হে কবিতা, দুধভাত, তুমি ফিরে এসো
উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা, হে দুধভাত, তুমি ফিরে এসো...তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়।
কবি আবুল হাসানের কবিতা।
আজ সারাটাক্ষণ এই কথাটাই বলি। সুসময় ফিরে আসুক। কবিতা পড়ার মতো সুসময়। আমাদের সন্তানেরা যেন দুধে-ভাতে সুখে থাকে।
আমরা যেন সকালবেলার সংবাদপত্রে সুখবর পড়তে পারি।
দুঃসংবাদ শুনতে আর ভালো লাগে না। দুঃসংবাদ পড়তে আর ভালো লাগে না।
একটা সুসংবাদ চাই। অন্তত একটা সুখবর দাও, প্রভু।
শেষতক বাংলাদেশ একটা টি-টোয়েন্টি জিতল। সাকিব আল হাসান ম্যাচসেরা হলেন। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। তবুও তো জয়। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে বলেই জয় ছাড়া অন্য কিছু নিতে পারি না। এরই মধ্যে আরেকটা সুখবর এল। রেশমার অক্ষত অবস্থায় ১৬ দিন পরে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ফিরে আসা। আমাদের মনে হলো, রেশমার সঙ্গে যেন আমরা সবাই বেঁচে উঠলাম। যেমন প্রতিবার প্রতিটি অপঘাত মৃত্যুর খবরে এক-একবার করে মরে যাচ্ছিলাম। ভেতরে-বাইরে। রেশমা বেঁচে থেকে যেন বলে উঠলেন, আমরা মরিনি, আমরা মরি না।
আবুল হাসানেরই কবিতার লাইন বিড়বিড় করে বলি:
‘মারী ও মড়কে যার মৃত্যু হয় হোক, আমি মরি নাই, শোনো, কেউ কোনোদিন কোনো অস্ত্রে আমার আত্মাকে দীর্ণ মারতে পারবে না।’ কিংবা ‘আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীব একজন বললেন, শাহীনাও বাংলাদেশ, রেশমাও বাংলাদেশ। শাহীনাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। এটা যেমন সত্য, রেশমা বেঁচে আছেন, আর তাঁকে উদ্ধার করা গেছে, এটাও সত্য। এই দুই সত্য মিলেও বাংলাদেশ।
আরেকজন বললেন, না, রেশমাই বাংলাদেশ। আমরা মরি না। আমরা বেঁচে থাকি।
কী জানি, এসবই তো কাব্য করে বলা কথা।
এই রকম অসহায় মৃত্যু তো আগেও দেখেছি মানুষের। হয়তো এই রকম হাজারে হাজারে নয়। কিন্তু দেখেছি তো!
একবার এক রাশান সাবমেরিনে অনেক কজন নাবিক আটকা পড়েছিলেন। সারা পৃথিবী জানল ওঁরা মারা যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের উদ্ধার করা গেল না। ১১৮ জন নাবিক মারা গেলেন। সেটা এই সহস্রাব্দেরই কথা।
মানুষের ক্ষমতা কত সীমিত। ধ্বংসের ক্ষমতা অপরিসীম, রক্ষা করার ক্ষমতা আছে সামান্যই। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার পর উদ্ধারকর্মীরা গিয়েছিলেন সেই ভবনে ছুটে, তাঁরাও মারা পড়েছিলেন।
একটা মানুষকেও বাঁচানো কত কঠিন। একটা প্রাণেরও কত মূল্য। শাহীনাকে যখন বাঁচানো গেল না, উদ্ধারকর্মীরা কীভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
আবার একটা মানুষ বেঁচে উঠলে যেন সমগ্র মানবতাই বেঁচে ওঠে। জেগে ওঠে। রেশমার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমরা সকলেই বেঁচে উঠলাম।
তার পরেও কেন আমরা এত মানুষ মারার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। কীভাবে, কত অবলীলায় আমরা মানুষকে মারছি।
ইশ্। কেমন করে একজন মানুষ পারে আরেকজন মানুষকে আঘাত করতে। কেমন করে একজন মানুষ পারে আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে!
