বেজার যদি হয় আমার ঘরের যৈবতী... by মোকাম্মেল হোসেন
নাকে-মুখে খাচ্ছি। ডালের বাটি এগিয়ে দিয়ে লবণ বেগম বলল-
: গলায় ভাত ঠেইক্যা মরবা তো! একটু আস্তে খাও।
খাওয়াটা ধীরেসুস্থেই শুরু করেছিলাম। হঠাৎ আলাল-দুলালের ফোন পেয়ে আউলা লেগে গেল। আলাল বলল-
: তুমি কই?
- বাড়িতে।
: আমগরে বাজারে আসতে বইল্যা তুমি বাড়িতে বইসা রইছ!
দুলাল বলল-
: তুমি বাড়িতে কী কর?
- ভাত খাইতেছি।
: অহনও খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে আছ- গরু কিনবা কখন?
কোরবানির গরু কিনতে আজ আমার অষ্টধার বাজারে যাওয়ার কথা। বন্ধু আলাল ও দুলালকে সাহায্যকারী হিসেবে সঙ্গে থাকার অনুরোধ করেছি। তারা এত তাড়াতাড়ি বাজারে পৌঁছে যাবে ভাবিনি। আলাল পুনরায় বলল-
: খাওন-দাওন সাইডে রাইখ্যা দৌড় দেও। নইলে পরে কিন্তু পস্তাবা...
এ কথা শোনার পর খাবারের থালা একপাশে রেখে দৌড় দেয়া উচিত। কিন্তু একজন ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত খাবারগুলো পেটে চালান করে দিচ্ছিলাম। লবণ বেগম সামনে থাকায় সমস্যা হচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম-
: তুমি ফোন কইরা কী কী আনতে বলছিলা- আনছি তো...
- কই?
: আমার ব্যাগের সামনের পকেটে দেখ আছে।
লবণ বেগম উঠে গেল। এই ফাঁকে খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনই ঘর থেকে লবণ বেগমের চিৎকার ভেসে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই লবণ বেগম বিস্ফোরিত চোখে বলল-
: হোয়াট ইজ দিস?
- বলপেন।
: আমি কি তোমারে বলপেন আনতে বলছিলাম?
- কী আনতে বলছ!
: তুমি বল- কী আনতে বলছি!
- বলাবলির কী আছে! তুমি যা যা আনতে বলছ- তাই তো আনছি!
: অবশ্যই তা আন নাই। আমি তোমারে আনতে বলছি ভ্রু পেন, আর তুমি আনছ বলপেন!
- ভ্রু পেন?
: হ্যাঁ, ভ্রু পেন। মানুষের চোখের ওপর যে দুইটা ভ্রু আছে- এইটা জান তো!
- জ্বি, জানি।
: সেই ভ্রুতে ব্যবহার করার জন্য এক ধরনের কলম পাওয়া যায়। সেইটারে ভ্রু পেন বলে।
- অঃ।
: আর এইটা কী আনছ?
- লিপ লাইনার!
: ব্যাগে ভরার আগে জিনিসটা একবার নাকের কাছে নিছিলা?
- নাকের কাছে নেওন লাগব কী জন্য!
: আহা! নিছিলা কিনা সেইটা বল।
- না।
: এখন নিয়া দেখ- কী পচা গন্ধ!
- পচা গন্ধ মানে? দোকানদাররে বলছি, সবচাইতে ভালোটা দেন। দোকানদার বলছে, এইটাই ভালো। বিশ্ববিখ্যাত জর্ডানা কোম্পানির মাল। ওইটার গায়ে কোম্পানির নাম লেখা আছে দেখ।
: লেখা থাকলেই হইয়া গেল! আমি একটা সাদা কাগজের ওপর এক হাজার টাকা লেখলেই সেইটা এক হাজার টাকার নোট হইয়া যাবে?
চুপচাপ কিছুক্ষণ লবণ বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মাথা নেড়ে বললাম-
: জি না।
থুম ধরে বসে থাকার একপর্যায়ে লবণ বেগম হাতের জিনিসগুলো সশব্দে টেবিলের ওপর রেখে বলল-
: বুঝছি! তোমার প্রতি মায়া দেখাইয়া কোনো লাভ নাই। চল আমার সঙ্গে...
- কোথায়?
: শহরে।
- তোমার সঙ্গে এখন শহরে গেলে গরু কিনব কখন?
: আগে আমার আর বাচ্চাদের কেনাকাটা শেষ কর। তারপর তুমি তোমার ছাগল-গরু-উট যা খুশি কিইন্য...
নৌকাডুবির পর সাঁতার না জানা কোনো যাত্রী যেমন সামনে খড়কুটো যা পায়- আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, আমিও তাই করলাম। বললাম-
: এই এলাকায় আজই গরু-ছাগলের শেষ হাট।
- আগামীকাইল বিদ্যাগঞ্জের হাট আছে।
: এতদূরে যাব!
- মানুষ গরু কেনার জন্য নদী পার হইয়া সিরাজগঞ্জ চইল্যা যাইতেছে, আর তুমি বিদ্যাগঞ্জে যাইতে পারবা না?
মহাফাঁপরে পড়ে গেলাম। লবণ বেগমের হুকুম পালন না করলে সে বেজার হবে। আবার আলাল-দুলালকে ডেকে আনার পর এখন যদি অষ্টধার বাজারে না যাই তাহলে তারা বেজার হবে। কী করব- তাই নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি, লবণ বেগম বলল-
: কী হইল, যাবা না?
এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হওয়া উচিত- না। কিন্তু সংসারে অশান্তি যাতে কম হয় সে ব্যাপারে প্রত্যেক বিবাহিত পুরুষের যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। আমি গভীরভাবে তা উপলব্ধি করার পর লবণ বেগমকে শুনিয়ে আবৃত্তি করলাম-
আলালের বেজারে আমার হইব কী
দুলালের বেজারে আমার হইব কী
বেজার যদি হয় আমার ঘরের যৈবতী-
আন আমার জামা, আন আমার জুতা
সঠিকভাবে পালন করি যৈবতীর কথা॥
প্রতিবেশী হারেজ আলীকে সঙ্গে নিয়ে পরদিন বিদ্যাগঞ্জ বাজারে গেলাম। গরু কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। লেনদেন সম্পন্ন করে চা-নাস্তা খাওয়ার পর হারেজকে বললাম-
: বিসমিল্লাহ বইল্যা তুমি গরু লইয়া হাঁটা দেও। আমি ট্রেনে পিয়ারপুর হইয়া বাড়িতে যাব।
বাড়িতে পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছি- এমন সময় হারেজের ফোন পেলাম। বললাম-
: কী খবর হারেজ! কুন পর্যন্ত আসছ?
- আমি নিমতলী বাজারে।
: মাশাল্লাহ। পা চালাইয়া আইসা পড়।
- ভাইজান...
: কিছু বলবা?
- ভাইজান, একটা ঘটনা ঘইট্যা গেছে!
: কী ঘটনা!
- নিমতলী বাজারে পৌঁছার পর রেললাইন পার হইতেছিলাম, এমন সময় একটা ট্রেন...
: কও কী! গরু কি ট্রেনের নিচে কাটা পড়ছে?
- না।
: তাইলে?
- ট্রেনের শব্দ শুইন্যা গরুটা একটা লাফ দিয়া আমার হাত থেইক্যা ছুইট্যা গেল। পিছনে-পিছনে অনেকক্ষণ দৌড়াইছি ভাইজান, ধরতে পারি নাই।
: আশপাশে খোঁজ-খবর নেও নাই?
- পুরা এলাকা মই দিয়া ফেলছি ভাইজান। কোনো লাভ হয় নাই...
