পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ : সমস্যা ও সম্ভাবনা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন
(গতকালের পর)
উপজাতি সম্প্রদায় বিশ্বাস করে জমি, বন ও পাহাড় হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। তাই সরকারিভাবে প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি আর উপজাতিদের বংশানুক্রমিকভাবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। চাকমারা মনে করে এ অঞ্চলের ভূমি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। তাদের আবাসভূমি ছাড়া বাকি সব জমির ওপর যৌথ মালিকানা বহাল। চাকমা সম্প্রদায় মনে করে, যে কেউ যে কোনো জমিতে আবাস করতে পারবে এবং এর জন্য কোনো চুক্তি বা কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। ভূমির মালিকানা এবং ব্যবহার সম্পর্কে বিভিন্ন উপজাতি বিভিন্ন ধারণা পোষণ করে থাকে। চাক উপজাতি মনে করে অন্য কেউ আগে ব্যবহার না করলে, যে কোনো জমি চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা যাবে। খিয়াং জনগোষ্ঠী মনে করে সন্তান ও জমি হচ্ছে প্রকৃতির দান এবং প্রত্যেকের জমির ওপর সমান অধিকার রয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির উন্মেষ ঘটলেও উপজাতি সম্প্রদায় এখনও জমির ব্যাপারে তাদের সনাতনী চিন্তাভাবনা আঁকড়ে ধরে আছে। এছাড়া CHT Regulation এর ৪২ ধারা অনুযায়ী জুম চাষের জন্য মালিকানার দরকার হয় না। ফলে উপজাতীয়রা নিবন্ধন ছাড়াই জমিতে বসবাস এবং চাষাবাদ করতে পারে এবং সার্কেল প্রধানকে খাজনা দিয়ে তারা নতুন জমির মালিকানা লাভ করে। বাস্তবতার নিরিখে উপজাতি সম্প্রদায়ের এ উপলব্ধি আধুনিক সময়োপযোগী মাত্রা পাবে এটাই কাম্য।
যেহেতু সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ভূমি জরিপ হয়নি, তাই এ অঞ্চলের মোট ভূমির পরিমাণ নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য এলাকার মোট জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ৭৭৫.৬৩ বর্গমাইল, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ১ হাজার ৪২৩ বর্গমাইল এবং অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বন ২ হাজার ৮৯৪.৩৭ বর্গমাইল। উল্লেখ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, কর্ণফুলী পেপার মিল এবং সরকারি অধিভুক্ত জমি শান্তিচুক্তির আওতাধীন নয়। তিন জেলার ব্যক্তিমালিকানাধীন সর্বমোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৪২৩ বর্গমাইল। বাকি ৩ হাজার ৬৭০ বর্গমাইল এলাকা সরকার নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তি। শান্তিচুক্তির ৬৪ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে ভূমি লিজ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যা মহামান্য হাইকোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধি চূড়ান্তকরণে বিলম্ব এবং চেয়ারম্যানের অনাগ্রহের কারণে এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে একসঙ্গে জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সার্কেল প্রধান নিয়ন্ত্রিত প্রচলিত পদ্ধতি দ্বারা ভূমি ব্যবস্থাপনা চলছে। জেলা প্রশাসক সার্কেল প্রধানের পরামর্শক্রমে হেডম্যান নিয়োগ দেন। সার্কেল প্রধানের অধীনে থেকে হেডম্যান তার মৌজার ভূমি এবং জুম চাষ থেকে রাজস্ব আদায় করে। ভূমি প্রশাসন বিশেষত ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যার ফলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে অনেকে মৃত্যুবরণ করে বা ক্ষেত্র বিশেষে আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে অনেকেই অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয়সহ অননুমোদিতভাবে ভূমির মালিক হয়ে থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রতারক নিজ নামে ভূমি নিবন্ধন করে নিরীহ জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত দাঙ্গার জন্ম দিচ্ছে। অবৈধভাবে জমি দখল না করলে জমির মালিক হওয়া কঠিন- এমন বাস্তবতা পার্বত্যাঞ্চলে বিতর্ক এবং সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জটিলতা দীর্ঘসূত্রতা লাভ করছে।
