোগ পায়। অপরিণত বয়সে এসব ছবি দেখার সুযোগ শিশুদের মধ্যে
বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যার ফলে তারা বিপথগামী হয়ে পড়ে। এ
বিপথগামীদের একাংশ মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
মাদক এমন দ্রব্য যা সেবনে নেশার উদ্রেক করে। একজন ব্যক্তি মাদক সেবনের পর যখন তার স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পায় তখন তাকে মাতাল বলা হয়। একজন ব্যক্তির পক্ষে মাতাল অবস্থায় ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণ সম্ভব নয়। মাদক সেবনের পর যতক্ষণ তার ওপর মাদকের প্রভাব থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণত তার আচরণে স্বাভাবিকতা আসে না। একজন ব্যক্তিকে তখনই মাদকাসক্ত বলা হয়, যখন সে শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল অথবা অভ্যাস বশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী।
আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব মাদকদ্রব্য মাদকসেবীদের কাছে সহজলভ্য তা হল- ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা। এর বাইরে গাঁজা, পেথিডিন এবং বিভিন্ন রকম মদ বলতে গেলে সহজলভ্য। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভিপ্রায়ে ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়। আইনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ২০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে বোর্ডকে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব প্রদানসহ মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধে অপরাপর দায়িত্ব প্রদান করা হলেও কার্যক্ষেত্রে অদ্যাবধি সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়নি।
বর্তমানে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফরের পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারা তদন্ত সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। দু-তিনটি থানার সমন্বয়ে একটি সার্কেলে এ ধরনের একজন পরিদর্শক থাকে। মাদক সংক্রান্ত মামলা সংশ্লেষে কোনো আলামত যেমন- ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা প্রভৃতি জব্দ করা হলে মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত জব্দকৃত মালামাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফরের জেলা পর্যায়ের কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। অপরদিকে যেসব মামলা দায়ের পরবর্তী তদন্তকাজ পুলিশ পরিচালনা করে, ওই মামলা সংশ্লেষে কোনো আলামত জব্দ করা হলে জব্দকৃত আলামত জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন মালখানায় সংরক্ষণ করা হয়।
যে কোনো মামলা সংশ্লেষে জব্দকৃত মালামালের বিষয়ে আদালত কর্তৃক বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। জব্দকৃত মালামাল মাদকদ্রব্য হয়ে থাকলে মামলার রায় প্রদানকালে আদেশাংশে উল্লেখ করা হয় যে, মামলা সংশ্লেষে বাজেয়াপ্তকৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হোক। বাজেয়াপ্তকৃত মালামালের পরিমাণ বেশি হলে এবং তা সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে অনেক সময় বাজেয়াপ্তকৃত মালামালের কিছু অংশ নমুনা হিসেবে রেখে মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় আদালতের অনুমতি নিয়ে অবশিষ্ট বৃহদাংশ ধ্বংস করা হয়। জব্দকৃত মালামাল প্রকৃতই মাদকদ্রব্য কি-না সে সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষা মামলা তদন্তাধীন থাকাবস্থায় সম্পন্ন করা হয়।
হেরোইন নামক মাদকদ্রব্যটি দেখতে অনেকটা আটা বা অন্যান্য সাদা পাউডারের সদৃশ। এক কেজি হেরোইনের প্রকারভেদে বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা। এ উচ্চমূল্যের কারণে এবং আটা বা পাউডার সদৃশ হওয়ায় জব্দকৃত হেরোইনের রাসায়নিক পরীক্ষার পর একে আটা বা পাউডার সদৃশ দ্রব্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করে মাদকদ্রব্য অধিদফরের একশ্রেণীর কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা আয় করে সমাজে মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধের পরিবর্তে মাদকদ্রব্য বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনই একটি অভিযোগ দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল, যেখানে প্রকাশ পায়, ৫টি মামলা সংশ্লেষে জব্দকৃত ১৪ কেজি ১৪ কোটি টাকা মূল্যের হেরোইন ১৪ কেজি হেরোইন সদৃশ দ্রব্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত অপর এক সংবাদে জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনরত জনৈক সহকারী জজ কয়েকশ’ বোতল ফেনসিডিলসহ মাইক্রোবাসযোগে পরিভ্রমণকালে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক দায়িত্ব পালনকালে জব্দকৃত আলামত ফেনসিডিল ধ্বংসের আদেশ দিয়ে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় আসল ফেনসিডিল অপসারণপূর্বক পানিভর্তি ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে প্রতিস্থাপনের বেআইনি ও জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিলেন। আরও আশ্চর্য হতে হয় যখন শোনা যায়, ওই ম্যাজিস্ট্রেট মন্ত্রণালয়ের সৎ, দক্ষ, জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়নে বিশেষ উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট।
১ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট, ৫ হাজার ইয়াবা বিকল্প এবং ইয়াবা প্রস্তুতের সরঞ্জাম ও কাঁচামালসহ মাদকসম্রাট আমিন হুদার র্যাব কর্তৃক আটকের ঘটনা সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা রয়েছে। এই আমিন হুদা ও তার সহযোগীকে বিচারিক আদালত ৭৯ বছরের সাজা দিলে সাজা প্রদান পরবর্তী ৭ মাস অতিক্রান্তের আগে সে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিন লাভে সক্ষম হয়। তবে আশার কথা, আপিল বিভাগের হস্তক্ষেপে জামিন আদেশ বাতিল হয় এবং আবার তাকে কারাগারে যেতে হয়।
দেশে ১৯৮২ সালে ওষুধ নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে কাশির সিরাপ হিসেবে ব্যবহৃত ফেনসিডিল উৎপাদন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মাদকসেবীদের কাছে ফেনসিডিলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নিষিদ্ধ পরবর্তী ভারত থেকে মাদক পর্যায়ভুক্ত ফেনসিডিল চোরাচালানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং এ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে ভারতে বাংলাদেশ সীমান্তের চারপাশে ১৩২টি ফেনসিডিল উৎপাদন কারখানা গড়ে ওঠার তথ্য পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনক বিষয় হল, ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য ও গরু নিয়ে আসার সময় অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ফেনসিডিল নিয়ে আসার সময় হত্যাকাণ্ড দূরের কথা, আটকেরও কোনো নজির নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বর্তমানে ফেনসিডিল সহজলভ্য এবং এর শতভাগই ভারতের প্রশ্রয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের ভূমিকা উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
হেরোইন আফিম উদ্ভূত মাদ্রকদ্রব্য, অপরদিকে ইয়াবা সহধর্মী কৃত্রিম উপায়ে তৈরি মাদকদ্রব্য। উভয় মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে আসে মিয়ানমার থেকে এবং এ ক্ষেত্রেও দেখা যায়, সে দেশের প্রশাসনিক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। ইয়াবা ছোট ট্যাবলেট আকৃতির মাদক হওয়ায় এর চোরাচালান সহজসাধ্য এবং একজন ব্যক্তি অনায়াসে পকেটে করে চার-পাঁচশ’ ইয়াবা ট্যাবলেট স্থানান্তর করতে পারে। রাজধানী ঢাকায় মানভেদে একটি ইয়াবা ট্যাবলেট পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ইয়াবার পরিবহন সহজসাধ্য এবং লাভের মাত্রা বেশি হওয়ায় বর্তমানে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবার প্রতি অধিক হারে ঝুঁকছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, হেরোইন ও ইয়াবা বিপরীতমুখী মাদক। হেরোইন শরীরকে নিস্তেজ করে দেয় আর ইয়াবা প্রাথমিক পর্যায়ে শরীরে উত্তেজনা বাড়ায়। যদিও পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, দুটি মাদকই একপর্যায়ে শরীরকে নিস্তেজ করে দেয়।
