পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জয়
পাকিস্তানে ১১ মের নির্বাচনটি ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই প্রথম
দেশটিতে কোনো নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে
পেরেছে। এবারই পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এমনকি নির্বাচনের
পর কোনো দল ‘মানি না মানব না’ বলে শোরগোল না তুলে প্রজ্ঞার পরিচয়
দিয়েছে। নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ যে তৃতীয়বারের মতো
ক্ষমতাসীন হতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এতে প্রমাণিত হয়েছে
সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতি দিতে না পারলে এবং দুর্নীতি কমাতে না পারলে কোনো
দলের পক্ষেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব নয়। প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর প্রতি
জনগণের আবেগকে পুঁজি করে পিপিপি ক্ষমতায় এলেও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে
ব্যর্থ হয়েছে। জাতি-গোষ্ঠীগত সহিংসতা ও অব্যাহত তালেবানি সন্ত্রাসের
পাশাপাশি বিদ্যুতের তীব্র সংকট পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনকে
বিপর্যস্ত করলেও পিপিপি সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমনকি মেয়াদের
শেষ দিকে এসে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের সঙ্গে বিরোধে জড়ানো ছিল তার
রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ। নির্বাচনের সময় দলটির নেতৃত্বের সংকট আরও
প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। নির্বাচনে সেই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে
কিছুটা ডানের দিকে ঝুঁকে থাকা নওয়াজের মুসলিম লিগ। এই বিজয়ের পেছনে দল
হিসেবে মুসলিম লিগের কৃতিত্বের চেয়েও ক্ষমতাসীন পিপিপির ব্যর্থতাই নিয়ামক
শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, যদিও বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে দলটির শক্ত ভিত
বরাবরই ছিল। এই নির্বাচনের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, সাবেক ক্রিকেটার ইমরান
খানের দল পিটিআইয়ের তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। দলটি নতুন
ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বাইরে এসে তাঁদের এই
সমর্থন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিক পরিবর্তনেরই পূর্বাভাস। বিজয়ী
নওয়াজ শরিফের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তিনি পুরোনো পদ্ধতিই অনুসরণ করবেন,
না অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতিমুক্ত এবং দেশ পরিচালনায় দক্ষ
একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। এর আগে দুই দফায় দুর্নীতি ও
অযোগ্যতার অভিযোগে তাঁর সরকারকে অকালে বিদায় নিতে হয়েছে। তাঁর দল কেন্দ্র
ও পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে বটে, কিন্তু বাকি তিনটি প্রদেশেই
বিরোধী দলের আসনে বসতে হবে। পাকিস্তানে কেন্দ্রের একাধিপত্য কেবল সুশাসন ও
গণতন্ত্রের অন্তরায় নয়, বিচ্ছিন্নতাবাদও উসকে দেয়। নওয়াজ শরিফের সামনে
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে
সম্পর্কোন্নয়ন। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা চলে
যাওয়ার পর কীভাবে তালেবান জঙ্গিদের মোকাবিলা করা হবে, অনেকটা তার ওপরই
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি নির্ভর করছে। গণতান্ত্রিক
ধারাবাহিকতা এবং নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপটে আমরা নওয়াজ
শরিফের বিজয়কে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে পাকিস্তানের এই নির্বাচনকে আমরা
ইতিহাসের অর্ধেক সময় ধরে সেনাশাসনে পীড়িত দেশটির গণতন্ত্রের বিজয়
হিসেবেও বিবেচনা করি।
No comments