এবার আর ভাতের মায়া করলাম না। একটা ভ্যানযোগাড় করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিমতলী বাজারে পৌঁছলাম। হারেজ আলী রেললাইনের পাশে নির্বাক হয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি ইশারায় তাকে কান্না থামানোর নির্দেশ দিয়ে বললাম-
: কাইন্দা কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কান্না বন্ধ কর।
আকাশে জিলহজ মাসের অপূর্ণ চাঁদ। চপলা নারীর ন্যায় ভেসে বেড়ানো শরতের মেঘমালা সেই চাঁদকে একটু পরপর তার ভালোবাসার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে। আধো আলো আধো ছায়ার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া চারপাশের পরিবেশ যেন রহস্যের বোরকা পরে বসে আছে। সেই রহস্যের অবগুণ্ঠন ভেদ করে সচল-গতিসম্পন্ন কোনো প্রাণীকে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য বলে মনে হল। হঠাৎ হারেজ আলী বলল-
: ভাইজান, মাইকিং করলে কি খোঁজ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
নিমতলী বাজারে মাইকের কোনো দোকান নেই। একজন বলল-
: মাইক পাইতে হইলে মুক্তাগাছা যাওন লাগব। তবে...
- তবে কী?
: আধামাইল সামনে এক এতিমখানায় একটা মাইক আছে। সেই মাইক দিয়া এতিমখানার লোকজন বাজারের দিন টাকা-পয়সা কালেকশন করে। পয়সাকড়ি দিলে তারা মাইক দিতে রাজি হইতে পারে।
এতিমখানার মাইকটা পাওয়া গেল। কী বলতে হবে- তা একটা কাগজে লিখে হারেজের হাতে দিলাম। টর্চের আলোয় লেখাগুলো দেখতে দেখতে হারেজ বলতে লাগল-
ভাইসব- ভাইসব। একটি মাঝারি আকারের ষাঁড় হারানো গিয়াছে। ষাঁড়টির গায়ের রঙ টকটকা লাল। দুই দাঁত। কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি ষাঁড়টির সন্ধান পাইলে ০১৭১৫৪০১১৪৫ নম্বরে ফোন কইরা জানাইলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। ভাইসব- ভাইসব...
মাইকিং করতে করতে অগ্রসর হচ্ছি- পাশ থেকে বয়স্ক এক ব্যক্তির ডাক শুনে ভ্যান দাঁড় করালাম। তিনি ভ্যানের সামনে এসে বললেন-
: কখন হারাইছে?
উত্তর দিল হারেজ। বলল-
: এশার আজানের একটু আগে।
মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে মুরুব্বি বললেন-
: ভালো লোকের হাতে পড়লে গরু ইনশাল্লাহ ফেরত পাওয়া যাবে। আর যদি কোনো দুষ্টুলোকের হাতে পড়ে, তাইলে তার গোশত দিয়া আগামীকাইল কোনো হোটেলে কাবাব তৈরি হবে- সেইটা আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউ জানে না। আইচ্ছা- আপনেরা গরু সাইড় করেন নাই?
এবার উত্তর দিলাম আমি। বললাম-
: করছি তো!
- ইজারাদার যে কাগজ দিছে, তাতে গরুর মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা নাই?
গরু নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় যাতে কোনোরকম ঝামেলা না হয়, সে জন্য মাসুলের কাগজ হারেজের হাতে দিয়েছিলাম। হারেজ পকেট থেকে সেটা বের করে দেয়ার পর দেখলাম-মালিকের নাম লেখা ইজ্জত শেক। ঠিকানা কাবারিকান্দা।
মুরুব্বিকে এ কথা জানানোর পর তিনি বললেন-
: অনেক সময় পোষা প্রাণীরা মালিকের মায়া ত্যাগ করতে পারে না। কোনোভাবে একবার সুযোগ পাইলে ছুটতে ছুটতে মালিকের বাড়িতে যাইয়া হাজির হয়। আপনেরা মাইকিং করতেছেন- করেন। তবে একবার মালিকের বাড়িতে যাইয়া খোঁজ নেন...
কাবারিকান্দা গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখন গভীর রাত। ইজ্জত শেখের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়লাম-
: বাড়িতে কেডা আছুইন গো...
অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মন ধৈর্যের প্রান্তসীমায় পৌঁছার ঠিক আগমুহূর্তে ঘরের ভেতর থেকে খুলুর-খুলুর কাশির শব্দ শোনা গেল। পুনরায় ডাক দিতেই বয়স্ক গলায় একজন বললেন-
: কেডা ডাহুইন গো!
- আমরা।
: আমরা কেডা?
- এইটা ইজ্জত শেখের বাড়ি না?
: হ।
- মেহেরবানী কইরা একটু বাইরে আসেন।
বাইরে যিনি এলেন- তিনি ইজ্জত শেখের বাবা এলেম শেখ। আমাদের মুখে সবকিছু শোনার পর এলেম শেখ বললেন-
: আমরা খাওন-দাওন শেষ কইরা শুইতে যামু, এমন সময় দেখি লালু উঠানে খাড়া। লালুরে গোয়ালে বাইন্ধা রাখছি, কিন্তু ইজ্জত তো বাড়িতে নাই।
ষাঁড়টার তাহলে একটা নামও আছে! নশ্বর পৃথিবীর এই সংসার-বাগানে মানুষ ও একটা অবলা জীবের মধ্যে যে মায়াবৃক্ষটি দিনে দিনে বেড়ে উঠেছে, তার শেঁকড় কতটা গভীরে প্রোথিত তা আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে করতে বললাম-
- ইজ্জত শেখ কই গেছে?
: সে বোরোরচর গেছে তার মেয়ের জামাইরে ঈদের দাওয়াত দিতে। টাকাগুলা অন্য একজনের হাতে পাঠাইয়া দিয়া আমারে মোবাইল কইরা শুধু বলছে- লালুরে বিক্রি কইরা দিছি। এখন সে কার কাছে বিক্রি করছে, কী বিষয়-বৃত্তান্ত- তা না জাইন্যা তো আমি গরু দিতে পারি না।
বৃদ্ধের কথা শুনে মুখ দিয়ে দম ছাড়লাম। তারপর তার হাত দুটো আমার দু’হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম-
: ঈদের তো এখনও দুইদিন বাকি আছে। এই দুইদিন লালু আপনের বাড়িতেই থাকুক। আমরা ঈদের দিন ভোরবেলা আইসা তারে নিয়া যাব...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: গলায় ভাত ঠেইক্যা মরবা তো! একটু আস্তে খাও।
খাওয়াটা ধীরেসুস্থেই শুরু করেছিলাম। হঠাৎ আলাল-দুলালের ফোন পেয়ে আউলা লেগে গেল। আলাল বলল-
: তুমি কই?
- বাড়িতে।
: আমগরে বাজারে আসতে বইল্যা তুমি বাড়িতে বইসা রইছ!
দুলাল বলল-
: তুমি বাড়িতে কী কর?
- ভাত খাইতেছি।
: অহনও খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে আছ- গরু কিনবা কখন?
কোরবানির গরু কিনতে আজ আমার অষ্টধার বাজারে যাওয়ার কথা। বন্ধু আলাল ও দুলালকে সাহায্যকারী হিসেবে সঙ্গে থাকার অনুরোধ করেছি। তারা এত তাড়াতাড়ি বাজারে পৌঁছে যাবে ভাবিনি। আলাল পুনরায় বলল-
: খাওন-দাওন সাইডে রাইখ্যা দৌড় দেও। নইলে পরে কিন্তু পস্তাবা...
এ কথা শোনার পর খাবারের থালা একপাশে রেখে দৌড় দেয়া উচিত। কিন্তু একজন ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত খাবারগুলো পেটে চালান করে দিচ্ছিলাম। লবণ বেগম সামনে থাকায় সমস্যা হচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম-
: তুমি ফোন কইরা কী কী আনতে বলছিলা- আনছি তো...
- কই?
: আমার ব্যাগের সামনের পকেটে দেখ আছে।
লবণ বেগম উঠে গেল। এই ফাঁকে খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনই ঘর থেকে লবণ বেগমের চিৎকার ভেসে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই লবণ বেগম বিস্ফোরিত চোখে বলল-
: হোয়াট ইজ দিস?