ইয়াবা সেবন-পরবর্তী প্রভাব বিষয়ে চিকিৎসকদের অভিমত, এটি এমন একটি ভয়ংকর মাদক যা মানুষকে শুধু মেরেই ফেলে না, মারার আগে ওই ব্যক্তিকে পাগলে পরিণত করে ফেলে এবং এ ধরনের পাগলামির কারণে গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। ইয়াবা প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তেজনা বাড়ানোর পাশাপাশি মন থেকে ভয়ভীতি দূর করে দেয়, যার কারণে সেবনকারী বুঝতে পারে না কী করবে। এভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে এক সময় ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ইয়াবা সেবনকারীর মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব সবচেয়ে বেশি থাকে। একটি কাজ করলে পরে তার ফল কী হবে সেটা সেবনকারী ভাবে না। সেবনের একপর্যায়ে সে ধীরে ধীরে তার পাশে একটি অবাস্তব জগৎ তৈরি করে থাকে। কল্পনায় সে তার চারপাশের মানুষদের শত্র“ ভাবতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সে নিজেকেও শত্র“ ভাবতে শুরু করে। সে তখন অদৃশ্য শব্দ শুনতে পায় এবং অদৃশ্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তু দেখতে পায়। তার কাছে মনে হয়, তার নিজের ছবি তাকে হত্যা করবে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, এমনকি নিজেকেও না। তাছাড়া ইয়াবাসহ যে কোনো প্রথম শ্রেণীর মাদক মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়, যার কারণে সেবনকারী স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারে না। স্বাভাবিক চিন্তার অনুপস্থিতিতে অস্বাভাবিক ঘটনার জন্ম হয়। এমন একটি অস্বাভাবিক ঘটনা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে ১৭ বছর বয়সী এক সন্তানের হাতে জন্মদাতা বাবা-মা নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর ঘাতক সন্তান নির্লিপ্ত ও নির্বিকার থাকার ঘটনায়।
যে সন্তানটির হাতে সম্প্রতি পিতা-মাতা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, তার মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না। এই একটি ঘটনা গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাই জাতির বিবেকের প্রশ্ন- ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত? তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কী? এ ব্যবসা রোধের পরিবর্তে দিন দিন কেন বেড়ে চলেছে? রোধের ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও রাজনীতিকদের ভূমিকা কেন সহায়ক নয়? বিচারকার্য কেন যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না? কার ব্যর্থতায় পর্যাপ্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? কার ব্যর্থতায় সহজে জামিন লাভ ও খালাসের ঘটনা ঘটছে? বিচারকালীন কাদের কারণে জব্দকৃত মাদক প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে মাদকের থাবা থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ যুবসমাজ ও কোমলমতি শিশুরা মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
মাদক এমন দ্রব্য যা সেবনে নেশার উদ্রেক করে। একজন ব্যক্তি মাদক সেবনের পর যখন তার স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পায় তখন তাকে মাতাল বলা হয়। একজন ব্যক্তির পক্ষে মাতাল অবস্থায় ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণ সম্ভব নয়। মাদক সেবনের পর যতক্ষণ তার ওপর মাদকের প্রভাব থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণত তার আচরণে স্বাভাবিকতা আসে না। একজন ব্যক্তিকে তখনই মাদকাসক্ত বলা হয়, যখন সে শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল অথবা অভ্যাস বশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী।
আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব মাদকদ্রব্য মাদকসেবীদের কাছে সহজলভ্য তা হল- ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা। এর বাইরে গাঁজা, পেথিডিন এবং বিভিন্ন রকম মদ বলতে গেলে সহজলভ্য। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভিপ্রায়ে ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়। আইনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ২০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে বোর্ডকে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব প্রদানসহ মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধে অপরাপর দায়িত্ব প্রদান করা হলেও কার্যক্ষেত্রে অদ্যাবধি সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়নি।
বর্তমানে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফরের পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারা তদন্ত সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। দু-তিনটি থানার সমন্বয়ে একটি সার্কেলে এ ধরনের একজন পরিদর্শক থাকে। মাদক সংক্রান্ত মামলা সংশ্লেষে কোনো আলামত যেমন- ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা প্রভৃতি জব্দ করা হলে মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত জব্দকৃত মালামাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফরের জেলা পর্যায়ের কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। অপরদিকে যেসব মামলা দায়ের পরবর্তী তদন্তকাজ পুলিশ পরিচালনা করে, ওই মামলা সংশ্লেষে কোনো আলামত জব্দ করা হলে জব্দকৃত আলামত জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন মালখানায় সংরক্ষণ করা হয়।
