স্মৃতির অতলে ঢাকার ‘টাকার হাট’ by শফিক রহমান
সংরক্ষণ,
গবেষণা আর প্রচারণার অভাবে স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে ঢাকার ‘টাকার হাট’।
এলাকাটির নাম বিকৃত হয়ে এখন ‘টেকের হাট’ ধারণ করেছে। সিটি করপোরেশনসহ
সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নথিপত্রে বিকৃত নামটিই ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরান
ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতিহাস অনুসন্ধানে বিশদ
গবেষণা দরকার। ঢাকার ক্ষেত্রে বরাবরই যার ঘাটতি রয়েছে।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানের কাপ্তানবাজার মোড় থেকে সদরঘাটমুখী নাবাবপুর সড়ক ধরে দুই পাশের ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যসহ বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলো পেছনে ফেলে সামনে এগুলেই ২০৫নং এবং ২০৬নং হোল্ডিংয়ের মাঝ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে সরু একটি লেন। বসত-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠা এবং ছোট ছোট দোকানে ঠাসা লেনটি ভেতরে একটু ঘুরে আবার নবাবপুর সড়েকে এসে শেষ হয়েছে। ছোট এই লেনটিই সবার কাছে আজ ‘টেকের হাট লেন’ হিসেবে পরিচিত। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডেও লেখা তাই।
লেন ধরে একটু এগুলেই ২৪নং টেকের হাট লেন। দোতলা এই স্থাপনাটির কার্নিশে এখনও ঝুলছে নকশা ও কারুকার্য খচিত কাঠের কাজ। যার অধিকাংশ ভেঙ্গে পড়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ভবনটির দেয়াল ঘেষে ডান দিকের পথ ধরে এগুলে মোঘল স্থাপনা রীতিতে নির্মিত আরও কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। যেগুলোর দেয়ালের চুন-সুরকির পলেস্তারা খসে পরে বেড়িয়ে গেছে পাতলা ইটের গাঁথুনি। ভেঙ্গে পড়েছে কার্নিশগুলোও।
বলা হচ্ছে এই স্থাপনাগুলো ঘিরেই ছিল ঢাকার ঐতিহাসিক ‘টাকার হাট’। স্থানীয়দের মুখে মুখেও রটে বেড়াচ্ছে মুদ্রা বেচা-কেনার ইতিহাস ও গল্প। তবে এর স্বপক্ষে জোর যুক্তি তুলেন আরবান স্টাডি গ্রুপের (ইউএসজি) প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলাম। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে পুরান ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এ স্থপতি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, ‘ফিজিক্যাল এভিডেন্স যা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে বলা যায় এখানে মুদ্রা বিনিময়ের একটি কেন্দ্র ছিল।’
তিনি বলেন, ঢাকার মোঘলরা যখন চলে গেলেন, বিশেষ করে এখান থেকে ক্যাপিটাল শিফট করে মুর্শিদাবাদের নেয়া হলো। তার পরও প্রায় ৫০ বছর ধরে ঢাকায় একটি ভাইব্রেন্ট ইকোনমিক একটিভিটিস ছিল। ওই সময়ে ঢাকায় ৭ ধরনের মুদ্রা ব্যবহারের কথা জানা যায়। সেগুলো বিনিময় হতো কোথায়? খুব সম্ভবত এই টাকার হাটে।
এদিকে তাইমুর ইসলামের বক্তব্যের পক্ষে প্রামাণ পাওয়া যায় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ আয়োজিত একটি সেমিনারের কার্যবিবরণীতে। ১৯৯৩ সালের ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ‘আর্কিটেকচারাল কনজারভেশন’ শীর্ষক এক সেমিনারের ওই কার্যবিবরণীতে মীর মোবাশ্বের আলীসহ ফারুক এ ইউ খান, শাহেদা রহমান ইমাম, মহিবুল আরেফিন খান এবং এম শহীদুল আমীনের ‘Early 20th century mansions of Dhaka city: Contextual concepts’ শিরোনামের একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়, ওই সময় প্রত্যেক অঞ্চলের নিজস্ব মুদ্রা ছিল। ১৭৮৭ সালের দিকে বিশেষ করে ঢাকাতে ৭ ধরনের মুদ্রার প্রচলন ছিল।
যাকে মূলত ‘কারেন্সি ক্যাওয়াস’ হিসেবেই উল্লেখ করেন মীর মোবাশ্বের আলীসহ তাঁর সহলেখকরা।
তাঁরা আরও জানান, প্রত্যেকটি মুদ্রার নিজস্ব মূল্য ছিল এবং সেগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির বিনিময় প্রক্রিয়ায় কতগুলো নিয়ম মানা হতো।