বারবার করে বলি, হিংসা নয়, আসুন, ভালোবাসার কথা বলি। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলি, আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি, আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছি। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসারই জয় হবে। হতে যে হবেই।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণে যা বলেছিলেন তাঁর গুরু উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে, নিজেকে সেটাই যেন বারবার করে বলি: “জুলুম নির্যাতন নির্বাসন সত্ত্বেও আমাদের জবাব হচ্ছে ‘জীবন’। বন্যা, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ—কোনো কিছুই মৃত্যুর ওপরে জীবনের সুবিধার প্রাধান্যকে দমাতে পারেনি। এ এমন এক সুবিধা, যা দ্রুত বাড়ে আর গতিপ্রাপ্ত হয়। প্রতি বছর সাত কোটি ৪০ লাখ জন বেশি জন্মায় মৃতের সংখ্যার চেয়ে, যা নিউইয়র্কের জনসংখ্যার সাত গুণ। এসব জন্মের বেশির ভাগই ঘটে কম সম্পদের দেশগুলোতে, অবশ্যই যার মধ্যে লাতিন আমেরিকা অন্যতম। অন্যদিকে সম্পদশালী দেশগুলো এমন সব অস্ত্রভান্ডার গড়ে তুলেছে, যা কেবল সব মানুষকে ১০০ বার মারতে পারে তা-ই না, এই পৃথিবীর সব প্রাণীকুলকেই ধ্বংস করতে পারে। এমনি এক দিনে আমার গুরু উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, আমি মানুষের অবসান মেনে নিতে অস্বীকার করি।” মার্কেজ তাঁর ভাষণে একটা বিকল্প ইউটোপিয়া নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছিলেন এইভাবে, ‘একটা নতুন এবং যুগান্তকারী জীবনের কল্পরাজ্য, যেখানে কেউ ধার্য করে দেবে না যে অন্যেরা কীভাবে মারা যাবে, যেখানে ভালোবাসা প্রমাণিত হবে সত্য বলে এবং সুখ হয়ে উঠবে সম্ভবপর, যেখানে শত বছরের নির্জনতার শাস্তিপ্রাপ্ত মানবজাতি শেষবারের মতো এবং চিরকালের মতো পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাবে।’ বাংলাদেশের মানুষেরও মৃত্যু নেই। আমাদের দরকার এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে কেউ ঠিক করে দেবে না অন্যে কীভাবে মারা যাবে। ভালোবাসা যেখানে সত্য হয়ে উঠবে, সুখ হয়ে উঠবে সম্ভবপর।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ওসাংবাদিক।
কবি আবুল হাসানের কবিতা।
আজ সারাটাক্ষণ এই কথাটাই বলি। সুসময় ফিরে আসুক। কবিতা পড়ার মতো সুসময়। আমাদের সন্তানেরা যেন দুধে-ভাতে সুখে থাকে।
আমরা যেন সকালবেলার সংবাদপত্রে সুখবর পড়তে পারি।
দুঃসংবাদ শুনতে আর ভালো লাগে না। দুঃসংবাদ পড়তে আর ভালো লাগে না।
একটা সুসংবাদ চাই। অন্তত একটা সুখবর দাও, প্রভু।
শেষতক বাংলাদেশ একটা টি-টোয়েন্টি জিতল। সাকিব আল হাসান ম্যাচসেরা হলেন। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। তবুও তো জয়। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে বলেই জয় ছাড়া অন্য কিছু নিতে পারি না। এরই মধ্যে আরেকটা সুখবর এল। রেশমার অক্ষত অবস্থায় ১৬ দিন পরে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ফিরে আসা। আমাদের মনে হলো, রেশমার সঙ্গে যেন আমরা সবাই বেঁচে উঠলাম। যেমন প্রতিবার প্রতিটি অপঘাত মৃত্যুর খবরে এক-একবার করে মরে যাচ্ছিলাম। ভেতরে-বাইরে। রেশমা বেঁচে থেকে যেন বলে উঠলেন, আমরা মরিনি, আমরা মরি না।
আবুল হাসানেরই কবিতার লাইন বিড়বিড় করে বলি:
‘মারী ও মড়কে যার মৃত্যু হয় হোক, আমি মরি নাই, শোনো, কেউ কোনোদিন কোনো অস্ত্রে আমার আত্মাকে দীর্ণ মারতে পারবে না।’ কিংবা ‘আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীব একজন বললেন, শাহীনাও বাংলাদেশ, রেশমাও বাংলাদেশ। শাহীনাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। এটা যেমন সত্য, রেশমা বেঁচে আছেন, আর তাঁকে উদ্ধার করা গেছে, এটাও সত্য। এই দুই সত্য মিলেও বাংলাদেশ।
আরেকজন বললেন, না, রেশমাই বাংলাদেশ। আমরা মরি না। আমরা বেঁচে থাকি।
কী জানি, এসবই তো কাব্য করে বলা কথা।
এই রকম অসহায় মৃত্যু তো আগেও দেখেছি মানুষের। হয়তো এই রকম হাজারে হাজারে নয়। কিন্তু দেখেছি তো!