- বলপেন।
: আমি কি তোমারে বলপেন আনতে বলছিলাম?
- কী আনতে বলছ!
: তুমি বল- কী আনতে বলছি!
- বলাবলির কী আছে! তুমি যা যা আনতে বলছ- তাই তো আনছি!
: অবশ্যই তা আন নাই। আমি তোমারে আনতে বলছি ভ্রু পেন, আর তুমি আনছ বলপেন!
- ভ্রু পেন?
: হ্যাঁ, ভ্রু পেন। মানুষের চোখের ওপর যে দুইটা ভ্রু আছে- এইটা জান তো!
- জ্বি, জানি।
: সেই ভ্রুতে ব্যবহার করার জন্য এক ধরনের কলম পাওয়া যায়। সেইটারে ভ্রু পেন বলে।
- অঃ।
: আর এইটা কী আনছ?
- লিপ লাইনার!
: ব্যাগে ভরার আগে জিনিসটা একবার নাকের কাছে নিছিলা?
- নাকের কাছে নেওন লাগব কী জন্য!
: আহা! নিছিলা কিনা সেইটা বল।
- না।
: এখন নিয়া দেখ- কী পচা গন্ধ!
- পচা গন্ধ মানে? দোকানদাররে বলছি, সবচাইতে ভালোটা দেন। দোকানদার বলছে, এইটাই ভালো। বিশ্ববিখ্যাত জর্ডানা কোম্পানির মাল। ওইটার গায়ে কোম্পানির নাম লেখা আছে দেখ।
: লেখা থাকলেই হইয়া গেল! আমি একটা সাদা কাগজের ওপর এক হাজার টাকা লেখলেই সেইটা এক হাজার টাকার নোট হইয়া যাবে?
চুপচাপ কিছুক্ষণ লবণ বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মাথা নেড়ে বললাম-
: জি না।
থুম ধরে বসে থাকার একপর্যায়ে লবণ বেগম হাতের জিনিসগুলো সশব্দে টেবিলের ওপর রেখে বলল-
: বুঝছি! তোমার প্রতি মায়া দেখাইয়া কোনো লাভ নাই। চল আমার সঙ্গে...
- কোথায়?
: শহরে।
- তোমার সঙ্গে এখন শহরে গেলে গরু কিনব কখন?
: আগে আমার আর বাচ্চাদের কেনাকাটা শেষ কর। তারপর তুমি তোমার ছাগল-গরু-উট যা খুশি কিইন্য...
নৌকাডুবির পর সাঁতার না জানা কোনো যাত্রী যেমন সামনে খড়কুটো যা পায়- আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, আমিও তাই করলাম। বললাম-
: এই এলাকায় আজই গরু-ছাগলের শেষ হাট।
- আগামীকাইল বিদ্যাগঞ্জের হাট আছে।
: এতদূরে যাব!
- মানুষ গরু কেনার জন্য নদী পার হইয়া সিরাজগঞ্জ চইল্যা যাইতেছে, আর তুমি বিদ্যাগঞ্জে যাইতে পারবা না?
মহাফাঁপরে পড়ে গেলাম। লবণ বেগমের হুকুম পালন না করলে সে বেজার হবে। আবার আলাল-দুলালকে ডেকে আনার পর এখন যদি অষ্টধার বাজারে না যাই তাহলে তারা বেজার হবে। কী করব- তাই নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি, লবণ বেগম বলল-
: কী হইল, যাবা না?
এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হওয়া উচিত- না। কিন্তু সংসারে অশান্তি যাতে কম হয় সে ব্যাপারে প্রত্যেক বিবাহিত পুরুষের যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। আমি গভীরভাবে তা উপলব্ধি করার পর লবণ বেগমকে শুনিয়ে আবৃত্তি করলাম-
আলালের বেজারে আমার হইব কী
দুলালের বেজারে আমার হইব কী
বেজার যদি হয় আমার ঘরের যৈবতী-
আন আমার জামা, আন আমার জুতা
সঠিকভাবে পালন করি যৈবতীর কথা॥
প্রতিবেশী হারেজ আলীকে সঙ্গে নিয়ে পরদিন বিদ্যাগঞ্জ বাজারে গেলাম। গরু কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। লেনদেন সম্পন্ন করে চা-নাস্তা খাওয়ার পর হারেজকে বললাম-
: বিসমিল্লাহ বইল্যা তুমি গরু লইয়া হাঁটা দেও। আমি ট্রেনে পিয়ারপুর হইয়া বাড়িতে যাব।
বাড়িতে পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছি- এমন সময় হারেজের ফোন পেলাম। বললাম-
: কী খবর হারেজ! কুন পর্যন্ত আসছ?