যে কোনো মামলা সংশ্লেষে জব্দকৃত মালামালের বিষয়ে আদালত কর্তৃক বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়। জব্দকৃত মালামাল মাদকদ্রব্য হয়ে থাকলে মামলার রায় প্রদানকালে আদেশাংশে উল্লেখ করা হয় যে, মামলা সংশ্লেষে বাজেয়াপ্তকৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হোক। বাজেয়াপ্তকৃত মালামালের পরিমাণ বেশি হলে এবং তা সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে অনেক সময় বাজেয়াপ্তকৃত মালামালের কিছু অংশ নমুনা হিসেবে রেখে মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় আদালতের অনুমতি নিয়ে অবশিষ্ট বৃহদাংশ ধ্বংস করা হয়। জব্দকৃত মালামাল প্রকৃতই মাদকদ্রব্য কি-না সে সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষা মামলা তদন্তাধীন থাকাবস্থায় সম্পন্ন করা হয়।
হেরোইন নামক মাদকদ্রব্যটি দেখতে অনেকটা আটা বা অন্যান্য সাদা পাউডারের সদৃশ। এক কেজি হেরোইনের প্রকারভেদে বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা। এ উচ্চমূল্যের কারণে এবং আটা বা পাউডার সদৃশ হওয়ায় জব্দকৃত হেরোইনের রাসায়নিক পরীক্ষার পর একে আটা বা পাউডার সদৃশ দ্রব্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করে মাদকদ্রব্য অধিদফরের একশ্রেণীর কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা আয় করে সমাজে মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধের পরিবর্তে মাদকদ্রব্য বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনই একটি অভিযোগ দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল, যেখানে প্রকাশ পায়, ৫টি মামলা সংশ্লেষে জব্দকৃত ১৪ কেজি ১৪ কোটি টাকা মূল্যের হেরোইন ১৪ কেজি হেরোইন সদৃশ দ্রব্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত অপর এক সংবাদে জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনরত জনৈক সহকারী জজ কয়েকশ’ বোতল ফেনসিডিলসহ মাইক্রোবাসযোগে পরিভ্রমণকালে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক দায়িত্ব পালনকালে জব্দকৃত আলামত ফেনসিডিল ধ্বংসের আদেশ দিয়ে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় আসল ফেনসিডিল অপসারণপূর্বক পানিভর্তি ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে প্রতিস্থাপনের বেআইনি ও জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিলেন। আরও আশ্চর্য হতে হয় যখন শোনা যায়, ওই ম্যাজিস্ট্রেট মন্ত্রণালয়ের সৎ, দক্ষ, জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়নে বিশেষ উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট।
১ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট, ৫ হাজার ইয়াবা বিকল্প এবং ইয়াবা প্রস্তুতের সরঞ্জাম ও কাঁচামালসহ মাদকসম্রাট আমিন হুদার র্যাব কর্তৃক আটকের ঘটনা সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা রয়েছে। এই আমিন হুদা ও তার সহযোগীকে বিচারিক আদালত ৭৯ বছরের সাজা দিলে সাজা প্রদান পরবর্তী ৭ মাস অতিক্রান্তের আগে সে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিন লাভে সক্ষম হয়। তবে আশার কথা, আপিল বিভাগের হস্তক্ষেপে জামিন আদেশ বাতিল হয় এবং আবার তাকে কারাগারে যেতে হয়।
দেশে ১৯৮২ সালে ওষুধ নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে কাশির সিরাপ হিসেবে ব্যবহৃত ফেনসিডিল উৎপাদন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মাদকসেবীদের কাছে ফেনসিডিলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নিষিদ্ধ পরবর্তী ভারত থেকে মাদক পর্যায়ভুক্ত ফেনসিডিল চোরাচালানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং এ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে ভারতে বাংলাদেশ সীমান্তের চারপাশে ১৩২টি ফেনসিডিল উৎপাদন কারখানা গড়ে ওঠার তথ্য পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনক বিষয় হল, ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য ও গরু নিয়ে আসার সময় অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ফেনসিডিল নিয়ে আসার সময় হত্যাকাণ্ড দূরের কথা, আটকেরও কোনো নজির নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বর্তমানে ফেনসিডিল সহজলভ্য এবং এর শতভাগই ভারতের প্রশ্রয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের ভূমিকা উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
হেরোইন আফিম উদ্ভূত মাদ্রকদ্রব্য, অপরদিকে ইয়াবা সহধর্মী কৃত্রিম উপায়ে তৈরি মাদকদ্রব্য। উভয় মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে আসে মিয়ানমার থেকে এবং এ ক্ষেত্রেও দেখা যায়, সে দেশের প্রশাসনিক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। ইয়াবা ছোট ট্যাবলেট আকৃতির মাদক হওয়ায় এর চোরাচালান সহজসাধ্য এবং একজন ব্যক্তি অনায়াসে পকেটে করে চার-পাঁচশ’ ইয়াবা ট্যাবলেট স্থানান্তর করতে পারে। রাজধানী ঢাকায় মানভেদে একটি ইয়াবা ট্যাবলেট পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ইয়াবার পরিবহন সহজসাধ্য এবং লাভের মাত্রা বেশি হওয়ায় বর্তমানে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবার প্রতি অধিক হারে ঝুঁকছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, হেরোইন ও ইয়াবা বিপরীতমুখী মাদক। হেরোইন শরীরকে নিস্তেজ করে দেয় আর ইয়াবা প্রাথমিক পর্যায়ে শরীরে উত্তেজনা বাড়ায়। যদিও পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, দুটি মাদকই একপর্যায়ে শরীরকে নিস্তেজ করে দেয়।
ইয়াবা সেবন-পরবর্তী প্রভাব বিষয়ে চিকিৎসকদের অভিমত, এটি এমন একটি ভয়ংকর মাদক যা মানুষকে শুধু মেরেই ফেলে না, মারার আগে ওই ব্যক্তিকে পাগলে পরিণত করে ফেলে এবং এ ধরনের পাগলামির কারণে গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। ইয়াবা প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তেজনা বাড়ানোর পাশাপাশি মন থেকে ভয়ভীতি দূর করে দেয়, যার কারণে সেবনকারী বুঝতে পারে না কী করবে। এভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে এক সময় ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ইয়াবা সেবনকারীর মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব সবচেয়ে বেশি থাকে। একটি কাজ করলে পরে তার ফল কী হবে সেটা সেবনকারী ভাবে না। সেবনের একপর্যায়ে সে ধীরে ধীরে তার পাশে একটি অবাস্তব জগৎ তৈরি করে থাকে। কল্পনায় সে তার চারপাশের মানুষদের শত্র“ ভাবতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সে নিজেকেও শত্র“ ভাবতে শুরু করে। সে তখন অদৃশ্য শব্দ শুনতে পায় এবং অদৃশ্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তু দেখতে পায়। তার কাছে মনে হয়, তার নিজের ছবি তাকে হত্যা করবে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, এমনকি নিজেকেও না। তাছাড়া ইয়াবাসহ যে কোনো প্রথম শ্রেণীর মাদক মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়, যার কারণে সেবনকারী স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারে না। স্বাভাবিক চিন্তার অনুপস্থিতিতে অস্বাভাবিক ঘটনার জন্ম হয়। এমন একটি অস্বাভাবিক ঘটনা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে ১৭ বছর বয়সী এক সন্তানের হাতে জন্মদাতা বাবা-মা নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর ঘাতক সন্তান নির্লিপ্ত ও নির্বিকার থাকার ঘটনায়।
যে সন্তানটির হাতে সম্প্রতি পিতা-মাতা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, তার মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না। এই একটি ঘটনা গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাই জাতির বিবেকের প্রশ্ন- ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত? তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কী? এ ব্যবসা রোধের পরিবর্তে দিন দিন কেন বেড়ে চলেছে? রোধের ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও রাজনীতিকদের ভূমিকা কেন সহায়ক নয়? বিচারকার্য কেন যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না? কার ব্যর্থতায় পর্যাপ্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? কার ব্যর্থতায় সহজে জামিন লাভ ও খালাসের ঘটনা ঘটছে? বিচারকালীন কাদের কারণে জব্দকৃত মাদক প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে মাদকের থাবা থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ যুবসমাজ ও কোমলমতি শিশুরা মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
No comments