একবার এক রাশান সাবমেরিনে অনেক কজন নাবিক আটকা পড়েছিলেন। সারা পৃথিবী জানল ওঁরা মারা যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের উদ্ধার করা গেল না। ১১৮ জন নাবিক মারা গেলেন। সেটা এই সহস্রাব্দেরই কথা।
মানুষের ক্ষমতা কত সীমিত। ধ্বংসের ক্ষমতা অপরিসীম, রক্ষা করার ক্ষমতা আছে সামান্যই। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার পর উদ্ধারকর্মীরা গিয়েছিলেন সেই ভবনে ছুটে, তাঁরাও মারা পড়েছিলেন।
একটা মানুষকেও বাঁচানো কত কঠিন। একটা প্রাণেরও কত মূল্য। শাহীনাকে যখন বাঁচানো গেল না, উদ্ধারকর্মীরা কীভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
আবার একটা মানুষ বেঁচে উঠলে যেন সমগ্র মানবতাই বেঁচে ওঠে। জেগে ওঠে। রেশমার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমরা সকলেই বেঁচে উঠলাম।
তার পরেও কেন আমরা এত মানুষ মারার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। কীভাবে, কত অবলীলায় আমরা মানুষকে মারছি।
ইশ্। কেমন করে একজন মানুষ পারে আরেকজন মানুষকে আঘাত করতে। কেমন করে একজন মানুষ পারে আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে!
বারবার করে বলি, হিংসা নয়, আসুন, ভালোবাসার কথা বলি। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলি, আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি, আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছি। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসারই জয় হবে। হতে যে হবেই।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণে যা বলেছিলেন তাঁর গুরু উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে, নিজেকে সেটাই যেন বারবার করে বলি: “জুলুম নির্যাতন নির্বাসন সত্ত্বেও আমাদের জবাব হচ্ছে ‘জীবন’। বন্যা, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ—কোনো কিছুই মৃত্যুর ওপরে জীবনের সুবিধার প্রাধান্যকে দমাতে পারেনি। এ এমন এক সুবিধা, যা দ্রুত বাড়ে আর গতিপ্রাপ্ত হয়। প্রতি বছর সাত কোটি ৪০ লাখ জন বেশি জন্মায় মৃতের সংখ্যার চেয়ে, যা নিউইয়র্কের জনসংখ্যার সাত গুণ। এসব জন্মের বেশির ভাগই ঘটে কম সম্পদের দেশগুলোতে, অবশ্যই যার মধ্যে লাতিন আমেরিকা অন্যতম। অন্যদিকে সম্পদশালী দেশগুলো এমন সব অস্ত্রভান্ডার গড়ে তুলেছে, যা কেবল সব মানুষকে ১০০ বার মারতে পারে তা-ই না, এই পৃথিবীর সব প্রাণীকুলকেই ধ্বংস করতে পারে। এমনি এক দিনে আমার গুরু উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, আমি মানুষের অবসান মেনে নিতে অস্বীকার করি।” মার্কেজ তাঁর ভাষণে একটা বিকল্প ইউটোপিয়া নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছিলেন এইভাবে, ‘একটা নতুন এবং যুগান্তকারী জীবনের কল্পরাজ্য, যেখানে কেউ ধার্য করে দেবে না যে অন্যেরা কীভাবে মারা যাবে, যেখানে ভালোবাসা প্রমাণিত হবে সত্য বলে এবং সুখ হয়ে উঠবে সম্ভবপর, যেখানে শত বছরের নির্জনতার শাস্তিপ্রাপ্ত মানবজাতি শেষবারের মতো এবং চিরকালের মতো পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাবে।’ বাংলাদেশের মানুষেরও মৃত্যু নেই। আমাদের দরকার এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে কেউ ঠিক করে দেবে না অন্যে কীভাবে মারা যাবে। ভালোবাসা যেখানে সত্য হয়ে উঠবে, সুখ হয়ে উঠবে সম্ভবপর।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ওসাংবাদিক।
No comments