এদিকে টাকার হাটের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য ১৯১০ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত ঢাকার সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে-১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইনানুসারে সিলেট ও পার্বত্য জেলা বাদে সারা দেশে পরিচালিত জরিপ) ম্যাপের প্রসঙ্গ হাজির করেন স্থপতি তাইমুর ইসলাম। তিনি বলেন, এখন পুরো এলাকাটি নানা ধরনের স্থাপনায় ভরে গেলেও সিএস ম্যাপে ওই স্থাপনাটিকে কেন্দ্র করে প্রায় এক একর সম পরিমান আয়তাকার একটি ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছে। তাতেও অনুমান করা যায় এলাকাটি জুড়ে ওই ধরনের একটি কর্মকাণ্ড ছিল।
এদিকে বৃটিশ আমলে ‘নবাবপুর’ নাম নেয়া এলাকাটির পূর্বনাম ছিল ওমরাও পাড়া। তারও আগে এর নাম ছিল পুরানা মোঘলটুলি। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, এই এলাকারই আরেকটি অংশে ছিল ‘মহাজনপুর’। বলা হয়, মোঘল আমলের শেষদিকে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ঋণ প্রদান আর বন্ধকী ব্যবসা এবং সোনা-রুপা টাকায় পরিবর্তনের কাজ কারবার হতো টাকার হাট এলাকায়। আর মহাজনপুরে ছিল ওইসব ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগকারী তথা মহাজনদের বাসস্থান।
তাইমুর ইসলাম বলেন, অবহেলা এবং সংরক্ষণের উদ্যোগের অভাবে ইতোমধ্যে অনেক কিছু ধ্বংস গেছে। অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন সবার আগে দরকার সংরক্ষণ এবং পাশাপাশি গবেষণা। কারণ, বইয়ের পাতায় কিংবা গবেষণা পত্রে মানুষ যেই জিনিসটি জানতে পারবে সেটা যখন বাস্তবে এসে দেখতে পারবে তখনই ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল হবে বাস্তবের।
তিনি আরও বলেন, আরবান স্টাডি গ্রুপের করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার ২২০০ ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনার ধ্বংস, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। রায়ে অবিলম্বে এই ভবনগুলোকে এসেসমেন্ট করে তালিভুক্ত করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং প্রতি তিন মাস পর পর অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। টাকার হাটের স্থাপনাগুলোও ওই তালিকাভুক্ত। কিন্তু আদালতের ওই আদেশ বাস্তবায়নের কোন উদ্যেগ আমরা দেখছি না। সেটা যেমন আদালতের রায়ের বরখেলাপ তেমনি রায়কে অমান্য করেই ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে অনেক ভবন। ধ্বংস করা হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহ।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানের কাপ্তানবাজার মোড় থেকে সদরঘাটমুখী নাবাবপুর সড়ক ধরে দুই পাশের ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যসহ বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলো পেছনে ফেলে সামনে এগুলেই ২০৫নং এবং ২০৬নং হোল্ডিংয়ের মাঝ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে সরু একটি লেন। বসত-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠা এবং ছোট ছোট দোকানে ঠাসা লেনটি ভেতরে একটু ঘুরে আবার নবাবপুর সড়েকে এসে শেষ হয়েছে। ছোট এই লেনটিই সবার কাছে আজ ‘টেকের হাট লেন’ হিসেবে পরিচিত। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডেও লেখা তাই।
লেন ধরে একটু এগুলেই ২৪নং টেকের হাট লেন। দোতলা এই স্থাপনাটির কার্নিশে এখনও ঝুলছে নকশা ও কারুকার্য খচিত কাঠের কাজ। যার অধিকাংশ ভেঙ্গে পড়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ভবনটির দেয়াল ঘেষে ডান দিকের পথ ধরে এগুলে মোঘল স্থাপনা রীতিতে নির্মিত আরও কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। যেগুলোর দেয়ালের চুন-সুরকির পলেস্তারা খসে পরে বেড়িয়ে গেছে পাতলা ইটের গাঁথুনি। ভেঙ্গে পড়েছে কার্নিশগুলোও।
বলা হচ্ছে এই স্থাপনাগুলো ঘিরেই ছিল ঢাকার ঐতিহাসিক ‘টাকার হাট’। স্থানীয়দের মুখে মুখেও রটে বেড়াচ্ছে মুদ্রা বেচা-কেনার ইতিহাস ও গল্প। তবে এর স্বপক্ষে জোর যুক্তি তুলেন আরবান স্টাডি গ্রুপের (ইউএসজি) প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলাম। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে পুরান ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এ স্থপতি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, ‘ফিজিক্যাল এভিডেন্স যা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে বলা যায় এখানে মুদ্রা বিনিময়ের একটি কেন্দ্র ছিল।’