এ অঞ্চলে টেকসই শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে ভূমি সমস্যা সমাধান অতীব জরুরি। ভূমি কমিশনকে অবৈধভাবে দখলকৃত জমি এবং পাহাড়ের মালিকানা বাতিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বাস্তবিক সমস্যার কারণে কমিশন আশানুরূপভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। ২৭ জানুয়ারি ২০১০ সালে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত প্রথম ভূমি কমিশনের সভায় ভূমি সমস্যা সমাধানের আগে ভূমি জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু কমিশনের উপজাতীয় সদস্যরা সর্বপ্রথমে ‘CHT Land Dispute Settlement Commission Act 2001’ সংশোধনের দাবি জানান। সে মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ১৯টি ধারা সংশোধনের দাবি করেন। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রথমে ২৩টি ধারা সংশোধন করার কথা বললেও পরে ১৩টি ধারা সংশোধনের দাবি জানান। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যালোচনা কমিটি ২২ জানুয়ারি ২০১২ সালে ১২টি ধারা সংশোধনী করার পরামর্শ প্রদান করে। ২৮ মার্চ ২০১২ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় উল্লেখিত আইন সংশোধনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আহ্বান করে। ভূমি মন্ত্রণালয় ৬টি সংশোধনের জন্য সর্বসম্মতভাবে একমত হয় এবং বাকি ৭টি সংবিধানের পরিপন্থী বলে অনুমোদন পায়নি। এ সংশোধনগুলোর কিছু পদ্ধতিগতভাবে বেশ জটিল, কিছু অঞ্চলে অবস্থিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ, কিছু সংশোধন কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথে অন্তরায় ও কয়েকটি নীতিগতভাবে কার্যপ্রণালীর পরিপন্থী। এটা ধরে নেয়া যায় যে, শান্তিচুক্তির আগে উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় না থেকে পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি সার্বজনীন কর্মপন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। আনীত সংশোধনীগুলো সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা সঙ্গত ও শান্তিচুক্তির মূল্যবোধের সঙ্গে কতটা জুতসই তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
দীর্ঘ সময় ধরে কমিশনের স্থবিরতার জন্য মূলত কমিশনের উপজাতীয় সদস্যরা কমিশনকে তার কাজকর্মে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের ব্যাপারে অনাগ্রহই দায়ী। এছাড়া কিছু গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীর উপস্থাপনায় বস্তুনিষ্ঠতার অভাব মৌলিক বিষয়গুলোকে আড়াল করে রেখেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, শান্তিচুক্তির পর থেকে এপ্রিল ২০১২ পর্যন্ত সর্বমোট ৫১৭ জন নিহত, ৮৭৭ জন আহত আর ৯৫৯ জন অপহৃত হয়েছে। অথচ আঞ্চলিক নেতারা বিরাজমান আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন ব্যতিরেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। এমনকি সিএইচটি কমিশন, United Nations Permanent Forum on Indegenous Issue (UNFPII), ইউরোপীয় ইউনিয়ন উপজাতীয়দের প্রতি অযৌক্তিকভাবে সমর্থন ব্যক্ত করে বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলছে। বিভিন্ন বিদেশী ব্যক্তি ও সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে উপজাতি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা পার্বত্য অঞ্চলকে একটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরির বুনিয়াদ সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান Lord Eric Avebury একজন অভিজ্ঞ ব্রিটিশ সংসদ সদস্য। বৈশ্বিক নানা বিষয়ে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে; যেমন জনগণের অধিকার আদায়ে এর আগে তিনি পেরু, ক্যামেরুন এবং ইরানে কাজ করেছেন। তিনি সুদান এবং পূর্ব তিমুরে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বেশ পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এরই মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক উপজাতীয়দের খ্রিস্টান ধর্র্মে দীক্ষিত করার তথ্য রয়েছে, যা এ এলাকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। কমিশনের অপর সদস্য সুইডেনের নাগরিক Mr Lars Anders Bear বিভিন্ন দেশের আদিবাসী ইস্যু নিয়ে কাজ করেন। তিনি UNFPII-এ স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে নিয়োজিত। UNFPII এর ১০ম অধিবেশনে Mr Lars Anders Bear উপস্থাপিত ‘Status of the Implementation of CHT Peace Accord of 1997’ যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কমিশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন এবং তার সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত টঘঋচওও এর স্বার্থে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসামান্য অবদানের পরও তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ইস্যুটি বহির্বিশ্বে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আদিবাসী জনগণের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ ১৯৫৭ সালে আইএলও ১০৭ প্রণয়ন করে। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং কোনো দেশের সার্বভৌমত্বকে খাটো করেনি, তাই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আইএলও ১০৭ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে প্রণীত উপজাতিদের নিরাপত্তাবিষয়ক আইএলও ১৬৯ সনদ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২২টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষর করলেও এশিয়ার নেপাল ছাড়া বাকি কোনো দেশ স্বাক্ষর করেনি। আইএলও ১৬৯-এর সনদ অনুযায়ী ঐতিহ্যগত, ব্যক্তিগত এবং সাম্প্রদায়িক মালিকানা ছাড়াও রাষ্ট্র ভূমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে। আশ্চর্যজনকভাবে এ সনদে সরকারি খাসজমির ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই। অথচ এ খাসজমিতে বাঙালিদের অভিবাসনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ভূমি সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধিসহ নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সনদ মোতাবেক স্থানীয় অধিবাসীদের অনুমতিক্রমে সামরিক অভিযানসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যেন, বহিরাগত কেউ জমির মালিক হতে না পারে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ ইস্যুটি আজ আর কোনো আলাদা বিষয় নয়। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও উপজাতি সম্প্র্রদায়গুলো ‘আদিবাসী’ শব্দটি ভূমি অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে ব্যবহার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মরহুম বোমাং সার্কেল প্রধান অং সাং প্র“ পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো আদিবাসীর অস্তিত্ব নেই। ২০০৮ সালে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় যখন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও এমন দাবির পক্ষে অবস্থান নেয়নি। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার নেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪১ ও ৩৪২নং ধারা অনুযায়ী ভারতে Scheduled Caste ও Scheduled Tribes রয়েছে। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৪ ভাগ লোক বিভিন্ন গোত্রের হলেও তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে একসঙ্গে বসবাস করছেন। মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত ভূমি বিরোধ সংশোধন আইন এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তবে এতদসঙ্গে বাঙালিদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি বিবেচনা ব্যতিরেকে এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতটা সহায়ক হবে তা সময়ই বলে দেবে। অন্তত পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন বাঙালি সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া থেকে এমনটিই লক্ষণীয়।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর জাতি সফলভাবে সামাজিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই জমি এবং সম্পদ সংকুচিত হয়ে আসছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তাই পার্বত্যাঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতির সমাধানে কালক্ষেপণ বৈশ্বিক বাস্তবতায় কাম্য নয়। উপজাতি বিষয়ে আমাদের সুষমভাবে তাদের অধিকার এবং উত্তরাধিকার নিশ্চিতকরণসহ বাঙালিদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা জরুরি। পুনর্বাসিত বাঙালিদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বটি সরকারকেই পালন করতে হবে। পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাঙালি। সময়ের পরিক্রমায় পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের আগমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যার সুষ্ঠু সমাধান বাঙালিদের ফিরিয়ে নেয়ার মধ্যে নয়, বরং উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ নিশ্চিতকরণসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এখনই সময় যেন সরকার গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং সর্বস্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করে চুক্তি বাস্তবায়নের বাকি কাজ সম্পন্নের জন্য এগিয়ে যায়। এ অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে এখানকার অধিবাসীকে দেশের মূল স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত করা জরুরি। জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রেখে সরকারের পাশাপাশি উপজাতীয় নেতাদের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে এ অঞ্চলের শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে কাজ করতে পারলেই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ সুগম হবে। (শেষ)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি : পার্বত্য এলাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত
(গতকালের পর)
উপজাতি সম্প্রদায় বিশ্বাস করে জমি, বন ও পাহাড় হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। তাই সরকারিভাবে প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি আর উপজাতিদের বংশানুক্রমিকভাবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। চাকমারা মনে করে এ অঞ্চলের ভূমি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। তাদের আবাসভূমি ছাড়া বাকি সব জমির ওপর যৌথ মালিকানা বহাল। চাকমা সম্প্রদায় মনে করে, যে কেউ যে কোনো জমিতে আবাস করতে পারবে এবং এর জন্য কোনো চুক্তি বা কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। ভূমির মালিকানা এবং ব্যবহার সম্পর্কে বিভিন্ন উপজাতি বিভিন্ন ধারণা পোষণ করে থাকে। চাক উপজাতি মনে করে অন্য কেউ আগে ব্যবহার না করলে, যে কোনো জমি চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা যাবে। খিয়াং জনগোষ্ঠী মনে করে সন্তান ও জমি হচ্ছে প্রকৃতির দান এবং প্রত্যেকের জমির ওপর সমান অধিকার রয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির উন্মেষ ঘটলেও উপজাতি সম্প্রদায় এখনও জমির ব্যাপারে তাদের সনাতনী চিন্তাভাবনা আঁকড়ে ধরে আছে। এছাড়া CHT Regulation এর ৪২ ধারা অনুযায়ী জুম চাষের জন্য মালিকানার দরকার হয় না। ফলে উপজাতীয়রা নিবন্ধন ছাড়াই জমিতে বসবাস এবং চাষাবাদ করতে পারে এবং সার্কেল প্রধানকে খাজনা দিয়ে তারা নতুন জমির মালিকানা লাভ করে। বাস্তবতার নিরিখে উপজাতি সম্প্রদায়ের এ উপলব্ধি আধুনিক সময়োপযোগী মাত্রা পাবে এটাই কাম্য।
যেহেতু সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ভূমি জরিপ হয়নি, তাই এ অঞ্চলের মোট ভূমির পরিমাণ নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য এলাকার মোট জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ৭৭৫.৬৩ বর্গমাইল, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ১ হাজার ৪২৩ বর্গমাইল এবং অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বন ২ হাজার ৮৯৪.৩৭ বর্গমাইল। উল্লেখ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, কর্ণফুলী পেপার মিল এবং সরকারি অধিভুক্ত জমি শান্তিচুক্তির আওতাধীন নয়। তিন জেলার ব্যক্তিমালিকানাধীন সর্বমোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৪২৩ বর্গমাইল। বাকি ৩ হাজার ৬৭০ বর্গমাইল এলাকা সরকার নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তি। শান্তিচুক্তির ৬৪ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে ভূমি লিজ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যা মহামান্য হাইকোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধি চূড়ান্তকরণে বিলম্ব এবং চেয়ারম্যানের অনাগ্রহের কারণে এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে একসঙ্গে জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সার্কেল প্রধান নিয়ন্ত্রিত প্রচলিত পদ্ধতি দ্বারা ভূমি ব্যবস্থাপনা চলছে। জেলা প্রশাসক সার্কেল প্রধানের পরামর্শক্রমে হেডম্যান নিয়োগ দেন। সার্কেল প্রধানের অধীনে থেকে হেডম্যান তার মৌজার ভূমি এবং জুম চাষ থেকে রাজস্ব আদায় করে। ভূমি প্রশাসন বিশেষত ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যার ফলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে অনেকে মৃত্যুবরণ করে বা ক্ষেত্র বিশেষে আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে অনেকেই অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয়সহ অননুমোদিতভাবে ভূমির মালিক হয়ে থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রতারক নিজ নামে ভূমি নিবন্ধন করে নিরীহ জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত দাঙ্গার জন্ম দিচ্ছে। অবৈধভাবে জমি দখল না করলে জমির মালিক হওয়া কঠিন- এমন বাস্তবতা পার্বত্যাঞ্চলে বিতর্ক এবং সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জটিলতা দীর্ঘসূত্রতা লাভ করছে।
এ অঞ্চলে টেকসই শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে ভূমি সমস্যা সমাধান অতীব জরুরি। ভূমি কমিশনকে অবৈধভাবে দখলকৃত জমি এবং পাহাড়ের মালিকানা বাতিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বাস্তবিক সমস্যার কারণে কমিশন আশানুরূপভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। ২৭ জানুয়ারি ২০১০ সালে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত প্রথম ভূমি কমিশনের সভায় ভূমি সমস্যা সমাধানের আগে ভূমি জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু কমিশনের উপজাতীয় সদস্যরা সর্বপ্রথমে ‘CHT Land Dispute Settlement Commission Act 2001’ সংশোধনের দাবি জানান। সে মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ১৯টি ধারা সংশোধনের দাবি করেন। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রথমে ২৩টি ধারা সংশোধন করার কথা বললেও পরে ১৩টি ধারা সংশোধনের দাবি জানান। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যালোচনা কমিটি ২২ জানুয়ারি ২০১২ সালে ১২টি ধারা সংশোধনী করার পরামর্শ প্রদান করে। ২৮ মার্চ ২০১২ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় উল্লেখিত আইন সংশোধনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আহ্বান করে। ভূমি মন্ত্রণালয় ৬টি সংশোধনের জন্য সর্বসম্মতভাবে একমত হয় এবং বাকি ৭টি সংবিধানের পরিপন্থী বলে অনুমোদন পায়নি। এ সংশোধনগুলোর কিছু পদ্ধতিগতভাবে বেশ জটিল, কিছু অঞ্চলে অবস্থিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ, কিছু সংশোধন কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথে অন্তরায় ও কয়েকটি নীতিগতভাবে কার্যপ্রণালীর পরিপন্থী। এটা ধরে নেয়া যায় যে, শান্তিচুক্তির আগে উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় না থেকে পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি সার্বজনীন কর্মপন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। আনীত সংশোধনীগুলো সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা সঙ্গত ও শান্তিচুক্তির মূল্যবোধের সঙ্গে কতটা জুতসই তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
দীর্ঘ সময় ধরে কমিশনের স্থবিরতার জন্য মূলত কমিশনের উপজাতীয় সদস্যরা কমিশনকে তার কাজকর্মে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের ব্যাপারে অনাগ্রহই দায়ী। এছাড়া কিছু গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীর উপস্থাপনায় বস্তুনিষ্ঠতার অভাব মৌলিক বিষয়গুলোকে আড়াল করে রেখেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, শান্তিচুক্তির পর থেকে এপ্রিল ২০১২ পর্যন্ত সর্বমোট ৫১৭ জন নিহত, ৮৭৭ জন আহত আর ৯৫৯ জন অপহৃত হয়েছে। অথচ আঞ্চলিক নেতারা বিরাজমান আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন ব্যতিরেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। এমনকি সিএইচটি কমিশন, United Nations Permanent Forum on Indegenous Issue (UNFPII), ইউরোপীয় ইউনিয়ন উপজাতীয়দের প্রতি অযৌক্তিকভাবে সমর্থন ব্যক্ত করে বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলছে। বিভিন্ন বিদেশী ব্যক্তি ও সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে উপজাতি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা পার্বত্য অঞ্চলকে একটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরির বুনিয়াদ সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান Lord Eric Avebury একজন অভিজ্ঞ ব্রিটিশ সংসদ সদস্য। বৈশ্বিক নানা বিষয়ে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে; যেমন জনগণের অধিকার আদায়ে এর আগে তিনি পেরু, ক্যামেরুন এবং ইরানে কাজ করেছেন। তিনি সুদান এবং পূর্ব তিমুরে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বেশ পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এরই মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক উপজাতীয়দের খ্রিস্টান ধর্র্মে দীক্ষিত করার তথ্য রয়েছে, যা এ এলাকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। কমিশনের অপর সদস্য সুইডেনের নাগরিক Mr Lars Anders Bear বিভিন্ন দেশের আদিবাসী ইস্যু নিয়ে কাজ করেন। তিনি UNFPII-এ স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে নিয়োজিত। UNFPII এর ১০ম অধিবেশনে Mr Lars Anders Bear উপস্থাপিত ‘Status of the Implementation of CHT Peace Accord of 1997’ যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কমিশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন এবং তার সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত টঘঋচওও এর স্বার্থে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসামান্য অবদানের পরও তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ইস্যুটি বহির্বিশ্বে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আদিবাসী জনগণের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ ১৯৫৭ সালে আইএলও ১০৭ প্রণয়ন করে। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং কোনো দেশের সার্বভৌমত্বকে খাটো করেনি, তাই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আইএলও ১০৭ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে প্রণীত উপজাতিদের নিরাপত্তাবিষয়ক আইএলও ১৬৯ সনদ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২২টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষর করলেও এশিয়ার নেপাল ছাড়া বাকি কোনো দেশ স্বাক্ষর করেনি। আইএলও ১৬৯-এর সনদ অনুযায়ী ঐতিহ্যগত, ব্যক্তিগত এবং সাম্প্রদায়িক মালিকানা ছাড়াও রাষ্ট্র ভূমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে। আশ্চর্যজনকভাবে এ সনদে সরকারি খাসজমির ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই। অথচ এ খাসজমিতে বাঙালিদের অভিবাসনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ভূমি সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধিসহ নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সনদ মোতাবেক স্থানীয় অধিবাসীদের অনুমতিক্রমে সামরিক অভিযানসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যেন, বহিরাগত কেউ জমির মালিক হতে না পারে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ ইস্যুটি আজ আর কোনো আলাদা বিষয় নয়। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও উপজাতি সম্প্র্রদায়গুলো ‘আদিবাসী’ শব্দটি ভূমি অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে ব্যবহার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মরহুম বোমাং সার্কেল প্রধান অং সাং প্র“ পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো আদিবাসীর অস্তিত্ব নেই। ২০০৮ সালে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় যখন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও এমন দাবির পক্ষে অবস্থান নেয়নি। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার নেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪১ ও ৩৪২নং ধারা অনুযায়ী ভারতে Scheduled Caste ও Scheduled Tribes রয়েছে। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৪ ভাগ লোক বিভিন্ন গোত্রের হলেও তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে একসঙ্গে বসবাস করছেন। মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত ভূমি বিরোধ সংশোধন আইন এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তবে এতদসঙ্গে বাঙালিদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি বিবেচনা ব্যতিরেকে এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতটা সহায়ক হবে তা সময়ই বলে দেবে। অন্তত পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন বাঙালি সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া থেকে এমনটিই লক্ষণীয়।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর জাতি সফলভাবে সামাজিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই জমি এবং সম্পদ সংকুচিত হয়ে আসছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তাই পার্বত্যাঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতির সমাধানে কালক্ষেপণ বৈশ্বিক বাস্তবতায় কাম্য নয়। উপজাতি বিষয়ে আমাদের সুষমভাবে তাদের অধিকার এবং উত্তরাধিকার নিশ্চিতকরণসহ বাঙালিদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা জরুরি। পুনর্বাসিত বাঙালিদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বটি সরকারকেই পালন করতে হবে। পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাঙালি। সময়ের পরিক্রমায় পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের আগমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যার সুষ্ঠু সমাধান বাঙালিদের ফিরিয়ে নেয়ার মধ্যে নয়, বরং উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ নিশ্চিতকরণসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এখনই সময় যেন সরকার গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং সর্বস্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করে চুক্তি বাস্তবায়নের বাকি কাজ সম্পন্নের জন্য এগিয়ে যায়। এ অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে এখানকার অধিবাসীকে দেশের মূল স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত করা জরুরি। জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রেখে সরকারের পাশাপাশি উপজাতীয় নেতাদের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে এ অঞ্চলের শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে কাজ করতে পারলেই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ সুগম হবে। (শেষ)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি : পার্বত্য এলাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত
No comments