- আমি নিমতলী বাজারে।
: মাশাল্লাহ। পা চালাইয়া আইসা পড়।
- ভাইজান...
: কিছু বলবা?
- ভাইজান, একটা ঘটনা ঘইট্যা গেছে!
: কী ঘটনা!
- নিমতলী বাজারে পৌঁছার পর রেললাইন পার হইতেছিলাম, এমন সময় একটা ট্রেন...
: কও কী! গরু কি ট্রেনের নিচে কাটা পড়ছে?
- না।
: তাইলে?
- ট্রেনের শব্দ শুইন্যা গরুটা একটা লাফ দিয়া আমার হাত থেইক্যা ছুইট্যা গেল। পিছনে-পিছনে অনেকক্ষণ দৌড়াইছি ভাইজান, ধরতে পারি নাই।
: আশপাশে খোঁজ-খবর নেও নাই?
- পুরা এলাকা মই দিয়া ফেলছি ভাইজান। কোনো লাভ হয় নাই...
এবার আর ভাতের মায়া করলাম না। একটা ভ্যানযোগাড় করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিমতলী বাজারে পৌঁছলাম। হারেজ আলী রেললাইনের পাশে নির্বাক হয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি ইশারায় তাকে কান্না থামানোর নির্দেশ দিয়ে বললাম-
: কাইন্দা কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কান্না বন্ধ কর।
আকাশে জিলহজ মাসের অপূর্ণ চাঁদ। চপলা নারীর ন্যায় ভেসে বেড়ানো শরতের মেঘমালা সেই চাঁদকে একটু পরপর তার ভালোবাসার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে। আধো আলো আধো ছায়ার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া চারপাশের পরিবেশ যেন রহস্যের বোরকা পরে বসে আছে। সেই রহস্যের অবগুণ্ঠন ভেদ করে সচল-গতিসম্পন্ন কোনো প্রাণীকে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য বলে মনে হল। হঠাৎ হারেজ আলী বলল-
: ভাইজান, মাইকিং করলে কি খোঁজ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
নিমতলী বাজারে মাইকের কোনো দোকান নেই। একজন বলল-
: মাইক পাইতে হইলে মুক্তাগাছা যাওন লাগব। তবে...
- তবে কী?
: আধামাইল সামনে এক এতিমখানায় একটা মাইক আছে। সেই মাইক দিয়া এতিমখানার লোকজন বাজারের দিন টাকা-পয়সা কালেকশন করে। পয়সাকড়ি দিলে তারা মাইক দিতে রাজি হইতে পারে।
এতিমখানার মাইকটা পাওয়া গেল। কী বলতে হবে- তা একটা কাগজে লিখে হারেজের হাতে দিলাম। টর্চের আলোয় লেখাগুলো দেখতে দেখতে হারেজ বলতে লাগল-
ভাইসব- ভাইসব। একটি মাঝারি আকারের ষাঁড় হারানো গিয়াছে। ষাঁড়টির গায়ের রঙ টকটকা লাল। দুই দাঁত। কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি ষাঁড়টির সন্ধান পাইলে ০১৭১৫৪০১১৪৫ নম্বরে ফোন কইরা জানাইলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। ভাইসব- ভাইসব...
মাইকিং করতে করতে অগ্রসর হচ্ছি- পাশ থেকে বয়স্ক এক ব্যক্তির ডাক শুনে ভ্যান দাঁড় করালাম। তিনি ভ্যানের সামনে এসে বললেন-
: কখন হারাইছে?