তিনি বলেন, ঢাকার মোঘলরা যখন চলে গেলেন, বিশেষ করে এখান থেকে ক্যাপিটাল শিফট করে মুর্শিদাবাদের নেয়া হলো। তার পরও প্রায় ৫০ বছর ধরে ঢাকায় একটি ভাইব্রেন্ট ইকোনমিক একটিভিটিস ছিল। ওই সময়ে ঢাকায় ৭ ধরনের মুদ্রা ব্যবহারের কথা জানা যায়। সেগুলো বিনিময় হতো কোথায়? খুব সম্ভবত এই টাকার হাটে।
এদিকে তাইমুর ইসলামের বক্তব্যের পক্ষে প্রামাণ পাওয়া যায় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ আয়োজিত একটি সেমিনারের কার্যবিবরণীতে। ১৯৯৩ সালের ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ‘আর্কিটেকচারাল কনজারভেশন’ শীর্ষক এক সেমিনারের ওই কার্যবিবরণীতে মীর মোবাশ্বের আলীসহ ফারুক এ ইউ খান, শাহেদা রহমান ইমাম, মহিবুল আরেফিন খান এবং এম শহীদুল আমীনের ‘Early 20th century mansions of Dhaka city: Contextual concepts’ শিরোনামের একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়, ওই সময় প্রত্যেক অঞ্চলের নিজস্ব মুদ্রা ছিল। ১৭৮৭ সালের দিকে বিশেষ করে ঢাকাতে ৭ ধরনের মুদ্রার প্রচলন ছিল।
যাকে মূলত ‘কারেন্সি ক্যাওয়াস’ হিসেবেই উল্লেখ করেন মীর মোবাশ্বের আলীসহ তাঁর সহলেখকরা।
তাঁরা আরও জানান, প্রত্যেকটি মুদ্রার নিজস্ব মূল্য ছিল এবং সেগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির বিনিময় প্রক্রিয়ায় কতগুলো নিয়ম মানা হতো।
এদিকে টাকার হাটের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য ১৯১০ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত ঢাকার সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে-১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইনানুসারে সিলেট ও পার্বত্য জেলা বাদে সারা দেশে পরিচালিত জরিপ) ম্যাপের প্রসঙ্গ হাজির করেন স্থপতি তাইমুর ইসলাম। তিনি বলেন, এখন পুরো এলাকাটি নানা ধরনের স্থাপনায় ভরে গেলেও সিএস ম্যাপে ওই স্থাপনাটিকে কেন্দ্র করে প্রায় এক একর সম পরিমান আয়তাকার একটি ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছে। তাতেও অনুমান করা যায় এলাকাটি জুড়ে ওই ধরনের একটি কর্মকাণ্ড ছিল।
এদিকে বৃটিশ আমলে ‘নবাবপুর’ নাম নেয়া এলাকাটির পূর্বনাম ছিল ওমরাও পাড়া। তারও আগে এর নাম ছিল পুরানা মোঘলটুলি। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, এই এলাকারই আরেকটি অংশে ছিল ‘মহাজনপুর’। বলা হয়, মোঘল আমলের শেষদিকে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ঋণ প্রদান আর বন্ধকী ব্যবসা এবং সোনা-রুপা টাকায় পরিবর্তনের কাজ কারবার হতো টাকার হাট এলাকায়। আর মহাজনপুরে ছিল ওইসব ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগকারী তথা মহাজনদের বাসস্থান।
তাইমুর ইসলাম বলেন, অবহেলা এবং সংরক্ষণের উদ্যোগের অভাবে ইতোমধ্যে অনেক কিছু ধ্বংস গেছে। অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন সবার আগে দরকার সংরক্ষণ এবং পাশাপাশি গবেষণা। কারণ, বইয়ের পাতায় কিংবা গবেষণা পত্রে মানুষ যেই জিনিসটি জানতে পারবে সেটা যখন বাস্তবে এসে দেখতে পারবে তখনই ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল হবে বাস্তবের।
তিনি আরও বলেন, আরবান স্টাডি গ্রুপের করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার ২২০০ ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনার ধ্বংস, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। রায়ে অবিলম্বে এই ভবনগুলোকে এসেসমেন্ট করে তালিভুক্ত করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং প্রতি তিন মাস পর পর অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। টাকার হাটের স্থাপনাগুলোও ওই তালিকাভুক্ত। কিন্তু আদালতের ওই আদেশ বাস্তবায়নের কোন উদ্যেগ আমরা দেখছি না। সেটা যেমন আদালতের রায়ের বরখেলাপ তেমনি রায়কে অমান্য করেই ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে অনেক ভবন। ধ্বংস করা হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহ।
এমনি গলি ও ভবনের আড়ালে হারিয়ে গেছে পুরনো ঢাকার ‘টাকার হাট’। টেকের হাট লেনে’র ২৪ নং স্থাপনার একটি অংশ, ছবি: দিপংকর হালদার |
No comments