উত্তর দিল হারেজ। বলল-
: এশার আজানের একটু আগে।
মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে মুরুব্বি বললেন-
: ভালো লোকের হাতে পড়লে গরু ইনশাল্লাহ ফেরত পাওয়া যাবে। আর যদি কোনো দুষ্টুলোকের হাতে পড়ে, তাইলে তার গোশত দিয়া আগামীকাইল কোনো হোটেলে কাবাব তৈরি হবে- সেইটা আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউ জানে না। আইচ্ছা- আপনেরা গরু সাইড় করেন নাই?
এবার উত্তর দিলাম আমি। বললাম-
: করছি তো!
- ইজারাদার যে কাগজ দিছে, তাতে গরুর মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা নাই?
গরু নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় যাতে কোনোরকম ঝামেলা না হয়, সে জন্য মাসুলের কাগজ হারেজের হাতে দিয়েছিলাম। হারেজ পকেট থেকে সেটা বের করে দেয়ার পর দেখলাম-মালিকের নাম লেখা ইজ্জত শেক। ঠিকানা কাবারিকান্দা।
মুরুব্বিকে এ কথা জানানোর পর তিনি বললেন-
: অনেক সময় পোষা প্রাণীরা মালিকের মায়া ত্যাগ করতে পারে না। কোনোভাবে একবার সুযোগ পাইলে ছুটতে ছুটতে মালিকের বাড়িতে যাইয়া হাজির হয়। আপনেরা মাইকিং করতেছেন- করেন। তবে একবার মালিকের বাড়িতে যাইয়া খোঁজ নেন...
কাবারিকান্দা গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখন গভীর রাত। ইজ্জত শেখের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়লাম-
: বাড়িতে কেডা আছুইন গো...
অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মন ধৈর্যের প্রান্তসীমায় পৌঁছার ঠিক আগমুহূর্তে ঘরের ভেতর থেকে খুলুর-খুলুর কাশির শব্দ শোনা গেল। পুনরায় ডাক দিতেই বয়স্ক গলায় একজন বললেন-
: কেডা ডাহুইন গো!
- আমরা।
: আমরা কেডা?
- এইটা ইজ্জত শেখের বাড়ি না?
: হ।
- মেহেরবানী কইরা একটু বাইরে আসেন।
বাইরে যিনি এলেন- তিনি ইজ্জত শেখের বাবা এলেম শেখ। আমাদের মুখে সবকিছু শোনার পর এলেম শেখ বললেন-
: আমরা খাওন-দাওন শেষ কইরা শুইতে যামু, এমন সময় দেখি লালু উঠানে খাড়া। লালুরে গোয়ালে বাইন্ধা রাখছি, কিন্তু ইজ্জত তো বাড়িতে নাই।
ষাঁড়টার তাহলে একটা নামও আছে! নশ্বর পৃথিবীর এই সংসার-বাগানে মানুষ ও একটা অবলা জীবের মধ্যে যে মায়াবৃক্ষটি দিনে দিনে বেড়ে উঠেছে, তার শেঁকড় কতটা গভীরে প্রোথিত তা আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে করতে বললাম-
- ইজ্জত শেখ কই গেছে?
: সে বোরোরচর গেছে তার মেয়ের জামাইরে ঈদের দাওয়াত দিতে। টাকাগুলা অন্য একজনের হাতে পাঠাইয়া দিয়া আমারে মোবাইল কইরা শুধু বলছে- লালুরে বিক্রি কইরা দিছি। এখন সে কার কাছে বিক্রি করছে, কী বিষয়-বৃত্তান্ত- তা না জাইন্যা তো আমি গরু দিতে পারি না।
বৃদ্ধের কথা শুনে মুখ দিয়ে দম ছাড়লাম। তারপর তার হাত দুটো আমার দু’হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম-
: ঈদের তো এখনও দুইদিন বাকি আছে। এই দুইদিন লালু আপনের বাড়িতেই থাকুক। আমরা ঈদের দিন ভোরবেলা আইসা তারে নিয়া যাব...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments